ডোমিনো
(জাহানারা বুলা)
পর্ব-৩
স্মৃতির পড়ার ঘরটা ওর ভীষণ পছন্দের। সাজসজ্জা নেই। কিন্তু, নিচে থেকে ভেসে আসে কামিনী ফুলের ঘ্রান। বড় জানালায় জাপটে ধরে আছে ডিপ ম্যাজেন্টা বাগানবিলাস। সেখানেই গ্যাট মেরে বসে আছে আনোয়ারের সাথে কফি খেয়ে ফিরে আসার পর থেকে। মায়ের প্রশ্নের উত্তরও কিছু দেয়নি। মা খেতে ডেকে গেলো, খেতেও যায়নি।
এই মাত্রই এক পসলা অনাহুত ভারি বর্ষণ হয়ে আবার থেমেও গেলো। সোদা মাটির ঘ্রাণ টেনে ওঠালো সেই ভারি বর্ষণ। কামিনী ফুলের ঘ্রানে মৌমৌ করছে পড়ার ঘরটা। অনেক সবুজ পাতা সহ বাগানবিলাসের চেহারাটা ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে। ধূলোয় ঢেকে যাওয়া গাছটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে এখন বৃষ্টির টুপ টুপ জমে থাকা পানি মরিচ বাতির মত জ্বলছে। ফুল-পাতাগুলো কেমন চকচক করছে! এরই একটুখানি দূরে অন্ধকার বেশ ঘন হয়ে আছে। রাস্তার নিয়ন বাতিটা পড়ার ঘরে জানালার বেশ কাছে। ঘরটাতেও ফটফটে আলো জ্বলছে। বাগান বিলাসের বিলাসিতা তাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে চোখের সামনে। সেই সৌন্দর্যের প্রতি ভ্রুক্ষেপ নেই স্মৃতির। কেবলই চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। চোখের জল চোখের পাড়েই গড়াগড়ি করছে।
আনোয়ার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলো। স্মৃতিও। তবে, দু’জন দুই ডিপার্টমেন্টের। তাই, স্মৃতি মনে করতে পারছিলো না আনোয়ারকে। মোট কথা এখনো মনে করতে পারেছে না। কিন্তু, আনোয়ার প্রোফাইল পিকচার দেখেই স্মৃতিকে চিনে ফেলেছিলো। বয়স কিছুটা হয়েছে স্মৃতির। কিন্তু, নুয়ে পড়েনি। অবিবাহিতা মেয়েদের শরীরের গড়ণ-বাঁধন অত সহজেই ভেঙে পড়ে না। তিরিশকে পঁচিশের মতই দেখতে লাগে। তাদের নিজেদের অনুভূতিও ঠিক তেমনই থাকে- তিরিশে পঁচিশ।
ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট হওয়ার সাথে সাথেই ম্যাসেজ দিয়েছিলো আনোয়ার- হাই স্মৃতি। আমাকে চিনতে পারছো? আমি আনোয়ার। রাস্ট্রবিজ্ঞান। ৮৫ ব্যাচ। আমি তো তোমাকে চিনি। ফিলোসোফিতে ছিলে তুমি। আরে, তোমার পেছনে কম ঘুরেছি? পাত্তাই দাওনি। গ্রামের ছেলে বলে তোমাদের সাথে কথা বলার সাহস ছিলো না। এখন লন্ডন থাকি, ব্যারিস্টার হয়েছি। তাই সাহস পেলাম। তুমি তো আরো সুন্দরী হয়েছো। তুমি নাকি গুলশান থাকো? বাপরে, এতো বড়লোকি জায়গায়! তোমার আর বান্ধবীরা কোথায়? আমার কথা ব’লো ওদের। আর, তুমি ভালো থেকো। দেশে এলে দেখা হবে। কফি খেতে হবে আমার সাথে। আগাম বলে রাখলাম। না, তনিমাকে সাথে আনবে না। তুমি একা আসবে।
তনিমা আনোয়ারের ক্লাসমেট। স্মৃতি আর তনিমা এক পেট, এক আত্মা। তনিমাকে জিজ্ঞেস করেই কনফার্ম হয়েছিলো যে আনোয়ার সত্যিই ওদের ব্যাচের। তনিমা সম্পূর্ণই চিনতে পেরেছে। এবং স্মৃতি সেই পরিচয়ের জের ধরেই তার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট করেছিলো। আর, ভাবছিলো- কি আজব মানুষরে বাবা, একেবারে কফির নিমন্ত্রণ! ভালোই লেগেছিলো সেদিন। তাই, বন্ধুত্বটাও গভীর করে নিয়েছিলো। তবে, এতোটাই দুর্বল হয়ে পড়বে তা স্মৃতি ভাবতে পারেনি।
আনোয়ার বিবাহিত। দুই সন্তানের জনক। ছেলেটা এখনো হাই স্কুল শেষ করেন। মেয়েটা কলেজে যাচ্ছে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে বেশ বিলম্ব হয়েছিলো তার। লন্ডনে আবার পড়তে যেয়ে সময় গেছে অনেক। বিয়ে করেছে নিজেদের গ্রামের মেয়েই। কালচারাল ক্ল্যাশ ছিলো শুরু থেকেই। তাই, বউকে খুব আপন করে নিতে পারেনি সে কখনোই। সংসারটা করতে হয় বলে করা। প্রায়শই ডিভোর্সের কথা মনে জাগান দিলেও সন্তানদের কথা ভেবে টিকে আছে।
আনোয়ার বাসা থেকে অফিস, অফিস থেকে বাসায় আসা যাওয়ার সময়টুকু একেবারে হালাল করে নেয়। ফেইসবুক, ফোন সব কিছু ওই ড্রাইভেই। ব্লুটুথ সেট করা আছে গাড়িতে। কথা বলতে তাই বাঁধা নেই। সমস্যা নেই। ঘন্টায় কয়েকটা করে ফোন দেয় স্মৃতিকে। কখনো সিগন্যাল এক্সিলেন্ট, কখনো সারভার ডাউন। যতবার লাইন কাটে ততবার কানেক্ট করে করে অনবরত কথা বলে আনোয়ার। ইংরেজী খুব শুদ্ধ কিন্তু কুমিল্লার এক্সেন্ট আছে। বাংলার চেয়ে বেশী ইংলিস ব্যবহার করেই কথা বলে। পান চিবোয়, সিগারেট খায় আর কথার ফুলঝুরি ফোটায়।
প্রোফাইলে যে ছবিটা আছে, তা আনোয়ারের বেশ কিছুদিন আগের তোলা। তখন মাথায় চুল ছিলো। সাদা শার্ট পরা ছবিটাতে বেশ সুন্দর লাগছিলো আনোয়ারকে। এখন যে চুল অনেকটাই কমে গেছে তাতে আনোয়ারের সৌন্দর্যের খুব একটা ঘার্তি হয়নি। তবে মুখ খুলে হাসলে দাঁতগুলো খুবই বাজে লাগে। আনোয়ার বিষয়টায় অবগত আছে। তাই, কথা সে যতই বলুক, হাসে সে বুঝেসুঝেই। তবুও পান খাওয়াটা ছাড়তে পারছে না সে কিছুতেই।
চলবে…..
৮ জুন, ২০২২
ঢাকা।
২ Comments
congratulations
next