দূরত্ব জুড়ে নিশীথের নীল জোৎস্না
(ফেরদৌসী শারমীন সুমী)
সবাই যখন দুপুরে বিশ্রাম নিতে যায় নীল তখন চিঠি লেখে নীলাকে৷ তার একটি চিঠি লেখার প্যাড আছে৷ অনেক পুরোনো প্যাডটি৷ কলেজে পড়বার সময় নীলা দিয়েছিল কোন এক ঈদে৷
নীল তখন টগবগে এক কিশোর যে কিনা হরহামেশাই রঙ বেরঙের রঙ্গনের মত প্রেম দেখতে পায় তার চতুর্দিকে৷
নীল দেখতে শ্যাম বর্ণ৷ চেহারায় কোন এক মায়া জুড়ে আছে চোখ দুটোতে৷ হরিণের মত কাজল পড়া চোখ যেন৷
এর উপর শারীরিক কাঠামো অত্যন্ত পুরুষালি৷ লম্বা পাঁচ ফিট ১১ ছুঁই ছুঁই! ভ্রু- যুগল যেন কালো থেকে কালো হয়ে উঠেছে চোখের সাথে পাল্লা দিয়ে৷
আর সবচাইতে সুন্দর তার হাসি৷ মুক্তো ঝড়ানো হাসি সম্ভবত একেই বলে৷
নীলের কাছে সেই প্যাড, প্যাডে লেখা উদ্ধৃতি আর নীলাকে তেমন আকর্ষণীয় লাগেনা৷
নীলা তাদের বাসার ঠিক দুটো বাসা পরেই থাকে৷
সামনে এস.এস. সি দিবে৷ হাল্কা পাতলা গড়নের নীলা দেখতে পুঁইশাকের কচি ডগার মতো লিকলিকে ।
আহামরি তেমন কোন সৌন্দর্য নেই নীলার , নীলের চোখে৷
কিন্তু নীলার অদ্ভুত সুন্দর দুটি চোখ আছে৷ যেই চোখের দৈর্ঘ্য প্রস্থ নিয়ে গল্প করবার মত কিছু নেই ।
কিন্তু যমুনার মত গভীরতা আছে চাহনীতে ৷
কোন কোন সময় মনে হয় নীলার এই চোখের কাছে আর যে কোন সৌন্দর্য বেমানান৷
আরেকটা সুন্দর জিনিস ওর মধ্যে আছে৷ অসম্ভব সুন্দর করে কথা বলে৷ কন্ঠ খুব মাতাল করার মত নেশাতুর।
যাই বলুক বা কেন তা যেন ঝর্ণার মতন ছন্দে বয়ে যায় মনে৷ একটা মানুষ কি করে এত সুন্দর করে কথা বলে তা ভাবাও যায়না৷
ছোট্ট একটা মেয়ে, গভীর দুটো চোখ ও সুন্দর করে কথা বলার অসাধারণ ক্ষমতা নীলের কাছে খুবই সাধারণ ।
নীলের চারপাশে অসম্ভব সুন্দরী মেয়েরা। কেউ ভাল বন্ধু, কেউ শুধুই ক্লাশমেট কেউ কেউ বা বন্ধুর চেয়ে বেশী। নীলের আসলে এত প্রেম বা এত উন্মাদনা এসবের কিছুই ভাল লাগেনা৷
ওর কেবলই মনে হয়,এই প্রেম এই ভাললাগা, এই সবকিছু তার সৌন্দর্যের জন্য৷
এতটুকু ছাড়া নীল খুবই সাধারণ একটা ছেলে। নেই কোন গভীর উপলব্ধি জীবন নিয়ে, নেই প্রজ্ঞা, নেই কোন সৃজনশীল প্রতিভা৷ তার নিজের কাছে নিজেকে প্রচন্ড ক্ষুদ্র লাগে৷
সে ভাবে তার জন্য যারাই আকুল তারা তার মনের জন্য না৷ তাই সে এসব নিয়ে নির্লিপ্ত থাকে৷
ওর সাথে নীলার প্রায় কথা হয়৷ এ বাড়ি ও বাড়ি বলে দেখাও হয় কয়েকবার দিনে৷
নীলা নীলকে দেখলে গভীর ভাবে তাকিয়ে থাকে৷ কিছুটা আনমনে হয়ে যায়৷ কিন্তু কখনো কিছু বলেনি৷
পরের দিন ঈদ৷ চাঁদ দেখা নিয়ে মহল্লায় হৈ হুল্লোড় পড়ে গেছে৷ নীল তার বন্ধুদের নিয়ে গলির মোড়ে আড্ডা দিচ্ছিল৷
নীলাও বান্ধুবীদের সাথে চাঁদ দেখে ফিরছিল পাশের গলি থেকে৷
নীলের যত বন্ধু আছে তাদের মধ্যে জয় খুব চঞ্চল এবং স্ট্রেইট কাট টাইপ৷
সে নীলের কাঁধে হাত রেখে বল্ল…..
—– নীল, ঐ মেয়েটি কে রে? আমার ভাল লেগেছে!
যাকে জয় দেখিয়ে দিল সে নীলা৷ খুব সাধারণ নীলা।
নীল বল্ল —এই মেয়েকে তোর ভাল্লাগল? কি এমন ও?
জয় — জানিনা দোস্ত। ওর চাহনী দেখছিস? রাজ্য পাহাড়ায় থাকা সৈন্যরাও বেসামাল হয়ে যাবে এই দৃষ্টি দেখলে!
নীল — ও আমাদের দুটো বাসা পরেই থাকে৷ মেয়ে ভাল৷ এস সি সি দিবে৷ তুই সরাসরি ওকে বলতে পারিস৷ যদ্দুর জানি তার প্রেম ট্রেম নাই। আর কে-ই বা ওকে পছন্দ করবে? কেউ নাই ওর !
এমন সময় নীলা হঠাৎ তাদের আড্ডার দিকে এসে পেছন থেকে সামনে এসে বল্ল —নীল ভাইয়া, ঈদ মোবারক৷
একটু দরকার ছিল, আসবা এদিকে একটু?
জয় তার কন্ঠ শুনে একদম তলিয়ে গেল এবার৷ কি সুন্দর করে কথা বলে। এই মেয়েকেই তার চাই! এরজন্য বাজিতে হারাও জেতা যেন!
জয় —যা, যা তুই শুনে আয় আর পারলে আমার কথাও বলিস। আমার ত হার্ট এটাকের দেরী নাই রে দোস্ত৷
নীল আড্ডা থেকে উঠে গিয়ে নীলার কাছে গেল। নীলার সাথে কাজরী। ও হিন্দু হলেও এই সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বান্ধুবী নীলার। কাজরীও একই ভাবে নীলদের প্রতিবেশি৷
——হুম, বলো নীলা।
—- তোমাকে একটা জিনিস দেবার ছিল ভাইয়া৷ এখন দেই?
—- হুম দাও। এতে জিজ্ঞেস করার কি আছে?
—- না, তেমন কিছু না। তোমার সাথে অনেকেই আছে তো তাই…
—- ও, আচ্ছা দাও। সমস্যা নাই। ওরা আমার কলেজের বন্ধু৷
নীলা নীলের দিকে একটা বড় খাম এগিয়ে দেয়।
—এটা কি?
—- এটা রাইটিং প্যাড ভাইয়া। আমি আসি।
বলেই নীলা আর কাজরী সোজা হেঁটে যাচ্ছে উত্তরদিকে। সম্ভবত বাড়ি ফিরবে।
নীলা চলে যেতেই জয় দৌড়ে এলো নীলের কাছে৷
—-কি কি দিল রে? কি বল্ল তোকে?
— বাদ দে, কাল ঈদ তো তাই একটা কিছু দিয়েছে।ঈদ কার্ড হতে পারে৷
জয় ও অন্যান্য বন্ধুরা নীলকে অনেক জোড়াজুড়ি করলেও সে তাদের রাইটিং প্যাডের খাম খুলতে দিল না৷
একসময় চাঁদ গাঢ় হতে লাগল। আকাশে স্পষ্ট হলো ঈদ ঈদ জোৎস্না।
নীল বাসায় ফিরে রাইটিং প্যাড খুলে হরবর করে পড়ছে ——
“কিছু লিখতে চাইলে লিখতে পারো৷ আমি শতাব্দী পেরুনো প্রতীক্ষা নিয়ে বেড়াচ্ছি কিছু একটা জানবার জন্য নীল”
চলবে……
১ Comment
Congratulations