কারোরই ছিলাম না আমি কোনো দিন
।। জাহানারা বুলা।।
( পর্ব -১)
অনন্যা নরওয়ে ছেড়ে এসেছে প্রায় ছ’বছর। তবুও, তার শরীর মন জুড়ে লেপটে আছে সেখানকার জলবায়ু। মোসেসের পবিত্র অবয়বের আদলে একটি অবয়ব। আর, সেই দেহের উষ্ণ অনুভব।
জীবনের অনেক ঘটে যাওয়া ঘটনাকেই ভুলে গেছে সে, ভুলতে পারছে না যা তা হলো নরওয়ের সেই বাড়ি আর বাড়ির সকাল, দুপুর, রাত। নরওয়ে তার মনের সাদা বোর্ডে কালো মার্কারের দাগের মত স্পষ্ট হয়ে জেগে আছে। এর কারণ, রজত এবং তার বাড়ি। দু’য়ে মিলে যেন এক সৌম্য সুখ রচনা করে দিয়েছিলো অনন্যার মনে।
এই তো আজ ভোরেও, বিছানায় শুয়ে থেকে অনন্যা
ফ্ল্যাশব্যাকে। মনে পড়ে গেলো সেই সকালগুলোর কথা- আড়মোড়া ভেঙে, হাই তুলতে তুলতে একটি ইলেক্ট্রিক কেতলিতে চা চড়ানোর কথা। ঘুম জড়ানো দুটি শরীর একসময় চাঙা হয়ে উঠতো চায়ের চুমুকে চুমুকে, সেই কথা।
বিষয়টি এমন নয় যে অনন্যা খুব ভালো চা বানাতে পারতো। এটা ছিলো অনন্যার এক ধরনের আনন্দ, ছেলেমানুষী আনন্দ – চা বানিয়ে রজতকে বিছানা থেকে টেনে তুলে লিভিং রুমে নিয়ে আসতো অনন্যা । দুই মাগ চা নিয়ে দুজনেই বসতো সেখানে।
লিভিং রুমের স্বচ্ছ কাচের জানালা ভেদ করে দেখা যেতো বেশ চওড়া একটি লেক- “লেক মিয়সা”, মিয়সা’র জলের ঢেউয়ে পিছলে আসা সোনা রঙের রোদ। আকাশটা সেখানে ভীষণ নীল। ডুব দিয়ে আছে যেন লেকের জলে। সেই জল একটি নীল শাড়ী হয়ে ক্রমশই সরু হতে হতে একটি পাকানো দড়িতে রূপ নিত দৃষ্টির দূর সীমানায়। পাহাড়ে ঘেরা “ইয়োভিক (Gjovic)” শহরটি যেন লেক মিয়সাকে গামছায় জল ছেকে মাছ ধরার মত চার দিক থেকে ধরে আছে। লেকের ওপাড়েই সটান দাঁড়িয়ে আছে একটি প্রাচীন গির্জা তার একাকিত্বের নির্জনতা নিয়ে। গির্জার নিঃসঙ্গতার মতই ছিলো রজতের একাকী নিঃসঙ্গ জীবন।
কলকাকলিবিহীন রজতের নেইবরহুড। কখনো দু’চারটি প্রাইভেট গাড়ি চোখে পড়ে আসতে যেতে। সম্ভ্রান্তদের এলাকা। ভদ্র, শব্দহীন মানুষ এবং তাদের ঘর। সেই নির্জনতায় অনন্যা যেন হঠাৎ বৃষ্টির মত ঝমঝম শব্দ করে এসে পড়লো তার বাড়ির আঙ্গিনায়। বাংলাদেশের সোঁদামাটির সুবাস মাখা এক খন্ড সবুজের ছায়া হয়ে আত্মপ্রকাশ করলো নরওয়ের ইয়োভিক( Gjovic) সিটির এই বাড়িতে।
একলা থাকার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিলো রজতের এতোগুলো বছরে। তবুও, কর্পূরের শীতলতা নিয়ে অনন্যার আবির্ভাব রজতের একলা জীবনে প্রাণের সঞ্চার এনে দিলো। আবার, এক আলো ঝলমলে সকাল বেলা কর্পূরের মতই উবে গেলো অনন্যা রঞ্জনের হৃদয়খানি ছিঁড়েখুঁড়ে দিয়ে।
লেকের ওই পাড়ে একান্তে দাঁড়িয়ে থাকা গির্জাটি প্রতি নিয়তই রজতকে মনে করিয়ে দেয় তার এবারের একাকিত্বতাকে। মনে করিয়ে দেয় অনন্যার কাঁচ ভাঙা হাসি এবং ঘর জুড়ে, জীবন জুড়ে তার আধিপত্য। রজত তো একা ভালোই ছিলো। আবার কেন স্বপ্নকে আপন করা, ভাবে রজত।
অনন্যা, রজতের প্রেয়সী হওয়ার পর ঘরের নক্সাই পালটে দিলো। থ্রি-সিটার সোফা যেটা দেয়াল ঘেঁষে বসানো ছিলো তা টেনে নিয়ে এনে রাখলো জানালার কাছে। সোফার সেই ফাঁকা জায়গাটাতে রাখলো ওর ল্যাপ্টপ টেবিল। জানালার পাড়ের বিভিন্ন গাছ গাছালিগুলো রাখলো টেবিলের দুই পাশে। যদিও, এই অদলবদলে ঘরের সৌন্দর্য বেশ কিছুটা হ্রাস পেয়েছে, তবুও
এটাই ঠিক আছে তার কাছে। কারণ, এখানে রজতের কোলে মাথা রেখে সুন্দর একখন্ড পৃথিবী দেখতে পায় সে, যে পৃথিবী কেবল অনন্যা আর রজতের ভালোবাসা রচনার সহায়ক।
প্রেমে দুটি হৃদয় এবং শরীর আপন তো হয়ই, তবে পরিবেশ-প্রকৃতির ইন্ধনও বেশ কিছুটা ভুমিকা রাখে প্রেমিক
প্রেমিকাকে ঘনিষ্ঠ করে তুলতে। তাই তো রাতের আঁধারের গুরুত্ব বেড়ে যায় প্রেমে। প্রকৃতি প্রেমকে ত্বরান্বিত যেমন করতে পারে তেমনি ভরে দিতে পারে বিক্ষিপ্ত বিমর্ষতায়ও। এমন অনেক দিন যায় গোমট প্রকৃতির সাথে ভালোবাসাও হয়ে পড়ে বাক্য এবং কাব্যহীন। সেদিন কেবল দুটি দেহ পাশাপাশি হেঁটে চলে কিছুই ভালো না লাগার মেজাজ নিয়ে।
সন্ধ্যার অন্ধকার নেই ইয়োভিকের (Gjovic) আকাশে। শুধু ইয়োভিক কেন পুরো নরওয়েই আলোর নিচে। রজত ফিরে আসে অফিস থেকে, অনন্যা তার ক্লাস থেকে। তখন চা খাওয়া হয় আর এক দফা। এবার চা বানায় রজত নিজেই। কারণ বিকেল অব্দি চায়ের তেষ্টাতা তার রয়েই যায়। অনন্যাকে খুশি করতে যে চা সকালে খেয়ে বের হয় তা রজতের জন্য মাইল্ড। দ্বিতীয় দফার চা’টা হতে হয় তাই স্ট্রং। ইচ্ছে করলে সে অফিসেই চা খেতে পারে। কিন্তু, চা পানের এই বিকেলটা রজতের কাছে অমুল্য সময়। যাকে বলে কোয়ালিটি টাইম স্পেনড করা।
( পর্ব -২)
একটু পরেই রজত টিভির সামনে গিয়ে বসবে। বিভিন্ন চ্যানেলের নিউজ দেখবে-শুনবে। আর, অনন্যা বসবে তার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কঠিন সব পড়াশোনা নিয়ে। তার পর ডিনার শেষে অনন্যার আবার পড়তে বসা। আর, রজতের শেষ করতে হবে অন্যান্য কাজ যেমন, বিভিন্ন ইমেইলের জবাব দেয়া, অনলাইনে ক্রেডিড কার্ডের বিল পেমেন্ট করা ইত্যাদি। এবং ঘরের কাজও কিছু কিছু। প্রায় মধ্য রাত অব্দি দুজনে দুজনার কাজ নিয়ে ব্যস্ত।
মাঝে মধ্যেই পড়া ছেড়ে উঠে আসে অনন্যা। রজত কি করছে তা দেখে যায়। দু’চার কথা বলে আবার পড়তে চলে যায়। একটানা যে কোনো কাজই ক্লান্তিকর অনন্যার জন্য। মূলত, সকলের জন্যেই। কিন্তু সবাই অনন্যার মত ছটফট করে না। রজতের মাঝে মধ্যে মনে হয়, পাখির মত চঞ্চল আর ফুলের মত নরম এই মেয়েটা ইঞ্জিনিয়ার কেন হবে।“ ইঞ্জিনিয়ার”! শব্দটায় কেমন যেন লোহালক্কড়ের ঝনঝনানি, নাহয় এমোনিয়ার দুর্গন্ধ, কয়লার খনির ভয়াবহতা বা ইলেক্ট্রিক সব তার নিয়ে কনফিউশন,মোটরের ডিজেল ফিজেল, ভোঁভোঁ কাররবার। উফ, ম্যাথস, ফিজিক্স, ক্যামিস্ট্রির মিস্ট্রি একেবারে। এটুকু মাথায় এতো চাপ! ইচ্ছে হয় অনন্যাকে বলে- তুমি সাহিত্য পড় না কেন? তোমার সাথে কবিতার খুব মিল। কোমল প্রেমের কবিতার।
বিকেলের চা খেতেখেতে অনেক গল্প হয় দু’জনার মধ্যে। অনন্যার মাথাটি তখন রজতের কোলে। দৃষ্টি কাচের ওপারে। অনন্যা রজতকে শুধায়,
-একদিন ওই পাহাড়ে যাবি, সোনু? দ্যাখ, কি দারুণ সোনালী ধানের খেত। পাহাড়ের ঢাল থেকে চুড়া অব্দি। কি অসাধারণ!
চায়ের চুমুক শেষে রজত বলে,
-ওটা ধান ক্ষেত না, সোনা। ওখানে গম চাষ হয়।
– ও, রিয়েলি! কী অপুর্ব! মনে হচ্ছে সোনালি সিল্কের চাদর। তার উপর বাতাসের ঢেউ। একদম রিভার অফ গোল্ড, সোনার নদী, তাই না সোনু?
-হ্যাঁ সোনা, একদম তাই।
অনন্যনাকে রজত ভালোবাসে একটি শিশুর মত। যত্ন নেয় মেশ শাবকের মত। কখনো হাত তুলে নেয় হাতে। শুষ্ক রুক্ষ হাত দুটিতে লোশন মেখে দেয়। চুল আচড়ে দেয়, রান্না করে খাওয়ায়, বিছানাটাও সেই পেতে দেয়। অনন্যার জন্য এই বাড়িটাকে যেমন সে অভয় অরণ্য করে দিয়েছে তেমনি তার হৃদয়কে করে দিতে চেয়েছে এক নির্ভরতার আধার। অনন্যা যেন সহজ হতে পারে তার চলায় বলায় সে চেষ্টার ত্রুটি নেই রজতের। রজত মানুষটাই এমন। নির্ভরতার কন্ট্র্যাক্ট সাইন করে তুলে দেয় প্রতিটি সম্পর্কের হাতে।
কখনও কখনও রজত ভাবে -লাভ কি হোলো, কে নির্ভর করলো? স্ত্রীর আমার প্রতি নির্ভরতা, সেতো হারিয়েছে আমি দেশান্তর হতেই। এর পর অনন্যার। তবে, অনন্যা অযৌক্তিক ছিলো না। কিইবা করার ছিলো ওর। তবুও, ভালোবাসা যেটুকু পেয়েছি তা অনন্যারই দেয়া। কি জানি মনে আছে কিনা আমাকে। স্বামীর সংসারে গেলে মেয়েদের মনে থাকে না কিছুই। কদাচিৎ কোনো ঘটনার সাথে অতীত মিলে গেলে মনে পড়ে বড়জোর। এতে ওদের কোনো দোষ নেই। স্বয়ং ঈশ্বরই ওদের মনের গঠনটা এভাবে গড়েছেন, যে পাত্রে ঢালা হয় সে পাত্রেই ফিট। নারীদের ব্যক্তিত্ব তরলই হয়। অথবা, আলোর মত। তাইতো বয়ে চলে হৃদয় থেকে হৃদয়ে ওরা, আলোকিত করে জীবন।
সেদিন কৌতূহলে, অনন্যা জিজ্ঞেস করেছিলো রজতকে – স্যার, আপনি বিয়ে করেননি? আপনার কোনো গার্লফ্রেন্ডও নেই? রজত প্রশ্নের প্রথম অংশের উত্তর না দিয়ে সোজা বলে ফেললো- তুমিই হয়ে যাও আমার গার্লফ্রেন্ড। কি, হবে? রজত তখন রান্নায় ব্যস্ত। পিঁয়াজ কাটতে কাটতেই কথা বলছে। অনন্যা ডাইনিং চেয়ারে পা দোলাচ্ছে আর আপেল খাচ্ছে। অনন্যার চঞ্চল স্বভাবের কারণে ওর প্রশ্ন হয় একাধারে কয়েকটি। কিন্তু, উত্তর কোনটার আসে তা সে ভ্রুক্ষেপ করে না। বরং, এর পর আরো প্রশ্ন সে করতেই থাকে। অনন্যা রজতের প্রস্তাব শুনে হেসে দিয়ে বলে, কিন্তু, আমি তো আপনার অনেক ছোট! রজত বলে, তাতে কি, আমিতো বড়। একজন বড় হলেই তো হয়। কথাটা শুনে অনন্যা ভীষণ মজা পায়। হিহি করে হাসে। রজত আবার বলে- আমার তো বন্ধুও নেই। অন্তত তুমি আমার বন্ধু হতে পারো। বন্ধু হলেই আমারা সমবয়সী হয়ে যাবো। বন্ধুত্বে ছোট বড় নেই। তাই কিনা? অনন্যা শুধায়, কি করে? এই যেমন বন্ধুরা এক সাথে ড্রিঙ্ক করে, এক সাথে সিগারেট খায়, এক সাথে মজা করে, পার্টি করে, সবচেয়ে যেটা সেটা হচ্ছে উভয়েই তুমি বা তুই বলে সম্বোধন করে। আমি আপনাকে তুমি বলবো? কেন নয়? বন্ধু ভাবলে বলবে। তুমি আমাকে তুই ও বলতে পারো। ঠিক আছে, তুমি বরং তুই করে বলো। আমিও তুই, তুমিও তুই। তাহলে দুজনেরই এক হোলো। আমি তুমি থেকে তুই আর তুমি আপনি থেকে তুই। আর একটি কথা, তুমি আমাকে আর স্যার ডাকবে না। কি ডাকবো তাহলে, তুমি আমাকে আমার নাম ধরে ডাকবে। অনন্যা একবার প্র্যাক্টিস করে “রজত”। তার পর আবার হাসে। তবে, মন্দ লাগে না তার। রাজি হয়ে যায় সম্বোধন পালটে বন্ধু হয়ে যেতে এবং বলে, আসলে সম্বোধন কোনো ব্যাপার না। ইংলিশে তো এত কিছু নেইও। শুধু “ইউ” ছাড়া।
অনন্যা যখন হাসে তখন তার হাসিটি চোখের তারায় এসে প্রতিফলিত হয়। তাই দেখে রজত মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে। রজতের জগত যেন হেসে ওঠে ওই মুহূর্তে। রজতের হৃদয় অস্থির হয়। সমস্ত শরীর শিরশির করে। মনে হয় শক্ত করে আলিঙ্গন করে মেয়েটাকে। এবং বলতে ইচ্ছে হয় –“ ইসকা রোনা নেহি কিউ তুমনে কিয়া দিল বারবাদ, ইসকা গাম হ্যায় কে বহত দের মে বারবাদ কিয়া”
পর্ব -৩
বন্ধুত্ব পুরনো হলেও জড়তা কাটেনি অনন্যার । তবে রজত বেশ স্বচ্ছন্দ। কথা বলতে বলতে হাত ধরে ফেলা, পিঠে হাত রাখা , কাঁধে হাত রাখা হয়েই যায়। মনের অজান্তেই হয়ে যায়। ভালো বা মন্দ কোনো ইন্টেনশনই কাজ করে না তার। অনন্যা বড়জোর মাঝে মধ্যে হাই ফাইভ, ডুড ইত্যাদি শব্দগুলো ব্যববাহার করে থাকে। কিন্তু, রজতের স্পর্শ গুলো অনন্যাকে একটু অন্য রকম অনুভব দেয়। কিছু বলে না সে। ভালো লাগে। তাই চুপচাপই থাকে এই ব্যাপারে।
নরওয়েতে তখন লং উইকেন্ড। তবু, দু’জনই বাড়িতে। একদিন বাইরে ডিনার আর মুভি দেখে অপরাধ বোধে ভুগে আর বাইরে যেতে চায় না অনন্যা। রজত অনন্যার মতের বিরুদ্ধে যায় না কখনোই। তাছাড়া রজত জানে, অনেক পড়া জমে আছে অনন্যার। সেগুলো শেষ করারই তাগিদ মনের মধ্যে ওর। মিডটার্মও খুব কাছে। তাই, আর বাইরে যাবে না বলেই সাব্যস্ত ক’রলো দুজনে মিলে।
অনন্যা, রজতকে বললো খিচুড়ি আর মাটন ভুনা খেতে ইচ্ছে করছে। রজত জো হুকুম বলে রান্না ঘরে যেতে উদ্যত। অনন্যা বললো, আমি হেল্প করে দিচ্ছি। অনন্যা রান্না তেমন জানে না। তবে, টুকটাক সাহায্য সে করতে পারে।
অনন্যা বাড়ি ভাড়া নেয়ার সময়ই বলেছিলো ঘরের সাথে সে খাবারটা চায়। রজত ভাবলো আমি তো ঘরের খাবারই খাই, এতটুকু একটা মেয়ে সে খেলোই নাহয় আমার সাথে। অনন্যার পড়ার চাপ বেশী। তাই রান্না করে খাওয়া তার জন্য বিরাট সমস্যা। বাইরে খেলে খরচ অনেক বেশী। ডর্মের ওই পাঁচ মিশাল মানুষের সাথে ভালো লাগেনি তার। খাবারও মুখে রোচে নি। তাই সে হন্যে হয়ে খুঁজছিলো কোনো একটি বাঙালি পরিবার। বা, কোনো বাঙালি যার সাথে শেয়ার করে থাকা যায়।
কিচেনের স্পেসটা একটু ছোটো। বাকিটা লিভিং, বেশ বড়। ওইটুকু জায়গা বলে নয়। দু’জনে কাজ করতে গেলে এটা সেটা দেয়া নেয়ায় এদিক সেদিক স্পর্শ লেগেই যায়। যেতেই পারে। সেই ছোটছোট স্পর্শগুলো অনন্যার শরীরে বিরাট বিরাট অনুভবের জানান দেয়। অনুভুবগুলো একদম নতুন। কেমন এক ভালো লাগার ঝিম ধরা আনন্দ। মদ খেয়েও মানুষ ঝিম মেরে যায়। তবুও, কিছুটা অপ্রকৃতস্ত হয়ে যায়। নিজেকে নিজের জায়গায় হাতড়ে পাওয়া যায় না। তেমনিই আজ অনন্যা নিজেকে খুঁজে পাচ্ছে না তার মধ্যে। রজত যেন টানছে তাকে। এমন টলমল অবস্থায় রজতকেই জাপটে ধরে স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে চাচ্ছে অনন্যা। অশান্ত শরীরের উন্মদনায় তাই রজতের ঠোঁটের কাছে ঠোঁট নিয়ে বলতে থাকে- কিস মি। প্লিজ কিস মি। আই জাস্ট ওয়ান্ট ইউ এন্ড আই নিড ইউ টু। ফিসফিস করে বলতে লাগলো- স্টপ কুকিং, স্টপ কুকিং, রজত ……….
রজত তো সেই কবে থেকেই আশা করে আছে অনন্যাকে ভালোবাসতে। আজ ভালবাসা যখন বুকের উপর আছড়ে পড়লো তাহলে তা ফেরায় কি করে? এ তো শাপে বর হয়ে ধারা বইয়ে দিলো রজতের দেহটিতে।
সূর্য তখনও লুকানো। প্রায় দুমাস নিয়ন এবং এলইডির আলোতে পথ চলা। জনমানবের ছায়াকায়া কোথায় তা কে জানে। রাস্তায় মানুষ হাঁটে না। এমন কি নেইবরহুডের কুকুরগুলোও যার যার মনিবের ঘরে। শুধু গাড়িগুলো স্পিড মেইন্টেন করে যে যার গন্তব্যে চলছে। তার ভেতরে বসে আছে যারা তারা মানুষ না রোবোট কে দেখে। শুধুই তুষারপাত, শুধুই বরফবৃষ্টি। বাইরে তাকালে প্রাণ হুহু করে। দেশের কথা, বাড়ির কথা আরো কত স্মৃতি মনে হয়ে যায় হৃদয়কে ঘাবড়ে দিতে, উশকে দিতে। কেউ একজন, খুব কাছের একজনকে ভীষণ প্রয়োজন তখন। মা-বাবা, ভাই-বোন বা কোনো আপন, খুব আপন কেউ থাকলে ভালো হয়। রজতের তো আপন এখন অনন্যা। অনন্যারও রজত। আজ তাই বয়সের সংখ্যা গুণতি নয়, দুটি ঝরা পাতার মৃদু বাতাসে উড়ে উড়ে শুধু কাছে আসা।
রজত অনন্যার প্রথম ভালোবাসা। অনন্যার বয়স তখন কেবলই উনিশ-বিশ। রজত সংসার বিবাগী মধ্যবয়সী পুরুষ। স্ত্রী সন্তান ছেড়ে পলাতক এক আসামী। দেশ দ্রোহিতার আরোপ তার অদৃষ্টে। বিয়ে করে মাত্র তিন বছর সংসার করেছে। এর পর সব ছেড়ে সে নরওয়েতে। অনন্যা কিছুই জানে না এসবের। রজত বলেনি কোনোদিন। রজত পুরোনো ঘা খুঁটে রক্তাক্ত হতে চায় না। তাছাড়া, রজত তো একাই। তাই, ভাবে কি হবে আর ওসব বলে বা ভেবে। যে তাকে পাচ্ছে সে পুরোটাই তো পাচ্ছে। ভাগাভাগি তো নেই কিছুরই।
নরওয়ের জীবন যাপনে অভ্যস্ত তখন রজত। চাকরি, ঘরের কাজ, বাইরের কাজ এক হাতেই করে। এসব প্র্যাকটিসে কর্ম চঞ্চল সে সর্বক্ষণ। তাই, জীবনী শক্তির অভাব নেই তার। কর্মেই মানুষের জীবন, আলস্যে জীবন নাশ, জানে তা রজত। যেটুকু ঘাটতি গেছে বিয়ের তিন বছরে আর দেশের মাটিতে নানান ঝামেলায়, নরওয়ের জলবায়ু তার চেয়ে দ্বিগুনই তাকে দিয়েছে। উনিশ-বিশের অনন্যাকে ভালোবাসতে তাই কোনো সমস্যা হয় না রজতের। তা ছাড়া মেজাজে, স্বভাবে সে অনন্যার কাছাকাছিই হয়ে যেতে পেরেছে। অনন্যার আগে আর কোনো মেয়ে বন্ধুও ছিলো না তার। ইচ্ছে হয়নি রজতের। বিষিয়ে ওঠা জীবনে আনন্দের ধারা বইতে দেয়নি সে। এটাই প্রায়শ্চিত্তের পথ তার স্ত্রীকে একা করে দেয়ার। কিন্তু, পারলো কই। অনন্যার কাছে সব কাঠিন্যই তো জল হয়ে গেলো। এমনি হয়। এটা জীবনের নিয়ম, নিয়তির খেলা। অনন্যার ক্লাসে, ক্যাম্পাসে তো কত সুদর্শন যুবক, নানা দেশের। নিয়তিই যদি না হবে অনন্যা সব আন দেখা করে রজতকেই ভালো বাসবে কেন। মূলত হৃদয় এবং রক্ত কনিকার vibes বা অনুরণনটাই আসল। তন্ত্রীর এই যে কম্পন তার টিউনিং ঠিক না হলে ভালবাসা হয় না। রজত আর অনন্যার সেই টিউনিংটাই ছিল অসাধারণ। তাই, বয়সের ধার ধারেনি এই প্রেম।
অনন্যা তখন ইয়োভিক ( Gjovik ) এর NTNU: Norwegian University of Science and Technology এর ছাত্রি। বোচা বোচা মিষ্টি চেহারা অনন্যার। গায়ের রং বেশ ফরসা। চকচকে সিল্কি চুল। পিঠ পর্যন্ত। উঁচু করে পনিটেল বাঁধে ঘরে। বাইরে গেলে ছেড়ে দেয় পিঠের উপর। চুলগুলো সোনালী রং দিয়ে হাইলাইট করা। বাঙালিদের মত লাগে না খুব বেশী। তবে, সাদাদের মতও না। এক মিশ্র সুন্দর অনন্যা।
পেইং গেস্ট হিসেবে উঠেছিলো রজতের বাড়িতে সে। দুটো একা জীবনের দ্বিপাক্ষিক পেমেন্টে পেইং কেটে গেলো, শুধু গেস্ট হয়েই থেকে গেলো এতগুলো বছর। কিন্তু, এখন যে যেতেই হবে। বাড়ি থেকে ডাক এসেছে। বিয়ের পিড়ি অপেক্ষা করছে অনন্যার জন্যে। রজত তাকে বিয়ে করতে পারবে না। কারণ, তার স্ত্রীর সাথে দূরত্ব হলেও ডিভোর্স হয়নি। একথা রজত বলতে পারছে না অনন্যাকে। ইচ্ছে করলেই বলতে পারে এবং ডিভোর্স করতেও পারে। কিন্তু, তার সমস্ত ইতিহাস খুঁড়ে তুলতে সে চাচ্ছে না। এভাবেই বা কত দিন? অনন্যনা ওভারস্টেও করতে পারবে না। তাহলে সে ভবিষ্যতে আসতে চাইলেও আসতে পারবে না। এদিকে চাকরিও অনিশ্চিত। বেশ কিছু জায়গায় এপ্লাই করেছিলো সে। কিন্তু, উত্তর কিছুই আসেনি। ওয়ার্ক পারমিট, ভিসা সবই শেষের পথে। অনন্যা এক স্নায়বিক চাপের মুখে। সিদ্ধান্ত নেয়ার বয়সও তার হয়নি বাঙালি মেয়ে হিসেবে। অগত্যা দেশে ফিরতেই হবে। অনন্যা ইচ্ছে করলে রজতকে অভিযুক্ত করতে পারতো। কিন্তু, কিছুই বলে না সে। অনন্যা রজতের খুব কাছে থাকতে চায়। কিন্তু, রজতের কিছু তো একটা সমস্যা আছে, নাহয় রজত তাকে যেতে দিতই না এই বিশ্বাস তার আছে। তাছাড়া, ভালোবাসা তো চুক্তি বদ্ধ ভাবে হয় না, ভালোবাসা হতে হয় আনকন্ডিশনাল, অনন্যা ভাবে। তবে, রজতের জন্য অনন্যা জীবনভর অপেক্ষা করতে রাজি আছে। অনন্যা এও জানে, রজতও ওর অপেক্ষায়ই জীবন কাটিয়ে দেবে। আর কাউকেই তার জীবনে আসতে দিবে না আর।
পর্ব – ৪
যেদিন অনন্যার চলে যাওয়া নিশ্চিত হলো সেদিন থেকে রজতের হৃদয় রক্ত ক্ষত । অত্যন্ত বিষাক্ত একটি সাপ যেন দংশন করে যাচ্ছে তাকে থেকে থেকেই। কী যে এক বিষের ছোবল! কুঁকড়ে ওঠে মন। তবুও, সম্পূর্ণ স্বাভাবিক দেখাচ্ছে রজতকে।
স্নান করে বেরিয়ে অনন্যার খবর নিচ্ছে, সে তৈরী কিনা। ওয়াশ রুম থেকে বের হওয়া সদ্য স্নাত রজতের উদম শরীর বেয়ে তখনও দু’চার ফোটা জল গড়িয়ে পড়ছে। পদ্ম পাতায় শিশির যেমন। মাথা ভরা চুলগুলো মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলো রজত। বুকের কালো পশমগুলো ফর্সা দেহটিকে আরো স্পষ্ট করে তুলেছে। রজতের এমন সৌন্দর্য এর আগে কখনই যেন দেখেনি অনন্যা। শরীর দিয়ে যেন আলোর আভা বেরিয়ে আসছে। অনন্যা দৌড়ে সামনে আসে, গিভ মি এ হাগ- বলে ব্যতিব্যস্ত হয়ে জড়িয়ে ধরে রজতকে। রজতের বুকে অনন্যার মুখটি যে কোথায় রাখবে বুঝতে পারছে না অনন্যা। রজত যদি নরম মাটি হতো অনন্যা উট পাখি হয়ে লুকিয়ে রাখতো মুখটি তার।
সাবানের সুগন্ধ, জলের শীতলতায় ছেয়ে আছে রজতের শরীর। অনন্যার অনন্ত ভালোলাগার এই আশ্রয়টি ছেড়ে আজ চলে যেতে হচ্ছে তাকে। চুপচাপ আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে রইলো বেশ কিছুটা সময় অনন্যা। রজত পাথরের মত শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে কেবল বললো, ছাড় সোনা, দেরী হয়ে যাচ্ছে।
জীবনের কাছে রজতের অনেক অভিমান জমা হয়ে আছে। তাই, এবারও নিশ্চুপ সে। কতবার হৃদয় ভাঙতে পারে তাই শুধু গুনে রাখছে রজত। রজত একবারও যদি অনন্যাকে থেকে যেতে বলতো অনন্যা থেকে যেতো। কিন্তু, বললো না। কি করে পারবে এমন অনিশ্চয়তা দিয়ে অনন্যাকে বেঁধে রাখতে; যদিও, রজতের ভালোবাসার গভীরতা মাটি ভেদ করে জল স্পর্শ করেছে।
রজত হয়তো অনন্যাকে সব কিছু গোপন করেও বিয়ে করতে পারতো। কিন্তু, এদেশের নাগরিকত্ব নেয়ার সময় সে যে বিবাহিত এবং এক সন্তানের পিতা সে কথাটি সে ডিক্লেয়ার করেছিলো। কারণ, রজত চেয়েছিলো পায়ের নিচের মাটি শক্ত হলেই স্ত্রী পুত্রকে নিয়ে আসবে তার কাছে।
রজতের মর্মবেদনা হচ্ছে। ভীষণ অসহায় বোধ করছে সে। রজত ভেবেছিলো অনন্যার চাকরী হয়ে যাবে। তখন এমনিতেই তারা একসাথে থাকতে পারবে। কে জিজ্ঞেস করবে, কি? রজতের শহরে কোনো বাঙালী নেই। আর, স্থানীয় যারা তারা এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। সিঁথিতে সিঁদুর, তা অনন্যা চাইলেই পরতে পারতো। প্রজাপত্য বা গান্ধর্ব বিয়েও করা যেত। কিন্তু কিছুই করা গেলো না। অপরাধ বোধ ছাড়া আর কিছুই তার হাতে নেই তখন।
অনন্যা দেশে ফিরলেও বিয়ে করলো না। পরিবারের ডাকে এবং অচিরেই ভিসা ফুরিয়ে যাবে বলে সে চলে আসতে বাধ্য হলেও, রজতের প্রতিমুহূর্তের ভালোবাসার অনুভব মুছে ফেলতে পারলো না সে।
রজতের দৃঢ় বিশ্বাস, অনন্যার বিয়ে করতেই হবে। ওর বয়স অল্প। বাবা-মা ওকে কনভিন্স করেই ফেলবে। নাহ, ও বিয়ে করুক। সুখে থাক। আমিই বরং বিদেয় হই ওর জীবন থেকে। নাহয়, আমাকে পাওয়ার অদম্য চেষ্টায় ওর ক্যারিয়ার, সংসার সব নষ্ট হয়ে যাবে। সেই থেকেই দুজনের যোগাযোগ বন্ধ।
অনন্যা, ফোন করেছে, মেইল করেছে। কিন্তু, কোনো ভাবেই আর রজতকে পায়নি। হারিয়ে যাওয়া মানুষ খুঁজে পাওয়া যায়, যে নিজেই গা ঢাকা দেয় তাকে পাওয়া কষ্ট। ভীষণ চেষ্টা সাপেক্ষ। যা অনন্যার দ্বারা সম্ভব হয়নি আর। তবুও অনন্যা বিশ্বাসে অনড়। রজতকে সে পাবেই। এসব কথায় অনন্যার বাবা-মা সন্ত্রস্ত। তারা ভাবে, ব্যক্তিত্বে ভাঙন ধরেছে অনন্যার। অনেক দিন বলেছে মনোরগ বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে। একথা শুনলেই অনন্যার রাগ উঠে যায়। বিরক্ত হয়। অপমান বোধ করে। বাবা-মা তার ভালোবাসাকে অবমূল্যায়ন করছে ভেবে দূরে সরে যায় তাদের কাছ থেকে সে।
চাকরি পেয়েই একটি ফ্ল্যাটে উঠে যায় অনন্যা। বাবা-মাকে বলে যায়, তোমাদের সাথে থাকলে আমি পাগল হয়ে যাবো, বিয়ে ছাড়া কিছুই ভাবতে পারছো না তোমরা।
ছুটির দিন। অসাড় মন নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রজত। মনে হচ্ছে যেন দূরের কোনো দৃশ্যে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ। মূলতঃ দিগন্ত ছাড়িয়ে অদৃশ্য আলোকে চোখ মেলে আছে রজত। কোনো এক ভাবের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে সে। দেয়াল ঘড়িটি বেজে উঠলো তখনই ঢং ঢং…। ভাবাবিষ্ট রজতের সম্বিত ফিরে এলো। পলক নড়তেই হঠাত দৃষ্টি আটকে গেলো সেই প্রাচীন গির্জাটির চূড়ায়। আজ যেন এর নতুন একটি অর্থ খুঁজে পেলো সে। গির্জাটি যেন রজতকে বলছে- এবার ফিরে যাও, আমার মত একাকিত্বের নিরবধি কাল হওয়ার আগে চলে যাও রজত। অনেক হারিয়েছো, আর হারিও না।
রজতের মন উতল হলো। ভাবলো, সে যাবে। এখন সরকার বদল হয়েছে। দেশে যওয়ার বাধা কি তার। কিন্তু, কার কাছে যাবে। স্ত্রী-পুত্র নাকি অনন্যা। অনন্যা নিশ্চই এত দিনে সম্পুর্ণ গৃহস্থালি সামলাচ্ছে। নিজের স্ত্রী কি গ্রহণ করবে সহজে। ছেলে বড় হয়েছে। তাকে কি বাবা বলে ডাকবে? ভাবতে ভাবতে দেশে আসার তাগিদটা প্রদীপের শেষ আলোর মত জ্বলে উঠে পরক্ষণেই আবার দপ করে নিভে গেলো বুকের ভেতরে।
আরো দুটি বছর গেলো। কিন্তু, রজত এখনও বর্তমান হয়ে আছে অনন্যার মনে। পরিণত বয়স এখন অনন্যার। বুদ্ধিশুদ্ধি পাকা হলেও শরীরের কাঠমোটা ঠিক রাখতে পারেনি সে। ঢাকায় যে পরিমান রেস্টুরেন্ট আর ফাস্টফুডের দোকান হয়েছে তাতে শরীর ঠিক রাখা দায়। অনন্যা রান্নাবান্না শেখার পরও বাইরের খাবারের প্রতিই ঝুকে গেছে বেশী। এটা জীবনের প্রয়োজনে জীবন পালটায় সেই ব্যাপার না। কেমন যেন অলস হয়ে গেছে ও। রান্না করতে ওর ভালোই লাগে না। কলিগদের সাথে হরহামেশাই বাইরে খেয়ে বেড়ায়। দাওয়াত তো আছেই। তাই বেশ খানিকটা ওজন বেড়েছে তার। তা ছাড়া প্রেম যদি কাছাকাছি না থাকে নারীপুরুষ কেউই সুন্দর থাকে না। সেটা স্বমী-স্ত্রীর প্রেম হোক বা বিবাহপূর্ব প্রেম। তবে, ইদানিং – অনন্যা মোটা হয়েছো, অনন্যা মোটা হয়েছিস শুনতে শুনতে এখন পার্কে হাঁটতে যায় সে। প্রায় রোজদিনই অফিস থেকে ফিরে হাঁটতে চলে যায় জগার্স পার্কে।
হাঁটে বেশ দ্রুতই অনন্যা। কর্ণপাতহীন, বাধাহীন হাঁটছে সে। হঠাৎই কেউ একজন পথ আগলে দাঁড়াল। বিরক্ত হলো অনন্যা। উলটো দিক থেকে তো হাঁটার নিয়ম নেই। কোনো প্রশ্ন করার আগেই অনন্যাকে ডাক দিলো সেই আগন্তুক – সোনা।
রজতকে বৃদ্ধই বলা চলে এখন। একা জীবনের যে ঝড় তাতে অনেকটাই ক্ষয় প্রাপ্ত তার জীবন। অনন্যা চলে আসার কিছুদিনের মধ্যেই একটা হার্ট এটাক হয়ে যায় রজতের। প্রচন্ড বেদনাহত হৃদয়টি ডাক্তারের হাতে যেয়ে উন্মুক্ত। ওপেনহার্ট একেবারে। এর পর থেকে রেস্ট্রিকটেড জীবন। এ্যালকহল বন্ধ। খাওয়া দাওয়া সাদামাটা। বেশ শুকিয়েছে রজত। লম্বায়ও যেন কিছুটা টান ধরেছে।
অনন্যা চকমে ওঠে। রজতকে দেখে চিনতে পারে না। মাত্র ৭-৮ বছরে মানুষের অবয়ব এতোটাই পালটে যায়? রজত পেছন থেকেই চেনে অনন্যনাকে। অনন্যার হাঁটার ছন্দটা সেই কিশোরী কালের মতই। পরিনত অনন্যার অনেক কিছুই বদলেছে। সারা দেহের মাংস বেড়েছে, ঠোঁট দুটো আরো পুরু হয়েছে, স্তন জোড়া স্পোর্টস ব্রার ভেতর থেকে উপচে উঠে আসতে চাইছে। চুল গুলো আগের চেয়েও রেশমের ভাব ধরেছে বেশী। পেছনের পনিটেলটি ডান বাম করছে অনন্যার স্টেপিংয়ের দোলায় দোলায়। ল্যাগিংসের ভেতর পশ্চাৎদেশ দুলেদুলে উঠছে স্পষ্ট হয়ে। রজত ভাবছে, বাংলাদেশের বেশ উন্নতি হয়েছে! আজকাল খোলা পার্কে এমন সংক্ষিপ্ত কাপড় পরে অনন্যা হেঁটে বেড়াচ্ছে! অনন্যার সাথে হেঁটে পারবে না বলে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো রজত। এই পথেই তো ঘুরে আসবে। তখন কথা বলবে, ভাবলো সে।
রজতের হাতে লাঠি, মুখ ভরা দাড়ি। চুল সাদা। শুকিয়ে কেমন ঠকঠকা হয়ে গেছে মচমচা কাঠের মত। চামড়ার নিচে চর্বি নেই, তাই কুঁচকে গেছে বেশ। রক্ত বাহী নালীগুলো নীল হয়ে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। চোখের নিচে পকেট ঝুলে আছে, একটু যেন কুঁজোও হয়ে গেছে। শুধু ফর্সা গায়ের রঙটা আগের মতই আছে তার।
কিছুক্ষণ স্তম্ভিত থেকে অনন্যা জাপটে ধরে রজতকে। রজত আশা করেনি এতটা। হাঁটার ট্র্যাক ছেড়ে দুজনে পুকুর পাড়ের বেঞ্চিতে গিয়ে বসে। অনন্যার খুশী যেন বাঁধ ভাংছে। একদম জড়তা নেই ওর। পাশে বসে হাতের মধ্যে হাত গেঁথে দিয়েছে অনন্যা। বারবার বলছে- আমি বলেছিলাম আমরাই ঘর বাঁধবো। দেখলি তো আমাকে ছাড়া যে থাকতে পারলি না তুই। কিন্তু, এখানে আমি আছি তা তুই কি করে জানলি?
জানিনি। এটা কাকতালীয়। আমকেও ডাক্তার খোলা হাওয়ায় হাঁটতে বলেছে। তাই একজন এই পার্কের কথা বলায় আমি উবার নিয়ে চলে এলাম।
রজত শুধু অনন্যার খুশি দেখে। আর বলে, অনেক কথা জমে আছে সোনা। ভেবেছিলাম কোনো দিনই বলতে হবে না। আসলে অনেক আগেই বলা উচিৎ ছিলো। সেদিন তুই বুঝতে পারতিস না আমার সকল কথা। এখন তুই অনেক বড় হয়েছিস। আজ তোকে সব বলবো। এর পর রজত অনন্যাকে সব খুলে বলে –
রজত আর্মি অফিসার ছিলো। একটা কু করার পরিকল্পনা করেছিলো কয়েকজন অফিসার। তা জানাজানি হতেই তারা সকলে দেশ ত্যাগ করে। তার পর অনেক স্ট্রাগল। তার স্ত্রী এখনও বর্তমান, তার ছেলে আছে এবং সে বিয়েও করেছে। স্ত্রী, পুত্রের অসাধারণ ভালোবাসার কথা, তাকে স্বাগত জানানোর কথা। সব। শুধু বলছেনা অনন্যার প্রতি তার ভালোবাসার কথা।
রজত ভাবে, অনন্যার কি এমন বয়স। এখনো সামনে ওর উজ্জ্বল জীবন। আমিতো প্রায় ফুরিয়েই গেছি। ওকে আর দ্বিধাদ্বন্দে নাই রাখি। বিয়ে যদি জীবনে ও নাও করে, অন্তত আমাকে ওর গলোগ্রহ করে রাখতে হবে না। তা ছাড়া এই বৃদ্ধ স্ত্রীকেও তালাকের কাগজে সই করাতে চাই না। সেওতো কম কষ্ট ভোগ করেনি এতগুলো বছরে। তার চেয়ে যে কটা দিন বেঁচে থাকে শাঁখা সিঁদুর নিয়েই বেঁচে থাক। আর কষ্ট নাই দিই তাকে।
কিন্তু, অনন্যা ভালোবাসে। ঠিক আগের মত করেই ভালোবাসে। মূলতঃ অনন্যা চায় রজত তার কাছেই থাকুক। অনন্যা একবারও ভাবে না রজতের বয়স, শরীর বা সৌন্দর্যের কথা। ভালোবাসা সর্বক্ষণ দেহ নির্ভর হবে তা কেন। ওর ভাবনা, রজত তারই জীবনভর। ছিলো। আছে। এটাই অমোঘ সত্য। কারণ, রজতের সাথে সংসার করলেও সেতো আজকের মতই দেখতে থাকতো, এমনই লাঠি থাকতো হাতে, সব এমনই। অথবা, আর একটু যুবা। তাহলে শুধু মাঝের বছর গুলো তারা একসাথে না থাকায় সব পালটে কেন যাবে। কিন্তু, রজত সে ভাবে কথা বললো না তার সাথে। রজত যেন অনন্যার জন্য আসেইনি এমনই একটা ইঙ্গিত দিলো তার কথায়। কারণ, এতেই অনন্যার মঙ্গল বলে মনে করে সে।
( শেষ পর্ব / ৫)
পলি মাটির মত উর্বর হৃদয়ে ভালোবাসার যে বীজ বুনেছিলো অনন্যা, তা যে খানিক পরেই বানভাসি হয়ে যাবে, ভাবেনি সে। রজতের সাথে পার্কে বসে থেকে বারবার যে খুশির চমক ঝিকিয়ে উঠছিলো চোখে-মুখে-কথায়-অঙ্গ ভঙ্গিতে এখন তা আর নেই।
এবারও প্রতিবাদ করলো না অনন্যা। বাবা-মায়ের বাইরে আর কারো সাথেই সোচ্চার নয় সে।
রজত বিবাহিত, এই কথাটা কেন গোপন করলো সেদিন। কম বয়স ছিলো তাতে কি। কম বয়সেই যে ভালবাসা বুঝেছিলাম। তাহলে সব কথা কেন গোপন রইলো। কেনই বা রজত আজ ফিরে এলো। না, না রজত তো ফিরে আসেনি। আমার সাথে দেখা করতেও আসেনি। আমার ফোন নম্বর, ইমেইল এড্রেস সবই ছিল ওর কাছে। আজ প্রায় মাস কাছিয়েছে রজত ঢাকায়। অথচ, আমি জানতেই পারলাম না! জানতে দিল না! আমার সাথে রজতের দেখা হওয়াটা তো কাকতালীয় ছিলো। তার মানে ও চলে যেত আমাকে বেখবর রেখেই! কী আশ্চর্য, একেবারে লোমহর্ষক গল্পের মত। তাহলে কি পেলাম আমি। তার চেয়ে আশাটাই বেঁচে থাকতো যদি, তাইতো বেশ ছিলো। এখন যে আমি দেউলিয়া হয়ে গেলাম।
তবুও রজতকে ভুলতে পারবো না আমি। রজতের স্ত্রী দীর্ঘকাল পর, জীবন সায়াহ্নে এসেও যদি রজতকে পেতে পারে, আমি কেন নই। রজত তার স্ত্রী’র সাথে ছিলো মাত্র তিন বছর। আমি কি তারচেয়ে বেশী ছাড়া কম ছিলাম ওর সাথে। সে যদি বিবাহিতা স্ত্রী হয়ে থাকে আমিও তো রজতের বিবাহিতাই। শুধু সিঁদুর পরিনি বলে, শুধু আমার শরীর থেকে রজতের কোনো সন্তান জন্মায়নি বলে আমি আজ কেউ নই? রজতের স্ত্রী তো রজতকে একলা করে দিয়েছিলো। অসহায় করে দিয়েছিলো। আজ তাহলে তার অধিকার আমার চেয়ে বেশি কি করে হয়, ভবতে ভাবতে অনন্যার চোখে বন্যা বয়।
এতদিনের চাপা কষ্ট যা পাথর হয়ে বুকের তলায় ডুবে ছিলো আজ তা বেদনার উত্তাপে জল হয়ে বইতে লাগলো দু’চোখের পাড় ভেঙে। ঘুম নেই অনন্যার। কান্নার জল ভাসিয়ে নিয়ে গেছে সব ঘুম। নিদ্রিত রাত, শব্দহীন। অনন্যার হৃদয় উৎসারিত সংলাপ বিলাপ হয়ে ঘুরছে দেয়াল থেকে দেয়ালে। বুক ফাটা আর্তনাদ অনন্যার– সোনু, আমি তোর জন্যে আজও একা। কোনো কিশলয় মন, উন্মত্ত শরীর কিছুই আমাকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। মুছে দিতে পারেনি তোর সুবাস আমার বুকের ভাঁজে যা আজও জীবিত। তুই যদি পৃথিবী ছেড়েও যাস তোর চিতার ছাই আঁচলে বেঁধে জীবন কাটিয়ে দেবো। তবু,অন্য কাউকে ভালবাসতে পারবো না।
ঘুম যেন আজ দিশেহারা। অনন্যা বা রজত কারোর চোখেই ঘুম নেই। দু’জনকে বঞ্চিত করে সব ঘুম রজতের স্ত্রী প্রতীমার চোখে ভর করে আছে। রজত শুয়ে আছে স্ত্রীর পাশেই। রজতের বুকের উপর প্রতিমার হাত। রজত আসার পর এমনই ঘুম তার- মস্তিষ্ক শরীর- সব নিথর হয়ে পড়ে।
পাশের ঘরটাতে রজতের ছেলে আর তার নববিবাহিতা স্ত্রী। রজতের মনে হচ্ছে ওরাও ঘুমোয়নি। হয়তো ওরা রজতকে নিয়েই কথা বলছে। কি বলছে, বউ’মা আমাকে কি ভাবছে। ছেলেটা আমার জন্য স্ত্রীর কাছে হেয় হচ্ছে না তো। এমন অনেক রকম ভাবনা এখন রজতের মনে। ভাবনা অনন্যাকে নিয়েও, কি করছে অনন্যা। কি ভাবছে। অনন্যার চোখে আমি হয়তো বাজে মানুষ হয়ে গেলাম। আবার ভাবে, হলামই নাহয়। তবুও ও নিজেকে গুছিয়ে নিক। আমার সাথে ওর কোনো ভবিষ্যৎ নেই। প্রতীমাকে ডিভোর্সও আমি দিতে পারবো না। এ হয় না। এই বয়সে এতো বড় অপমান আমি তাকে করতে পারি না। যদিও প্রতীমাকে আমি আর ভালোবাসি না। ভালোবাসি না অনন্যাকে পাওয়ার পরে নয়। বরং ওকে ভালোবাসি না বলেই অনন্যাকে ভালোবাসাটা সহজ হয়েছিলো। তা ছাড়া ছেলের কাছেই বা কি জবাব দিব।
ছেলের বিয়ে উপলক্ষেই রজতের দেশে আসা। সন্তান এবং স্ত্রীর সাথে যোগাযোগ ছিলো তার সব সময়ই। তবে, কদাচিৎ। প্রয়োজনীয় কথার বাইরে কথা হতো না বললেই চলে। কারণ, স্বামীর কথিত দেশ দ্রোহিতার আরোপটি সে গ্রাহ্য করেছে। এমন পিতার ছায়াও তার সন্তানকে স্পর্শ করুক তা চায়নি সে। অথচ, বিষয়টি ছিলো রজতের দলের কাছে কল্যাণকর।
রজতের স্ত্রী ব্যাপারটাকে এমন জায়গায় নিয়ে ভাবলো যেন তার স্বামী একজন সস্তা খুনী। খুন করে ফেরারী আসামী সে। সে বুঝতে চায়নি যে কোনো সরকারের বিরোধিতা দেশ দ্রোহিতা নয়।
রজত যখন দেশ ছাড়ে তার ছেলের বয়স তখন কেবল এক বছর। ছেলেকে চোখের সামনে একটু একটু করে বেড়ে উঠতে দেখবে না। তার সকল প্রয়োজনের সঙ্গী হবে না তা মেনে নেয়া কঠিন ছিলো রজতের কাছে। একথা বারবার বুঝিয়েছে সে তার স্ত্রীকে। অনেক অনুনয়-বিনয় করেছে। কিন্তু, রজতের স্ত্রীর একটিই কথা – তোমার সন্তান আছে কথাটা আগে ভাবা উচিৎ ছিলো। কিন্তু, একজন সৈনিক দেশের কথাই তো আগে ভাববে। এটাই তো স্বাভাবিক। তখনকি ভেবেছিলাম এমন হয়ে যাবে- এমন বহু দিন বহু কথায়ও মন গলাতে পারেনি সে স্ত্রী’র। প্রতিবারই ফোনে কথা হলে রজত তাকে নরওয়েতে যেতে বলেছে। কিন্তু, সমস্ত ভ্রান্ত ধারণা রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা অভিমান একসাথে ঘনীভূত তখন তার মনে।
স্ত্রীর যুক্তিহীন যুক্তির কাছে হেরে গেলেও কর্তব্য থেকে পিছিয়ে যায়নি রজত। তাই সন্তানকে ভালো স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর এবং তার যাবতীয় খরচই রজত বহন করেছে। স্ত্রীর দায়িত্বও নিতে চেয়েছে রজত। কিন্তু, তার স্ত্রী তার টাকায় দিনাতিপাত করতে নারাজ। সে নিজেই তার নিজের জীবীকার জন্য উপার্জন করেছে। এবার ছেলে সোচ্চার হয়ে বলেছে তার বিয়েতে বাবা আসুক। ছেলে সব সময়ই চাইতো বাবা দেশে ফিরুক। কিন্তু, মায়ের জেদের সাথে পেরে উঠেনি কোনো দিন।
পুরো জীবনটায়ই রজত একা। এখানে স্ত্রীও একাই বলা চলে। কামনা বাসনা সব মাটি দিয়ে জীবন কাটিয়েছে সেও। এবার স্বামীকে ক্ষমা করে দিয়ে একই ঘরে দু’জনে আজ। মূলতঃ একটা সময় আসে জীবনে, যখন অভিমানগুলো সরিয়ে দিয়ে জীবন কেবল জীবনমুখী হতে চায়। যৌবন বিদায় নিলেও একাকিত্ব মেনে নেয়াটা কঠিন হয়। ভালোবাসা বিদায় নিলেও একটি ছায়া সঙ্গী যেন জরুরী হয়ে পড়ে খাওয়ার টেবিলে, বসার সোফায়, শয্যা পাশে। কাম স্পৃহা ছাড়াও দুটি শরীরের এক সাথে ঠাসাঠাসি তখন জরুরী হয়ে পরে। জরুরী তখন দেহের উষ্ণতা নয় বরং একটি শীতল স্পর্শের- স্নেহের মত, মমতার মত। আরো জরুরী হয়ে পড়ে রোগভোগের বার্তা বিনিময়ের, জরুরী মৃত্যুর শঙ্কা ভাগাভাগির, জরুরী ভোর বেলায় দু’জনে মিলে রাতের দুঃস্বপ্নের অর্থ খুঁজে বের করায়।
রজত তার স্ত্রীর হাতটি বুকের উপর থেকে আলতো করে ধরে বিছানায় রাখে। অনন্যার জন্য ছটফট করা হৃদয়টা বুকটাতে এমন এক উদ্বেগের সৃষ্টি করে যে ওই হাতটির ওজন বড় বেশি মনে হতে লাগে। রজত কখনো কাঁদে না। সহস্র বেদনার অনুভবও তার চোখে জল আনতে পারে না। আজ বুক চেপে ধরে আছে রজত, আর তার চোখে প্রচন্ড বেদনার জল। চোখের সামনেই যেন অনন্যা দাঁড়িয়ে আছে। অথচ, বুক থেকে হাত সরিয়ে বাড়িয়ে দিতে পারছে না অনন্যার দিকে। ধীরে ধীরে এক আলোকময় জ্যোতি যেন পর্দা টেনে দিচ্ছে দুজনার মাঝে। সেই মেরুজ্যোতি, নর্দান লাইট যা দেখেছিলো অনন্যাকে বুকে নিয়ে রজত লেক মিয়সা’র পাড়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে। সে এক অপূর্ব আলো। তখন নরওয়েতে রাত। তারা ঝকমকে আকাশ। বিচিত্র সব রঙের নাচন আকাশে। সবুজ, বেগুনী আলোগুলো এমন করে দৌড়তে থাকে যেন এক স্বর্গীয় পরিবেশ তৈরী করে। সমূদ্রের বিরাট বিরাট মোড়ানো ঢেউয়ের মতই আকাশে রঙের ঢেউ, বাঁক খেয়ে দিগন্তের পা স্পর্শ করছে। আবার, মনে হয় শিফনের হালকা ত্রিপল দ্রুত ধেয়ে আসছে কাছে তাদের ঢেকে দিতে, তারপর রুমালের মত ভাঁজ হয়ে যাচ্ছে নিজেরাই। এই দৃশ্য দেখে সেদিন অনন্যার সে কি বিস্ময়। শিশুর মত লাফাতে লাফাতে ওয়াও, ওয়াও করে সেকি তাঁর চিৎকার।
কিন্তু, আজকের যে আলো রজতের দৃষ্টি ঢেকে দিচ্ছে তা আনন্দের নয়, মৃত্যু পথযাত্রীর দৃষ্টির বিভ্রম। মূলতঃ ধুসরতার পথেই অগ্রসরতা। তার পরই চোখের তারা স্থির। মরা মাছের মত ঘোলাটে দুটি চোখ তখন রজতের।
শেষ হার্ট এটাকটা কিছুক্ষণ আগেই হলো- যেন অনন্যার হৃদয় বিদীর্ণ করা কান্নার ঝাপটায় রজতের নিঃশ্বাস উড়ে গেলো অলীক নিঃসীমের নীলে।
১ Comment
মর্মস্পশী বিয়োগান্ত গল্প,একাকীর্ত মানুষকে ক্ষুরে ক্ষুরে নিঃস্ব করে দেয় তার প্রমান তিনটা মানুষ ,হাতের তুলিতে সেটা উপজীব্য করে তুললেন লেখিকা জাহানারা বুলা ,অসংখ্য ধন্যবাদ শব্দচয়নের যথার্থরা জন্য লেখিকাকে