বাবা আমার বাবা
বাবা কতদিন…. কতদিন… দেখিনি তোমায়…. এই গানটি দূরে কোথাও বাজছিল, হঠাৎ করেই কানে এসে আটকে গেল গানটি। সুরের আবেশে আচ্ছন্ন হয়ে স্মৃতিতে হাতরে বেড়াতে শুরু করলাম। কিছু স্মৃতি গাঢ় আবার কিছু স্মৃতি ঝাপসা হয়ে ভাসতে শুরু করলো।
১৮ ফেভ্রুয়ারী, ১৯৭৭ সাল। রাত সাড়ে নয়টা। আমাদের জীবনে নেমে আসলো আর্ত চিৎকারে ভরা অন্ধকারাচ্ছন্ন, দুর্যোগময় মূহুর্ত। হ্যাঁ আমার বাবার শেষ নিঃশ্বাসের মুহূর্ত, আমাদেরকে এতিম করে চলে গেলেন এ পৃথিবী ছেড়ে।
আমার কাছে আমার বাবার সর্বশেষ স্মৃতি তারঁ মৃত্যু ও মৃত্যু পরবর্তি কার্যক্রম। আমি তখন মাত্র পঞ্চম শ্রেনীর ছাত্রী। সুস্থ বাবার স্মৃতি খুব হালকা ঝাপসা হয়েই মনে পড়ে কিন্তু বাবার চলে যাওয়ার সব স্মৃতি ভীষণ উজ্জল।
তখন আমাদের বাসায় ইলেকট্রিসিটি ছিল না, হারিকেনের আলো আধারিতে সদ্য প্রয়াত বাবার মুখ টি আর সেদিন রাতে দেখা হয়নি।
পরদিন সকাল বেলায় আত্মীয় স্বজনদের সাথে দেখলাম বাবার মুখটি। কী যে সুন্দর, শান্তিময়,আার হাস্যজ্জ্বল চেহারা নিয়ে শুয়ে আছেন আমাদের অত্যন্ত প্রিয়,পরম স্নেহময়, নিশ্চিন্ত ভরসা, সকল ভালবাসার উৎসস্থল আমার বাবা।
তারপর, শেষ যাত্রার সকল প্রস্তুতি চলছে। পাশাপাশি পারিবারিক বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত,যেহেতু আমরা সবাই খুব ছোট। তাইসকল বিষয়ে সিনিয়র আত্মীয় স্বজনরাই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এ নিয়ে আমার মায়ের সাথে অনেক বিষয়ে তাদের মত মিলছে না। এতে মায়ের কষ্ট আরও বেড়ে যাচ্ছে। এতটুকু বুঝতে পারছি, কিন্ত কিছু করা বা মায়ের পাশে দাঁড়ানোর মত ক্ষমতা আমাদের কারোর ছিল না। আমি আমার বাবা মায়ের দ্বিতীয় সন্তান, বড় বোন ক্লাশ সিক্সে পড়ে। আমরা শুধু অসহায়ের মত দেখে যাচ্ছি। ভাবছি কত বড় ভরসা আমাদের ছেড়ে চলে গেল, যা প্রভাব চলে যাওয়ার সাথে সাথেই টের পাচ্ছি। যিনি অসুস্থ অবস্থায়ও বটবৃক্ষের মতো রোদ, বৃষ্টি, ঝড় থেকে আগলে রেখেছিলেন। অসুস্থ অবস্থায় খুব একটা চলা ফেরা করতে পারতেন না, তার পরও কী তার ক্ষমতা!
এখন এই বয়সে এসে, না তাও না, বড় হবার পর থেকে মনে হতো আমার বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো আমরা আরও অন্যরকম ভাবে মানুষ হতাম। অথবা আমরা তখন বড় থাকলে হয়তো বাবাকে আরও উন্নত চিকিৎসা করাতে পারতাম, বাবাকে পরিপূর্ণ ভাবে সেবা যত্ন করতে পারতাম,হয়তো আরও বেশী দিন বেঁচে থাকতেন। এ গুলো আমার মনকে খুব পীড়া দেয় ।আফসোস হয়,কষ্ট হয়।
আমার বাবা পুলিশের ওসি ছিলেন। সুস্থ বাবার খুব একটা জীবন্ত স্মৃতি নেই আমার। তবে একটি স্মৃতি বেশ মনে পড়ে। ক্লাশ টু বা থ্রি তে পড়ি তখন।একটি জেলা শহরে বাবার পোস্টিং। ঐ শহরের গার্লস স্কুলে মাত্র ভর্তি হয়েছি। আমি হেঁটে স্কুলে যাচ্ছি, যাও্য়ার পথে রাস্তায় কয়েক জন পুলিশ যাচ্ছে, আমি পুলিশ দেখে খুব ভয় পেয়ে গেছি, ভয়ে একদম জড়সড় হয়ে গেছি । এ কথা বাসায় জানাজানি হওয়ার পর আব্বা আমাকে তাঁর কোলে মধ্যে টেনে নিয়ে আদর করে বল্লেন, তুমি আমাকে ভয় পাও? আমিও তো পুলিশ! বাবার কেলের সেই ওম, মমতা ভরা আদর, সাহস আর সান্ত্বনা দেয়া ; আমি এখনও মাঝে মাঝে অনুভব করি।
বাবার আদর, ভালবাসা, সাহস, ভরসা মানুষকে যে কতটা আস্থার সাথে সমাজে শিরদাঁড়া সোজা করে বাঁচতে শেখায় সেটা যারা বাবা ছাড়া বড় হয়েছে তারাই কেবল বুঝতে পারবে। তবে বাবার দোয়া আর ভাল চাওয়া এ দুটেো আমাদের সাথে আছে সেটা বুঝতে পারি ভাল ভাবেই।। নাহলে এত সংগ্রাম করে হয়তো আমরা এ পর্যন্ত আসতে পারতাম না। বাবা তোমার প্রতি অনেক কৃতজ্ঞতা, অনেক ভালবাসি তোমায়।
একবার আমি তখন ক্লাশ সেভেনে পড়ি আমাদের বাংলা শিক্ষক আমাদেরকে “তোমার জীবনের স্মরণীয় ঘটনা” শিরেনামে একটি রচনা লিখতে দিলেন। আমরা পরদিন সবাই যে যার মতো করে রচনা লিখে স্যারের কাছে জমা দিলাম। তারপর যথারীতি ক্লাশ হলো। সব ক্লাশ শেষে স্কুল ছুটি হলো। পরদিন সবাই স্কুলে এলাম। ক্লাশ শুরু হলো। সম্ভবত তৃতীয় ক্লাশটি ছিল বাংলা দ্বিতীয় পত্র। স্যার এলেন। এসেই আমাকে ক্লাশ থেকে বের হতে বললেন। সবাই তো অবাক৷। কারণ আমি লেখা পড়ায় ভাল, আচরণও ভাল তাহলে কেন এ শাস্তি।? তখন স্যার বললেন এটা শাস্তি নয়, এটা তোমার পুরষ্কার। আমি বাইরে চলে এলাম কিন্তু তখনও বুঝিনি কী হতে যাচ্ছে। তারপর বাইরে থেকে শোনার চেষ্টা করছি স্যার কী বলেন? শুনলাম স্যার আমার সম্পর্কে অনেক গুণবাচক কথা বলছেন এবং তারপর আমাদের ফার্স্ট বয়কে দিয়ে আমার লেখা রচনাটি পড়ে শুনাচ্ছেন সকলকে।। আমি ক্লাশে দ্বিতীয় ছিলাম।পড়া শেষ হলে আমাকে ডেকে ক্লাশে নিয়ে যায়, যেয়ে দেখি ক্লাশে প্রায় সকলের চোখ কান্না ভেজা হয়ে আছে। পরে বুঝলাম আমার কষ্ট হবে ভেবেই স্যার আমাকে ক্লাশ থেকে বের করে দিয়েছন।। কারণ আমার রচনাটি সকলকে পড়ানোর উদ্দেশ্য ছিল স্যারের।। স্যার আমাকে বললেন, লেখা খুব ভাল হয়ছে।, সর্বচ্চো নম্বর পেয়েছিলাম। তখনও বাবাকে স্মরণ করে মনে হয়েছিল, বাবা তুমি এমন ঘটনা দিয়ে গেলে যা আমাকে এতটা প্রশংসা এনে দিল। আমার এখন আর মনে নেই আমি সেদিন আসলে কী লিখেছিলাম!
বাবা না থাকাতে অনেক ধরণের সামাজিক প্রতিবন্ধকতা ও গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছে আবার কখনও কখনও অনেকের অনেক সাপোর্ট ও পেয়েছি, যা অস্বীকার করার কেন উপায় নেই।। আমার কাছে সেই সাপোর্ট টাকে বোঝা বলে মনে হয়েছে বরাবর। সে কারনেই অতৃপ্তি আমাকে কখনও ছেড়ে যায়নি।
বাবা অভাবের প্রভাব কোথায় না পড়েছে? ঐ দিন কোন একটি পত্রিকায় নারী বিষয়ক পাতায় একটা শিরোনাম দেখেছিলাম “যে মেয়েদের বাবা নেই তাদেরকে কি বিয়ে হবে না?” লেখাটিতে চোখ পড়তেই নিমিষেই পড়ে ফেললাম। যা পড়লাম তাতে বুঝা গেল এই যে মেয়েটির দীর্ঘদিনের সম্পর্ক বিয়েতে গড়ায়নি বাবা না থাকার জন্য। এরপর যত প্রস্তাব এসেছে সব ভেঙে গেছে, কারণ হচ্ছে বাবা নেই জামাই এর আদর যত্ন, তত্ত্ব তালাশ কেউ করতে পারবে না ,বরং জামাইকে উল্টো শ্বশুরবাড়ির দায়িত্ব পালন করতে হবে। এই ধরণের কথাবার্তা আমার শ্বশুরবাড়িতেও হয়েছে যা আমি বিয়ের অনেক পরে আমি শুনেছি আমার স্বামীর কাছে। অন্য দিকে স্বামী ও তার কিছু আত্মীয় স্বজন তার পরিবারকে তাদের মহৎ ও আধূনিক চিন্তাধারা দিয়ে বুঝিয়েছে তার পরিবারকে। একথা অবশ্য এখন পর্যন্ত আমার পরিবারের কারো কাছে পৌঁছেনি। কিন্তু আমি তো ঠিকই বুঝতে পেরেছি এবং স্বীকার হয়েছি সামাজিক এহেন আচরণ এবং সামাজিক এ ধরণের নেতিবাচক মূল্যবোধের।। সেটা তো শুধুমাত্র বাবা না থাকার কারণে।। তাই বাবা এমন একটি শব্দ যার কোন প্রতিশব্দ নেই, যার কোন প্রতিস্থাপন নেই, তার তুলনা শুধু তিনি নিজেই । এ বয়সে এসে পারিবারিক ও সন্তানের অনেক দায়িত্ব কমে যাওয়াতে এক ধরণের একাকীত্ব তৈরী হয়েছে, ফলে এ একাকীত্বের সঙ্গী হয়েছে নিজের সাথে নিজের স্মৃতিচারণ। আর বাবার সমৃতি যখন নাড়া দেয় তখন মনে হয় আমি যেন সেই ছোট্ট মেয়েটি। বাবার কোলে চড়ে আদর নিচ্ছি,। চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে, চোখের কোণের পানি চিবুক বেয়ে নেমে আসে। বলতে ইচ্ছে করে বাবা তোমাকে অনেক মিস করি। নিজের অজান্তেই গুন গুন করে উঠি বাবা কত……দিন, কত………দি…..ন.…….দেখিনি তোমায়………।
জানি না আমার মনের এই আর্তি, আকুতি , আমার কষ্ট বোধ, আমার ভালবাসা বাবা ওপারে থেকে শুনতে পারছেন কিনা বা বুঝতে পারছেন কিনা! তবুও বলবো, বাবা অনেক ভালোবাসি তোমায়!!
মহান আল্লাহ রাব্বুল আল আমিনের কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমার বাবাকে মাফ করে দেন এবং জান্নাতুল ফেরদাউস দান করেন ।
২ Comments
congratulations
ধন্যবাদ