“উত্তর আধুনিকতা এবং স্বাধীনতা শব্দের মানদণ্ড”
(সুমনা খান)
সময়ের বিবর্তনে বিশাল পরিবর্তন আসে জীবন ব্যবস্থায়।মানুষের দৃষ্টির সীমানা পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হয়।কিন্তু কিছু সত্য যা নিতান্ত’ই চিরন্তন এবং অপরিবর্তনীয় যদিও অসংখ্য মানুষ যারা নিয়ত এসব সত্যের বিপক্ষে প্রশ্ন দাঁড় করিয়ে দেয়, একটা নড়বড়ে জীবনে দাঁড়িয়ে অগোছালো দৃষ্টির আলোকে সে জীবনের নিখুঁত সুন্দর ও সত্য বিষয়গুলোকে ক্রমশ ব্যবচ্ছেদ করে চলে।
কেননা মানুষ নিয়ম ভেঙে নিয়ম গড়তে বেশি আনন্দ পায়, কিন্তু নিয়মের ভেতর থেকে জীবনকে দাঁড় করানোর সত্য শক্তির উপাসনা করতে তাঁরা নারাজ।এ এক অদ্ভুত ইচ্ছে তাঁদের, সহজ-সরল জীবনকে তিলে তিলে অনিয়মের জালে জড়িয়ে ফেলে এবং একটা সময় আকটে পড়া মাছের মতো জীবন-মৃত্যুর মাঝে দাঁড়িয়ে নিরাশার বালুচরে ছপফট করতে লাগে।এ যন্ত্রণার বিষাদময় অনুভূতি কতটা তীব্র তা বোধহয় ওই অবস্থানে না গিয়ে বুঝতে পারা সম্ভব নয়।
কিন্তু এমন পরিস্থিতির জন্ম একদিনে হয়নি।সময় আমাদের আজ এখানে এসে দাঁড় করিয়েছে।তাইতো একাবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও আমাদের তরুণ প্রজন্মের মাঝে আশা অপেক্ষা নিরাশার বিষবৃক্ষ বেশি বেড়ে ওঠে,আর তার’ই নীলাভ বিষে জর্জরিত হতে হতে একটা সময় আত্মহননের পথে পা বাড়ায়। যদিও তারা এটাকে মুক্তি বলে মনে করে কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ বিষয়ে বলেছিলেন, “মৃত্যু কখনো মুক্তি দিতে পারে না বরং এটা একটা মাধ্যম যাকে অবলম্বন করে আমরা জীবনের এক অধ্যায় শেষ করে অন্য অধ্যায়ে প্রবেশ কর।”
রবি ঠাকুর যথার্থ বলে গিয়েছেন। মৃত্যু আসলেই মুক্তি দিতে পারে না।
বর্তমান সময়ে মানুষের জীবনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গিয়েছ যে হতাশা-গ্লানি,কদর্যতা, বিষাদগ্রস্থতা,দুঃখবোধ তা বোধহয় উত্তর আধুনিকতার চোখধাঁধানো জীবন বোধের ফলস্বরূপ। আজকালকার মানুষ কেউ নিজের মতো হতে চায় না, কেউ তার আমিকে বুঝতে চায় না,আমিত্বকেও খুঁজতে চায় না বরং নিতান্ত নির্বোধের মতো নিজেকে বিজ্ঞ প্রমাণ করতে আপনার বাহিরে গিয়ে এক আপন জগৎ তৈরি করে। যে জগতে না সে নিজে থাকে না থাকে অন্য কেউ বরং সেখানে থাকে তার তৈরি করা কিছু নিয়ম নামক অনিয়ম,শৃঙ্খলা নামক বিশৃঙ্খলা আর অন্যকে বিশ্লেষণ করবার অর্থহীন প্রয়াস।
আধুনিকতার তুমুল ঝড়ে আমরা আমাদের শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। যদিও আধুনিকতার মানদণ্ড নির্মাণের ভারও আমরা’ই নিয়ে নিয়েছি।যেমন করে প্রতিটি শব্দের জন্য আমরা নিজেদের জুতসই করে ব্যাখ্যা তৈরি করে নিতে শুরু করেছি।
যেমন আমরা এখন স্বাধীনতা বলতে লাগামহীন ঘোড়া বুঝিয়ে থাকি।কারো কোন ধরনের আদেশ-উপদেশ কোনকিছু’ই আমাদের কাম্য নয়।কিন্তু এটা কি আদতেই স্বাধীনতা! নিজের ইচ্ছে মতো চলা যা খুশি তাই করা যেমন ইচ্ছে আচরণ করা এটাই কি স্বাধীনতা?
তবে কেন সমাজ বলতে চারিপাশের সবকিছুকে বুঝতে হবে!কেনই বা রাষ্ট্রের জন্ম? কেন সংস্কৃতির বিপরীতে অপসংস্কৃতি! সংস্কারের বিপরীতে কেন’ই বা কুসংস্কার? কিসের জন্য ভালোর বিপরীতে খারাপ শব্দের জন্ম, রুচির পরিমাপক কেন সুরুচি আর কুরুচি!
তবে কি এগুলো নিতান্ত’ই কথার কথা, এর আদৌ কোন দরকার নেই!
আসলে জগতে টিকে থাকার বা জগৎ সংসারকে টিকিয়ে রাখতে অসংখ্য রীতি-নীতি তৈরি হয়েছে। আর যেগুলো সেই সৃষ্টির সূচনা লগ্ন থেকে হয়ে আসছে।কেউ আবার নিজেদের আখের গুছানোর ধান্দায় কূটনীতি করে চলেছে।এমন হয়ে আসছে আর হবেও বোধহয়। কারণ জগতে সমতা স্থাপন করার বোকা স্বপ্ন কখনো’ই পূর্ণ হবার নয়।
কারণ সবাই যদি মনে করে যে আমি ই রাজা তবে একটা সময় রাজা’য় রাজা’য় দ্বন্দ্ব হয়ে তাদের দাম্ভিকতার ফলস্বরূপ পৃথিবীর অস্তিত্ব’ই টিকে থাকবে না।
সুতরাং আত্মার অনুশীলন বা চর্চা না করে এই যে নিয়ত আমরা কিছু খোলস ধারী শিক্ষিত যুব সমাজ যারা নিজেদের প্রতিনিয়ত নিতান্তই প্রজ্ঞাবান বা জ্ঞানী প্রমাণ করবার বাসনায় যুক্তি-তর্কের কুস্তি লড়তে কুণ্ঠা বোধ করি না তারা আদৌ কতটা সঠিক সেই নিয়ে মাঝে মধ্যে সন্দিহান হয়ে পড়ি।আমি সঠিক আমিই জানি সর্বত্র শুধু আমিই জ্ঞানী এমন চিন্তার চর্চা যত্রতত্র দেখা যায়।এমনকি নিজের আত্ম অহমিকার পূজায় আমরা এতোটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছি ইদানীং যে… গুরুভক্তি বা অভিভাবকদের প্রতি নমনীয় আচরণের বিষয়টা অনেকটা ঝালমুড়ির নোংরা কাগজের মতো মুড়িয়ে ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলতে কুণ্ঠা বোধ করছি না।এ এক অন্যরকম স্বাধীনতার চর্চা যেখানে দাঁড়িয়ে আমরা এক নিমিষেই আপন পূর্ব পুরুষদের তিল তিল করে গড়ে তোলা নীতির নির্ধারিত শৃঙ্খলিত জীবন ব্যাবস্থাকে অস্বীকার করছি।দাবী করছি এ এক শেকল বা বেড়ি পড়ানো জীবন ব্যবস্থা বলে।অথচ এই জীবন ব্যবস্থার বিপরীতে দাঁড়িয়ে সেই আমরাই এক অসুস্থ জীবনের চর্চায় নিমজ্জিত হয়ে পড়ছি।নিয়মের বলয়কে ভেঙে ফেলবার তুমুল ঝড় তুলে সেই ঝড়ের কবলে পড়ে আমরাই এক পলকে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছি। এটা ঠিক কেমন জীবন যাপন আমার ঠিক বোধগম্য হয়ে ওঠে না।মাঝে মাঝে প্রশ্নের গোলকধাঁধায় ঘুরতে থাকি…খুঁজতে থাকি সমাজে প্রতিনিয়ত বেড়ে ওঠা শরীরী প্রাণের মধ্যে আত্মার স্পন্দন, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, মায়া,মমতা বা নীতি-নৈতিকতার একটু আধটু ছোঁয়া। কোন বিলুপ্ত প্রাণীর মতো মানুষ নামক প্রাণীর মানবিকতা ক্রমশ বিলুপ্ত হয়ে চলেছে। আর এর সমাপ্তি হয়তো কোনকালেই সম্ভব হবে না..কেননা যুগের সঙ্গে তাল মেলানোর নামে যে অনিয়ম বা স্বেচ্ছাচারিতা রূপী স্বাধীনতা নামক মরিচীকার পেছনে আমরা দৌড়াদৌড়ি করে চলেছি তাতে করে অতিশীঘ্রই আমরা প্রাণধারী যন্ত্রে পরিনত হতে চলেছি হয়তো বা।ভালোবাসা-বন্ধন,দায় বা দায়িত্ব বলতে যেখানে আসলে কিছুই থাকবে না।থাকবে শুধু আমিত্ব নামক একান্তই আমির অহমিকায় ভরপুর জীবনের গল্প। কিন্তু আমিত্ব শব্দের অর্থ বুঝতে পারবার মতো কোনো মন ই সেদিন আমাদের থাকবে না।এই শব্দের জন্যও খুব দ্রুত আমরা কয়েকটা নতুন অর্থ খুঁজে নেবো,জন্ম দিবো শব্দের বিপরীতে অজস্র শব্দ। আর এভাবেই হয়তো আমরা একটা সময় সুন্দর এর সংজ্ঞা ভুলে যাবো…জীবন উপভোগের অর্থ ভুলে যাবো এবং হয়ে যাবো জীর্ণতায় জর্জরিত এক হতাশাগ্রস্ত ঘুণে ধরা স্বাধীন জাতি।
৫ Comments
অসংখ্য ধন্যবাদ।
অসাধারণ।
বাস্তবতার প্যাথলজিক্যাল বিশ্লেষন।
প্রিয় লেখককে ধন্যবাদ দিয়ে খাটো করতে চাইনে।বরং অনেক শ্রদ্ধা আর অভিনন্দন।
অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
চিরায়ত সত্যের অসাধারণ উপস্হাপনা!!!
শুভকামনা আগামীর জন্য।
Thank you.