লোপা এবং রূপা
শাতি ইফফাত
খুব চেয়েছিলাম একটি মেয়ে হোক। কিন্তু একটি মেয়ে সন্তান জন্মের সাথে সাথে মনের কোনে বিষাদ নেমে আসে।
আমি লোপা। নিজের জীবনের চাওয়া পাওয়া মেটাতে মেটাতে যখন ক্লান্ত তখন আমার কোল জুড়ে আসে একটি কন্যা শিশু। ওর বাবা চেয়েছিল ছেলে হোক। কিন্তু আমি চাই নি। নিজেকে মেয়ে হিসেবে সবার সামনে উপস্থাপন করতে করতে আমি ক্লান্ত। কিন্তু তবু কেন চাইলাম জানি না। হয়ত নিজের অসম্মান ঢাকতে। মনে মনে চেয়েছি আমি আমার মেয়েকে ছোট হতে দেব না।
আমার মেয়ের নাম রূপা। আশে পাশের অনেকের মুখেই দেখেছি পুত্র সন্তান লাভের গর্বিত হাসি।
নিজে কন্যা সন্তান বলে তো সব কিছুতেই কম পেয়েছি আর করেছি বাড়তি কিছু। পরিবারের ভাইটিকেই দেখেছি, কিছুই করতে না পেরেও সবার কাছে দামী। এখন ভাবছি একটি কন্যার মায়া ভরা মুখ যদি নিজের ভেতরে না আঁকতাম তাহলেই ভালো হত। আজ খুব হতাশার সঙ্গে মেনে নিয়েছি।
এভাবে লোপা তার নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করে। লোপা ছোট থেকেই বড় হয়েছে একটা অস্থির পরিবেশে। আর বারবার হোঁচট খেয়েছে। যারা শিখিয়েছে প্রতি পদে পদে বাড়তিটা করবার জন্য তারা নিজের ভেতরে এতটাই কৃপণ যে, মুখের হাসি টুকুও শেয়ার করেনি। কিছুই মানবার নেই, কিছুই জানবার নেই। বিচারিক একটা আদালত যেন তৈরী হয়েই আছে। ওর মেয়ের জন্য ও কোন আদালত রাখবে না। আর কোনো কাঠগড়ায় দাঁড়াবে না ও নিজে। অহংকার আজ ওর নিজের ভূষণ। দুনিয়ার একপেশে ভাবনা থেকে আজ ও অনেক দূরে।
কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে। মেয়ের মুখের দিকে তাকায়। বলে, পারবি না রূপা মেয়ে হতে? নারী হতে? পারবি না দুনিয়াটাকে শাসন করতে নিজের মত? পারতে হবে তোকে। তোর মা যে পারে নি। শোষিত হয়েছে।
আমি লোপা। রক্ত চোষারা যেন আমার ঠোঁট কামড়ে চুষে খেয়েছে। আমার শরীরে বিঁধিয়ে দিয়েছে বিষ দাঁত। আমাকে অনুশোচনায় পুড়িয়েছে। আমাকে নগ্ন করেছে। দুহাতে আমার আব্রু সরিয়েছে। পেষণ যন্ত্রণায় পুড়িয়েছে। আমার উপর অভিশাপ বর্ষণ করেছে। কেটেছে বিনিদ্র রজনী।
না—- রূপা! প্রতিশোধ নয়। পেষণ যন্ত্রণার আঘাত ছিন্ন করে আমি তেজ পেয়েছি। সেই তেজে গলে যাবে বরফ নদী। আঁধার রাতে জোছনা স্নাত হব আমি। বয়সের ভারে নুয়ে গেলেও আমি মা, আমি নারী—–আমি লোপা।