কালো বউ
(ফারজানা ইয়াসমিন)
আমার দুইজন নিজেদের পছন্দে বিয়ে করেছি। দুই পরিবারের কেউ মেনে না নিলেও মানতে বাধ্য হয়েছে। যা হওয়ার হয়ে গেছে। কিছু করার নেই।
বিয়ের কথা জানতে পেরে শশুর আব্বা আমাকে ঢাকায় দেখতে এলেন। দেখে চলেও গেলেন। জানি না তার আমাকে পছন্দ হয়েছে কিনা।
ফোনে রনি (আমার স্বামী) শাশুড়ী মা-র সাথে কথা বলতে দিল। আমাদের বাড়ি যেতে বললেন তিনি।
আমার বাবা এলেন না আমাকে দেখতে।মা ছোট বোনকে নিয়ে চুপচাপ দেখে গেলেন। কেমন আছি আমি। হাজারো চিন্তা নিয়ে মা কিছু না বলে চলে গেল।
যাই হোক বাড়ি গেলাম। বড় ছেলের বউ। ছেলে তাদের এত সুন্দর। বউ কালো! তাদের মনেও কালো মেঘ জমলো। কিন্তু মুখে তখন কিছু বলেনি।
কেন সেদিন কিছু বলেনি আজ খুব ভালো করে বুঝি। সব দায়িত্ব ছেলের।তাই এখন বড় বউ যেন তার দায়িত্ব পালন করে। যা হবার তা হয়েছে।
কালো বউ সমাদরে যা না করলেই নয়।তাই করা হলো। যা আমার প্রাপ্তি তা আর পেলাম না।শাশুড়ীর বউ পছন্দ হয়নি।তাই কিছু দিলেনও না। এটা শুধু আমার বেলায় হয়েছে। অন্য বউরা যথা সময়ে সব পেয়েছে।
রনি নিজের থেকে তার নানির বাড়ি নিয়ে গেল। সেখানে মুরুব্বিরা তিব্র নিন্দা করলো।
বউ এসব কি কেনা জিনিস পড়ে আসছে? কেউ কিছু দেয়নি? তার মানে,বাবা মা কিছু দেয়নি?
আমার শাশুড়ী অবশ্য জানতেন। এমন হবে। উনি পারতেন বড় বউয়ের মুখ রাখতে। শূন্য হাতে বিদায় করেছেন।কালো বউ সাজিয়ে কি হবে?
আমার দেবরের বউরা কিন্তু এসেই সবার উপহার পেয়েছিল। আমি পাইনি। সবার দেওয়া হয়ে যাচ্ছে। ছেলে কবে কি বলে বসে।তাই বাধ্য হয়ে আমাকেও দিল এক জোড়া কানের দুল।
আমার বাচ্চাদের বেলায়ও তাই হয়েছে। তারাও দেরিতে পেয়েছে তাদের পাওনা।কষ্ট বুকে জমা থাকে।
এটা কার কাছে কি জানি না।আমার কাছে মনে হয়েছে অবহেলা করা।বিধাতার দেওয়া রূপের উপর আমার সন্তুষ্টি সব সময় আছে।
বাবা মা কখনো কালো বলেনি।বন্ধু বান্ধব, আত্নীয় স্বজন কখনো কালো বলেনি। সেই আমাকে আমার শাশুড়ী বলেছিল, আমি নাকি বংশের কালো বউ।
এত কালো কোন বউ নেই তার বংশে। এতটা তিক্ততা নিয়ে কথাটা বলেছিল।আজও মনে আছে। আমার ঘরে বসে বলে গেছে। ভুলিনি আমি।
আমার সন্তান আমার মতো রঙ পেয়েছে। আমি মা।পেটে আমি রেখেছি।জন্ম আমি দিয়েছি। অন্য কারো আমার ছেলেকে নিয়ে বাজে কথা বলার অধিকার নেই। আমার কাছে সে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর সন্তান। সে আমার মতো। সে তার মায়ের মত। যাক এ নিয়েও কম শুনিনি।
নিজেকে নিয়ে কথা সহ্য হয়।মা তো সন্তানকে নিয়ে এসব কথা মানতে পারি না।তাই ভুলিনি।
আমার জানা ছিল না। আমার শশুর শাশুড়ী আমাদের বাসায় কোন এক অনুষ্ঠানে আমার বাবা মাকে বলেছিলেন, আপনাদের মেয়ে দেখতে কাজের বুয়ার মতো। আমার ছেলে কি করে যে থাকে। আমার ছেলের কাছে তাকে কি মানায়? আরও অনেক কথা বলে অপমান করেছিল। কয়েক বছর পর শুনেছি সে কথা।
আমি কিন্তু আমার কোন দায়িত্ব পালনে কমতি রাখিনি। আমার যা সাধ্যে কুলায় তা করেছি। তারা আমার গায়ের রঙের জন্য আমার সব কিছু কালো করে দেখেছে।
সবকিছু আমার গায়ের রঙের সাথে মিশে গেছে। কে বলে, এখন যুগ পাল্টে গেছে? সবকিছুই আগের মতোই আছে। এখনো সুন্দর ছেলের কালো বউ হওয়া পাপ।এখনো কালোর আড়ালে সব সুন্দর চাপা পড়ে। এখনো শিক্ষা দীক্ষা সবকিছু বৃথা হয়ে যায়। শুধু রূপের কাছে। এখনো সুন্দরী মেয়েদের কালো ছেলের যোগ্যতা দেখে বিয়ে করা জায়েজ। কিছুই বদলায়নি।
আমি জানি কিছুই বদলাবে না। সবাই সুন্দরের পূজারী। সেটা শুধু রূপের বেলায়।মনের বা গুণের সৌন্দর্য কেউ দেখে না।কারণ তা দেখা যায় না। ক্ষণস্থায়ী এই রূপের বড়াই সবার কাছে দামী।
বাড়ির অন্য সুন্দরী বউদের সাথে তুলনা করে কথা বলা হয়।লজ্জা লাগে। কষ্ট লাগে। নিজের জন্য নয়।তাদের সংকীর্ণতার জন্য। যারা এত বছরেও আমার মনের গভীরের সৌন্দর্য দেখতে পারল না।তাদের কি বলবো?
আসলে কালো মেয়ে ভালোবাসা পেলেও।কালো বউ কখনো মন পায় না। ভালোবাসা তো দূরের কথা। বউয়ের সব ভালো যেন, গায়ের কালো রঙের নিচে চাপা পড়ে যায়।কালো মনটাও যে ভীষণ ভালো হতে পারে। তা তারা কোনদিন মানবে না।
কালো মেয়ের বাবা মায়ের ভোগান্তিও কম না। সব শর্ত মানতে হয়। মেয়ে যদি কালো হয়। নিজের ঘরের ছেলে বা মেয়ে কালো হলে। তাদের সন্তানদের তারা কালো বলতে নারাজ।
আজও আমি কালো।আজও শুনি রনির বউ রনির মতো হয়নি।বাচ্চারাও তার বংশের রঙ পায়নি। রূপ পায়নি। কার বাচ্চা? আমি বলি, আমার বাচ্চা। আমি পেটে রেখেছি। জন্ম দিয়েছি।আমার মতো হবে না তো কার মতো হবে?
রূপ দেখে কি যায় চেনা? কোনটা আসল, আর কোনটা নকল সোনা?
কেউ মনে কষ্ট নিবেন না। আমি কাউকে কষ্ট দিতে লিখিনি। বাস্তবতার একটা চিত্র তুলে ধরলাম। কালে রঙ নিয়ে বিধাতা যদি এত ভালোবেসে আমায় গড়তে পারে।আমি তাকে ভালোবাসে এই রঙে মুগ্ধতা খুঁজে নিব।
২ Comments
congratulations
চমৎকার লেখনী