শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ
আলোচক : প্রফেসর ড. এ কে এম আবদুল্লাহ
সাভার বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, ঢাকা।
শিক্ষা, শিক্ষণ, শিক্ষক ও প্রশিক্ষক শব্দগুলো পরস্পর জড়িত, একে অন্যের পরিপূরক। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার শুরু থেকে এগুলো নিয়ে নানা ধরনের চিন্তা গবেষণা চলছে। এরই প্রেক্ষিতে শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রাচীন ধ্যান-ধারনার পরিবর্তে নিত্য নতুন কলা-কৌশলের মাধ্যমে সময়োপযোগী শিক্ষাব্যবস্থার নতুন দ্বার উন্মোচিত হচ্ছে, এ অগ্রগতির ধারার একটি অনুষঙ্গ হচ্ছে শিক্ষার পাশাপাশি ‘প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা’। শিক্ষা শুধু গ্রহণ করলেই শেষ হয় না, বাস্তব ক্ষেত্রে তা প্রয়োগ ও ফলপ্রসূ করার জন্য প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। কিন্তু সে প্রশিক্ষণের উপর গবেষণাধর্মী খুবই কম মৌলিক গ্রন্থ রচিত হয়েছে।
এ ক্ষেত্রে উদীয়মান লেখক ও গবেষক ড. নজরুল ইসলাম খান স্বীয় উদ্ভাবনী চিন্তা-ধারার মাধ্যমে রচিত ‘শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ’ নামক গ্রন্থটি এক্ষেত্রে নতুন মাত্রা সংযোজন করবে বলে আমার বিশ্বাস। এটি শিক্ষক ও প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য একটি সহায়ক গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হবে বলে আমার ধারণা। বইটির রচিত বিষয়গুলো যদিও আলাদা-আলাদা স্বতন্ত্র শিরোনামে সন্নিবেশিত হয়েছে, এক্ষেত্রে আলোচনার ধারাবাহিকতার কিছুটা হেরফের হলেও সঠিক মূল্যায়নে সকল বিষয়ের মূল স্পিরিট লক্ষ্যচ্যুত হয়নি।
লেখক প্রথমেই আধুনিক শিক্ষাচিন্তা ও শিক্ষার ধারা ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে শিক্ষার উপর একটি নাতিদীর্ঘ আলোচনায় শিক্ষার স্বরূপ তুলে ধরেছেন যা সংক্ষেপে গ্রন্থটির মূল প্রতিপাদ্য পাঠকের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে। গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে ‘সভ্যতার বিকাশে শিক্ষা’ শিরোনাম দিয়ে যে বিষয়টি পাঠকের সামনে খোলাসা করতে চেয়েছেন তা হলো শিক্ষার জাগতিক লক্ষ যেমন আছে, পারত্রিক লক্ষও তেমন। আর তাই পারত্রিক সুখ শান্তি প্রত্যাশা করলে জাগতিক জীবনের শিক্ষার্জনে লক্ষ্যচ্যুত হওয়া যাবে না। বস্তুগত জগতের সবকিছু উপেক্ষা করে পরকালীন জীবনের মুক্তির প্রত্যাশা করাই হবে শিক্ষার একমাত্র লক্ষ। লেখকের উক্ত বক্তব্য সক্রেটিস, হার্বার্ট ও ফ্রোয়েসের বক্তব্যের প্রতিধ্বনী। তাঁদের মতে শিক্ষার লক্ষ্য হচ্ছে সত্যের আবিষ্কার ও মিথ্যার অপনোদন। নৈতিক চরিত্রের কাক্সিক্ষত পরিবর্তনই হচ্ছে শিক্ষার উদ্দেশ্য। একটি সুন্দর বিশ্বাসযোগ্য পবিত্র জীবনের উপলব্ধি হচ্ছে শিক্ষার লক্ষ্য।
‘শিক্ষাব্যবস্থার অনিবার্য অনুষঙ্গ’ শিরোনাম বিষয়টিতে লেখক, শিক্ষক-শিক্ষার্থী শিক্ষাক্রম, শিক্ষালয়, পরিবার-পরিবেশ বিষয়গুলো নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করে বুঝাতে চেয়েছেন শিক্ষাব্যবস্থার সাথে আলোচ্য অনুষঙ্গগুলো অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বলতে দ্বিধা নেই, লেখকের উক্ত মন্তব্য বাস্তব সম্মত। পরবর্তী অধ্যায়ে ‘শিক্ষকের জ্ঞান দক্ষতার উন্নয়নে শিক্ষা’ শিরোনামে যে বিষয়গুলো অবতারণা করেছেন তা হলো পেশাগত মনোভাব, ব্যক্তিগত দর্শন, আত্মমূল্যায়ন, ব্যক্তিগত মূল্যবোধ, পেশাগত দায়িত্ববোধ, সেবার মনোবৃত্তি, অজানাকে জানার স্পৃহা, নিয়মিত অধ্যয়ন, তথ্য-প্রযুক্তির জ্ঞানার্জন ইত্যাদি বিষয়গুলো চমৎকারভাবে তুলে ধরে শিক্ষককে সকল জ্ঞানের আধার বলে তাকে অগাধ পান্ডিত্যের অধিকারী হওয়ার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এরপর একটি চমৎকার বিষয়ের উপর লেখক যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছেন তা হলো- ‘শিক্ষকের জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ দক্ষতার উন্নয়নে গবেষণা’, লেখক এ ক্ষেত্রে জাতীয়ভাবে দৈন্যদশার কথা উল্লেখ করে আফসোসের সাথে বলেন- পরিতাপের বিষয় আমাদের শিক্ষক সমাজ যেমন গবেষণার মাধ্যমে দক্ষতা অর্জন করতে আগ্রহী নয়, তেমনিভাবে জাতীয়ভাবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভিভাবকত্বের দাবিদার আমাদের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রশিক্ষণ ও গবেষণার প্রতি তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয় সনাতন নিয়মানুযায়ী কিছু গতানুগতিক প্রশিক্ষণের রেওয়াজ চললেও মূলত প্রশিক্ষণের স্পিরিট প্রতিফলিত হচ্ছে না। আর গবেষণার বিষয় তো খুবই সীমিত আকারে মাত্র কিছুদিন আগে শুরু হলো। লেখকের উক্ত বক্তব্য বাস্তবতার সাথে হুবহু মিল রয়েছে। আমাদের জানা মতে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এমফিল ও পিএইচডিগুলো অত্যন্ত সীমিত আকারে চলছে এবং তা ধার করা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। অথচ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্বতন্ত্র স্বায়ত্ত শাসিত স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশের সর্ববৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয় যার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সরকারি-বেসরকারি স্বনামধন্য কলেজসমূহে উপযুক্ত ডক্টরেট ডিগ্রিপ্রাপ্ত বহু শিক্ষক রয়েছেন যারা এমফিল ও পিএইচডি গবেষণা করার মতো যোগ্যতা রাখেন। তাদেরকে কাজে না লাগিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারস্থ হওয়ার হেতু কী? সেটাই প্রশ্ন।
তাই লেখক বলতে চেয়েছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্যই খানিকটা ব্যাহত হয়েছে বলে আমার ধারণা। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দৈন্যতা সম্পর্কে বলার পর লেখক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু খণ্ডচিত্র তাঁর গ্রন্থে তুলে ধরেছেন, যা প্রয়োজন ছিল।
লেখক তার বইতে উপরোক্ত বিষয়গুলো আলোচনার পর পাঠকদের সামনে একটি বিশেষ শিক্ষাদর্শনের প্রতি আলোকপাত করেছেন। যা সমকালীন পৃথিবীর মানুষের জন্য অনুসরণীয় অনুকরণীয় হতে পারে। একটা কথা এখানে মনে রাখা প্রয়োজন। ভাষাবিজ্ঞানে সসীম ও অসীম দুটো শব্দের প্রয়োগ আছে। সে হিসেবে মানুষ সসীম তার জ্ঞানও সসীম। সে নিজেকে যতই জ্ঞানী ও বুদ্ধিদীপ্ত প্রতিভার অধিকারী মনে করুক না কেন তার সিদ্ধান্ত সর্বশেষ সিদ্ধান্ত নয়। তার প্রমাণ পৃথিবীতে যত আবিষ্কার হয়েছে কেউ কথা বলার সাহস রাখেনি যে, এরপর আর কোনো নতুন আবিষ্কার হবে না। কারণ সে জানে তিনি সসীম তার জ্ঞান বা আবিষ্কারও সসীম- যার সীমা আছে। অপর পক্ষে হলো অসীম-যার সীমা নেই। তা হলে বুঝা গেল যে, অসীমত্তের কাছেও সব অসহায়। বিশ্বাসীরা মনে করেন যে অসীমত্তের মালিক বিশ্বজগতের মহান স্রষ্টা আল্লাহ তাআলা। অতএব তিনি বিশ্বমানবের জন্য যে শিক্ষা দর্শন দিয়েছেন সেটাই আসল শিক্ষা। সে শিক্ষার প্রবর্তক তাঁর প্রেরিত বান্দাহ ও নবি হযরত মুহাম্মদ (স.)। যাঁর শিক্ষক ছিলেন সেই অসীম সত্তা মহান আল্লাহ্ তাআলা। সে শিক্ষা ছিল সর্বকালের সর্বযুগের বা অনন্তকালের জন্য সর্বশেষ নির্ভুল শিক্ষাব্যবস্থা। কুরআনের ভাষায় (লা-রাইবা ফিহে)। লেখক সে বিশেষ শিক্ষা দর্শনের প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে বলতে চেয়েছেন পৃথিবীর তাবত শিক্ষাবিদের সামনে যুগজিজ্ঞাসার সেরা মডেল উপস্থাপন করে অনুসরণীয় আদর্শের প্রতীক উপস্থাপন করে এক অসাধারণ বিস্ময়কর ভূমিকা পৃথিবীর জ্ঞান জগৎকে উপহার দিয়েছেন উম্মী নবি হযরত মুহাম্মদ (স.)। অতএব পৃথিবীর মানুষ যদি কোনো শিক্ষা অনুসরণ অনুকরণ করতে চায় তা হলে প্রশিক্ষণ নিতে হবে রাসুল (স.) এর জীবন থেকে যাঁকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন স্বয়ং অসীম সত্তা মহান আল্লাহ। জিবরাইলের মাধ্যমে হেরা পর্বতের গুহায় ‘পড় তোমার প্রভুর নামে’। কুরআনের এই বাণী দিয়ে, যা নির্ভুল ‘লা-রাইবা ফিহে’ রাসুল (স.) বিশ্ববাসীর উদ্দেশে বিদায় হজ্জের ভাষণে দূর শিক্ষণের উপর গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন- ‘উপস্থিত ব্যক্তি যেন অনুপস্থিত ব্যক্তির কাছে জ্ঞানের কথাগুলো পৌঁছে দেয়। কেননা হতে পারে যে ব্যক্তি জ্ঞানের কথা পৌঁছে দিচ্ছে তার চেয়ে যার কাছে জ্ঞান পৌঁছানো হচ্ছে সে অধিকতর সচেতন এবং বিশেষ অনুধাবন ক্ষমতা সম্পন্ন।
এ ধরনের গ্রন্থ শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা কোনো জাতীয় প্রতিষ্ঠান ক্রয় করলে এর ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেতে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারতো। ড. নজরুল এ দুঃসাহসিক কাজটি হাতে নিয়ে বিরাট জাতীয় দায়িত্বের পরিচয় দিয়েছেন। গ্রন্থের প্রত্যেকটি অধ্যায়ে যে বিষয়গুলো উপস্থাপন করা হয়েছে সে বিষয়গুলো আরও বৃহত্তর কলেবরে প্রত্যেকটি আলাদা আলাদা বিস্তারিত আলোচনা হলে পাঠক আরও বেশি উপকৃত হতে পারতো কারণ এ ধরনের গ্রন্থের সংখ্যা খুবই সীমিত। জানি বইয়ের কলেবর বৃদ্ধি করতে হলে যা প্রয়োজন, তা হলো- অর্থের জোগান, যা ব্যক্তি পর্যায়ে সম্ভব নয়। এরপরও ড. নজরুল ইসলাম এ দুঃসাহসিক কাজটি হাতে নেয়ায় ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। প্রমিনিন্টে পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত বইটির বহুল প্রচার কামনা করছি।
বইটি সংগ্রহ করতে যোগাযোগ করতে পারেন এই নাম্বারে-০১৭১১ ২৮ ৯৭ ৫৪
বইয়ের নাম: শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ
লেখক: ড. নজরুল ইসলাম খান
বইয়ের ধরন : প্রশিক্ষণ মডিউল
আলোচক : প্রফেসর ড. এ কে এম আবদুল্লাহ।
প্রকাশক: প্রমিনিন্টে পাবলিকেশন
বিনিময় মূল্য: ২৬০
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৯৬
১ Comment
Congratulations