ভ্রান্ত পথিক
সুলেখা আক্তার শান্তা
সারাদিন ঘুরে ফিরে দিন কাটে নাহিদের। কারো কথা শুনেনা সে। মা মর্জিনা ছেলেকে কাজের কথা বললে, সে চেঁচামেচি করে উঠে। মা আমার কাজ করতে ভালো লাগেনা।
কাজ করবি না খাবি কি?
রোজ রোজ তোমার একই কথা, কাজ করবি না খাবি কি? শুনতে আর ভালো লাগেনা।
তুই সংসারের বড় ছেলে, তোর তো সংসারের প্রতি দায়িত্ববোধ থাকা উচিত।
তুমি এবার থামো। দেখি একটা কাজ জুটিয়ে নিব।
দলবল নিয়ে দুরন্তপনায় নাহিদের দিন কাটতে থাকে। একদিন সকালে মর্জিনা ঘুম ভাঙ্গে লোকজনের চেঁচামেচির শব্দে। তাড়াতাড়ি উঠে দেখে সবাই রাস্তা দিয়ে একই দিকে ছুটছে। লতিফ বলে, আরে চাচি আপনি এখনো এখানে ওইদিকে আপনার ছেলেকে ধরে মারছে।
হায় হায় বলিস কি? এই ছেলেকে নিয়ে আর পারলাম না। সবার সঙ্গে নিজেও ছোটে সেই দিকে।
ছেলের কান্না শুনে মর্জিনার প্রাণ কেঁপে ওঠে। চিৎকার করে বলে, বাবা তোমার আমার ছেলেকে মেরো না। আমার ছেলে কি অন্যায় করেছে আমাকে বলো?
আপনার ছেলে সিঁধ কেটে ঘরে ঢুকে টাকা-পয়সা স্বর্ণ মোবাইল নিয়ে পালাতে গিয়ে হাতে নাতে ধরা পড়েছে!
আমার ছেলে একি সর্বনাশ করল। মান সম্মান সব ধুলোয় মিশিয়ে দিলো। সবাইকে অনুরোধ করে, তোমরা আমার ছেলেকে ছেড়ে দাও। আমি কথা দিচ্ছি ও আর এমন কাজ করবে না।
লতিফও সবাইকে মিনতি করে বলে, চাচি যখন বলছে তোমরা নাহিদকে ছেড়ে দাও। ও আর এমন কাজ করবে না। যে কাজ করেছে তার শাস্তি তো পেয়েছে।
লোকজন বলে, এরপর যেন এমন কাজ না করে সাবধান করে দেবে। মর্জিনা ছেলেকে বকাঝকা করতে করতে বাড়ি নিয়ে আসে।
এই অপবাদ মাথায় নিয়ে চলা দুষ্কর হয়ে পরে তার জন্য। ভগ্নহৃদয় নাহিদ সিদ্ধান্ত নেয় সে আর এই গ্রামেই থাকবে না। কাপড়চোপড় গুছিয়ে একদিন মাকে বলে, মা আমি চলে যাচ্ছি।
কোথায় যাচ্ছিস বাবা? এতদিনে তোর সুমতি হলো। বাবা যেখানেই থাকোস ভালোভাবে থাকিস। মন দিয়ে কাজকর্ম করিস। জীবন গড়ার চেষ্টা করিস।
নাহিদ ঢাকায় আসে। কাজকর্ম করে, ভালই তার রোজগার হয়। মায়ের জন্য টাকাও পাঠায়। এরমধ্যে সুন্দরী লিনাকে চোখে পড়ে তার। লিনার জন্য উতলা হয়ে পড়ে সে। একসময় সম্পর্ক হয় এবং সম্পর্ক থেকে বিয়ে। সাধারণ চেহারার নাহিদ সুশ্রী লিনাকে বিয়ে করতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করে। মনে তার আনন্দ ধরে না। এক সময় নাহিদ লিনাকে বলে, চলো আমরা দেশের বাড়ি বেড়াতে যাই। মনে মনে বলে, মাকে দেখাবো তাঁর ছেলে কেমন সুন্দরী বউ পেয়েছে। নাহিদ বউ নিয়ে বাড়ি আসে। মা দেখো তোমার বৌমাকে নিয়ে এসেছি। মর্জিনা বউকে বরণ করে নেয়। লিনাও ভালো লেগে যায় তাদের আদর ভালোবাসা পেয়ে।
দেবর মাসুদকে দেখে চমকে ওঠে লিনা, মাসুদ দেখতে সুদর্শন। চোখ ফেরাতে পারে না সে। মাসুদ সারাক্ষণ ভাবি ভাবি বলে একাকার। ভাবিকে ছাড়া কিছুই বোঝে না সে। লিনাও দেবরের সঙ্গে সারাক্ষণ খুনসুটি আলাপে মেতে থাকে। মোহাবিষ্ট এক স্বপ্নের মধ্যে ডুবে থাকে সে। কয়েকদিন বাড়ি থাকার পর নাহিদ বউকে নিয়ে ঢাকায় ফিরতে চায়। লিন স্বামীকে বলে, তুমি যাও আমি এখানে থাকবো কদিন।
তুমি এখানে থাকবে, আমাকে ছাড়া তোমার থাকতে ভালো লাগবে?
তুমি দেখো আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারি কিনা।
ঠিক আছে থাক। নাহিদ ঢাকায় যায়। ভালো করে জীবন সাজাতে চায় সে। সারাদিন কাজে প্রচণ্ড পরিশ্রম করে। বাসায় ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়। কাজের চাপে বাড়িতে কথা বলার সুযোগ হয়ে ওঠে না। বাসায় এসে নাহিদ যখন বাড়িতে কথা বলে লিনা তখন ঘুমিয়ে থাকে। লিনার সঙ্গে কথা হয়না। আস্তে আস্তে লিনার সঙ্গে যোগাযোগ কমতে থাকবে নাহিদের।
ছয় মাস পর বাড়ি যায় নাহিদ। বাড়িতে ঢুকার আগে পথে নানা জনে নানান কথা কানে আসে। লোকজনের কথা কানে না নিয়ে বাড়ির পথে চলতে থাকে। রাস্তায় লতিফের সঙ্গে দেখা হয়। তাকে জিজ্ঞাসা করে, ভাই লোকজন আমাকে কি সব কথা বলছে ঠিক বুঝতে পারছিনা!
তুই মাত্র ঢাকা থেকে এসেছিস আগে বাড়ি যায় তারপরে শুনতে পারবি। কেন আগে কোন কথা তুই শুনিসনি?
নাহিদ বিরক্ত হয়। তোমাদের কথা রহস্যের বেড়াজালে মোড়া, কিছুই বুঝতে পারছি না!
বাড়ি যা তারপর বুঝতে পারি।
নাহিদ বাড়িতে এসে মাকে উৎকন্ঠা নিয়ে বলে, মা তোমার বৌমা কোথায়?
মর্জিনা বলে, বাড়ি এসেছিস আগে খাওয়া-দাওয়া কর। তারপর সব জানতে পারবি।
মা লিনা কোথায়?
মর্জিনা ছেলের কথায় কোন উত্তর দেয় না।
লতিফ নাহিদের পিছে পিছে এসে এতক্ষন দাঁড়িয়ে কথা শুনছিল। তুই তো বাড়ি আসার সময় কিছু কথা হলোও জানতে পেরেছিস। লিনা এখন তো তোর নেই। সে তোর ছোট ভাই মাসুদকে বিয়ে করেছে।
লতিফ ভাই এটা কি করে সম্ভব! আমিতো এর কিছুই জানিনা।
কিছু মানুষের জন্য সবই সম্ভব।
লতিফ ভাই আমার জীবন তো এখানেই থেমে গেল।
জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না। তোর জীবন থেমে থাকবে না। তুই তোর জীবন সাজানোর চেষ্টা কর।
মাসুদের নির্বিকার আচরণ আরো বিস্ময়কর। বড় ভাই নাহিদের সর্বনাশে তার কোন ভ্রুক্ষেপ নাই। বরং সে আর লিনার হাত ধরে ছুটাছুটি করছে। তা দেখে নাহিদের বুকে মধ্যে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে। ক্ষিপ্ত হয়ে মাসুদকে বলে, আরে বেঈমান নিজের ভাইয়ের সঙ্গে বেঈমানি করতে তোর বাধলো না। নাহিদ দু’হাত দিয়ে মাসুদের গলা টিপে ধরে।
লিনা কাছে এসে বলে, ছেড়ে দাও আমার স্বামীকে। তুমি কি ছিলে আমি তা জানিনা। তুমি তো একটা চোর ছিলে। আর আমি একটা চোরের সঙ্গে করব সংসার। সব ধরনের খারাপ ভাষায় আক্রমণ করতে থাকে নাহিদকে। নাহিদের আর কথা বলার ইচ্ছে জাগে না। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে লিনা আর মাসুদের দিকে।
ঘটনার আকস্মিকতায় বিপর্যস্ত নাহিদ বাড়ি ছাড়ার প্রস্তুতি নেয়। মর্জিনা বলে, কোথায় যাচ্ছিস বাবা?
জানিনা মা।
এই বুড়ো মাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছিস?
তোমার আরেক ছেলে তো আছে।
মায়ের সব সন্তানের জন্যই মন পুড়ে। তুই মাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছিস? আমার যে তোর জন্য হৃদয় পুড়ছে।
মা আমাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করো না। অভিমানে বলে, আমি তো কারো কিছু নিয়ে যাচ্ছি না। আমি শুন্য এক হাত পায়ে চলে যাচ্ছি।
ছেলের অভিমানের কথা মর্জিনা বুঝতে পারে। সে দু’চোখের অশ্রু ছেড়ে দেয়।
নাহিদ ঢাকায় চলে আসে। কাজকর্ম করার তার কোন ইচ্ছা জাগে না। বেশ কিছুদিন সে বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করে না। একসময় তার মায়ের কথা মনে পড়ে। ফোনে মায়ের সঙ্গে কথা বলে। মর্জিনার ছেলের প্রতি অভিমান, আমার কথা কি তোর মনে আছে? থাকলে ঠিকই মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতি।
মা তোমার সঙ্গে কথা বলতে খুব মন চায়। কি করবো, কোন এক বাধা এসে আমার সামনে দাঁড়ায়। আর পারিনা তখন তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে।
বাবা বাড়ি আয়। এই বুড়া মার কাছ থেকে আর দূরে থাকিস না।
তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না মা। তোমার কষ্টে আমি নিজেও যে সুখ পাই না। মায়ের ডাকে নাহিদ বাড়ি আসে। কিন্তু বাড়িতে নাহিদের কোন কিছু ভাল লাগেনা। সব সময় মন খারাপ করে বসে থাকে।
মর্জিনা ছেলেরা এমন অবস্থা দেখে ভাবে ছেলেকে বিয়ে করে দিবে। মেয়ে দেখা শুরু করে। লিনা তাতে হিংসায় জ্বলে উঠে। সে স্বামী মাসুদকে বলে, শোনো আমি তোমাকে যেভাবে বলি তুমি সে ভাবে কাজ করে যাবে। তোমার ভাইকে এখান থেকে তাড়াতে হবে।
ভাইকে তাড়াবো কেন?
সে এখানে থাকলে এই সম্পত্তি ভাগ নিবে। তার চেয়ে তুমি আমার কথা মত কাজ করো। যাতে সে সম্পত্তি না পায়।
যা করো সাবধান করো।
কি করতে হবে সেদিকে আমার লক্ষ আছে।
লিনা নাহিদকে বাড়ি থেকে বিতাড়িত করার ফন্দি বের করে। লোকজনকে বলে, দেখেন আপনার চোরে কি কাণ্ড করেছে! আমার মহা সর্বনাশ করে ফেলেছে।
মর্জিনা এসে বলে, কি হয়েছে বৌমা?
কি আর হবার বাকি আছে। চোরকে আপনি বাড়িতে উঠিয়েছেন।
এসব কি কথা বলছো তুমি?
সর্বনাশ হয়েছে। আপনি বলছেন কি হয়েছে আমার? চোর ছেলে পেটে ধরেছেন! আমার টাকা পয়সা স্বর্ণ অলংকার সব চুরি করে নিয়েছে। আপনার গুণধর চোর ছেলে। মর্জিনা চমকে উঠে মাসুদকে জিজ্ঞেস করে, এসব কি শুনছি।
লিনা গ্রামের মাতুব্বরদের ডাকে।
বৌমা তুমি এ নিয়ে বিচার সালিশ বসিও না। নাহিদ যদি এসব নিয়ে থাকে ওর কাছ থেকে ওগুলি নিয়ে তোমাকে দেওয়ার চেষ্টা করব।
লিনা মুখ ভেংচে শাশুড়িকে উদ্দেশ্য করে বলে, চোরের কোন ধর্ম আছে নাকি? ছেলে অপকর্ম করলে মাকে তো তার অপবাদ নিতেই হবে। লিনার কথায় অসহ্য হয়ে মর্জিনা নাহিদকে বলে, বাবা তুই এই জিনিসপত্রগুলো নিয়ে থাকলে ফেরত দে।
মা আমি এসব কিছুই নেই নাই। আমার নামে সব মিথ্যা বলছে। মা আর কেউ বিশ্বাস না করুক তুমি অন্ততপক্ষে আমাকে বিশ্বাস করো।
বাবারে আমার বিশ্বাসে কার কি আসে যায়!
লিনা মাতব্বরদের বলে, আপনারা আমার অন্ততপক্ষে টাকা-পয়সা উদ্ধার করে না দেন। এই চোরকে মেরে গ্রাম থেকে বের করে দেন।
লোকজন সবাই নাহিদদের উপর ক্ষেপে যায়। উত্তেজিত হয়ে নাহিদের গায়ে হাত তোলে। নাহিদ প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলে।
মর্জিনার দু’চোখে অশ্রু ঝরতে থাকে, ছেলেকে বলে, তুই আর চুরি ছাড়তে পারলিনা!
নাহিদ বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। জীবনের একটি ভুলের অপবাদ তাকে বয়ে বেড়াতে হয়। আর সে বাড়ি ফিরে আসেনা। অজানা পথের ভ্রান্ত পথিক হয়ে চলতে থাকে তার পথ চলা।
১ Comment
congratulations.