বৈচিত্র্যে, প্রাচুর্যে বাংলা কথাশিল্পের জগতকে ঋণী করেছেন সেলিনা হোসেন। বাংলা একাডেমির নতুন সভাপতি হিসেবে নিয়োগ পেলেন একুশে পদকপ্রাপ্ত এই কথাসাহিত্যিক ও ঔপন্যাসিক। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে বৃহস্পতিবার এই প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। তাকে তিন বছরের জন্য এই নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ‘বাংলা একাডেমি আইন-২০১৩’ এর ধারা ৬(১) এবং ৬(৩) অনুযায়ী অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের সঙ্গে কর্ম-সম্পর্ক পরিত্যাগের শর্তে সেলিনা হোসেন এই নিয়োগ পেয়েছেন। যোগদানের তারিখ থেকে এই নিয়োগ কার্যকর হবে বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে। গত বছরের ৩০ নবেম্বর বাংলা একাডেমির সভাপতি স্বাধীনতা ও একুশে পদকপ্রাপ্ত শিক্ষাবিদ, গবেষক এবং লেখক অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম মারা যান।
সেলিনা হোসেনের লেখার জগত বাংলাদেশের মানুষ, তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। জীবনের গভীর উপলব্ধির প্রকাশকে তিনি শুধু কথাসাহিত্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি, শাণিত ও শক্তিশালী গদ্যের নির্মাণে প্রবন্ধের আকারেও উপস্থাপন করেছেন। তার উপন্যাসে প্রতিফলিত হয়েছে সমকালের সামাজিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সঙ্কটের সামগ্রিকতা। বাঙালীর অহংকার ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ তার লেখায় নতুনমাত্রা যোগ করেছে।
সেলিনা হোসেনের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৪ জুন রাজশাহী শহরে। সাত ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন চতুর্থ। তার কর্মজীবন শুরু হয় বাংলা একাডেমির গবেষণা সহকারী হিসেবে, ১৯৭০ সালের জুলাই মাসে। তিনি ১৯৬৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে চাকরি পাওয়ার আগ পর্যন্ত বিভিন্ন পত্রিকাতে উপ-সম্পাদকীয়তে নিয়মিত লিখতেন। কর্মরত অবস্থায় তিনি বাংলা একাডেমির ‘অভিধান প্রকল্প’, ‘বিজ্ঞান বিশ্বকোষ প্রকল্প’, ‘বিখ্যাত লেখকদের রচনাবলী প্রকাশ’, ‘লেখক অভিধান’, ‘চরিতাভিধান’ এবং ‘একশত এক সিরিজের’ গ্রন্থগুলো প্রকাশনার দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়াও ২০ বছরেরও বেশি সময় ধান শালিকের দেশ পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তিনি ১৯৯৭ সালে বাংলা একাডেমির প্রথম মহিলা পরিচালক হন। ২০০৪ সালের ১৪ জুন চাকুরি থেকে অবসর নেন।
তিনি ১৯৬৯ সালে প্রবন্ধের জন্য পান ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক স্বর্ণপদক, ১৯৮০ সালে উপন্যাসের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ১৯৮১ সালে ‘মগ্নচৈতন্যে শিস’ উপন্যাসের জন্য আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮২ সালে অগ্রণী ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮৭ সালে ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’ উপন্যাসের জন্য কমর মুশতারী পুরস্কার, ১৯৯৪ সালে ‘অনন্যা’ ও ‘অলক্ত’ পুরস্কার পান। এ ছাড়া ১৯৯৪-৯৫ সালে তিনি তার ত্রয়ী উপন্যাস ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ রচনার জন্য ফোর্ড ফাউন্ডেশন ফেলোশিপ পান। ১৯৯৬ ও ১৯৯৭ সালে শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। ইংরজী, হিন্দী, মারাঠী, কানাড়ী, রুশ, মালে, মালয়ালাম, ফরাসী, জাপানী, ফিনিস, কোরিয়ান প্রভৃতি ভাষায় তার বেশ কয়েকটি গল্প অনূদিত হয়েছে। ১৯৮৩ সালে ‘নীল ময়ূরের যৌবন’ উপন্যাসের ইংরেজী অনুবাদ প্রকাশ পায়। ২০০০ সালে প্রকাশিত হয় ‘টানাপোড়েন’ উপন্যাসের ইংরেজী অনুবাদ, ২০০১ সালে মালয়ালাম ভাষায় অনূদিত এবং ভারতের কেরল প্রদেশ থেকে প্রকাশিত হয়। পশ্চিমবঙ্গের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে তার ‘যাপিত জীবন’ এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তার ‘নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি’ উপন্যাস পাঠ্যসূচীভুক্ত। শিলচরে আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫টি উপন্যাস এম ফিল গবেষণাভুক্ত। ২০০৫ সাল থেকে শিকাগোর ওকটন কলেজের সাহিত্য বিভাগ দক্ষিণ এশিয়ার সাহিত্য কোর্সে তার ‘হাঙ্গর নদী গ্রেনেড’ উপন্যাসটি পাঠ্যসূচীভুক্ত হয়। ২০১০ সালে একুশে পদক পান সেলিনা হোসেন। ঐ বছরেই রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডি. লিট উপাধি দেয়। সেলিনা হোসেনের উপন্যাসের সংখ্যা ২৬টি, গল্পগ্রন্থ ১৮টি, প্রবন্ধ গ্রন্থ ৯টি, সম্পাদনা গ্রন্থ ৬টি, শিশুতোষ গ্রন্থ ১২টি।