তৈল সমাচার
(তানভীন সাজেদা)
প্রত্যুষে প্রাতঃরাশ তৈরি হেতু সকল আলস্যকে দূরে ঠেলিয়া সিঁড়ি ভাঙিয়া রসুইঘরের সম্মুখে যাইয়া উপস্থিত হইয়া সবে চৌকাঠে পা রাখিয়াছি, অমনি কর্তামশাই হা হা করিয়া উঠিলেন! সাবধান, বিড়াল আজ বড় অকাণ্ড করিয়া গিয়াছে। বেখেয়ালে প্রবেশ করিলে পা পিছলাইয়া মহাবিপদ হইবার আশংকা রহিয়াছে।
আমি জানি, উনি প্রত্যহ প্রভাতে নিদ্রাভঙ্গের পর নিচতলায় হাঁটাহাঁটি করিয়া থাকেন। উনার এহেন আচরণে আমি থমকাইয়া গিয়া রসুইঘরে চাহিয়া আমার চক্ষুদ্বয় একেবারে চরকগাছ। গতকল্য রজনীতে বাজার হইতে আনা প্যাকেটজাত তৈল রন্ধনকর্মের সুবিধার্থে বোতলে ঢালিয়াছিলাম। প্যাকেটের গাত্রে লাগিয়া থাকা তৈল সম্পূর্ণরূপে নিংড়াইয়া লইবার অভিপ্রায়ে আমি দেওয়ালের সাথে বোতলটি হেলান দিয়া প্যাকেটটিকে বোতলের মুখে নিপুনভাবে সেট করিয়া রাখিয়া মনে মনে ভাবিয়াছিলাম, যে তৈল ছাড়া সমাজ সংসারে ঠিকমত টিকিয়া থাকাই দায়, যে তৈলের আকাশচুম্বি মূল্য হওয়ায় গৃহে গৃহে অশান্তির আগুন জ্বলিতেছে, যে তৈলের কারণে চোর সাধু সব মিলে একাকার হইয়া গিয়াছে, সেই তৈলের একটি ফোঁটাও আমি নষ্ট হইতে দিবো না। না, কিছুতেই না।
বিগত কিছুকাল যাবৎ এই তৈল লইয়া বঙ্গদেশে কী না হইয়াছে! দেশের হোমরাচোমরা ব্যাক্তিগণ অতিরিক্ত লাভ করিবার আশায় লাজ লজ্জার মাথা খাইয়া গ্যালন গ্যালন তৈল চুরি করিয়া খাটের তলায়, মাটির তলায়, দেরাজের ভিতর লুকাইয়া রাখিয়া অবশেষে ধরা পড়িয়া তাহাদের নামের সম্মুখে তৈলচোর তকমাটি লাগাইয়া ফেলিয়াছে। এমন যে মূল্যবান তৈল, তাহা আমি নষ্ট হইতে দেই কী করিয়া?
যদিওবা কেহ কেহ মুখবইতে, পত্রপত্রিকায় দুঃখে শোকে রঙ্গব্যঙ্গ করিয়া, হাসিয়া কাঁদিয়া এই শিক্ষিত চোরদিগের চোদ্দগুষ্টির পিণ্ডি চটকাইতেছে, তাহা দেখিয়া বোধসম্পন্ন লোকেরা শরমে মরমে মরিয়া গেলেও চোরদের তেমন কোনো বিকার হইয়াছে বলিয়া আমার জ্ঞাত হয় না।
লেখক হরপ্রসাদশাস্ত্রী তৈল লইয়া বিশদ কথা বলিয়া গিয়াছেন! এ জগত সংসারে নিজেও এই তৈলের মাহাত্ম্য কী তাহা সচক্ষে দেখিয়াছি। কিভাবে ইহা একটি গর্দভকে বিজ্ঞের কাতারে লইয়া যায়। কিভাবে একজন জ্ঞানী ব্যক্তি নিজেকে বেকুবের খাতায় নাম লেখায়! এতো করিতকর্মা যে তৈল তাহাকে তো সবটুকু সযতনে লইতেই হইবে।
কিন্তু বিধিবাম, রজনীর কোনো এক প্রহরে চুরির অভিপ্রায়ে বিড়াল জানালা দিয়া টপকাইয়া তাকের উপরে রাখিয়া দেওয়া বোতলের উপর পড়িয়া সেই তৈল সমেত বোতল লইয়া রসুইঘরের মেঝেতে পতিত হইয়াছিল। আমি চাহিয়া দেখিলাম দেওয়াল ঘেষিয়া তৈল গড়াইয়া গিয়াছে। আর সমস্ত রসুইঘর জুড়িয়া বিড়ালের তৈলাক্ত পায়ের ছাপ দিয়া এক অদ্ভুত চিত্রের অবতারনা হইয়াছে। ইহা দেখিয়া আমার কি অবস্থা হইলো তাহা নাই বা বলিলাম। শুধু কোনোরকমে প্রাতঃরাশের পাট চুকাইয়া ঘরের লোকদিগকে বিদায় দিয়া বিড়ালের চৌদ্দগুষ্ঠির মুন্ডুপাত করিতে করিতে পরিস্কারের উদ্দ্যেশ্যে রসুইঘরে ঢুকিলাম।
এইবার একপাতিল গরম পানি লইয়া মেঝেতে ঢালিয়া ইচ্ছামত সাবান গুড়া ছিটাইয়া ঝাটার বাড়ি দিয়া ধৌত করিতে লাগিলাম। দীর্ঘ সময় ধরিয়া চেষ্টা করিয়া মেঝে পরিস্কার করিলাম বটে, তবে একটি কথা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করিলাম, তৈল, সে বড় কঠিন জিনিস। ইহা একবার গাত্রে লাগিয়া গেলে তাহা সরাইয়া ফেলা অত সহজ কর্ম নহে।
তাইতো যাহারা লোভে পড়িয়া অথবা নিজের অস্তিত্ব বিকাইয়া দিয়া একবার নানারকম তৈলাক্ত বাক্য দ্বারা সিক্ত হইয়াছে, অথবা কোনো সেয়ানা মহারথির দ্বারা গাত্রে গ্যালন গ্যালন তৈল মাখাইয়া লইয়াছে , কি করিয়া তাহারা সেই তৈল ভান্ডার হইতে নিজেকে উৎরাইয়া আনিবে?
অতএব এই তৈল গাত্রে মাখিয়া তাহারা হিতাহিত জ্ঞান হারাইয়া সব জায়গায় নয় ছয় করিতেছে। তাহাতে কিছু কূপমন্ডকের পোয়া বারো হইলেও, যোগ্য ব্যক্তিগণ নানাভাবে বঞ্চিত হইয়া নিজেদের অদৃষ্টের কথা ভাবিয়া জীবনের প্রতি বিরূপ মনোভাব লইয়া হতাশায় ভুগিয়া কপাল চাপড়াইয়া মরিতেছে।
ইহা ছাড়া তাহাদের আর কিইবা করিবার আছে!?
তাহারা যে তৈল ঢালিবার মতো নিকৃষ্ট কর্মে কিছুতেই নিজেদের আত্মাহুতি দিতে পারিবে না।
যাহাই হউক, বিড়ালটি আমার পুত্রধনের বড় পছন্দের ছিল। তাই সে পরদিন দুপুরে খাইতে বসিয়া আফসোস করিয়া বলিল , বিড়ালটি হয়তো আর কোনোদিনই আসিবে না। আমিও তাহার সাথে একটু যোগ দিয়া বলিয়াছিলাম, বোধহয় এমন অপকর্ম করিয়া সে অনুতপ্ত হইয়াছে।
আমাদের মাতা পুত্রের বাক্যালাপ শুনিয়া কর্তামশাই একটু হাসিয়া কহিলেন,
চোর কখনো অনুতপ্ত হয় না।
তাহার পায়ের ছাপ বলিয়া দেয়, তাহাকে তৈলের উপর হাঁটিয়া পলায়ন করিতে গিয়া কতখানি বেগ পাইতে হইয়াছে। তাই প্রাণ ভয়ে কিছুদিন ঘাপটি মারিয়া থাকিবে বটে, কিন্তু সময় সুযোগ বুঝিয়া আবারো সে তাহার পুরোনো অভ্যাসবশত চুরি করিতে আসিবে।
কারণ, সে তাহার অপকর্মের কারণে যথাযথ শাস্তি ভোগ করে নাই… আমরা এই বিষয়ে একেবারেই ব্যর্থ হইয়াছি…
২ Comments
congratulations
চমৎকার একটি লেখা