লোডশেডিং সমাচার
(সাজেদা পারভীন)
যাক্ না? সারাদিনে দু একবার ইলেকট্রিসিটি চলে যাওয়া সে কোন ব্যাপার না। যদি আমি সেটিকে পজিটিভলি নিতে শিখি। রাতে চলে যাবে দু এক ঘন্টার জন্য? মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে অনেকের। কিন্তু আমার তা হয় না। আমি খুব পজিটিভলি সেটি নিতে পারি। তখন বেশি বেশি মনে পড়ে শৈশবের কথা। একটা সময় বিদ্যুৎ মামা এতটা এভেইলেবল ছিল না। তারপরও দিন চলে গেছে। আমি বলবো খুব ভালোভাবেই গিয়েছে। রাতে বিদ্যুৎ মামার চলে যাওয়া মানেই মজার শুরু বিশেষ করে আমাদের ছেলেবেলায় তাইই মনে হতো। কত দৌড়াদৌড়ি করেছি, কত রকমের খেলা খেলেছি,হেসে কুটিকুটি হয়েছি। কারেন্টের অবাধ আসা যাওয়া থেকেই চাঁদকে ভালোবেসে ফেলা। চাঁদের অপরূপ সৌন্দর্যে অকারনে হারিয়ে যাওয়া,চাঁদের বুকে কাল্পনিক বুড়িকে খুঁজে পাওয়া,আবার সেই বুড়িকে চরকা কাটতে দেখা।উফ্ সে দিনগুলোর কথা মনে হলে আজো শৈশবে ফিরে যেতে ইচ্ছে হয়। দিনের বেলা হঠাৎ হঠাৎ বাতাসে সাদা সূতো ভেসে আসতো বাতাসে। সেই সূতো ধরার জন্য সেকি দৌড়! একসময় ধরে ফেলতাম ঠিকই। তারপর পুরো মাথায় পেঁচিয়ে ফেলতাম সেই সাদাসূতো। চুল কেশবতী কন্যার মতো লম্বা হবে ভেবে। তারপর কোন এক রাজকুমার সেই লম্বা চুল বেয়ে বেয়ে কোন এক চাঁদনী রাতে আমাকে ডাইনীর কাছ থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে। এসবই ছিল কিশোরী মনের কাল্পনিক ভাবনা। একসময় রোমান্টিক ভাবনায় মন উবে যেতো। জোসনার আলোয় মিশে যেতো সব রোমান্টিকতায়। মনে হতো রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত গান, ‘ চাঁদের আলোয় বাঁধ ভেঙেছে উছলে পড়ে আলো, ও রজনীগন্ধা তোমার গন্ধসূধা ঢালো।।’ ইস কি ছিলো সেইদিনগুলো! সেদিনগুলো খুব খুবই মিস করি। বেশ অনেক বছর পর বিদ্যুৎ এর আসা যাওয়া, এই বিষয়টা মেনে নিতে পারেনি অনেকে। কারন শিক্ষার্থীদের পড়াশুনার ক্ষতি। অনেকেই ঘরে সংযোগ করলো আইপিএস। কেড়ে নেয়া হলো শিশুদের বর্ণিল শৈশব কৈশোর। ভূলে গেল চাঁদমামার কথা। চোখের সামনে কেবল বই আর বই। দাদা দাদীর কোলে বসে গল্প শোনার দিন শেষ। আনন্দগুলো ধূলায় মিশে সেগুলো বৃহৎ অট্টালিকায় তৈরী হলো। মানুষের মনগুলোও আস্তে আস্তে কংক্রীটে রূপান্তরিত হলো। আমি আমার বাসায় ইচ্ছে করেই কখনো আইপিএস আনিনি। এই সময়টায় মানে লোডশেডিংয়ের সময় বড় বারান্দায় বা ছাদে বসে বাচ্চাগুলোকে নিয়ে গল্পে মেতেছি,চাঁদের সৌন্দর্যে সবাইকে নিয়ে ভেসেছি,সৃষ্টির মহিমাকে দেখে অবাক হয়েছি। আর স্বশৈশবে কত যে চাঁদের সাথে হেঁটেছি আর অবাক হয়েছি আমার সাথে সাথে চাঁদও কিভাবে হেঁটে যায়।
এখন সবই কাল্পনিক মনে হয়। এখন একটু ইলেকট্রিসিটি চলে গেলে আমাদের চরম মানসিক বিপর্যয় হয়। প্রযুক্তি আমাদের এতটাই নির্ভরশীল করেছে যে একঘন্টার লোডশেডিং ও আমরা মেনে নিতে পারি না। সবার হাতে আজ স্মার্টফোন ঘুরছে। মাত্র একঘন্টার জন্য আমরা নেটঅফ রাখতে পারি না। আমরা কয়েকজন একসাথে থাকলেও হাতে সেই যন্ত্র আমাদের চারপাশের যোগাযোগ বন্ধ রাখার পায়তারা করে নিত্য নতুন লোভনীয় অফারে। যাকে জন্ম জন্মান্তরেও দেখিনি সেই অচেনা একজন হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকে,আমরা আন্দোলিত হই সেই ভার্চুয়াল প্রেমে। অথচ পাশের বাড়ির কোন মানুষের খবর নিতে ভুলে গেছি। খুব প্রিয় কেউ একজন হয়তো আমারি অপেক্ষায় আছে তার কথা ভুলে যাই। পাশাপাশি স্মার্টফোন হাতে বসে থাকা কারো সাথে হৃদয়ের যোগাযোগ নেই। চোখ যেন শুধু কি খুঁজে বেড়ায়। এভাবেই হারিয়ে যাচ্ছে ভরা পূর্ণিমায় চাঁদের আলো,কমে যাচ্ছে সাহিত্যবোধ, হারিয়ে যাচ্ছে দূরন্ত শৈশব।
তাই একঘন্টার লোডশেডিং এ চলুন আবার সব খুঁজে নেই যা হারিয়ে গেছে কোন এক অজানা কারনে। সময় দেই শিশুদের গল্পের আড্ডায়,গল্পের ছলে তৈরী। নীতি নৈতিকতার,মানবিকতার। হাতপাখা ধরিয়ে দেই সন্তানের হাতে অসুস্থ ব্যাক্তিকে বাতাস করার জন্য। এই একঘন্টা পড়াশুনা না করলে কিচ্ছু এসে যাবে না।সৃষ্টি হোক দেশপ্রেমের। গল্প শোনাই একটি দেশের, যারা একসময় নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে। শিশুদের সাশ্রয়ী হতে শেখাই।আনন্দগুলো ফিরিয়ে দেই এই অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়টিতে।বৃষ্টির রিমঝিম শব্দের মতোই আনন্দে নেচে উঠুক লোডশেডিং এর মুহুর্তটি। মনে করি সেই বাড়িটির কথা যে বাড়িটিতে আজো উঠেনি ইলেকট্রিসিটির তার। সেও তো বেঁচে আছে??
সবাই ভালো থাকুন।
_______________________
সাজেদা পারভীন
কবি ও শিক্ষক
২০-০৭-২০২২ ইং
১ Comment
কষ্টের মাঝেও নিজের সোনালী অতীত হাতরিয়ে ফেরার নানান গল্প কথন, পড়ে বেশ মজা পেলাম। হৃদয়নিঃসারিত ভালোবাসা ও নিরন্তর শুভ কামনা লেখকের জন্য।