তুমি রবে নীরবে
[তাহ্ মিনা নিশা]
নির্জন দুপুরে বাড়ির সবাই যখন ভাতঘুমে প্রশান্তির আশ্রয়ে। আমি তখন শরৎ রচনা সমগ্র নিয়ে রিডিং টেবিলে। দুপুরের ঘুমটা কেন যেন আমার সহ্য হয় না। কোনোদিন যদি একটু গড়িয়ে নেয়ার ছলে চোখ লেগে যায় তো হলো— ঘুম থেকে ওঠার পর শরীরটাকে মনে হয় দশ মণ ওজনের হয়ে গেছে। পেট ফেঁপে ঢোল হয়। চোখের নিচে ও উপরের পাতা ফোলা ফোলা ভাব। দেখে মনে হয় যেন একটু আগে কান্না করেছি। অথচ আমার পতিদেব শ্রী ‘সুমন্ত ব্যানার্জি’ এই ছুটির দিনের দুপুরের ঘুমের জন্য পুরো সপ্তাহ অপেক্ষা করে। এই নিয়ে বিয়ের প্রথম দিকে আমার বেশ অভিমান হতো। আমি না ঘুমিয়ে থাকবো আর সে নাক ডেকে ঘুমাবে! তাঁরও অবশ্য আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল। নতুন নতুন বউ, অথচ ছুটির দুপুরে কাছে পাওয়া যায় না বলে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে সবই একসময় অভ্যস্ত হয়ে যায়। আমাদেরও তাই হলো, এখন আর নেই কোনো অভিমান বা অভিযোগ।
ফরিদপুরের ব্যানার্জি পরিবারের একান্নবর্তি সংসারে প্রায় বছর ত্রিশ আগে বউ হিসেবে আমার আগমন ঘটে। আমার স্বামী ভদ্রলোক হলেন একজন ব্যাংকার। আমিও একটা কলেজে আছি। আমার দুই মেয়ে। একজন ডাক্তার ও একজন সংগীত শিল্পী। দুজনেই ঢাকায় থাকে তাদের স্বামী সন্তানদের নিয়ে। পূজা পার্বণে মাঝে সাজে বাড়ি আসে। এই বুড়ী বুড়োর খবর নিতে। আমাদের বাড়িতে আমার স্বামীর তিনভাই ও তাদের সংসার ছিল একসময়। এখন শুধু আমরা দুজন আর সেজদা ও বৌমণি থাকে। আর থাকে হরিদাসী পিসি(পুরনো কাজের লোক) ও তার ছেলে। বাড়ির ভেতরের সমস্ত কাজের দায়িত্ব পিসির ছেলে বৌয়ের উপর। বাইরের কাজ সামলাতে হয় রজতকে(পিসির ছেলে)।
বড় মেয়ে ফোন করে বলল, ঢাকা যেতে হবে। ওরা দুইবোন মিলে ঠিক করেছে এই গরমের ছুটিতে কলকাতা যাবে। আমরাও যেন তাদের সফর সঙ্গী হই। আমি তো এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম। বাঁধ সাধলো তাদের বাবা। তার কথা, দুদিন পর ‘এল পি আর’ এ যাব, তখন বেড়াতে যাব,এখন যাব না। মেয়েরা খুব ভালো করেই জানে তাদের বাবা এক কথার মানুষ। হাজার সাধলেও রাজী হবার পাত্র সে নয়। তাই তাদের বাবাকে বাদ দিয়েই পরিকল্পনা করতে হলো। আমার জন্য টিকেট কেটে নিজেই আমাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে গেলেন আমার কর্তা। গাড়ি ছাড়ে খুলনা থেকে। পথে যশোর- মাগুরা- ফরিদপুর- রাজবাড়ী হয়ে ঢাকা পৌঁছে। প্রায় চলন্ত বাসে উঠতে হলো আমাকে। আশেপাশে খেয়াল করবার সুযোগ ও সময় হয়ে উঠেনি। কন্ডাক্টর সীট দেখিয়ে দিলে তার পিছু পিছু গিয়ে বসলাম। ছেলেটি আমার ব্যাগ কায়দা করে পেছনে রেখে দিল। ফেরিতে গিয়ে নীচের লকারে রাখবে বলে ট্যাগ লাগিয়ে দিল। আমার পাশের সিটে কলেজ অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ভীষণ মায়া মায়া চেহারার একটা মেয়ে বসেছে। আমাকে দেখেই মেয়েটা নড়েচড়ে বসল। ওর হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে আমার হ্যান্ডব্যাগটা নিজের কাছে রেখে আমাকে বসতে সাহায্য করল। তারপর আমার সীটের পাশের হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে সীটটাকে আমার কম্ফরটেবল করে দিল।
আমার সাথে এক পর্যায়ে ওর খুব ভাব হয়ে গেল। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি শুনে ও তার আব্বু আম্মুর কথাও বলল। আমি ওর বাবার নাম জানতে চাইলে ও আমাকে অবাক করে দিয়ে এমন একটা নাম বললো যার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। তারপর থেকে ও যতগুলো কথাই বলেছে তার কিছুই আমার মাথায় ঢুকেনি। শুধু ঘুরেফিরে ঐ একটি নামই মনে আসছে। আর ভাবছি এই মেয়ে ভগবানের কৃপায় আমারও তো হতে পারতো। এইসব সাত সতেরো ভাবতে ভাবতে কখন যে গাবতলী এসে পৌঁছেছি টের পাইনি। হঠাৎ স্নিগ্ধা- স্নিগ্ধা- করে খুব পরিচিত কন্ঠস্বর কানে ভেসে আসলে চমকে তাকিয়ে দেখি জানালা দিয়ে আমার দিকে ইশারা করছে পারভেজ।
চলবে …
১ Comment
বাকি লেখাটা দ্রুত পড়তে চাই দিদি।