ঢাকা টু ওয়াশিংটন
তোমার সাথে যোগাযোগ ফেসবুকের মাধ্যমে। যখন সংসারের ভীষন বেহাল অবস্থা, স্বামীর সাথে প্রচণ্ড ঝামেলা তখন একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবো বলে কথা বলার মানুষ খুঁজছিলাম। তখন বেশির ভাগ সময় ফেসবুকেই কাটাতাম। একদিন হঠাৎ দেখি এক আপুর পোস্টে একজন তুমি ভিনদেশি মানুষ। তারপর তোমার প্রফাইলের পোস্টগুলো দেখা শুরু করি। ছবি দেখতে দেখতেই একসময় তোমার ছবির প্রেমে পড়লাম। একদিন মনে হলো ম্যাসেনজারে তোমায় পেতে পারি হয়তো কথা বলার জন্য। সাহস করে তোমাকে বন্ধু রিকুয়েষ্ট পাঠাতেই তুমি একসেপ্ট করে নাও। এরপর টুকটাক চেটিং হতো চুকিয়ে আড্ডা হতো লিখে লিখে। একদিন মনেহলো এতো লিখে বলার চেয়ে কল দিয়ে দেখি যদি তুমি কথা বলো। তবে সংকোচটা ছিলো আমার ভাষার জন্য। তুমি নিশ্চিত বাংলা জানো না। আমি ভালো ইংরেজি জানি না। তবু্ও কল দিতেই তুমি রিসিভ করেছিলে। শুরুতেই বলেছিলাম i m not good enough in English. তুমি বলেছিলে no problem carry-on. তারপর ধীরেধীরে আমিই ইংলিশে পাকা হয়ে গেলাম দীর্ঘ এক বছরে।
তখন আমরা মাঝে মাঝে ভারচুয়াল আড্ডা দিতাম ঘন্টার পর ঘণ্টা। শনি-রবিবার সময় ম্যাচ করে নিয়েছিলাম দুজনে। সুবিধা ছিলো আমার রাত আর তোমার দিন। আমার কথা বলা বিভিন্ন টপিক নিয়ে তোমার সাথে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। আমি সময়গুলো উপভোগ করতে থাকি।
একদিন তুমি বললে আমাকে দেখতে চাও সামনা সামনি। আমি শুনে বিভোর হয়ে গেলাম। আমি বললাম সত্যি আসবো যদি সময় করে ঘুরতে নিয়ে যাও। আমার মাল্টিপল ভিসা ছিলো তবে যাওয়ার একটা অযুহাত খুঁজছিলাম। হঠাৎ শুনি অফিসের এক মিটিংএ একজন কলিক যেতে পারছেন না। সুতরাং তৎক্ষণাৎ কানট্রিম্যানেজার বললেন যার ভিসা আছে সে যেতে পারবে। দেখা গেলো শুধু আমারই ভ্যালিট ভিসা আছে সেই সময়ে। সুতরাং আমাকেই পাঠানো হবে বলে সিদ্ধান্ত দিলেন বস। যেহেতু দুরের পথ তাই বসকে বলেছিলাম ৭দিন আগেই যাব। ভাগ্যক্রমে আমাদের হেড অফিসটা ওয়াসিংটন এ। তাই কোন রকম ঝামেলা ছাড়াই অফিস মিটিং এর জন্য শুরু হলো যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি। এতো এতো গিফট কিনেছি তোমার জন্য তোমার মা-বোনদের জন্য।
সত্যি চলে এলাম ঢাকা থেকে ওয়াশিংটন। নেমেছি ডালাস এয়ারপোর্ট টারকিস এয়ারক্রাফট ছিলো এবং ল্যানডিং এর সময়টা ছিলো রাত ২টা। আমার লাগেজ নিয়ে বের হতেই তোমার দেখা পেলাম। ফেসবুকের ছবি আর ফোনে কথা বলার স্বর মিলিয়ে বুঝতে পারি এইতো আমার সেই স্বপ্নের পুরুষ যার অপেক্ষায় আমি এতদূর পাড়ি জমিয়েছি। তুমি নিতে এসেছো। দেখেই আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলে মনে হয়েছিলো তুমি আমার পুরোনো পরিচিত আপন মানুষ। তারপর কপালটা আলতো করে ছুঁয়ে দিলে। তুমি বললে রাতে ঘুমাতে পারোনি। আমাকে মধ্য রাতে নিতে আসবে বলে তুমি ছিলে খুব উদ্বিগ্ন। পথে গাড়ি থামিয়ে ডানকিন ডোনাট থেকে কফি আর ডোনাট খাওয়ালে যাএার ক্লান্তি দূর করার জন্য। তারপর তুমি সোজা নিয়ে এলে তোমার বাসা ম্যারিল্যানড এ। বাসাটা সাজিয়েছিলে কিছু তাজা ফুল দিয়ে আমার জন্য । আমাকে বাসায় নিয়েই ফুল দিয়ে স্বাগত জানালে। সে রাতটা গল্প করেই কেটেছে আমাদের। কখন যে ভোর হলো বুঝতে পারিনি দুজনে। মনে পড়ে সূর্য উঠার সাথে সাথে আমি অবাক বিস্ময়ে তোমার বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখেছি। তোমার এতো এতো সব সুভেনিয়র পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে এনেছো। তুমি বললে পৃথিবীর প্রায় সব দেশ তুমি ঘুরেছো। আমি একটার পর একটা জিজ্ঞেস করি কোন দেশের কোন জিনিসটা তুমি ধৈর্য ধরেই উত্তর দিয়ে গেলে। তোমায় দেখবো বলে বিভোর ছিলাম তখন। তোমাকে দেখে আমার সব জেটলক বাতাসে উবে মিলিয়ে যায়। আমি বার-বার তোমাকে ধরে দেখেছি অনুভবের চেষ্টা করেছি আমি কি সত্যি বাস্তবে? তুমি হাসি দিয়ে আরো জোরে আমায় জড়িয়ে ধরে বললে এবার অনুভব করো তুমি কোথায়।
প্রতিদিন শুধু ঘুরেছি লং ড্রাইভে। তোমার নতুন গাড়িতে চড়ে চষে বেড়িয়েছি এয়ার এন্ড স্পেস মিউজিয়াম, ক্যাসিনো, শপিং মল, পার্লামেন্ট হাউজ, পটমাক নদীর তীর আরো অনেক অনেক জায়গায়। একদিন স্পেশাল একটা ডিনার করিয়েছিলে তোমার পছন্দের রেস্টুরেন্টে যেটা ভার্জিনিয়ায়। তুমি আমাকে ফোনেই বলেছিলে এটা তোমার পছন্দের রেস্টুরেন্ট। আমার পছন্দের টাকোবেল খাইয়েছো। আমার কাছে চটপটি যেমন পছন্দের টাকোবেলও তেমন পছন্দের। সময়টা ছিলো অক্টোবর নভেম্বর একটু শীত তবে বাংলাদেশ এর চেয়ে অবশ্যই বেশি ঠান্ডা। আমি ঠান্ডায় জুবুথুবু। তুমি খুবই কেয়ারিং ছিলে আমার জন্য। তোমার মায়ের সাথে দেখা করে একসাথে লাঞ্চ করালে একদিন। আন্টিও খুব আপন করে নিয়েছিলো আমাকে। আন্টির ১ম কথাই ছিল আমকে উনার খুব পছন্দ হয়েছে। আমার দেয়া গিফট পেয়ে উনি মহা খুশি। উনার ইংরেজি তুমি মাঝে মাঝে আমাকে ব্যাখ্যা করে দিয়েছো। তোমার আমার রাতগুলো ছিলো অসাধারণ। অনেক দিনের ক্ষুধার্ত আমি তখন যেন ফিরে পেয়েছিলাম নতুন জীবন। অসাধারণ অনুভূতি আর তৃপ্ততায় ভেসেছিলাম ঠিক কল্পনার রাজ্যে। যেদিন তুমি তোমার বন্ধুর বাসায় পার্টিতে নিলে সেটা ছিল আমার জন্য নতুন পরিবেশে নতুন সংস্কৃতিতে প্রথম যোগদান। আমি খুব অসোসস্তিবোধ করছিলাম কারণ আমার ভাষার সমস্যা আবার নতুন পরিবেশ। বুঝতে পারছিলাম না কিভাবে কি করবো, কি কথা বলবো, কোন পানীয় টা আমার নেয়া উচিত। অথচ তুমি কি অদ্ভূত ভাবে আমাকে বুঝতে পেরেছিলে এই দুদিনেই। তুমি আমাকে সহজ করার জন্য নিজেই আমার জন্য খাবার, পানীয় তুলে দিয়েছো, কার সাথে কথা বলতে আমার ভালো লাগবে সেটাও বলে দিলে আর আমার সাথেই থাকলে তোমার আড্ডা দেয়ার বদলে। মনে হয়েছিল সত্যি আমি তোমার আপন ঘরের মানুষ।
ধীরে ধীরে রাতগুলোতে তুমি পাগল হয়েছিলে আমার জন্য। দুই মেরুর মানুষ হয়েও কিভাবে যেন আপন করে নিয়েছিলে। নিছিদ্র নিগুঢ় সম্পর্কটা বড়ো অদ্ভুতভাবে মিলেছিল দুজনের চাহিদা মতোই। আমার ভয়ছিলো তুমি আমেরিকান আর আমি এশিয়ান। হয়তো বা তুমি অতৃপ্ততায় মুখ ফিরিয়ে নিবে। না সেটা হয়নি বরং তোমার মায়াটা বেড়েছিলো একটু একটু করে আমার জন্য। ধীরে ধীরে তুমি আমাকে তোমার জীবন যাত্রা, পরিবেশ, অবস্থা, পছন্দ অপছন্দ এসব বলতে শুরু করলে। আমি কি খেতে পছন্দ করবো কোথায় ঘুরতে যেতে চাই এসব নিয়ে অস্থিরতা করেছো। আমার মনে হতে লাগলো আমি হয়তো তোমার মনে সামান্যতম হলেও জায়গা করতে পেরেছি। অফিসের মিটিং এ তুমি ড্রপ পিক করেছো তিনদিনই। এজন্য আমি ছিলাম দুশ্চিন্তামুক্ত ৷ যাওয়া আসা মানেই চিন্তা ছাড়া তুমি হাজির ছিলে। দেখতে দেখতে চলে এলো বিদায়ের দিন। রওনা দিব ভোর পাঁচটায়। তুমিই ঘড়িতে এলার্ম দিয়ে আমার কাপড় চোপড় গুছিয়ে সব ঠিকঠাক করে রেখেছিলে। আবার মন খারাপ করে বারবার আমাকে জড়িয়ে ধরে বলছিলে আবার এসো। আসার দিন তুমি বললে যোগাযোগ রাখবে।
কেটেছে বহুবেলা এরপর। আমি ফিরে যাই দেশে। যোগাযোগ কখনও হয়েছে আবার কখনও বন্ধ থেকেছে। তখন মনে করতাম ভিনদেশি মানেই সামনে যতো মায়া দূরে গেলে আর কোন মায়া থাকে না। ইদানিং বুঝতে পারি তুমিই আমার প্রেমে পড়েছো এখন। বেলায়-অবেলায় ফোন দাও এবার তুমিই আসতে চাও দেখা করতে। এতোদিনে আমি আলাদা হয়েছি আমার স্বামীর থেকে কারণ আর সহ্য হচ্ছিল না। এখন আমার একার সংসার। এটা শুনেই তুমি মনে হয় বেশি দূর্বল হয়েছো আমার জন্য। এখন তুমিই আমায় কাছে নিতে চাও যদি আমি রাজি থাকি। কিন্তু জানোতো সময় অনেক গড়িয়েছে আর কি বাসা বাঁধবার বেলা আছে? এখন তোমার কেয়ারিংটা বড্ডো বেশি বেড়েছে। দূরে থেকেও মনে হয় অনেক কাছেই তুমি। ফোন দেয়া, সাজেশন দেয়া উহ বেশি বেশি বাড়াবাড়ি এখন তোমার। মনে হয় আমি হারিয়ে যাব কোথাও তোমাকে ফেলে। এইতুমি এখন বলছো আমি তোমার কাছে সব সময়ের জন্য স্পেশাল কারনটাও ব্যাখ্যা করলে। আমি সত্যি বিস্মিত হয়েছি তোমার কথায়। আমি তোমার কছে স্পেশাল হয়েই থাকতে চাই। আমি জীবন চলতে কৃত্রিমতাকে প্রশ্রয় দেই না, সাদা মাটা সত্যকে নিয়ে সহজ ভাবে চলতে পছন্দ করি। আমার এই সরলতাই তোমাকে আকৃষ্ট করে বারবার। তাই তুমি ভৌগলিক দুরত্বের কারণে মুখ ফিরিয়ে নিতে চেয়েও পারোনি।
দিনের শেষে আর মনে করতে চাই না তোমায়। এখন আর কোন নতুন সপ্ন দেখি না তোমাকে নিয়ে। আগে তুমি বলতে আমার ম্যাসেজ আর ফোনে তুমি অস্থির হয়ে যাও। আর এখন হয়েছে ঠিক উল্টো। তুমি কল আর টেক্সট দিয়ে আমাকে অস্থির করো। তাইতো আমার কাছ থেকে আগের মতো আর কোন সাড়া পাওনা, ফোন মাঝে মাঝে ধরি না বলতে গেলে। আবার ইচ্ছে করেই তোমার নম্বরটা বেশির ভাগ সময় ব্লক করে রাখি। তুমি বুঝতে পারো আমার অভিমানের জায়গাটা। তোমাকে ফেসবুক বন্ধু তালিকা থেকেও ডিলিট করেছি কারণ সময়ের প্রয়োজনে তোমার কাছে যেতে পারিনি। আমি এয়ারপোর্টে যাওয়ার আগ মূহুর্তে বলেছিলে ভালোবাসার নিদর্শন স্বরুপ আমার কাছে থাকা খুব পছন্দের কোন একটা মূল্যবান জিনিস তোমাকে দিয়ে যেতে। তুমি ভেবেছিলে আমি পারবো না হয়তো। আমি গলা থেকে খুলে তোমায় দিয়ে এসেছিলাম আমার অতি প্রিয় সোনার রেইবো লকেট’টা। আজ এতোদিন পরে তোমায় লিখছি যদি নতুন কোন সম্পর্কে জড়িয়ে যাও, যদি অন্য কাউকে জীবন সঙ্গী করো তাহলে আমার সেই লকেটটা আমায় ফিরিয়ে দিও। কারণ ওটা তোমার কাছে হবে তখন একটা উচ্ছিষ্ট জিনিস।বিদায় বেলায় তোমার আলিঙ্গন তোমার রক্তিম অশ্রুভরা চোখ আমার কাছে বিশাল পাওয়া ছিলো। একটু হলেও কিছু সময়ের জন্য তোমার আপন হতে পেরেছিলাম। তুমি ঘড়ি ধরে আমার ট্রানজিন এয়ারপোর্টে হোয়াটসঅ্যাপ এ কল দিয়েছিলে আবার বাংলাদেশ এ নামার পরপরই কল দিয়েছিলে। তোমার অনেক দুশ্চিন্তা হচ্ছিল আমাকে নিয়ে আমি ঠিক মতো পৌঁছেছি কি-না। ও হ্যা তোমাকে জানানো হয়নি আমি চলে এসেছি জার্মানি অতি সম্প্রতি।
চিঠিটা লিখছি বাংলায় তবে এটা ভাষান্তর করে তোমার ডাক বাক্সে পাঠাবো। তুমি বুঝবে আমি তোমায় কতটুকু ভালোবাসতাম এক সময়, তবে সময় গড়ালে চাওয়া পাওয়ার অনুভূতিগুলোও পাল্টে যায়। একটা সময় তোমার কাছে আশ্রয়ের আশা করেই আমি পা বাড়িয়ে ছিলাম তোমার দিকে। অসহ্য অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে চেয়েছিলাম দেশ ছাড়বো। ভেবেছিলাম যদি কাছে নাও আমি হবো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখি মানুষ। আমার অভিজ্ঞতায় আমেরিকানরা বিয়ে করতে সময় নেয়। তবে আমার সে সময় তাড়া ছিলো তরী তীরে ভেড়ানোর। তখন তোমার খেয়া ঘাটটায় নোঙর ফেলতে দাওনি। এখন মনে হয় আবার কোন একদিন হয়তো সামনাসামনি দেখা হবে তবে সময়টা হবে একদমই নিভে যাওয়া মোমবাতির শেষক্ষণে।
লেসা সুসান
৬ই ফেব্রুয়ারী ২০২২
টরোন্টো / কানাডা
২ Comments
Great job
congratulation