যৌতুকের পুতুল বিয়ে
এ.কে.ম হাসানুজ্জামান (হাসান)
দূর্গাপুর গ্রামে ধনী দরিদ্রের মিলেমিশে বসবাস। হানু নদীর বাঁকে কয়েকটি পাড়া মিলে সবুজ গ্রামটি। গ্রামটিতে সম্প্রতির বন্ধনে সবাই যেন একাকার হয়ে বসবাস করে। গ্রীষ্মের ছুটিতে ছেলে মেয়েরা বিভিন্ন খেলা ধুলায় মেতে উঠে। ছেলারা হাডুডু, দাড়িয়াবাধা ও মেয়েরা গোল্লাছুট, কানামাছি ও কয়েকটি পাড়াতে কচি-কাঁচা মেয়েরা মাটির পতুল খেলা ও পুতুলের বিয়ে উৎসব মেতে উঠে। পুতুলের বিয়ে দেওয়ার জন্য ঘোটকের কাছে ছেলে পাত্র পুতুলের জন্য উপযুক্ত মেয়ে পাত্রী পুতুলের সন্ধান করতে হয়। তেমনি মেয়ে পাত্রী পুতুলের জন্য উপযুক্ত ছেলে পাত্র পুতুলের সন্ধান করতে হয়। ঘটক সাহেব এপাড়া থেকে ওপাড়ায় ঘুরে ঘুরে উপযুক্ত পাত্র ও পাত্রী পুতুলের বিয়ের মধ্যস্ততা করে। তেমনি উত্তর পাড়ার লাকীর ছেলে পতুলের সাথে মাঠ পাড়ার মিতুর মেয়ে পুতুলের বিবাহের প্রস্তাব করিলে উভয়ের সম্মতিতে শুক্রবার বিকালে বিয়ে অনুষ্ঠিত হবে। বিয়ের যৌতুক বাবদ সংসারে ব্যাবহার করার জন্য দুটি সিট কাপুড়ের শাড়ি, দুটি ব্লাউজ, মাটির হাড়ি, কলসি, কড়াই ও ছেলে পুতুলের জন্য মাটির একটি ঘোড়া দিতে হবে। মিতু বাবাকে বলেছে হাট থেকে মাটির ঘোড়া কিনে দিতে। হত দরিদ্র বাবা ঘোড়া কিনার পয়সা পকেটে নাই ও মাটির ঘোড়া কেনার প্রতি কোন গুরুত্ব দেননি, বাবা হাটে গেছে ঘোড়া কিনে নিয়ে আসবে, কাল পুতুলের বিয়ে আসায় বাবার হাট থেকে ফিরে আসার অপেক্ষায় পথের দিকে চেয়ে আসে। বাবা বাড়ি ডোকার সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে গিয়ে বলল বাবা ঘোড়া কিনে এনোছ। বাবা মেয়ের আবেগ বুঝতে পেরে খুবই নিচু স্বরে বলল মা আমিতো তোমার ঘোড়া কিনার কথা ভুলে গেছি। মিতু বাবার বাবার কথা শনে কেঁদে ফেলল। মিতু মা কেঁদো না আগামী হাটে ঘোড়া কিনে দিব। মেয়েকে আদর করে কান্না থামালেন। মিতু তাঁর মাকে বলল কাল বিকালে আমার পুতুলের বিয়ে হবে অনেক মেহমান আসবে, মা তুমি বিয়ের মেহমানের জন্য ভাতের জাও রেধে দিবে। মা খুব মনে মনে হাসলেন। মা মেয়ের পুতুলের বিয়ের কথা ভেবে ঘরে থাকা খেজুর গুড় ও গাভীর দুধ দিয়ে খির রেধে দিয়েছে। মিতু ও তার বান্ধবী পুতুলের সাজ-গোজ করিয়ে পুতুলে গায়ে হলুদ দিয়ে গোসল করিয়ে বাড়ির উঠানে কুল বড়ই গাছের তলাই মাদুর বিছিয়ে পানের বাটা সাজিয়ে পান চুন সুপাড়ী খেয়ে ঠোট লাল করে পুতুল বিয়ের গিত গইতে শুরু করিলঃ
হলুদ বাটো মিন্দি বাটো পুতুল বিয়ে হবে,
কুলা সাজাও ধান দুবলায় বরন করে নিবে,
মিতুর মেয়ে বিয়ে হবে পালকী করে নিবে,
বর যাবে ঘোড়ায় চড়ে পালকীর পিছে পিছে,
পতুল বিয়ে হবে আজ পুতুল বিয়ে হবে।
গাইতে গাইতে আনন্দ করিতে লাগিলেন। আস্তে আস্তে দুুপুর গড়েিয় সূর্য পশ্চিম আকাশে ধাবিত হলো বিকাল হয়ে এলো বর পুতুল পক্ষের অপেক্ষা করতে করতে বরযাত্রী নিয়ে মেহমানে বাড়ী ভরে গেল। বর পুতুল আসছে কলা গাছের খোসা দিয়ে বানানো সুন্দর পালকীতে, দুই পাশে পাটকাঠি দিয়ে পালকীর হাতল বানানো, সবাই পাতার বাঁশি বাজিয়ে পু পু শব্দে ও হাসিতে মুখরিত গাড়ির পুতুল বিয়ে অনুষ্ঠান। এমন দৃশ্য দেখে পাড়ার অন্য সব ছেলে মেয়ে ও মহিলারা ছুটে এল পুতুল বিয়ে দেখতে। যেন সত্যি সত্যি বাড়িতে কোন মেয়ের বিয়ে হচ্ছে। মিতু বর পুতুলকে বকুল ফুলের ছোট মালা গলায় পড়িয়ে পালকি থেকে নামালো। সমস্ত মেহমানকে সারি বদ্ধ বসিয়ে কলার পাতায় খির খেতে দিয়ে আপ্রায়ন করালেন। খেজুর গুড়ের খিড় বিয়ের রীতি অনুযায়ী বর পুতুলের সাথে এক বাটি দিয়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত করিয়ে রাখিলেন। বিয়ের কাজী, উকিল ও স্বাক্ষী গনের সামনে দুই পক্ষের মধ্যস্তায় বিয়ের কাবিন দেনমোহর বার আনা পয়সা নির্দ্ধারন করা হলো তাও বাকীতে, তাতে কন্যা পক্ষের কোন আপত্তি রইনা না। কেননা কন্যা পুতুল দ্বায়গ্রস্ত বলে। এবার বর পক্ষ প্রস্তাব করিলেন বরের দেনা-পাওনা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য। কথামত দুটি সিট কাপুড়ের গাড়ি, দুটি ব্লাউজ, মাটির হাড়ি, কলসি, কড়াই বুঝিয়ে দিলেন। বর পুতুলের মা লাকী বলল বরের ঘোড়া কোথায়, কন্যা পুতুলের মা মিতু বলল বরের জন্য মাটির ঘোড়া হাটের পরের দিন দিব, লাকী বলল তা হবে না, এখন দিতে হবে, নইলে এ বিয়ে হবে না। বর কি ঘোড়ায় না চড়ে হেটে যাবে পালকীর পিছনে পিছনে। মিতু অনেক অকুতি মিনতি করিতে লাগিল পুতুলের বিয়ের জন্য। কিন্তু কোন কথায় শুনলো না বর পক্ষ। বিয়ের ভরা মজলিসে যৌতুকের ঘোড়া না দিতে পাড়ার কারনে বিয়ে ভেঙ্গে গেল। বর পুতুল পক্ষ সবাই বর পুতুল নিয়ে চলে গেল। মিতুর মেয়ে পুতুল বাড়ীর উঠানে কুল বড়ই গাছের কাছ সেজে কন্যার আসনে রইল। মিতু পুতুলকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে গেল।
আঠার বছর পর উত্তর পাড়ার লাকী লেখা পড়ায় তেমন ভাল করতে না পড়ায় বাবার পিরাপিরিতে কোন মত মাধ্যমিক পাশ করিয়ে পারিবারিক ভাবে পারুলপুর গ্রামে বিদেশ প্রবাসী ছেলের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সুখে শান্তিতে সংসার জীবন শুরু করিলেন। সংসার জীবনে সচ্ছল পরিবারে বিবাহ হওয়ার কারনে তেমন কষ্ঠ সহ্য করতে হয়নি। দুই কন্যা সন্তানের জননী হয়ে সুখে শান্তিতে দিন যাচ্ছে। আপর দিকে মাঠ পাড়ার মিতু মাধ্যমিক পাশ করার পর পারিবারিক ভাবে বহরামপুরে শিক্ষিত এক যুবকের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে স্বামীর সাহাতায় সংসার করার পাশাপাশি লেখা পড়া শেষ করে গ্রামের স্কুলের শিক্ষিকা হিসাবে নিয়োগ করেন। সংসার জীবনে এক ছেলে এক মেয়ের জননী।
পঞ্চাশ বছর পর মিতুর ছেলের বিবাহ দেওয়ার জন্য যখন পাত্রী খোজ করা হচ্ছে, শিক্ষিত ও চাকুরে ছেলের জন্য যোগ্যতা সম্পন্ন পাত্রীর দরকার। ঘটক এগ্রামে ওগ্রাম থেকে অনেক মেয়ের সন্ধান নিয়ে আসে ও আনুষ্ঠানিক ভাবে ছেলের বিয়ের জন্য মেয়ে দেখেছে। কিন্তু কোন না কারনে পছন্দ হয় না। মেয়ে দেখা বাবদ বেশ কিছু টাকা ও খরচ হয়েছে তাতে মনে কোন কষ্ঠ হচ্ছে না। মনের মত ছেলের বৌ ও ভাল একটা পরিবার পাওয়া চাই। কেননা আত্মীয়তো বিপদে সবার আগে আসে। তেমনি একদিন বকুল ঘটক পারুলপুর গ্রাম থেকে এক মেয়ের সন্ধান নিয়ে এলেন। উচু লম্বা চিকনা গঠনের সুন্দর রুপোসী মেয়ে। ছেলের মা মিতু তার ভাইয়ের দিয়ে মেয়ের সামস্ত খোজ খবর নিলেন। মেয়ের বাবার নাম ও ঠিকানা, মায়ের নাম, মেয়ের নান বাড়ির ও খোজ খবর মিতু নিশ্চিত হলেন তার বান্ধবী লাকীর ছেলে। বকুল ঘটকের মাধ্যমে কথা আদান প্রদানের মাধ্যমে আগামী সোমবার বাদ যোহর মেয়ে দেখতে যাবে পাত্র পক্ষ। মেয়ে দেখতে চার জন যাবে ছেলের মা (মিতু), বাবা, মেয়ে ও ছেলে (পাত্র)। বহরামপুরের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি রসগোলা, কালোাজাম ও খিরের চমচম নিয়ে পারুলপুরে লাকীর মেয়ে দেখতে গেলেন। চিকন পার লাল জামদানী গাড়ি ও লাল ব্লাউজ পড়া কাঁচা হলুদের মুখ খানা যেন সোনার রবি পূর্ব দিকে লজ্জা সচল চোখে উকি দিচ্ছে। এমন হালকা পাতলা গঠনের মায়াবী মেয়ে ছেলের মা মিতু ও সবাই দেখে খুব পছন্দ করেছে। পাত্রী বৈঠক থেকে প্রস্থানের পর ঘটক প্রস্তাব করিলেন মেয়ের মা লাকীকে, মেয়ের বিয়েতে যৌতুক বাবদ কি দিবেন, এমন সুন্দর চাকুরী ছেলের উপযুক্ত যৌতুক দিতে হবে। সুন্দর ছেলে দেখে লাকীর ও কন্যা পক্ষের সবার পছন্দ হয়েছে। মেয়ের বাবা প্রস্তাব করিলেন আমি আমার মেয়ের সংসারের সব ব্যাবহারের জিনিস দিয়ে দিব। ছেলের মা বলে উঠিলেন কিছুই দিতে হবে না আমার ছেলের বিয়েতে ঘোড়া দিতে হবে ও আগামী শুক্রবার আচর নামাজ বাদ বিকাল বেলা বিবাহ অনুষ্ঠিত হবে। মজলিশে সবাই ঘোড়ার কথা শুনে হেসে উঢ়িয়ে দিলেন এবং বিয়ের দিন তারিখ কথামত ঠিক হল। মেয়ে পক্ষ বরযাত্রীদের খানা পিনায় আপ্রায়নে কোন কৃপনাতা করলেন না, মেয়ের বিয়ে বলে কথা। ধুমদাম করে বিবাহ অনুষ্ঠান শেষে দেনা পাওনা বাবদ খাট-পালঙ্ক, লেপ-তোশক সহ সংসারের যাবতীয় জিনিস ছেলের মায়ের কাছে বুঝিয়ে দিয়ে আদরের মেয়েকে বরের হাতে ধরিয়ে দেওয়ার সময় মিতু বলে উঠিলেন, আমি এত কিছু চায়নি, আমি এসব জিনিস পত্র নিতে পারবো না। আমি চেয়েছি ঘোড়া, ঘোড়া কোথায়, ঘোড়া ছাড়া আমি বৌ নিবো না, যতদিন ঘোড়া দিবে না, ততদিন বৌ তার বাবার গাড়িতে থাকবে। ঘোড়া ছাড়াতো মেয়ে বিদায় হবে না ভেবে লাটুর চাচার গাড়িটানা ঘোড়া জোর পূর্বক নিয়ে এল। লাটু চাচাকে মেয়ের বাবা বলিলেন আমাকে তোমার ঘোড়া দিয়ে এখন অপমান থেকে মুক্ত করা, কেননা আমার অপয়া হিসাবে গন্য হবে। বিয়ের পরে মেয়ে না নেওয়া সমাজে কত বড় আপমান তুমিতো জানো। আমি আগামী হাটে তোমার এর থেকে ভাল ঘোড়া কিনে দেব। তোমার ঘোড়াতো খোড়া। ছেলের মা মিতু গাড়িটানা খোড়া ঘোড়া দেখে বলে উঠিলেন আমিতো গাড়ি টানা খোড়া ঘোড়া চাইনি, আমি চেয়েছি মাটির ঘোড়া, আসল ঘোড়া না। অতঃপর মিতুর মেয়ের সাখে লাকীর ছেলে পুতুলের বিয়ের কথা মনে পড়ে যায়। দুই বান্ধবী স্মুতিতে কিমোরী বয়সের সেই যৌতুকের পুতুল বিয়ের কথা মনে যায়। একে অপরকে চিনতে পারে। দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠিলেন।
১ Comment
congratulations