অখ্যাত বীরাঙ্গনা
আলেয়া আরমিন (আলো)
-কেডা! কেডা গো আফ্নেরা? এ্যাঁ…সংবাদিক? কি কইতাছুইন?
আফনেরা আমার দারোওই আইছুইন, কিইর লাইগা আইছুইন?
-এ্যাঁ…! ফরোশ্নো!… কিছু ফরোশ্নো করবাইন?
-আইচ্ছা…আইচ্ছা , তাইলে জিগাইন কি জিগাইবাইব?
-আমার নাম? আমার নাম শাপলাবানু।
-বাপ মা?
-তারা তো নাই গা, সংগ্রামের বছর মইরা গেছে গা, পাকিস্তানি মিলিটারি গুলি কইরা মারছে।
-বিয়া…?
-না…না…আমারে বিয়া করবা কেডায়? আমি তো অন্য সব মাইয়া গো মতন না। মিলিটারিরা যে আমারে তিনমাস আর্মিরা কেম্পো আটকাইয়া রাখছিলো সংগ্রামের সময়! আমি যে সেকান্দরের বইন। ওই যে মুক্তিযুদ্ধে গিয়া আর ফিরা আাইলো না যেই সেকান্দর, আমি হের বইন। ভাইয়ের যুদ্ধে যাওনের অপরাধেই পাকি সেনারা আমার বাপ মায়েরে মারলো, ঘরবাড়িতে আগুন দিয়া আমারেও ধইরা নিয়া গেলো। কতো কানলাম… তাগো হাতে পায়ে ধরলাম…
তবুও জানোয়ারের বাচ্চাগুলা আমারে কিছুতেই ছাড়লো না। তিনমাস আটকাইয়া রাইখা কি অইত্যাচাইর না করলো। হেই কথা মনে হইলে, অহনও আমার গতরে কাঁডা দিয়া ওডে।
-অ্যাঁ…? আমিও মুক্তিযোদ্ধা?
না.. না, মুক্তি যোদ্ধা তো আমার ভাই সেকান্দর। আর হের বন্ধুরা। যারা বন্ধুকের গুলি দিয়া ওই হারামী পাকিস্তানি জানোয়ারদের বুক ঝাঁঝরা কইরা দিছে। যারা দেশের লাইগা সিকান্দারের মত জীবন দিছে। যারা এই দেশ থাইকা পিশাচ গুলারে ঝাটাইয়া বিদায় করছে।
তারা হগ্গলেই মুক্তিযোদ্ধা।
-বীরাঙ্গনা? হেইডা আবার কি?
-আমি তো নষ্ট মাইয়া। ওই হানাদারদেরেরা দল বাইন্ধা আমারে দিন রাইত চব্বিশ ঘণ্টা নির্যাতন করছে। পৌষ মাইসা কনকইন্না ঠান্ডার মইধ্যে খালি গায়ে ফালাইয়া রাখছে রাইতের পর রাইত। কি জঘন্য নির্যাতন করছে তা কাউরেই কইয়া বুঝাইবার পারুম না। হেইডা কেবল আমিই জানি।
-কি কইন? হের লাইগাই আমি বীরাঙ্গনা?
এ্যাঁ…! বীরাঙ্গনাদের সরকার সম্মান দিবো?
-না…না… মিছা কথা! নষ্ট মাইনসেরে কেউ কামেই লইতে চাই না, তারে আবার সম্মাননা! হাহাহা…
-এ্যাঁ…? সত্য কইতাছেন?
-কিন্তুক আমার যে বিশ্বাস অয় না গো! কেমনে বিশ্বাস করি কইনছেন দেহি? যুদ্ধ থামনের পর থাইকা কত লাত্থি ওস্টা খাইয়া এই ইটের ভাটায় আইয়া ঠেকছি। এইহানেও শান্তি পাই নাই, হগ্গলেরই আমার জোয়ান গতরের দিকে নজর দেয়। দিনের বেলা গাধার খাটুনি খাইটা রাইতে কুনুদিন শান্তিমতে ঘুমাইবারও পারি নাই। মানুষের চেহারার পাগলা কুত্তাদের নির্যাতনে আমি হাড়ে হাড়ে টের পাইছি…
পাকিস্থানি হানাদার বাহিনী চইলা গেলেও হেরার দোসর রাইখা গেছে আমারে আজীবন অইত্যাচারী করার লাইগা। দুইমুঠ ভাতের বিনিময়ে হেরা আমারে দিয়া শইল্লের ভোখ মিডাই। ইটের ভাটার কামটা হারাইবার ডরে আমি মুখ বুইঝা সব সইহ্য করি।
….জানেন?
হগলতে যহন কয় দেশ স্বাধীন হইছে, আমি তহন চুপ কইরা থাহি, আর ভাবি তাইলে আমার মুক্তি কৈ?
-ওই স্বাধীনতার সংগ্রামেই তো আমার কপাল পুড়ছে। ভাই শহীদ হইছে, বাপ মা মরছে, বাড়িঘর পুড়ছে।
নিজের পুড়া ভিটাতেইও আমারে মাতবর উঠতে দেয় নাই। আমি নাকি নষ্ট নারী! হের লাইগা আমারে গেরাম থেইক্কাও খেদাইয়া দিছে।
না…গো, আমি কোন সম্মান চাই না, আফনেরার সরকারেরে খালি একবার কইয়া দেন, আমারে যেন্ কম মেন্নতের একটা ভালা কাম যোগার কইরা দেয়।
বয়স হইছে তো, বুইড়া শইল্লে আর আগের মতো খাটতে পারি না।
সম্মান চাই না আমি, ক্ষিধা লাগলে কেবল দুইমুঠ ভাত চাই।