রক্তকরবী নাটক: রঞ্জনের মৃত্যু ও প্রাসঙ্গিকতা।:
রক্তকরবী নাটকে মূলত নন্দিনী ও রাজার মধ্যে এক ধরণের দেওয়া-নেওয়ার পালা দেখতে পাওয়া যায়।
রাজা নিষ্ঠুরতাকেই তার আভিজাত্য বলে মনে করে। এটিই তার চরিত্রের ব্যক্তিত্ব। সে কেবল নিতেই চায়। এই চাওয়াটার ক্ষেত্রে রাজা কোন আপোষ করতে নারাজ।
অন্য দিকে নন্দিনী শুধু দিতে চায়। সে যেন দেবার জন্যেই জন্মেছে। এই দেবার ক্ষেত্রে তার কোন বাছ-বিচার নেই। নন্দিনীর দেবার সম্পদ— তার ভালোবাসা। এ ভালোবাসা আহেল-ভালোবাসা। চন্দ্র যেমন জ্যোৎস্না বিলায়—- তার এই বিলানোচ্ছুও আহেল। নন্দিনীর ভালোবাসা— কিশোর থেকে অধ্যাপক এমন কি বিশু সকলেই পেয়েছে। এই ভালোবাসার পরশে সকলের মধ্যেই এসেছে পরিবর্তন। সেই পরিবর্তনের দিকটি হল— মনোক্রমবিবর্তন। যেমন মাতাল বিশুর মনোসামাজিক বিবর্তন ঘটল। সে প্রেমে পাগল হলো।
নন্দিনীর ভালোবাসা একসময় দাম্ভিক রাজাও পেল। দেখা গেল রাজার মনে যখনি নন্দিনীর আহেল ভালোবাসা বিদ্ধ হল, ক্রমে রাজার মধ্যে পরিবর্তন হতে শুরু করল। নাটকের শেষে যে রাজাকে আমরা পেলাম, সেই রাজা যেন অনেক মার্জিত। তখনো সে নিষ্ঠুর কিন্তু তার সংলাপ অনেক পরিশীলিত। রাজার এই পরিণতিই এক সময় তার চারদিকে ঘেরা যে জাল তা থেকে বেরিয়ে এল।
সমগ্র নাটকে এই পরিণতির আর একটা ভয়ংকর রূপকে আমরা পেলাম। দিকটিকে উপেক্ষা করলে চলবে না। নন্দিনীর আহেল-ভালোবাসাতে রাজার মধ্যে যে মানসিক পরিবর্তণের সূচনা হয়েছিল তার পরিণতিই রঞ্জনের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠল।
রাজা নন্দিনীর ভালোবাসাকেও নিষ্ঠুর-চাহিদার মত একার করে পেতে চাইল। কিন্তু এই একক চাওয়ার ক্ষেত্রে যে বাঁধা এবং এই প্রতিবন্ধক রঞ্জন—- তা রাজা জানত এবং এ-ও জানত নন্দিনী সত্যি করে কেবল ভালোবাসে শুধু রঞ্জনকেই।
রাজার মধ্যে নন্দিনীর ভালোবাসা পাওয়ার এই যে পরিবর্তিত আকাঙ্খা— এবং তা স্বাভাবিক প্রবনতা। পুরুষের মধ্যে ভালোবাসার ক্ষেত্রে সে যে, কোন প্রতিদ্বন্দ্বীকে সইতে পারে না ; আর এ জন্যে সে কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে— তা দেখা গেল নন্দিনী প্রাণের থেকে ভালোবাসে যে রঞ্জনকে, তাকেই জঘন্ন নিষ্ঠুর ভাবে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিল।
যদি রাজার মনোসামাজিক ক্ষেত্রে এই বিবর্তন না ঘটত তাহলে নাটকের পরিণতি অন্য রকম হতে পারত।
একটু লক্ষ্য করলে দেখতে পাব— রক্তকরবী নাটকের মূল যে ভাব, তার কথা বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, “একদিন সেসব আবর্জনা সরিয়ে সে হঠাৎ মাথা তুলে উঠল একটি লাল ফুল নিয়ে— সে বললে ভাই মরিনি তো, আমাকে মারতে পারলে কই ?”
রবীন্দ্রনাথ এইটা দেখার পরই বলছেন, “নাটকটাকে আর যক্ষপুরী, নন্দিনী প্রভৃতি বলে আমার তৃপ্তি হয়নি। তাই নাম দিলাম রক্তকরবী।” (–রবীন্দ্রনাট্যপ্রবাহ: প্রমথনাথ বিশি)
এই যে ভাবনা-প্রবাহ, অর্থাৎ জীবনের জয়গান, প্রতিটি অনুপরমাণুর মধ্যে যে বেঁচে থাকার প্রাণান্তকর লড়াই, সেখানে রঞ্জনের মৃত্যু কি মূল ভাবনা থেকে সরে আসা নয়।
আসলে কর্ষণজীবী বনাম আকর্ষণজীবীর লড়াইয়ের মাঝখানে ভালোবাসা নামক তৃতীয় শক্তির অনুপ্রবেশের পরিণতিই হল রঞ্জনের মৃত্যুর কারণ।
তসলিমা হাসান
কানাডা: ০৩-০১-২০২২