মা কী করেন
[দিল আরা বেগম]
আমি একটি উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করেছি দীর্ঘদিন। প্রায় আঠার বছর। সেখানে কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে পরীক্ষায় যাঁরা পাশ করেন, তাদের মৌখিক পরীক্ষা নেয়া হয়। এমনি একটি মৌখিক পরীক্ষার বোর্ডে আমিও একজন সদস্য ছিলাম। সেখানে আমিএকজন পুরুষ প্রার্থীকে পরিচিতি মূলক প্রশ্ন হিসেবে জিজ্ঞেস করেছিলাম আপনার বাবা কী করেন? উত্তরে ছেলেটি বললেন, ‘আমার বাবা একজন কৃষক, কৃষি কাজ করেন করেন।‘ তার পর তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার মা কী করেন?’ উত্তরে ছেলেটি বলল, কিছু করেন না।‘
আমি তাকে আরও স্পষ্ট করে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার মা কী কাজ করেন? ‘ ছেলেটি আবার উত্তর দিল কোন কাজ করেন না।‘ এরপর সাক্ষাৎকার পর্বের প্রয়োজনীয় আলোচনা শেষ করে তাকে আবার জিজ্ঞেস করলাম, একটু মনে করতে চেষ্টা করুন তো আপনার মা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কী কী কাজ করে। ছেলেটি বললো, ‘এখনতো অনেক দিন মায়ের সাথে গ্রামে থাকা হয় না। পড়াশুনার জন্য এস,এস,সি পাশের পর থেকেই শহরে থাকছি। তাই এখনকার কথা সেভাবে বলতে পারবো না। তবে তার আগে মা সারাদিন কি কি কাজ করতেন তা আমি বলতে পারবো।
‘আমাদের গ্রামের বাড়ি অনেক বড়। সেই বাড়ির উঠান, বাড়ির আনাচ কানাচ সহ বিশাল জায়গা। মা কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে ওঠেন। প্রার্থনা ও প্রয়োজনীয় কাজ সেরেই মা সংসারের কাজে নামেন। আমরা ও বাবা তখনও ঘুমিয়ে থাকি। হাঁস মুরগী বের করে খাবার দেয়া থেকে শুরু হতো মায়ের কাজ।তারপর উঠান, ঘর, কাচারি ঘর, সারা বাড়ি ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করা। এরপর গরু বাছুরের খবার দিয়ে কল চেপে পানি তুলে রাখতেন আমাদের সবার সকালের কাজ সারার জন্য। আমরা ও বাবা তখনও ঘুমিয়ে। এরপর ভাত তরকারি রান্না করে আমাদেরকে ডেকে তুলতেন। বাবাকে হাত মুখ ধোয়ার পানি এগিয়ে দিয়ে সকালের খাবার দেয়ার ব্যবস্থা করতেন। বাবা ও আমাদের খাইয়ে জমিতে যারা কাজ করতেন তাদের খাওয়াতেন। এরপর দৌঁড়ে যেতেন ধান রোদ দেয়ার জন্য। উঠানে ধান রোদ দিয়েই যেতেন বাড়ির গাছের সবজি তুলতে।
শাক সবজি তুলে এনেই শুরু করতেন দুপুরের রান্নার আয়োজন। এরই সাথে এক ফাঁকে গোগ্রাসে সকালের খাবারটা খেয়ে নিতেন।রান্নায় বসেও উঠানে চোখ রাখতে হতো যাতে পাখি বা মুরগী ধান খেতে না পারে। মাঝে মাঝে উঠানে ধান উল্টে পাল্টে দিতেন। এসব কাজ মা একই সাথে করতেন। মাকে দেখতাম সারাক্ষণ রান্নাঘর, উঠান, থাকার ঘর, বাইরের ঘরে ছুটোছুটি করতে। চূলোয় তরকারী , দেখা গেল বৃষ্টি নেমেছে,মা অমনি উঠে গিয়ে ধান ঘরে তুলতেন এবং পাশাপাশি রান্নাও সেরে ফেলতেন।মা কিভাবে যেন সব গুছিয়ে করে ফেলতেন। মাকে কখনও দু’দন্ড বসতে দেখিনি।
দুপুরের রান্নার পর ছোট ভাইবোনদের গোসল করিয়ে খাবারের ব্যবস্থা করতেন। বাবা ও জমির কাজের লোকদের খাইয়ে পরে মা যেতেন গোসলে। গোসল সেরে মা যখন দুপুরের খাবার নিয়ে বসতেন, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল পাঁচটা বেজে গিয়েছে। খাবার খেয়েই শুকনো ধান ভাঙ্গনোর ব্যবস্থা করা, কোন জমিতে কি পরিমান ফসল /সবজি হয়েছে, কি পরিমান বিক্রি উপযোগী হয়েছে তা হিসাব নিকাশ করা এবং বিক্রী যোগ্য সবজি/ফসল বাজারে পাঠানোর ব্যবস্থা করে বাবাকে সাথে পাঠাতেন। আমি এমনও দেখেছি বিক্রিযোগ্য সবজি র বস্তা ধরে লোকের মাথায় পর্যন্ত উঠিয়ে দিতেন। এরই ফাঁকে আত্মীয় স্বজন এলে তাদের আপ্যায়ন করতেন।
সন্ধ্যায় মা সবজির গাছে পানি দিতেন।হাঁস, মুরগী খোপে তুলে,গরু বাছুরের খবর নিতে গোয়াল ঘরে যেতেন।গরু বাছুর সব ঠিক ঠিক এসেছে কিনা। তারপর আমাদের হাত- পা ধুইয়ে ঘরে উঠিয়ে বসতে বলতেন। এবং পড়তে বসার জন্য তাড়া দিতেন। তারপর কখনও মাকে দেখতাম বাঁশ বেত দিয়ে ঝুড়ি, পাটি এসব বানাচ্ছেন। রাতে রান্নার কাজ শেষ করে, আমাদের পোশাক, আগামী দিন আমরা যেগুলো পরবো সেগুলো সেলাই করা, বোতাম লাগানো বা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আছে কিনা তা দেখে ঠিক করে রাখতেন । আমরা তখন পড়াশুনা করতে থাকতাম, মা মাঝে মাঝেই এসে আমাদের খোঁজ নিতেন, তাগিদ দিতেন। রাতের খাবার খেয়ে সব কিছু গুছিয়ে শুতে শুতে অনেক রাত হতো মায়ের। আমরা অনেক আগেই শুয়ে পড়তাম। মা তখনও বাজার থেকে বাবার ফেরার অপেক্ষা করতেন। বাবা এলে তাঁকে খাইয়ে তারপরও দেখতাম মা সংসারের খুঁটিনাটি কাজ করেই চলেছেন’।
তারপর আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম আপনি আপনার মায়ের সারাদিনের কাজের যে বর্নণা দিলেন, তাতে তাঁর কর্মসময় কতঘন্টা তা কি চিন্তা করে দেখেছেন? এ কর্মসময়ের জন্য তিনি কত পারিশ্রমিক পেতে পারতেন তা কি কখনও ভেবে দেখেছেন?
এখানে দেখা যাচ্ছে, আপনার যে কাজগুলো করেছেন তা হলোঃ
● পারিবারিক /সাংসারিক কাজ
● সামাজিক কাজ
● উৎপাদনে অংশ গ্রহণ
● সন্তান লালন পালন
● সরাসরি ভাবে অর্থনৈতক কাজ
অথচ একটু আগে আপনি বলেছেন ‘তিনি কিছু করেন না’। তখন ছেলেটি বললো, আসলে আপা এভাবে কখনও চিন্তা করিনি বা ভেবেও দেখেনি। ‘আজথেকে আমার চিন্তার নতুন একটি দিক খুলে গেল। আমার তো মনে মায়েদের কাজের পরিমাণ এতই বেশি যে শুধু ‘গৃহিণী’ শব্দটি দিয়ে প্রকাশ করা যায় না। এজন্য নতুন কোন উপযুক্ত শব্দ থাকা দরকার’।
আসলে ছেলেটির প্রথম উত্তরের জন্য সে দায়ী নয়। দায়ী আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় নারীর শ্রমের উপর থাকে পুরুষের নিয়ন্ত্রণ। পুরুষের আধিপত্য নারীর অস্তিত্বকে বিলীন করে দেয়। যেখানে সামাজিক ভাবেই গৃহিণীর সাথে মাতৃত্বকে এক করে দেখা হয়। যে ব্যবস্থায় নিজেরা উৎপাদন না করেও, অন্য উৎপাদকদের শ্রম নিয়ণ্ত্রণ করে এবং উৎপন্ন বস্তু ভোগ করে; যার ফলে আমাদের সমাজের প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে শিক্ষিত অংশও নারীর শ্রমকে স্বীকৃতি দিতে শিখেনি বা এ ধরণের কোন চিন্তা তাদের চেতনাকে নাড়া দেয়নি। এ দায়ভার আমাদের, আমরা যারা অগ্রজ তাদের!!
৪ Comments
চমৎকার ও অত্যন্ত কঠিন একটা সত্যকে উপলব্ধি করলাম আপনার লেখার মধ্য দিয়ে। আপনি আরো লিখুন আপা।
congratulations
ধন্যবাদ
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এখনও নারীর ঘরের কাজের কোনো মূল্যায়ন নেই। শহরে কিছুটা থাকলেও, গ্রামে একেবারেই নেই। কেন নেই? গত চারদশক থেকে উন্নয়ন সংস্থা গুলো কাজ করছে নারীর অধিকার নিয়ে তারপরও কেন হচ্ছেনা? আসলে পারিবারিক মূল্যবোধ শিক্ষায় মা-বাবার এ বিষয়ে আরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
লেখাটা অনেক ভালো লেগেছে দিলআরা আপা। আপনি আরও লিখুন।