মোবারক আমার কেউ না
(রাজু আহাম্মেদ)
রাত তখন ১২ টা।বিশেষ কিছু জায়গায় বাতি জ্বলছে তাছাড়া স্বর্ণলতা টেক্সটাইলের সম্পূর্ণ ভবনই অন্ধকার। সবাই বেরিয়ে গেছে। কোলাহলময় পরিবেশ এখন নিঃস্তব্ধ। মমতাজ মিয়া প্রতিদিন এই সময়টার অপেক্ষায় থাকেন। সবাই বের হয়ে গেলে গেট লাগিয়ে তিনি চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়েন।
ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছে, তিনি জানালা খুলে দিলেন। রাস্তায় দু একটা গাড়ি তখনো চলছে।কিছুক্ষণ ফাঁকা রাস্তার দিকে চেয়ে থেকে পাল্লা আটকাতে যাবেন, তখনই তিনি জানালার পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে নড়েচড়ে বসলেন। প্রথমেই আওয়াজ না দিয়ে, আড়চোখে দেখার চেষ্ঠা করলেন। দেয়ালে হেলান দিয়ে পিচ্চি একটা ছেলে বসে আছ। ঠান্ডায় কাঁপছে দেখে মমতাজ মিয়া বললেন,”কেরে তুই? এই পানির মইধ্যে এহানে কি করিস?”
ছেলেটা চমকে উঠে জানালার দিকে তাকিয়ে আবারো হাঁটুতে মাথা গুঁজে দিলো। যেন কিছুই হয়নি। “কিরে, কতা কানে ঢোকে না? “এবারে ছেলেটা উঠে জানালার সামনে এসে দাঁড়ালো। শুকনো চেহারা, শরীরে ছেঁড়া কালো গেঞ্জি। মমতাজ মিয়া জিজ্ঞেস করলেন, নাম কিরে তোর? এহানে কি করিস?
“মোঃ মোবারক হোসেন।”
ছেলেটা স্পষ্টস্বরে তার নাম বলে চুপ হয়ে রইল।তিনি আবার বললেন, বাড়ি কোনে? পথ ভুইলা গেছিস নাকি? সে মাথা নাড়িয়ে বললো, না।
-তাইলে কি? বাপের নাম কি? থাকিস কোনে?
-মাজারে।
-কোন মাজার?
ছেলেটা আঙুল উুঁচিয়ে দক্ষিণ দিকে দেখিয়ে দিলো। সেদিকে আশপাশ কোনো মাজার নেই, তবে কাছেই একটা মাজার টাইপ জায়গা রয়েছে অবশ্য। কিন্তু সেটাকে মাজার বললে ভুল হবে। রাত ১২টার পরে সেখানে জমে ওঠে নারী আর মদ গাঁজার আড্ডাতে।তিনি বললেন, ঐ বটতলী…?
-হো।
-ঐডা তো ভালো জায়গা না রে।খাওন দেয় কে?
-খিদা লাগলে ভিক্ষা করি। ট্যাহা পাইলে খাই।
-ওহ।রাতে খাইছিস?
-নাহ।আইজ ট্যাহা পাইনি। বিকালের তিন ট্যাহা আছে। ক’ডা ট্যাহা দিবেন?রুটি কিইন্যা চা দিয়া খাইতাম।
মমতাজ মিয়া আর কিছু বললেন না। বিছানা থেকে নেমে সোজা গেট খুললেন।মোবারককে ঘরে নিয়ে আসলেন।ভেজা কাপড় খুলে দিয়ে গামছা দিয়ে বললেন, শরীরডা মুইছ্যা এইডাই পেঁচায়ে পড়। লুঙ্গি ছাড়া কিছু নাই।লুঙ্গি তো তুই পড়তে পারবি নে।
মোবারক শরীর মুছে চৌকির উপরে উঠে বসলো।
কারেন্ট তখন নেই, মমতাজ মিয়া হারিকেন জ্বালিয়ে টেবিলের উপরে রেখেছেন। ঘরে চার্জার লাইট থাকলেও তিনি হারিকেনেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। যখন ঘুম আসে না তখন টিপটিপ করে জ্বলা আলোর দিকে তাকিয়ে থাকলে ঠিক ঘুম চলে আসে উনার।
চৌকির নিচে থেকে বোয়াম বের করে মোবারকের হাতে দিয়ে তিনি বললেন, নে মুড়ি খা। মুড়ি ছাড়া এহন আর কিছু নাই।
মোবারক হারিকেনের আলোর দিকে চেয়ে,হাতের মুঠো ভরে ভরে মুড়ি মুখে দিতে লাগল। খানিকবাদে দু-গ্লাস পানি ঢকঢক করে খেয়ে মমতাজ মিয়ার দিকে বিনয়ের চোখে তাকালো।
-বোয়ামের মুখ লাগাইয়া চোকির নিচে রাখ।
অতঃপর বালিশ এগিয়ে দিয়ে বললেন, নে ঘুমা। সকাল হোক,পরে অন্য বেবস্থা হইবো।
মোবারক ইতস্তত মনোভাব নিয়ে শুয়ে পড়লো। মমতাজ মিয়া চোখ বুঝে ঘুমানোর চেষ্ঠা করলেন।খানিকবাদেই তিনি নাকডাকা শুরু করলেন।পুরো ঘর যেন মুহূর্তেই বর্ষায় ব্যাঙে ভরা ডোবার মত হয়ে গেলো।
ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে মমতাজ মিয়া মোবারককে বিছানায় পেলেন না।বাহিরে এসে দেখেন, বারান্দায় শানের উপরে ঘুমিয়েছে বেচারা।তাকে না ডেকে, তিনি তাঁর দৈনন্দিন কাজ শেষ করে নাস্তা নিয়ে আসলেন।নাস্তা খেতে খেতে বললেন, কিরে মোবারক তুই বিছানা ছেড়ে, এহানে ঘুমাইছোস কেন্?
-ঘরের ভিত্রে ঘুম আইতাছিলো না।
-আইচ্ছা,বুঝবার পারছি।মাটিত ঘুমায়ে ঘুমায়ে অভ্যাস আর কি।যাকগে, তোর বাপের নাম কি?
-জানিনে।
-আর মা?
-মইরা গেছে।
-কবে?
-জানিনে।
-বাপ কই থাকে?খোঁজ নেই না?
-না,হেই তো পাগল।
-মাজারে তোর দেখাশুনা কেডা করে?
-কেউ না।
অতঃপর মোবারক”চইল্যা যাই” বলেই দৌড় দিলো।মমতাজ মিয়া বললেন, দুপুরে আইসা খাইয়্যা যাস। মোবারক আর পিছনে তাকালো না।
খানিকবাদেই হাঁপাতে হাঁপাতে গেটের কাছে ছুটে এসে বললো, গেঞ্জি?
মমতাজ মিয়া হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি এনে দিলেন। গেটের সামনে ওসব পড়েই আবার দিলো দৌড়।
মমতাজ মিয়া দুপুরের খাবার অর্ধেক খেয়ে, বাকিটা মোবারকের জন্য রেখে দিলো।কিন্তু মোবারক আর আসলো না।পরেরদিনও অপেক্ষায় গেলো, কিন্তু সে আর আসে নি। একটু মাজারে গিয়ে খোঁজ নিবে, সে উপায়ও নেই। গেটে দাঁড়োয়ান দুজন, সিরাজ নামে একজন আর তিনি। সিরাজ গেছে ছুটিতে, এখন একা তিনি। যেজন্য গেট ছেড়ে বেশিদূর যেতে পারেন না। এভাবেই কয়েক’টা দিন কেটে গেলো, কিন্তু মোবারক আর এলো না। তিনিও ভুলে যেতে লাগলেন ধীরে ধীরে।
একদিন রাত ন’টার দিকে হুট করে গেটের সামনে এসে হাজির হলো মোবারক।পরনে নতুন গেঞ্জি।
-কিরে, কই ছিলি এতোদিন?আর নতুন কাপড় কোনে পেলি?
-দিছে একজনে।
-এতদিন আসিস নি কেন্?
-এমনি।
-খাইছিস?
-নাহ্।
-কেন্?
-ট্যাহা নাই।
-হোটেলে চাইলে খাওন দেয় না?
-দ্যায়, আবার দ্যায় না।
মমতাজ মিয়া পকেট থেকে বিশ টাকা বের করে মোবারকের হাতে দিয়ে বললেনন,কলা আর রুটি নিয়া দৌড়ে এহানে আসবি।
মোবারক দৌড়ে গিয়ে কলা রুটি নিয়ে আসলো। গেটে বসেই গপাগপ খেয়ে নিলো।পানি খেয়ে, কিছু না বলেই দিলো ভোঁ দৌড়।
আবার তার আসা বন্ধ হয়ে গেলো, কোনো খোঁজ নেই।সিরাজ ফিরে আসলে একদিন রাতে তিনি গেলেন মাজারে। সেদিন মাজারে নাচ গান হচ্ছিলো, অনেক মানুষ। এতো মানুষের ভিড়ে তিনি মোবারকের দেখা পেলেন না। নিরাশ হয়ে ঘরে ফিরে এলেন।সে-রাতে উনার আর ঘুম হলো না। দু-চোখের পাতা বন্ধ করলেই কেবল মোবারকের চেহারা ভেসে ওঠে। “পচা ডোবা ড্রেনের পাশে বসে আছে মোবারক। পচে যাওয়া রুটি খাচ্ছে সে, পাশেই বসে আছে কয়েকটি কুকুর।”চিৎকার দিয়ে তিনি শোয়া থেকে বিছানায় উঠে বসেন।তিনি বুঝে উঠতে পারছেন না, ছেলেটার জন্য তাঁর মনে দিন দিন এত মায়া বেড়ে যাচ্ছে কি করে? কত এরকম ছেলে-মেয়ে তার নজরে পড়লো, হাতে পাঁচ টাকা দিলেই চলে যেতো। একবার মহাস্থানগড় গিয়ে একটা ছোট্ট মেয়ে, বয়স ৪-৫ বছর হবে।পা টেনে ধরেছিলো। কালিমাখা ক্ষুধার্ত চোখ দেখেও তাঁর এতো মায়া হয় নি।তবে কেন এখন এমন হচ্ছে!তিনি কোনো মতেই বুঝে উঠতে পারছেন না।