আমারও অভিমান হয়।
গল্প।
[ফারজানা ইয়াসমিন]
দুই দিন ধরে অসুস্থ। মা কল করে বলে, বাচ্চারা কেমন আছে? ঠিক মতো খাওয়াই কিনা? ওরা দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে। একদম খেয়াল রাখি না।কী করি সারাদিন? আরও দশজনের বাচ্চার উদাহরণ দিয়ে বসে।মাথা নষ্ট হয়ে যায়। সেদিন শরীর মন দুটোই চরম খারাপ ছিল। তাই বললাম,
মা আমিও একটা মানুষ। কতদিন জিজ্ঞেস করো না আমার কথা? হাজার দোষ ধরো সবাই। একবার ভেবে দেখেছো আমিও ক্লান্ত হই?সব মানুষ এক হয় না।আমি হয়তো একটু বেশি অকেজো মানুষ। বলে ফোন রেখে দিলাম। মা ফোন দিল আবারও। আমি বন্ধ করে রাখলাম।
এখন আদর, স্নেহ, মায়া, মমতার কাঙ্গাল হয়ে যাচ্ছি। এগুলো কোথায় পাবো?সারাদিন বাচ্চাদের পিছনে দেও।তবুও স্বামীর অভিযোগ তাদের সঠিক ভাবে মানুষ করতে পারছি না।সংসার গুছিয়ে রাখতে পারি না।তার মতো করে সে কিছুই পায় না।
চারিদিকে শুধুই অভিযোগ আর অবহেলা।একটা মেয়ে মা হলে কী তার কোনো আবেগ অনুভূতি থাকতে নেই? নিজের কোনো ইচ্ছা থাকতে নেই? অসুখ হলে সেবা পাওয়ার ইচ্ছা হতে নেই? কেউ একটু কেয়ার করুক এটা তো সবাই চায়।
শরীরের চেয়ে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল।সুমনকে ফোন করে বললাম,
— পারলে ছুটি নিয়ে বাসায় চলে আসো।আমার খুব খারাপ লাগছে।সুমন রেগে গিয়ে বলল,
— এটা অফিস অণু।চাইলেই ছুটি দেয় না।তোমার খারাপ লাগছে ঔষধ খাও।একটু রেস্ট নেও।আমি আসলেই তো ভালো হয়ে যাবে না।আমার অনেক কাজ আছে। সময় নেই একদম।
আমার খুব অবাক লাগলো।দুটো বাচ্চা নিয়ে আমি কীভাবে রেস্ট নিব?মাঝে মাঝে স্বামীর উষ্ণ ভালোবাসা আর আদুরে স্পর্শ মন ভালো করে দেয়।ঔষধ হয়ে কাজ করে অসুখ হলে।এতোটা অবহেলা কেন করে সবাই?
বাবার এখন সময় হয় না খোঁজ নেওয়ার। বড় হওয়া মানে কী সব অধিকার হারিয়ে ফেলা?তাহলে ছোটই ভালো ছিলাম। কেন বড় হলাম?
সুমন অসুস্থ হলে রাত দিন এক করে সেবা করি।নিজের ঘুম হারাম হয়ে যায়। আগলে রাখি সবসময়। অথচ এই মানুষটা আমার অসুখে একটা খোঁজ নিতে পারে না।
আমার খবর নেওয়ার মানুষটা কই? যেখানে শরীর খারাপ প্রাধান্য পায় না।সেখানে মন খারাপের কোনো জায়গা নেই। সবকিছু মেনে নিতে নিতে হঠাৎ কেন যেন মনে ক্ষোভ জমা হলো।
ফোন অন করতেই বাবার ফোন এলো।ছোট বেলার মতো আদুরে গলায় বলল,শরীর কী বেশি খারাপ মা?মনের অজান্তেই চোখে পানি চলে আসলো।উত্তর দিতে পারছি না।গলা ধরে এলো।তারপর বললাম,
— তুমি জানো আমার খবর? আছি ভালো।
বাবা আমার অভিমান বুঝতে পারলো।বলল,
— রাগ করে আছো? ভুল হয়ে গেছে মা।তোমাকে দেখতে আসা উচিত ছিল মা।
আমি ফোনটা রেখে দিলাম।
বাবা নাকি মা’কে বলেছিল, অণুর শরীর ভালো না।মেয়েটা একা কষ্ট পাচ্ছে।
মা নাকি বাবাকে বলেছিল, আমি তো এতো বছর পেরেছি।ও পারবে।আমার চার বাচ্চা ছিল। আমি অসুস্থ হলে তুমি কোনদিন খোঁজ নিয়েছো?
বাবা নাকি বলেছিল, ভুল হয়ে গেছে। আমি অসুস্থ হলে তো তুমি রাত জেগে বসে থাকতে।তোমার প্রতি অন্যায় করেছি বলেই।আজ আমার মেয়েটা কষ্ট পাচ্ছে।
মা বাবার কথা শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। আর কিছু বলতে পারেনি।
সুমন সেদিন তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে আসে।রাতের খাবার নিয়ে আসে হোটেল থেকে। সাথে আমার পছন্দের দই।আমার কোনো অসুখ হলে আমি দই খাওয়ার আবদার করতাম বাবার কাছে।
সেদিন সুমন ফ্রেশ হয়ে বাচ্চাদের খাইয়ে দিয়ে ঘুম পারিয়ে দিল।আমি চুপচাপ সব দেখছিলাম।প্লেটে ভাত এনে আমার সামনে বসলো।বলল,এসো আমি খাইয়ে দেই।আমি বললাম, লাগবে না।আমি পারবো।তুমি তোমার প্লেট আনো।অনেক করেছো।
সুমন হেসে বলল,তুমি তো রোজ করো।আজ আমি করলাম।আর আমি অসুস্থ হলে তুমি তো খাইয়ে দেও।আসলে কী জানো? আমরা খুব স্বার্থপর। শুধু নিজের কথাই চিন্তা করি।আমার কাছেও তো তোমার চাওয়া পাওয়ার অনেক কিছু আছে। তা ভুলে যাই।
আমার কেন যেন কান্না পেল।সুমন আমার চোখ মুছে দিয়ে বলল,রাগ করো না।অফিসে গেলে এতো চাপ থাকে।মাথা কাজ করে না।
তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হও।এই সংসারের প্রাণ তুমি।
দুই দিন পর সুমনকে ফোনে বাবাকে বলতে শুনলাম,
— আপনাকে অনেক ধন্যবাদ বাবা।আমাকে বোঝানোর জন্য। অন্য সময় না হোক।ওর যখন আমাকে দরকার তখন ওর পাশে আমার থাকা দায়িত্ব।
আমার খুব ভালো লাগল। বাবা নিজের ভুল ধরিয়ে দিয়ে সুমনকে বোঝাতে চেয়েছে। সুমন বুঝতে পেরেছে বলেই এই দুই দিন পাশে ছিল। সাথে ছিল।
১ Comment
congratulations