দুঃস্বপ্ন
– লিয়া শারমিন হক
রাত তিনটা৷ শম্পার ঘুম ভেঙে গিয়েছে৷ তারপর থেকেই অস্থির লাগছে৷ শুয়ে থাকতে পারছেনা৷ কে যেন ওর গলা চিপে ধরে আছে? ও দেখতে পাচ্ছে।কালো লিকলিকে দুটি হাত।ঝাঁটার কাঠির মতন সরু নখ।শম্পার গলার মাংসে ঢুকিয়ে দিয়েছে।শম্পা কথা বলতে পারছেনা।গলা থেকে শুধু গোঁ গোঁ আওয়াজ করছে।এপাশ ওপাশ করে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো কিন্তু কিছুতেই পারছে না।ওর চোখ জবা ফুলের মতন লাল হয়ে গিয়েছে।জিহ্বাও বেরিয়ে গিয়েছে দু আঙ্গুল। আরেকটু হলেই জান টা বেরিয়ে যাবে।এমন অবস্থা।হঠাৎ শম্পার মনে হলো হাত দুটি মিলিয়ে যাচ্ছে।হু হু করে কাঁদছে।তারপর ঝাপসা হতে হতে মিলিয়ে গেলো।খাটের পেছনে তারপর জানালা দিয়ে।ও দিকে একটি পুরনো কাঁঠাল গাছ আছে।আর পরপর অনেক গুলি বাড়ি।বাইরে তেমন বাতাস নেই।কতগুলি পাতা জানালার গ্রিলে আছাড় খাচ্ছে। ঝমঝম করে বাজছে।শম্পা শোয়া থেকে লাফ দিয়ে উঠে বসলো।দোয়া দরুদ যা জানে পড়তে লাগলো,’লা ইলাহা ইল লাল ল্লাহ্’…’ভূত! ভূত!’ ও রে বাবা রে…ভূত!’ গলায় হাতড়ে দেখলো।রক্ত বের হচ্ছে নাকি? ‘নাহ্ নাহ্ কিছু হয়নি! সব ঠিক আছে!’ কোনো দাগও বসেনি।নাহ্ আমি মরিনি, বেঁচে আছি।’ পা ঝুলিয়ে বিছানায় বসে রইল কতক্ষণ৷ জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে শম্পা।’ভূত…ভূ…ত!’ নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ভীষন।এখনো মনে হচ্ছে ঘরে কেউ আছে।সেই জঘন্য হাত ওর দিকে আসছে৷ ফিস ফিস করে কথা বলছে,‘মরবি…মরবি…!’সাদা দেয়াল থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরছে৷ লাল রক্ত! পঁচা দূর্গন্ধ খেলছে ঘরের ভেতর।শম্পার নাকে।ঐ রক্তে মেঝের কার্পেট ভিজে যাচ্ছে।শম্পা চিৎকার করে উঠলো এবার, ‘আঃ….হ…! কে কে…কে ওখানে?’ হলুদ চেক নাইটি ঘেমে একাকার হয়ে গিয়েছে৷ নিজেকে সামলে কোন রকমে দৌড়ে শম্পা বাথরুমে ঢুকতে চাইলো।অন্ধকার রয়েছে সিটকিনি খুঁজে পাচ্ছেনা, ’ও মা!…ও আল্লাহ! বাঁচাও আমায়..কি করবো এখন? সিটকিনি সিটকি..নি খুলছেনা কেন? একটু পানি দেবো মাথায় নাকি হাত মুখ ধোবো? কেমন বিটকেল গন্ধ করছে….ছিঃ! ছিঃ! রক্ত এলো কোত্থেকে? সাবান সাবান কোথায়? জীবনেও ভাবিনি এই দিন আমায় দেখতে হবে?’ টানাটানি করতে করতে অনেক কস্টে সিটকিনি টা খুলতে পারলো।বেসিনের কল ছেড়ে দিয়েছে।কল থেকে ঝপ ঝপ করে পানি পড়ছে। কিন্তু শম্পা বুঝতে পারছেনা। কি করছে বা কি করতে চাইছে? মুখে,চোখে, মাথায় পানি ছিটাতে শুরু করলো।পানি যে কোথায় ছিটাচ্ছে?কোথায় পড়ছে? শম্পা ফিসফিস করে বললো, ‘সাবান, সাবানটা কোথায় গেলো? ছিঃ! হাত ধোবো!’ওভাবে থাকলো কতক্ষণ৷ মিনিট পাঁচেক পরে পাগলের মতন বেরিয়ে এলো৷ এলোমেলো চুল,পাকা মরিচের মতন চোখ, ভিজে জবজবে শরীর৷ বারান্দায় ছুটা বুয়া শেফালি স্ট্যান্ডে তোয়ালে শুখাতে দিয়েছিলো, দুপুর বেলা।যাবার সময় বলে গিয়েছিলো, ‘আফা শুখায় গ্যালে উডাইতে ভুইল্লেননা! আফনার তো খেয়াল থাকবোনা! আফা! ও আফা… হুনছেন।’ শেফালি, শম্পাকে অনেক মায়া করে। জানে ঢাকা শহরে শম্পার আপন কেউ নেই।শম্পা একটু আহ্লাদের সুরেই বলেছিলো,’আচ্ছা শেফালি তুই এত মায়া করিস কেনো রে? ঠিক আছে বাবা, কাপড় শুখালে উঠিয়ে নেবো মনে করে।এখন হলো তো? এই ধর একশো টাকা।পান খাবি আর রিক্সায় যাস কেমন!’ সেই দুপুরে মেলেছিলো এখনো ঝুলছে। লাইট কোনমতে জ্বালিয়ে, কি মনে করে নিভিয়ে দিলো শম্পা। বাইরে এমনিতেই অনেক আলো৷ রাস্তায় লাইট জ্বলছে। আবার ওর ফ্যাটের ঠিক উল্টো দিকে,বি সি ডি রিয়েল এস্টেটের প্রজেক্ট চলছে।আরো একটি নয়-তলা হবে।চারদিকেই নতলা দশতলা।রোদ আসেনা।গিজ গিজ করছে।শম্পার মাঝে মাঝে ভীষন রাগ হয়।নিজে নিজেই বকবক করে,‘ঢাকায় মানুষ থাকে? ছিঃ! বিল্ডিংয়ের পর বিল্ডিং উঠছে।ভাল করে নিঃশ্বাস ফেলবার জায়গা নেই৷ সবুজ নেই, মাঠ নেই, গাছ নেই।অক্সিজেন নেই।এ কোথায় এলাম আল্লাহ্…? এ কোন জাহান্নামে এলাম?এখানে মানুষ থাকার জন্য আবার হেদিয়ে মরে! সকাল হলেই দেখবে বাস ভর্তি করে ছুটছে ঢাকায়। গ্রামে তো লোকজনই নেই।বাক্স প্যাটরা বগলে করে,এদিক ওদিক খ্যাক্ খ্যাক্ করে সর্দি, কাশি,পানের পিক ফেলতে ফেলতে ঢাকায় উঠে আসছে।’ শম্পার গ্রামে কত গাছ। বাড়ির উঠোন জুড়ে গাছ।আম, জাম, লিচু, আতা, কদবেল সব আছে। কোনো ফল বাজার থেকে কিনতে হয় না।গাছের মাথায় বসে বসেই খাওয়া যায়।কত্ত মজা! শম্পা, শম্পার বড় বোন টুম্পা আর ওদের ছোট ভাই শুভ স্কুল না থাকলে গাছের মগডালেই বসে থাকতো।কাঠবিড়ালির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এডাল, ওডাল, মগডাল ছুটোছুটি করতো।ঝড়ের দিনে তো কথায় নেই! চাচাতো ভাই বোন অনু, মিনু,দোয়েল,ময়না ওরা ডাকতো,’ টুম্পা, শম্পা ঝড় আসছে। চল আম কুঁড়াবি না?’ আম কুঁড়াতে কুঁড়াতে গান গায়তো ওরা,‘ঝড় এলো, এলো ঝড়।আম পড় আম পড়! কাঁচা আম পাঁকা আম! টক টক মিস্টি। এই যাহ্! এলো বুঝি বৃস্টি…ইইই.. !‘ ওদের কোঁচড় ভর্তি আম আর, ’হি হি হি…. হাসি।আম কুঁড়ানো, বৃস্টিতে গোসল, নদীতে মাছ ধরতে যাওয়া শম্পার অনেক প্রিয়।আরো কত দস্যিপনা? মা কত বকেছে।বারন করেছে,’টুম্পা, শম্পা, শুভ জ্বর আসবে…যাস্ নে! আসুক তোদের বাবা আজ…!’ কে শোনে মার কথা।এক ছুটে নদীর পাড়, বাঁশ বাগান, বন্ধু শেলীদের বাড়ি।ওদিকে ব্রিজের নীচে কুলকুল জলের শব্দ। ঘন্টার পর ঘন্টা জলের শব্দ শোনা।পেছন দিকে পাহাড়।ওর ভাই শুভকে দেখাতো‘ শুভ, দেখ দেখ! ঐ যে, ঐ দিকে,ঐ পাহাড়ের পেছনে ইন্ডিয়া।আগে সব এক ছিলো জানিস? বাংলাদেশ, ভারত।ঐ উত্তর দিকে আমাদের মামু বাড়ি।’ শুভ বললো,’মামু তো এখনো আসেন।’ শম্পা বললো,’হ্যা মামু তো এখনো আসেন কিন্তু এখন মামুর পাসপোর্ট লাগে।আগে লাগতো না।’ শুভ মুগ্ধ চোখে দেখতো, সবুজ গালিচায় ঢাকা উঁচু উঁচু পাহাড়।ঘন ধূসর মেঘ।থেমে থাকা পাহাড়ের খাঁজ।এদিকে ভীষন নীরব। তেমন আসে না কেউ।কিন্তু শম্পারা সময় পেলে দল বেঁধে আসে।বুনো ফুলের ঘ্রান নেয়।শম্পার বড় বোন টুম্পা চিৎকার করে বললো,’এই শম্পা মেঘ করেছে।দেখ দেখ বৃস্টি হচ্ছে।ভিজবি চল?’ ভীষন বৃস্টি হলো।সেদিন ঐ বৃস্টিতে বন বাঁদাড় ঘুরে ঘুরে সন্ধ্যা।চুপচুপে ভিজে একহাঁটু কাঁদা পায়ে শম্পা বাড়িতে এলো।মা দেখেই তেড়ে মারতে এলেন,‘ধিঙ্গি মেয়ে! এই তোদের আক্কেল! জ্বর এলো বলে।জ্বর এলে তোদের সামলাবে কে শুনি?হায় আল্লাহ্! আমি আর কত কিছু দেখবো? আমার তো মা দূর্গার মতন দশ হাত নেই।তোদের বাবা তো বাড়ি এসেই খালাস। কোনো কিছু দেখে? আমার হয়েছে যত জ্বালা! আমি আর পারবোনা! যে দিকে দু চোখ যায় চলে যাবো।’ মা সবাইকে মেরে পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসলেন।মার খেয়ে হিচকি তুলতে তুলতে পড়তে বসলো সবাই।সে কান্না কি সহজে থামে?’ঘ্যা…ঘ্যা…ঘ্যা…..।’মা থামাতে হিমশিম খেয়ে গেলেন,’আচ্ছা হয়েছে,আর মারবোনা। এবার থাম বাবা! এবার থাম! সোনা পাখি খেয়ে নে আয়! তোদের জন্য কুলের আচার বানিয়েছি।গুড়ের পায়েস করেছি।’ বলে আদর করে করে মুখে তুলে খাওয়ালেন।তারপর সব শান্ত হলো। ওসব মনে পড়লে চোখ ভিজে যায় শম্পার। কান্না পায়।শহরে বিল্ডিং আর বিল্ডিং।বিল্ডিং এর বাগান।শুধু পড়তে আসতে হলো। তারপর চাকরি, তাই? না হলে জীবনেও শম্পা ঢাকায় আসতো না।বাঁশ বাগানের ও দিক দিয়ে বাড়ি ফিরতে ভয় লাগতো শম্পার।একদিন রাত হয়ে গিয়েছিলো শম্পার সেদিন একাই ছিলো।বাঁশ ঝাড়ের নীচ অব্দি আসতেই হঠ্যাৎ ঝড় উঠলো।শোঁ শোঁ করে বাতাস! শম্পা এগুতেই পারছেনা।দেখলো কঞ্চির উপর লম্বা কাপড়।একজন বসে।মুখ দেখা যাচ্ছে না।পা দুলিয়ে দোল খাচ্ছে।নাঁকি সুরে বলছে, ‘কাছে আয়! দোল খাবি!’ আর কিছু মনে নেই শম্পার।সাত দিন সাত রাত জ্বর।চোখ খুলতে পারেনি।ভুল বকেছে ’ভূত…!ভূত..!’
একটি ট্রাক এসে থেমে আছে ওদিকটায়, বি সি ডি রিয়েল এস্টেটের প্রজেক্টে। দু জন লেবার ট্রাকের উপর দাঁড়িয়ে৷ ইট নামিয়ে দিচ্ছে৷ নীচে তিন চারজন সেগুলি সাজাচ্ছে।এও এক শিল্প।ওরা ছাড়া কেউ পারবেনা।বিকট শব্দ৷ হেড়ে গলায় চ্যাঁচামেচি৷ ওদের মধ্যে একজনের বয়স পঁচিশ ছাব্বিশ হবে? মনে হয় কাজে সবে ঢুকেছে? একজন বলছে,’এই সবুইজ্জা মাথায় গামছা প্যাঁচাই নিস? নে ধর!’ বলে একটি গামছা ছুঁড়ে দিলো সবুজের দিকে।ধূলো ময়লায় গামছার রং বোঝা যাচ্ছেনা।’ওইডা প্যাঁচান লাগবো নাইলে হালার ব্যাডা তর মাথার খুলি উইড়া যাইবো।ঐ ভারী চাঁই চাঁই ইট! দেখছশ?’ওর নাম সবুজ।কুঁতকুতে চোখ, কালো কুঁচকুচে চেহারা।কে যেন ডাকলো,’ঐ ব্যাডা হারামজাদা সবুইজ্জা…তাড়াতাড়ি ল।আরেক টিরিপ মারোন লাগবো।’ তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে সবুজ আরেকজনের পায়ের উপর মাথার সব ইট ফেলে দিলো।যার পায়ের উপর ইটের চাঁই পড়লো তার নাম মুকুল।মুকুল চেঁচিয়ে উঠলো,’ওরে… মা রে…মরছি!’ মুকুলের পা থেঁতলে গিয়েছে।রক্তে ভেসে যাচ্ছে।সবুজ ভ্যাবলার মতন ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে।মুকুল অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে।ট্রাকের উপর থেকে আলম নামের একজন ষাঁড়ের মতন চ্যাঁচাতে লাগলো,’হায়! হায়! মুকুল স্যাস! মরছে… রে মরছে! মুকুল মইরা গ্যাছে…গোপাল দা মুকুল মরছে!’ আর যায় কোথায়? কেয়ার টেকার গোপাল কোনায় দাড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছিলো। তড়িঘড়ি করে সিগারেট ফেলে বেরিয়ে এলো। এসেই মুকুলেকে কিলাতে লাগলো আর অকথ্য ভাষায় বাপ মা তুলে গালি।‘হারামজাদা শুয়োরের বাচ্চা মাল খেয়েছিস? চোখে দেখিস না?’ ভীষণ হট্টগোল।অত রাত! সাড়ে তিনটা কি তার একটু বেশী।লোকজন ঘুমিয়ে আছে। এত আওয়াজ! আশপাশের ফ্লাটে আলো জ্বলে উঠলো।এ জানালা ও জানালায় কেউ কেউ উঁকি দিতে লাগলো। কি হচ্ছে বুঝে উঠতে পারছেনা?
সারাদিন ধুপ ধাপ দুম দাম তো চলতেই থাকে৷ রাতে ও আশপাশের লোক ঘুমোতে পারেনা৷ শম্পা ভাবে রাতে হয়ত শব্দ থাকবেনা৷ দুদন্ড শান্তি থাকবে।একটু ঘুমোবে। না হয় নির্বিঘ্নে জরুরী কাজ থাকলে করতে পারবে৷ পরদিন অফিস থাকে।কত কাজ! সকাল সকাল উঠতে হয়।সে গুড়ে বালি৷ যত ট্রাক সব রাতে ঢোকে৷ ইট,পাথর,রড দিড়িম দিড়িম করে নামায়।শোভেল দিয়ে পাথর, বালি, সুড়কি, হাবিজাবি রাজ্যের যত আছে খ্যাস্ খ্যাস্ করে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে উঠাতে থাকে।সূর্য উঠা অব্ধি।রাতের শব্দ উত্কট হয়৷ কানে যেন আছড়ে পড়ে৷ মনে হয় কানের মধ্যে বসে কেউ ড্রাম বাজাচ্ছে।ওরে বাবা! ব্যস, রাতের ঘুম শেষ৷ শম্পার চোখ গেল গ্রিলের বাইরে৷ একটু ভোলার চেস্টা করছে। দাঁড়িয়ে একটু দেখলো শেষ রাতের তামাশা। এখনো বুকের ভেতর কাঁপছে।এসব ওর কিছুই ভালো লাগছে না।কাল কি করবে চিন্তা করছে? কোথায় যাবে? এত বড় শহরে কাউকে চেনে না শম্পা। আপন বলতে কেউ নেই। কোথায় একটু আশ্রয় নেবে? তোয়ালে মুঠোয় ধরে রেখেছে এখনো।শম্পা হাত মুখ মোছার চেষ্টা করলো।হাত কাঁপছে।আগের জায়গায় ঝুলিয়ে রাখতে চেষ্টা করলো।পারলো না।পড়ে গেলো বারান্দায় রাখা ক্যাকটাসের উপর।শম্পা দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেনা এখন। ধুপ করে বসে পড়লো।কিন্তু বসতে পারলো না। পড়ে গেলো।মাথা বেঁকে দুম করে লাগলো ছাল চামড়া ওঠা অফ হোয়াইট গ্রিলে।জ্ঞান হারিয়ে ফেললো।ওভাবেই পড়ে রইলো।শম্পার কাঁচা হলুদের মতন মুখ রাস্তার আবছা আলোয় একদম বেগুনী দেখাচ্ছে।কিছুক্ষন পর জ্ঞান ফিরলো। হাতড়ে গ্রিল ধরে উঠে দাড়িয়ে রইলো।কালো মূর্তির মতন কালো অন্ধকারে৷ কতক্ষণ দাড়িয়ে থাকলো খেয়াল নেই৷ ওর গোলাপি নাক গ্রিলের বাইরে৷ বের করে রেখেছে৷ ভাল করে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছে৷ নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে,’আল্লাহ্ কি করবো এখন? কোথায় গিয়ে আশ্রয় নেবো?’
শম্পা এই ফ্ল্যাটে উঠেছে একমাসের কিছু সময়৷ একাই থাকে৷ দুই বেড রুমের ফ্ল্যাট৷ রুমগুলি বেশ বড়৷ ভাড়াও কম নয়৷ ব্যাচেলর কাউকে বাড়ীওয়ালা ভাড়া দিতে চায় না৷ তাই শম্পা সমস্যায় পড়ে গিয়েছিলো। ওর অফিসের পিয়ন রহমত জানতো শম্পা বাসা খুঁজছে।রহমত বদমাইশের হাড্ডি।বেজায় ধান্দাবাজ।একদিন এসে বলল, ‘ম্যাডাম একটা বাসার খোঁজ পাইছি৷ আফনে চাইলে কথা কমু৷’ আগে পিছে আর খোঁজ নেয়নি শম্পা। রহমতের উপর আস্থা নেই কিন্তু প্রয়োজন ছিলো।তাড়াহুড়ো করে উঠে পড়েছে৷ মোটামুটি গুছিয়ে নিয়েছে৷ জিনিসপত্র বলতে তেমন কিছু নেই।দুটি খাট, কাঠের আলমারি, সোফাসেট৷ ছোট খাটো সাংসারিক জিনিসপত্র।মাস খানিক উঠেছে কিন্তু তেমন কিছু বোঝেনি শম্পা। মাঝে মাঝে কেমন গা ছমছম করে এতটুকুই। সারাদিন কাজ করে শরীর এত ক্লান্ত থাকে। শোয়ার সাথে সাথে ঘুমিয়ে যায়।পরদিন কিছু বানিয়ে নাকে মুখে গুঁজে অফিস যায়।
২
গুছিয়ে উঠতে তেমন সময় লাগেনি শম্পার।কি বা এমন জিনিসপত্র
আছে ওর গুছানোর? কিন্তু গতকাল সন্ধ্যায় বাসার কেয়ারটেকার আবুল এলো।আবুল খাটো মতন মাঝ বয়সি।হাতে সার্ভিস চার্জের স্লিপ।শম্পা দরজা খুলে ভেতরে আসতে বললো।একথা সেকথা বলতে বলতে হঠাৎ আবুলের মুখ ফসকে বেরিয়ে গিয়েছে,’ ছি! ছি! ছি! কি কেচ্ছা! কি কেচ্ছা! আপা, আপনি তো জানেন না?’ বলে জিহ্বায় কাঁমড় দিলো।‘যাহ্ বলে ফেল্লাম! মুখ থেকে বেরিয়ে গেলো যে। কি করি? স্যার তো কলিজা টেনে বের করবে এখন?’ প্রথমে শম্পা কিছুই বুঝতে পারেনি।কিন্ত জিজ্ঞাসা করতে করতে আবুল বলে ফেললো সব।এখানে এক মুহূর্ত আর থাকার ইচ্ছে নেই শম্পার৷ কথাগুলি মনে পড়তেই বুক চিনচিন করছে। কণ্ঠনালী শুখিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে৷ এই ফ্ল্যাটে বছর খানেক আগে খুন হয়েছিলো।খুন হবার পর লাশ কুঁচি কুঁচি করে কেটে বস্তায় ভরা হয়।রাত তিনটেই একটি লাল গাড়ি ঢোকে।নীচে গ্যারাজে।কালো পোষাকে দুজন উপরে উঠে যায়।আধা ঘন্টা পর বস্তা দুটি নিয়ে নেমে যায়।সেই রাতে এ ফ্লাটের ভাড়াটিয়া রায়হান সাহেব বাড়িতে ফিরেছিলেন। কিন্তু কোথায় গেলেন কেউ জানেনা? রাতে যে বস্তা দুটি নামানো হয়েছিলো সেগুলি কিসের বস্তা? রায়হান সাহেবের স্ত্রী, রহিমা আক্তার কোথায় গেলেন? তাদের একমাত্র পনেরো বছরের মেয়ে রুকু কোথায় হারিয়ে গেলো? এই প্রশ্ন গুলির উত্তর এখনো অজানা।
স্কুলের পিছনে শাহিন রুকুকে জড়িয়ে পাগলের মতন চুমু খেয়ে চলেছে৷ ফিস ফিস করে বলছে,’বেবি, ইউ আর হট৷ ইউ আর হট৷ আই লাভ ইউ… আই লাভ ইউ৷’ শাহিন স্কুলে নতুন ভর্তি হয়েছে৷ বড় লোক বাবার স্পয়েল্ড চাইল্ড।টাকা পয়সার মা বাপ নেই।শাহিন একেক দিন একেক গাড়িতে স্কুলে আসে।এসেই রুকুর সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেলেছে৷ ক্লাসে কি পড়া হয়? বেখবর! জানার চেষ্টাও নেই৷ পিটার স্যর লিটারেচার ক্লাসে সেক্সপিয়রের ‘হ্যাম-লেট ‘ পড়াচ্ছেন৷ ‘এটি ২৯,৫৫১ টি শব্দ নিয়ে শেক্সপিয়র রচিত সবচেয়ে দীর্ঘতম নাটক। ডেনমার্ক সাম্রাজ্যের পটভূমিতে রচিত নাটকটি যুবরাজ হ্যামলেট ও তার চাচা ক্লদিয়াসের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ স্পৃহাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে যিনি সিংহাসন দখলের জন্য হ্যামলেটের পিতাকে হত্যা করেছিলেন এবং হ্যামলেটের জন্মদাত্রী মাকে বিয়ে করেছিলেন।’ দারুন পড়ান পিটার স্যার। উনার ক্লাসে পিন ড্রপ সাইলেন্স থাকে।পিটার স্যার পড়ান অদ্ভুত ভঙ্গিমায় হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে। ড্রামার এক্ট, সিন বর্ণনা করছেন, ‘এক রাতে King Hamlet এর প্রেতমূর্তি Prince Hamlet এর সাথে দেখা করে। প্রেতমূর্তি তাকে জানায়, Claudius (চাচা) তাকে হত্যা করেছে, Prince Hamlet কে তার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে হবে।প্রেতমূর্তির কাছ থেকে পিতার মৃত্যুর বর্ণনা শোনার পর বর্ণনাটি আদৌ সত্য কিনা Hamlet তা যাচাই করার চেষ্টা করে। কৌশলে সে একটি নাটক মঞ্চস্থ করে যেখানে অভিনেতাদের মাধ্যমে Hamlet প্রেতমূর্তির কাছ থেকে শোনা তার পিতৃহত্যার কাহিনী তুলে ধরে। Claudius এবং Gertrude নাটকটি দেখে বিচলিত হয়ে পড়ে। Hamlet এর তখন বুঝতে বাকি থাকে না, Claudius এবং তার মা Gertrude ই তার পিতার খুনি। Hamlet পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মনস্থির করে।পর্দার আড়ালে দাড়ানো Polonius কে তার চাচা Claudius ভেবে ছুরি দিয়ে হত্যা করলো…কিন্তু….এদিকে..’ পিটার স্যার পড়িয়েই যাচ্ছেন।কখন ক্লাস ব্রেক হয়ে গিয়েছে পিটার স্যার খেয়ালই করেননি।সুমি মনে করিয়ে দিলো। ‘এক্স কিউজ মি স্যার! ক্লাস টাইম ইজ ওভার!’ সুমি ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল।পিটার স্যার একটু মুচকি হাসলেন শুধু ‘প্লিজ গো থ্রু দ্য টেক্সট।ওকে ফোকস সি ইউ ইন দ্য নেক্সট ক্লাস’ পিটার স্যার হাত ঘড়ির দিকে একবার তাকালেন তারপর হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলেন।পিছন সারিতে শাহিন ঘুমোচ্ছে৷ সেদিন সোমবার,রুটিনে গেমস ক্লাস ছিলো। শফিক স্যার ভলিবল প্র্যাকটিসের পর সবাইকে ডেকে বললেন, ‘কাম অন বয়েজ… টেন মিনিটস ব্রেক নাও৷’ শাহিন একটু দূরেই ছিল৷ দশ মিনিটের ব্রেকে কোত্থেকে ছুটে এসে রুকুকে আড়ালে নিয়ে ঠোঁটে ঘাড়ে চুমু খেতে শুরু করলো।রুকু বাধা দিলো না।যেন কিছুই হয়নি৷ স্কুলের শেষে ওরা শাহিনের বন্ধু তপু, মিটন, একেকজনের বাসায় যায়৷ অন্তরঙ্গ সময় কাটায়৷ খুবই নর্মাল। রোজ কার রুটিনের মতন।শাহিন রুকুর অভ্যাস হয়ে গিয়েছে৷ ও রুকুর ভালবাসা৷ ওকে ছাড়া বাঁচবেনা৷ শাহিনের শরীর,নানান নেশা রুকুকে চুম্বকের মতন টানে৷
বাড়ীতে দেরিতে ফিরলে কেউ দেখার নেই৷ রুকুর মা, রহিমা আক্তার পার্টি করেন৷ বিভিন্ন কাজে বাইরে থাকতে হয়৷ ফিরতে রাত হয়ে যায়৷ গতকাল রাত নটা বেজেছে৷ এত টায়ার্ড লাগছিল না খেয়েই শুয়ে পড়েছেন রহিমা আক্তার।রুকুর বাবা রায়হান সাহেব ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকেন৷ উনারও ফিরতে রাত হয়৷ কোন কোনদিন বাসায় ফিরেননা। ওদের একমাত্র আদরের মেয়ে এই রুকু৷ অভাব নেই৷ না চাইতেই সব হাজির৷ বাবা মায়ের চোখের মনি রুকু।বাবা মা ব্যস্ত। পনর বছর বয়সী মেয়েটি বাড়ীতে সারাদিন একা থাকে৷ কি করছে? কার সাথে মিশছে? মা, রহিমা আক্তার কোন দিন জিজ্ঞাসা করেন না৷ ফ্রি থিংকিং আর কি! সময় কোথায়? কত কাজ! রহিমা আক্তার আজ গাজীপুর যাবেন৷ সমাবেশ আছে৷ কিন্তু কিছু দূর যেতে না যেতেই ফোন এলো৷ কে একজন ওপাশ থেকে বলল,’ম্যাডাম ফিরে যান৷ আজ সমাবেশ হবেনা৷ কি যেন ঝামেলা হয়েছে? আমি খবর নিয়ে পরে ডিটেল জানাচ্ছি।’ রহিমা আক্তার ড্রাইভারকে বললেন,’বাবা হাবুল গাড়ী ঘুরাও৷ বাসার দিকে চলো।’ হঠাৎ মনে হল বাসায় বাজার নেই৷ সবজি মাছ শেষের দিকে৷ ড্রাইভারকে বললেন,’হাবুল,গাড়ী আগোরায় থামিও….বাজার করতে হবে৷’ আগোরায় নেমে একগাদা বাজার করলেন।তারপর বাড়ী ফিরলেন৷
‘লিফট নষ্ট হইছে খালাম্মা৷ লোক ডাকছি৷ এহনো আই নাই!’ দারোয়ান হাশেম পান খাওয়া তেঁতুল বিচির মতন দাঁত বের করে বলল৷ হাশেম একটু আগে কার সাথে যেন মোবাইলে কথা বলছিলো? রহিমা আক্তারকে গেইটে ঢুকতে দেখেই তাড়াহুড়ো করছে।চোর চোর ভাব! ‘পরে পরে..রাইখ্যা দেই.. রাইখ্যা দেই…’ তাড়াতাড়ি লাইন কেটে দিয়েছে৷ বিশ্রী দেখতে এই হাশেম৷ থ্যাবড়া ছয় ইঞ্চি নাক৷ দু গালে পক্সের বড় বড় গর্ত৷ তারপর আবার মুখ প্যাঁচার মতন কালো করে দাড়িয়ে আছে৷ দু হাত ঝুলছে সামনে নাভির নীচ বরাবর৷ জল জ্যান্ত দানব।রহিমা আক্তারের দেশের লোক।রহিমা আক্তারই রেখেছেন।রহিমা আক্তারের বাবার খাঁস লোক এই হাশেম।’লিফট নষ্ট৷ এখন? আর সময় পেলো না? সারাদিন কি করো হাশেম? শুয়ে শুয়ে ঘুমাও নাকি? তোমাদের দিয়ে কিছু হয়না।এখন এই ব্যাগ বোচকা নিয়ে কি করে উঠবো বলতো?’ রহিমা আক্তারের মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছে।দাঁতে দাঁত চিবিয়ে কট কট করে বলেই যাচ্ছেন, ‘ধ্যাত! এতগুলি লোক করো কি? Bunch of idiots… ও মাই গড! চার তলায় উঠা চাট্টি খানি কথা?’ কি আর করা।উপায় নেই৷ তারপর রহিমা আক্তারের হাঁটুর ব্যথা ক দিন হলো বেড়েছে।এর মধ্যে জিম জয়েন করেছেন। কাজ হচ্ছে না।কোন রকম বাসার সামনে অব্ধি উঠে এলেন৷ এতগুলি সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠা হাঁপিয়ে গিয়েছেন৷
কতক্ষণ দম নিয়ে ব্যাগ থেকে চাবির গোছা বের করে কি হোলে রেখেছেন।কিন্তু কেমন যেন খটকা লাগলো? বুঝলেন দরজা আগে থেকেই খোলা৷ ঢুকলেন ভেতরে।ডাইনিং টেবিলের উপর ব্যাগ গুলি রাখলেন।রাখতে গিয়ে চোখ পড়ল উল্টো দিকের লিভিং হলে। যুগল নগ্ন-মূর্তির দিকে৷ রুকু না? তাই তো! একটি ছেলে রুকুর গোলাপের মতন ঠোঁটে চুমু খাচ্ছে৷ দুজন সম্পূর্ণ নগ্ন৷ শরীরে একটি সুতোও নেই৷ এ কি? কেউ বাসায় ঢুকে পড়েছে বা ঢুকে পড়তে পারে? সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই দুজনার। রহিমা আক্তার এসবের জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না৷
৩
ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহবল হয়ে গিয়েছেন৷ যেন মাথায় বাজ পড়েছে৷ নিজেকে সামলাতে পারছেন না৷ হাত পা কাঁপছে৷ যেন সারা পৃথিবী তছনছ হচ্ছে! ভেতর বাহির দোলনার মতন দুলছে! চেঁচিয়ে উঠলেন রহিমা আক্তার ‘রুকু…কে? এটি কে? এসব কি হচ্ছে এখানে? হায় আল্লাহ্ কি দেখছি? এ কি ….হচ্ছে? এসব দেখার জন্য বাঁচিয়ে রেখেছো আল্লাহ্? ইউ রাসরেল!’ ষাঁড়ের মতন চিৎকার করতে লাগলেন। রুকু স্বাভাবিক অবস্থায় নেই৷ কিন্তু উঠে এলো। কোন রকম দুলতে দুলতে এলো। ওর খোলা গোলাপী বুক, নাভী, হাত, উরু, হাঁটু সব দুলছে।রহিমা আক্তার যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো ওখান অব্দি ওভাবেই এলো।কথা জড়িয়ে যাচ্ছে।জড়ানো কথায় বোঝানোর চেষ্টা করছে। রহিমা আক্তার ‘রু…কু! রু…কু! কাছে এসো না। এন্ড ডোন্ট ডেয়ার টু টাচ মি রুকু…’ রুকুকে আলতো ধাক্কা দিয়ে দূরে সরে গেলেন রহিমা আক্তার।রুকু বলছে,’ম..ম! মম! ও শাহিন..ও শাহিন, মম! মাই বয় ফ্রেন্ড!’ কথা জড়িয়ে যাচ্ছে রুকুর৷ রহিমা আক্তার চেঁচিয়েই চলেছেন ‘দাঁড়াও …তোমার এত স্পর্ধা! এখনই তোমার বাবাকে ফোন করছি৷’ উনি ফোন খুঁজে নং প্রেস করলেন।সেল ফোন কানে দিলেন ঠিকই। কথা বলতে পারলেন না৷ মুহূর্তেই লুটিয়ে পড়লেন মার্বেলের সাদা ধবধবে মেঝেতে৷ রক্তে ভিজে যাচ্ছে।রুকু তাকিয়ে আছে।হাতে রক্ত মাখা কিচেন নাইফ।পড়ে আছে রহিমা আক্তারের নিথর দেহ৷ একটি পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেল যেন নিমেষে৷ রুকুর হাতে রক্ত মাখা কিচেন নাইফ! শাহিন উঠে এসেছে।রুকু বিলাপ করছে…’ম…ম…মম…! মম কি মারা গিয়েছে শাহিন?…এখন কি করবো শাহিন…? মম তো নেই…এখন…কি হবে আমার? এ আমি কি করলাম….মম! মম! উঠো মম..! বাবা চলে আসবেন একটু পরেই…ও গড! পুলিশ আসবে?’ পড়ে আছে রহিমা আক্তারের লাল জবজবে দেহ! ঘটনার আকস্মিকতায় শাহিনের চোখ ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইছে..’What the hell is this Ruku..? Now..এখন এখন কি করবো বলো..চলো পালিয়ে যায়’ কজন কে অনবরত ফোন করলো শাহিন,’কি কি বলছো? পারবে না? কত কত টাকা চাও বলো? দু লাখ, পাঁচ লাখ? যা চাও দেবো লোক জোগাড় করো। কোনো কথা শুনতে চাই না।তাড়াতাড়ি এসো। সময় নেই বুঝতে পেরেছো?’ দুজনে জামা কাপড় পরে নিলো।নীচে শাহিনের ড্রাইভার বল্টু বসে ছিলো।বল্টুকে ফোন করলো,’বল্টু উপরে আয় দরকার আছে।’ বল্টু উপরে এলো।কিছুই বুঝতে পারছেনা কি হয়েছে? ভেতরে ঢুকে শাহিনকে জিজ্ঞাসা করলো,’ভাইয়া কন ক্যান ডাকছেন?’ শাহিন বল্টুকে বললো,’বল্টু! ভাই তোর হেল্প লাগবে বিপদে আছি। তুই উপায় বল? সময় কম, যা হয় একটা কিছু কর প্লিজ..প্লিজ বাঁচা! কি করবি কর!’ বল্টুও দেখে শুনে ভয় পেয়ে গিয়েছে।তবুও বললো,’শাহিন ভাইয়া! আমি দেখছি কি করা যায়?’ দ্রুত কিচেনের দিকে গেলো।গিয়ে মাছ, মাংস কাটা বটি নিয়ে হাজির হলো।’ বললো, ‘ভাইয়া বডি ডা শক্ত কইরা ধরেন!’ এমন সময় দরজায় বেল বেজে উঠলো।রুকু বললো,’এখন কি হবে বাবা এসেছে?’ বল্টু বললো,’আফা! ভয় পাইয়া লাভ নাই দরজা খুলেন।আমি দেখতাছি!’ রহিমা বেগমের সেল ফোন বেজেই চলেছে….ট্রিম ট্রিম ট্রিম….! রুকু দরজা খুলে দিলো। রায়হান সাহেব দাঁড়িয়ে হাতে ব্রিফকেস, খবরের কাগজ, বেশ কটি শপিং ব্যাগ,’রুকু মা মনি! সুইট হার্ট! দরজা খুলতে দেরি করছো কেন? কখন থেকে ওয়েট করছি! তোমার মম কে কল দিচ্ছি! পাচ্ছিনা? তুমি কিছু জানো?এসেছে বাসায়?দেখো তো তোমার জন্য কি এনেছি? আমি জানি তুমি লাইক করবে…’ বলতে বলতে ঘরের ভেতর ঢুকলেন।রায়হান সাহেবের চোখ পড়লো মেঝেতে।পড়ে থাকা স্ত্রীর জবজবে, নিথর দেহের উপর।উনি এগুতে পারলেন না।দরজার পেছনে বল্টু। হাতে মাছ কাটা বটি,’শাহিন ভাইয়া ধরো! ধরো!’ বলে বসিয়ে দিলো রায়হান সাহেবের ঘাড়ে! আবার কলিং বেল বাজলো।জঘন্য দেখতে দুজন! হাতে গালে কোঁপের দাগ।পরনে কালো পোষাক।ঘরের ভেতর ঢুকলো।একজনের হাতে বস্তা।শাহিন ভাইয়া,’কি অবস্থা? শুনছি! কি করতে হইবো কন? টাকা দিবেন কাম হইবো।কথা শ্যাশ!’ শাহিন বললো,’টাকা পয়সা পরে।আগে ঝামেলা ক্লিয়ার করো!’ কালো পোষাকের দুজন সাথে হুইস্কি এনেছিলো।বোতল ধরেই ঢগ ঢগ করে গলায় পুরে দিলো।বললো,’মন্টু মাল গুলা ভাল কইরা কুঁচায় নিতে হইবো।ঐ ব্যাডা ছ্যারাব্যারা কইরা রাখছে! তারপর ভরবি বুঝছিস?’ধরাধরি করে দেহ দুটি বস্তায় ঢুকিয়ে ফেললো।টেনে হিঁচড়ে লিফটের কাছে নিয়ে গেলো।দুম দাম করে বেরিয়ে গেলো।লাল পুরনো ধাঁচের গাড়িতে ওরা এসেছিলো।গাড়ীটি রাত তিনটায় বেরিয়ে গেলো।বল্টুর হাতে কাপড় আর প্লাস্টিকের নীল রঙের বালতি।পানিতে একগাদা ফিনাইল দিয়ে নিয়েছে।পানির রং কালো কুচকুচে দেখাচ্ছে।বল্টু রক্তের দাগগুলি মুছছে।শাহিন আর রুকু ভেতরের রুমে কি যেন করছে? বল্টু ওখান থেকে গলা বাড়িয়ে একটু জোরে বললো,’শাহিন স্যার যা লাগে গুছায়া লন। এই হানে এহন থাকন যাইবো না।পুলিশ ঝামেলা করবো। আমি দাগ গুলান মুছা মুছি কইরা শ্যাশ করতাছি।আপনেরা তাড়াতাড়ি করেন।রাত থাকতেই বাইর হইতে হইবো! আমার দ্যাশের বাড়ির দিকে আগে যামু তার পর দেখা যাইবো কি করন যায়।আপনার মম, ড্যাডরে কি কইবেন ঠিক করছেন…?’
ফ্ল্যাটটি এতদিন বন্ধ ছিল৷ কেস চলছে এখনো৷ বাড়ীওয়ালা, মাহতাব হোসেন ভাড়া দিতে পারছিলেননা। হঠাৎ শম্পার মত একজনকে পেয়ে ভাড়া দেওয়ার লোভ সামলাতে পারেননি৷ শম্পাও খোঁজ খবর না নিয়ে উঠে পড়েছিলো। এখনো বারান্দায় দাঁড়িয়ে শম্পা৷ ভোর হবার অপেক্ষায়৷ পিছনে তাকাবার সাহস নেই৷ এই রাত যেন শেষ হবার নয়৷ শেষ হবেনা কোনদিন৷ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে৷ মুহূর্ত শতাব্দী৷ কোলাহল থেমে গিয়েছে৷ ট্রাকটি নেই৷ মাটিতে রক্তের কালচে দাগ আছে।কতগুলি কুকুর দৌড়াদৌড়ি করছে। শম্পা তাকিয়ে। পাথর দৃষ্টি৷ কুকুরগুলি এত ডাকাডাকি করছে কেন? ওদের চিৎকারে কাঁপছে নিস্তব্ধতা৷ কাউকে তেমন কোথাও দেখা যাচ্ছেনা৷ দূরে কে একজন হেঁটে যাচ্ছে।খাঁকি জামা, হ্যা তাই তো! শম্পার ভয় করছে এখনো।মনে হচ্ছে ওর একাকী নিঃসঙ্গ রাত আর কাটবেনা কোনো দিন।কুকুরগুলি ডেকে ডেকে বলছে,’ ভয় পেও না শম্পা! আর কেউ না থাকুক, আমরা আছি৷’ চিৎকার করতে করতে মিলিয়ে গেল অন্য গলিতে। নীরবতায়!
————- হরর এন্ড সাইকো থ্রিলার-দুঃস্বপ্ন- দুঃস্বপ্ন