২৬০ বার পড়া হয়েছে
বিছনাকান্দি-সিলেট পরিভ্রমণ।
(জেবুন্নেছা সুইটি)
(জেবুন্নেছা সুইটি)
অনেক দিনের ইচ্ছে, ঘর হতে দু’পা ফেলিয়া দেখে নিব নিজের স্বদেশ, দেখে নিবো ঘাসের উপর সেই শিশির বিন্দু। সে ইছেরই বাস্তব রূপায়নের মানসেই রওয়ানা হলাম বিছনাকান্দি সিলেটের উদ্দেশ্যে। প্রথমেই চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে এসে “উদয়ন এক্সপ্রেস নামে ট্রেনে উঠলাম রাত নয় টায়। সকাল পাঁচটায় সিলেট রেলস্টেশন গিয়ে পৌঁছলাম। হোটেল ভ্যালি গার্ডেনে আগে থেকে রুম বুকিং দেওয়া ছিল। বিসমিল্লাহ পড়ে, সিলেট শাহজালাল মাজার পরিদর্শন করলাম। তারপর দুপুরে “পানসী” রেস্টুরেন্টে চার রকমের ভর্তা ডাল গরুর মাংস দিয়ে গরম ভাত খেলাম। সারাদিন শহরে ঘোরাঘুরি শেষে রাতে পাঁচ ভাই রেস্তরায় ডিনার করলাম। খাবারের স্বাদ বিশ্লেষণ করলে, পানসীর চেয়ে পাঁচভাই রেস্তরার খাবার বেশি সুস্বাদু। রাতে ঘুমানোর আগে ঠিক করে নিলাম সকালে বিছনাকান্দি পরিদর্শন করতে যাব। হোটেল ভ্যালি গার্ডেন থেকে একটা হাইস ভাড়া করলাম। দুই বান্ধবী এবং ছেলে মেয়ে সহ আমরা মোট আট জন। গাড়ি চলছে দ্রুতগতিতে একেবারই যানজট নেই বললেই চলে। পনেরো মিনিটের মধ্যে দেখতে পেলাম সেই আমাদের চিরো সবুজ বাংলাদেশ।
যেদিকেই তাকাই বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ, রাস্তার দুই কূল ঘেঁষে বড় বড় গাছের সারি! গাছের শাখা প্রশাখার মাঝে উকি দিচ্ছে সূর্য আর সাদা তুলার মত খন্ড খন্ড মেঘেদের বিমূর্ত মুখ”। চমৎকার দৃশ্যপট অবলোকন করতে করতে কখন যে চলে এলাম গোয়াইনঘাট বাজারে! গোয়াইনঘাট বাজারে, গাড়ি থামিয়ে সকালের নাস্তা খেলাম । খাবার হোটেল থেকে বের হতেই চোখ পড়ল আধাপাকা একটা বাড়ি। বাড়ির উঠুনে তিনটে টক বরই গাছ। হলুদ লাল সবুজ রঙের বরই গুলি দেখলে লোভ সামলানো দায়!!! যেহেতু শীতের মৌসুম! লবণ, মরিচ দিয়ে টক বরই খেতে মন্দ না। একেবারই জ্বিভে জলে টুইটুম্বুর!! তাই বরই খাওয়ার লোভ কিছুতেই সামলানো গেল না। দরজায় টোকা দিতেই এক মহিলা বের হয়ে আসলেন। মহিলার সাথে মজা করে খাতির জমিয়ে দিলাম। এবং বললাম, আপা আপনি যদি কিছু মনে না করেন, মানে, যদি অনুমিত দিন, আমরা নিজ হাতে বরই পেড়ে আনন্দ পেতে চাই। মহিলা বললেন পাড়েন আপা, যতগুলি বরই পাড়বেন, তত্ত্ব গুলি কিনতে হবে। মনের আনন্দে প্রায় দুই কেজির মত বরই পেড়ে মহিলার হাতে একশো টাকা তুলে দিলাম, মহিলা খুশি হয়ে লবণ মরিচ সঙ্গে দিলো। যেহেতু শুকনা মৌসুম, গোয়াইনহাট ঘাটে পানি নেই, নৌকাও নেই! কি আর করা! প্রখর রোদের মধ্যে অনেক দূর হাঁটলাম এবং লবণ মরিচ দিয়ে টক টক বরই খেতে ভীষণ মজাই লাগছিল। কিছুদূর হেঁটে যাওয়ার পর নৌকা পেলাম। চার-পাঁচজন মাঝি এসে সামনে দাঁড়ালো, হাঁক ডাক কাকে বলে! একজন বললো আমার নৌকায় আসেন, অন্যজন বললো আমার নৌকায় আসেন! কারো সাথে কথা না বলে আমি একা দূরে সরে গেলাম, একজন মাঝিকে জিজ্ঞেস করলাম বিছনাকান্দি যেতে ভাড়া কত লাগবে? মাঝি বললো ১৫০০ টাকা, আমি বললাম ১০০০ টাকায় যাবে? মাঝি মাথা নুইয়ে বললো আসেন উঠেন।বললাম দাঁড়াও আমার লোকজন নিয়ে আসছি। ঐ জায়গায় যেয়ে দেখলাম মাঝিদের মধ্যে ঝগড়া! বললাম ঝগড়া থামাও… কত টাকায় যাবে শুনি? পাঁচজন মাঝি একই কথা ২০০০ টাকা করে ম্যাম। আমি সবাইকে ডেকে আগে ঠিক করা মাঝির নৌকায় উঠে পড়লাম। এক মাঝি রেগে বলে উঠলো ” মরা মাঝির নৌকায় উঠেন সারাদিন কাটিয়ে দিবে বিছনাকান্দি আর যেতে হবে না ” মনে মনে হেসে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললাম ইঞ্জিনচালিত নৌকা মাঝি মরা হলে হোক তাতে কি। ততোক্ষণে অন্য মাঝিরাও ভাড়া পেয়ে গেল, সেই নৌকায় ১১ জন ছেলে উঠলো। সবগুলো একই বয়সের, সম্ভবত মাত্র ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। সবার গায়ে কমলা কালারের গেঞ্জি পরা। ঐ মাঝি আমাদের নৌকার পাশ ঘেঁষে দ্রুতগতিতে নৌকা চালিয়ে হাসতে হাসতে আমাদের নৌকা ক্রস করে চলে গেলো। ছেলেগুলো আনন্দে সেই নৌকার মধ্যে গান বাজনা নাচানাচি করছিল। দৃশ্যটা দেখে আমরাও ভীষণ মজা পেলাম। আমাদের মাঝি বলল “এই নদীতে রক্ত গরম করে নৌকা চালানো উচিৎ না। আমি কিছু কিউরিসিটি থেকে জিজ্ঞেস করলাম “কেন কি হয়েছে কোন সমস্যা”? মাঝি বললো, “জ্বী ম্যাডাম, হঠাৎ হঠাৎ বিছনাকান্দির পরিবেশ খুব গরম থাকে, নদীর তলদেশে কিছু গর্ত হয় , সেখানে ঘূর্ণি হয়, সব সময় দৃষ্টি রেখে নৌকা চালাতে হয়।
যেসব জায়গায় ঘূর্ণি হয় তাকালেই বুঝা যায়,আমরা তখন পাশ কেটে নৌকা চালায় “। মাঝির কথা শুনে ভয়ে বুকটা কেঁপে উঠলো।সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললাম “বাচ্চারা বলছি শুনো, আনন্দ কর ফুর্তি কর আর যাই করো না কেন আল্লাহকে স্মরণ রেখো,, সবাই একসঙ্গে থাকবে, দল ছাড়া হবেনা কেউ “।নৌকা চলল ধীরগতিতে, নদীর দুই কুল ঘেঁষে চর আর চর। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের ভূমি শীতে একরকম বর্ষায় অন্য রকম সুন্দর, বিছনাকান্দি যাওয়ার পথ। এখানে-ওখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে পাথর আর পাথর, যেনো প্রকৃতির এক অপূর্ব সৌন্দর্য। এই সৌন্দর্য দেখে নিমিষেই ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে।নৌকায় বসেই খালি চোখে দৃষ্টির শেষ সীমানা পর্যন্ত শুধু মেঘালয় রাজ্যের পাহাড় আর পাহাড়। শুকনো মৌসুমে বিছনাকান্দির আসল সৌন্দর্য চোখে পড়ে না তেমন। শুনেছি বর্ষায় বেশি সুন্দর। প্রায় ঘন্টার মধ্যে আমাদের নৌকা পৌঁছে গেলো বিছনাকান্দির মূল পয়েন্টে। নৌকা থেকে নেমে দেখলাম ছোট ছোট কিছু খাবার হোটেল তাও খোলা আকাশের নিছে! যেদিকেই তাকাই না কেনো শুধু বড় ছোট পাথর আর পাথর! একেবারেই জলপাথরের বিছানা! শুয়ে বসে, হাঁটুপানিতে ডুবিয়ে ছবি তুলার অনুভুতি টাই অন্য রকম ভালোলাগা। স্বচ্ছ শীতল পানির তলদেশে পাথরের পাশাপাশি নিজের শরীরের লোমও দেখা যাবে স্পষ্ট।বিছনাকান্দির সৌন্দর্য সত্যিই দৃষ্টিনন্দন! পাথর আর পাহাড়! দূর থেকে দেখলে মনে হয় আকাশ আর মেঘের সাথে পাহাড়ের ঢলাঢলি। পাহাড়ের গা ঘেঁষে ঘন কুয়াশা গুলি যেন আঠার মতো লেগে থাকে। বিছনাকান্দির এই অপরূপ দৃশ্য দেখতে দেখতে কখন যে দুপুর হয়ে গেল টেরই পেলাম না!!! চারিদিকে তাকিয়ে দেখি আমরা কেউ একসাথে নেই। নৌকাতে বসে যে শপথ করেছিলাম সবাই তা ভুলে গিয়েছে। আমি নিজেও! একেই বলে প্রকৃতি প্রেমিক । এবার ফোন করে সবাইকে একসাথ করলাম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি দুপুর দু’টো! সময় দেখে মনে হলো ভীষণ খিদে পেয়েছে।
খোলা আকাশের নিচে হোটেলগুলোতে খেতে বসলাম। প্যাকেজে হাঁসের মাংস ডাল কয়েক পদের ভর্তা দিয়ে ভাত খেলাম। মুখোরোচক সুস্বাদু খাবার খেয়ে সবাই তৃপ্তির ঢেকুর উঠালাম। পানি খাওয়ার জন্য মিনারেল ওয়াটার চেয়েছিলাম। এক মহিলা বললো “আপা এখানে এসে কেউ মিনারেল ওয়াটার খায় না। আমরা সবাই আল্লাহর প্রদত্ত জমজমের পানি খাই। আমি বললাম মানে? মহিলা বলল “আসেন জমজম কূপ দেখায় আপনাকে”। প্রায় ১২/২৪ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য প্রস্থের একটা কুয়া! যেটা মাটির সরা দিয়ে ঢাকনা থাকে। ঢাকনাটা খুলে মহিলা অনবরত মগে ভরে পানি উঠাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে কুয়াটা আবার ভরে যাচ্ছে! এক অবাক করা দৃশ্য! কোথাথেকে এত পানি আসে!খেয়ে দেখলাম মিনারেল ওয়াটার চেয়েও ভালো, পানির স্বাধ মিষ্টি মিষ্টি! মহিলা বলল “এই পানি পাহাড়ি ঢালের, পাথরের মধ্যে পরিষ্কার হয়ে এই কুয়ায় জমে। যত তুলি শেষ হয় না, এবার বলেন এটা জমজম কুয়ার পানি না”?। বুঝতে অসুবিধে হলোনা যে, পাহাড়ের কান্না এতো পিওর! মিষ্টি মজাদার। এমন সময় হঠাৎ চতুর্দিকে শোরগোল শুনতে পেলাম। কয়েকজন লোক বলাবলি করছে একটা ছেলে মারা গিয়েছে।একটু দূরে কিছু লোকের জটলা দেখলাম। বুকের ভিতর ধুক ধুক করছিল হাত পা সব অবশ হয়ে আসছিল। এমন দৃশ্য দেখার সহস হলোনা আমার। সাবাইকে বললাম তাড়াতাড়ি চলো এখান থেকে। ঘাটে গিয়ে মাঝি কে ফোন দিলাম। দেখলাম মাঝি দৌড়ে দৌড়ে হায় হায় করতে করতে আসছে। মাঝি এসে বললো “ম্যাডাম আমাদের পাষ দিয়ে যে নৌকাটা দ্রুত গতিতে চলে গিয়েছিল, ঐ যে সব ছেলেরা এক রঙের গেঞ্জি পরাছিল, ঐ নৌকারোহী একটা ছেলে খাদে পড়ে পানিতে ডুবে মারা গিয়েছে।
মনে হয় চোরা খাদে পড়েছে। শুনে তাৎক্ষণিক নিজের মনকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। মায়ের মন, নিজেরও এই বয়সি একটা ছেলে আছে।আল্লাহ মাবুদ কোন মায়ের বুকের ধন শেষ হয়ে গেল!!! দৌড়ে লোকের ভিড়ের মধ্যে ছেলেটাকে দেখতে গেলাম। দেখলাম, একটা লোক ছেলেটার নিথর দেহটাকে কাঁধে নিয়ে লাফালাফি করছে আর ছেলেটার মুখ থেকে পানি বের হচ্ছে! আমি চিৎকার করে বললাম ” এমন করছো কেনো, ছেলেটা ব্যাথা পাচ্ছে”। একজন লোক আমাকে বললো ” ম্যাডাম, যা করছে ঠিক আছে, ছেলেটা যদি বেহুশ অবস্থায় থাকে, তাহলে এই চিকিৎসায় জ্ঞান ফিরবে”।
আমি বললাম ” হসপিটালে নিয়ে চলুন ডাক্তার ডাকুন”। অন্য একজন বললো, “ম্যাডাম দুঃখের বিষয় যে এই বিছনাকান্দিতে প্রতি বছর কত টুরিস্ট আসে, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, মন্ত্রী মিনিস্টার, কবি সাহিত্যিক,মিডিয়া, হাজার হাজার পর্যটক আসে। এটা বৃহত্তম একটা পর্যটন কেন্দ্র, সারাবছর সিনেমার শুটিং হয় এখানে। প্রতি বছর একটা না হয় একটা অঘটন ঘটেই যাচ্ছে । তার পরেও কেউ কোনো একটা হসপিটাল করার উদ্যোগ নেয়নি। থানায় ফোন করা হয়েছে, পুলিশ আসতে দুই ঘন্টা লাগবে। তারপর পুলিশে যা করার করবে।আমি হতভম্ব হয়ে নৌকার কাছে ফিরে আসলাম। মাঝিকে বললাম সাবধানে নৌকা চালিয়ে নিয়ে চলো। সারা নৌকায় মনটা এতটাই খারাপ ছিল, চিৎকার করে কাঁদতে পারিনি। মনে মনে ভাবছি, দেশের মানুষ কবে সচেতন হবে? আমাদের জন্য কি কোন জায়গায়ই নিরাপদ নই? আমি বিজ্ঞ মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। সিলেট বিছনাকান্দি তে একটা হসপিটাল করা হোক। নিরাপত্তা জোরদার করা হোক। প্রতিবছর কোন মায়ের সন্তান যেন অকালে না ঝরে যায়। সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া হোক। শেষ..
১ Comment
congratulations