পতিতা
[তসলিমা হাসান]
আমায় তুমি পতিতা বলো, নষ্টাদেরকে বলবে কি?
এই সমাজের দোষেই তো আমি পতিতা হয়েছি !
বাপটা আমার অল্পবয়সে দিয়ে দিলো বিয়ে,
প্রথমেতে সুখেই ছিলাম স্বামীকে নিয়ে ।
জামাই আমার কসাই চামার,
একজনেতে নাকি মেলেনা সুখ ।
সুখের লাগি আনলো ঘরে,
সতিন নামক আরেক মুখ ।
বাপও গেলো মা ও দিলো অচিন দেশে পাড়ি,
স্বামীর ঘরে চলছে তখন অত্যাচার আর ঝাড়ি ।
বছর দেড়েক পরে,
নতুন এক অতিথি এলো কোল আলো করে ।
ভাবলাম এই বুঝি মোর ভাগ্যে ফিরে এলো হাসি ,
কিন্তু এই পতিতার জীবন শুধুই সর্বনাশী ।
ছেলেকে মোর দুচোখে দেখতে নাহি পারে,
সতিন নামক জল্লাদটি কাছে পেলেই মারে ।
স্বামী একদিন হঠাৎ আমার কাছে এসে বলে,
তকে আর রেখে কি লাভ?
অন্ন শুধু হচ্ছে নষ্ট মিথ্যে সংসারের ছলে !
আখি পানে চাহি দেখিলাম হিংসাত্মক ভাব,
বিয়ের দিনই বুঝিছিলাম এই এ স্বামী নয় যেন পাপ !
সতিনের লাগি মোর কপাল পুড়িল,কিইবা করার আছে,
অভিযোগই শুধু পারি দিতে ঐ বিধাতার কাছে ।
স্বামী ভিটে ছেড়ে ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়ি যাই,
গিয়ে দেখি সেই বাড়ি আর আমার বাড়ি নাই ।
কতৃত্ব নিয়ে নিয়েছে আমারই আপন চাচা,
শেষে হেসে কহিলাম চাচা আপন প্রাণ বাঁচা !
বাপের বাড়িতেও প্রত্যাখান, ঠাঁইও নাকি মিলবে না?
মিললেও অন্ন আমার এ মুখ দিয়ে যে আর গিলবে না ।
শুধু একটা শাড়ি পড়ে,
ছেলেকে কোলেতে করে এই শহরে আসা ।
সেই আগের আমিই তো এখনো সর্বানাশা !
এখন আমার অঢেল টাকা, শত খানেক শাড়ি,
পতিতা নামক স্মারকলিপিতে মুছে গেছে এই নারী !
তুমি আমায় দয়া করো এই দেহেরই জন্য,
এই দেহেতে কিইবা আছে,
যা পেলে নিজেকে মনে করো ধন্য!
আমাকে তুমি পতিতা বলো, যা ইচ্ছে দাও গালি ,
জীবনের এক খন্ড টুকরো তুলে ধরলাম খালি।
হ্যা আমিই পতিতা-নষ্টা , আমিই সব,
আমার ইতিহাস ভালো করে জানেন দয়াময় ঐ রব !
আমাকে তুমি বেশ্যা বল না,
আমিও কারো মা,
মায়ের তো কখনো বেশ্যা হতে পারে না !
সে কি তুমি জানো না !
আমি রহস্যময়ী
[তসলিমা হাসান]
যুগ যুগ ধরে ঘুমিয়ে আছি দুই বাহু বিস্তৃত করে,
কাউকে বিরক্ত করি না, কাউকে কাছে টানি না, কারো কাছে যাইও না;
অথচ মানুষগুলো মাঝেমধ্যে আমার কোলে এসে পড়ে।
আচ্ছা, একটুও কি শান্তিতে থাকবার উপায় নেই!
এই যে আমি গোল গোল করে ঘুরি
আমার মাথার উপর বিশাল মেঘের আচ্ছাদন
থরে থরে ঢেউগুলো কেঁপে ওঠে;
মানুষের যদি ভয় হয়, তবে আসে কেন এখানে?
যেতেই পারে পাশ কাটিয়ে।
অতি সামান্য পরিধি নিয়েই তো আমার বিস্তৃতি;
বারমুডা থেকে ফ্লোরিডা, ফ্লোরিডা থেকে পারটো রিকো,
আবার পারটো রিকো থেকে বারমুডা।
এই বিশাল পৃথিবীতে মাত্র এইটুকুই তো আমার,
তাতেও মানুষের আপত্তি!
আমার থেকেও তো মানুষগুলো বেশি ভয়ংকর,
কিছু জানলই না আমার সম্বন্ধে,
অথচ কত নামই দিয়ে দিল।
কেন রে বাবা, আমি কি নিজে থেকে কখনও
গেছি তোদের গোলাপ বাগানের বেড়া ডিঙিয়ে?
তোরাই তো পাঁচ দশক ধরে আমাকে জ্বালিয়ে মারলি।
হাসিও পায়,
কত ব্যখ্যা;
“ মিথেন গ্যাস ”,
“ সারগেসো সি ”,
“ ইলেকট্রনিক ফগ ”।
মানুষগুলোকে দেখে মায়া হয় আমার,
এত জানার ইচ্ছা! ওফ।
যদি সত্যিই জানতে চাস, আসতে হবে আমার সামনে,
টেনে নেব আমি ভিতরে।
সবাই ঘুরে বেড়াচ্ছে আমার গভীর কোলে,
ওরা এখন প্রলাপ বকে।
আমি অনেক দয়াবান
সবাই বেঁচে আছে এত যুগ পরেও।
তোদের ওখানে তো মানুষের কয়েক বছর পরেই
শ্বাসটা কর্পূরের মত উবে যায়।
আমার এখানে, আমার ইচ্ছার বাইরে মরতেও পারে না ওরা।
আসবি নাকি ক্যারিবিয়ান সমুদ্র ভেসে?
চলে আয়, আমি এখনও ঘুরছি বৃত্তাকারে।
আমার এই বিস্তৃত রাজত্বে কারোর মৃত্যু নেই, জন্ম নেই।
তারা শুধু ঘোরে বৃত্তাকারে, মুদিত চোখে।
আমার জলোচ্ছ্বাস লোকে ডেভিল বলে ভয়ে,
একবার ভয় না পেয়ে জোরে শ্বাস নিয়ে অনুভব কর তো;
দেখ আমি কত ভয়ংকর সুন্দর।
আমার রূপ শুধু জলেই সীমাবদ্ধ নয়,
আকাশে ঘিরে আছে ঘন মেঘ, ওখানেই তো
মেলে দিয়েছি আমার সুপ্ত ইচ্ছার বসন।
যা আকৃষ্ট করে মানুষকে।
টেনে আনে আমার গভীরে।
আমি ভালোবাসা ছড়িয়ে দেই শরীরের প্রতিটি কোনায়।
আর মানুষ, তারা অবশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে ভালোলাগায়।
আমি আদি অনন্ত কাল শুয়ে আছি নিজেকে মেলে।
ভালো না বেসে পারবেই না আমার গর্জন।
ভালো বাসতেই হবে আমার মেঘের মুকুট।
ভালো লাগবেই আমার পেশীবহুল বাহু যুগল,
যখন ওলট পালট করবো তোমায় হাসতে হাসতে।
ওই যে কীসের শব্দ আসে ভেসে?
বোধ হয় কেউ আসছে পথ ভুলে,
বহুযুগ পর আবার,
আবার আমি ভীষণ খুশি।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, ভীষণ খুশি আমি।
আনন্দে তাণ্ডব শুরু করেছে আমার নিম্নাঙ্গ,
আকাশে উড়ছে কালো কুন্তল রাশি,
মেঘ হয়ে শরীরটা ঢেউ তুলে থর থর কাঁপছে,
হা – হা – হা – হা – হা – হা।
শান্তি- শান্তি- শান্তি।।
তসলিমা হাসান
কানাডা, ০১-০১-২০২২
১ Comment
Congratulations