কথার কথকতা, মানুষ কেন লেখে
— মাইন উদ্দিন আহমেদ
আপনি কেন লেখেন? এই লেখা দিয়ে আপনার, অন্যদের, সমাজের, প্রাণীদের, পৃথিবীর কোন উপকার হয়কি?
এগুলো মৌলিক প্রশ্ন। যে কোন লেখকের কাছে মানুষ এগুলো জানতে চাইতে পারেন নিঃসন্দেহে। তবে তা পদ্ধতিগত এবং শালীন ভাবেই জানতে চাওয়া উচিত।
“আপনি এসব হাবিজাবি কেনো লেখেন”- এ জাতীয় প্রশ্ন যেমন বেয়াদবি তেমনি “অমুকের পোলাডা নষ্ট হয়ে গেছে, কবিতা লেখে, পড়াশুনা আর হইছে” এরকম মন্তব্যও অশিক্ষিত গোঁয়ারের মতোই হয়। লেখা আর খেলা এক কথা নয়। হ্যাঁ, যদি বলেন অমুক কবি ছন্দ নিয়ে খেলেন, তখন তা হয় এক উচ্চ মার্গের বক্তব্য। লেখা নিয়ে ইয়ার্কি ফাজলামি এই ডিজিটাল যুগেও অনেককে করতে দেখা যায় কিন্তু কাজটি খুবই বড় ধরনের বেয়াদবি। লেখার কাজটি কোন মতেই সহজ কিছু নয়। আর লেখাটি যদি সাহিত্য জাতীয় হয় তাহলে তা আরো অনেক কঠিন। তাই কেউ যদি লেখক হন এবং তিনি তাঁর লেখায় শালীনতার মাত্রা ঠিক রাখেন তখন তাঁকে সবাই অবশ্যই সম্মাণ করা উচিত।
মানুষ কেনো লেখে? আমি কোন এক লেখাতে উল্লেখ করেছিলাম যে, একটা মানুষ তখনই লেখে যখন আর না লিখে পারেনা। কোন এক অনুভূতি বা পরিস্হিতি তাকে লিখতে অনুপ্রানিত বা বাধ্য করে। এরকম অবস্হা হতে পারে প্রেমের চমৎকার অনুভূতির জন্য, বিরহ বা বেদনার তীব্রতার জন্য, প্রকৃতির স্নিগ্ধতা বা রুক্ষতার জন্য। পরাধীনতার নিগড় ভাঙ্গার স্পৃহা থেকেও লেখার প্রয়োজনীয়তা বোধ করার পরিস্হিতি সৃষ্টি হতে পারে। বস্তুতঃ মানুষ কেনো লেখে এই শিরোনামের উপর লিখতে থাকলে তা সহজে শেষ হবেনা। তাহলে ওই কথাই সত্য যে, মানুষ যখন না লিখে পারেনা তখনই লেখে।
সম্প্রতি আরেকটা প্রশ্ন প্রায়শঃই লেখকদের মুখে শোনা যায়, তা হচ্ছে, মানুষ বই কেনেনা কেনো? ভালো প্রশ্ন। কিন্তু সাথে সাথে ঐ প্রশ্নটিই আবার জেগে ওঠে যে, মানুষ আপনার বইটি কিনবে কেনো? কেনার সঙ্গত কোন কারন থাকতে হবে। পাঠক আপনার বইয়ের মধ্যে নিজেকে পেতে হবে অথবা এমন কিছু পেতে হবে যা পাঠক তার জন্য আনুষঙ্গিক মনে করে।
রবীন্দ্রনাথের লেখা কবিতা বা গল্প পড়লে মনে হবে, আপনার কথাই বলা হচ্ছে। অষ্টম শ্রেণীতে পড়া নজরুলের কবিতা পড়লে ঝাঁকুনী দিয়ে ওঠে পাঠক আর তার লেখার উপর ডক্টরেট করার সময় নজরুল ডিকশনারীর সাহায্য নেয়া লাগে। জীবনানন্দকে পড়লে পাঠকও চলে যায় প্রকৃতির কাছে, মধুসূদনকে পড়লে পাঠক খুঁজে পায় সমৃদ্ধ এক ব্যতিক্রম, জসিম পড়লে শিশুদের সাথে বয়স্কদেরও তালেতালে নড়েচড়ে দুলে উঠতে হয়। খুব সংক্ষেপে এক বাক্যেই বললাম। বিজ্ঞজন বিষয়টা ধরে ফেলবেন, জানি। এখন তাহলে কথাটা কি দাঁড়ালো? মোদ্দা কথা হচ্ছে, লেখকের বইটিতে লেখা থাকবে এবং পরোক্ষভাবে পাঠকও থাকবেন, তখনই পাঠক সেই বইটি কিনবে। জোর করে বই কেনানো যায়, কিন্তু সত্যিকারের পাঠক পাওয়া যায়না।
উপরের এই সংক্ষিপ্ত লেখাটি পড়ার পর যে কোন অসহিষ্ণু ব্যক্তি প্রশ্ন করে বসতে পারেন, তাহলে আমি কি লিখবোনা এবং আমার বইটি কাউকে কিনতে বলবোনা? আমাদের উত্তর হবে, আমরাতো সেকথা বলছিনা!
লেখক প্রসঙ্গেও হাজার রকমের কথা আছে। একজন লেখক দেখা গেলো দুএকটা বই লিখেই সুনাম অর্জন করছেন এবং পুরস্কৃত হচ্ছেন, অন্যদিকে আরেকজন প্রায় শখানেক বই লিখেও ছটফট করছেন কিছু পাবার জন্য। তাহলে কিসে কি হচ্ছে? পুরস্কার কি সব সময় লেখার মান নির্দেশ করে হয়? সব লেখাই কি লেখা হয়? এরকম অনেক প্রশ্নও সামনে চলে আসে। আসলে ভালো লেখকও যেমন হুট করে সৃষ্টি হয়না, তেমনি একটি সমঝদার পাঠক গোষ্ঠীও দুচার বছরে সৃষ্টি হয়ে যায়না।
আমাদের আজকের বিষয়টি এতোই জটিল একটা ব্যপার যে, এর উপর লিখতে শুরু করেই মহা মুশকিলে পড়ে যেতে হলো। কারন বাংলা সাহিত্যজগতে এখন এমন একটা অবস্হা বিরাজ করছে যে, এর একটা সুষ্ঠু সমাধান খুব একটা সহজ নয়। দেখা গেলো, লেখা ঠিক নেই কিন্তু সেটিকে পুরস্কৃত করে ফেললো একটি সংগঠন, আবার দেখা গেলো, একটি ভালো লেখা পুরস্কার দানকারী বুঝতেই পারলেননা বা নজরেই এলোনা। এ অবস্হাটা একদিনে হয়নি। শিক্ষাক্ষেত্রে মেধাবী ছেলে বা মেয়েটিকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন না করার সংস্কৃতি লম্বা সময় ধরে চলতে থাকলে মেধাহীনতার সাম্রাজ্য বিস্তৃত হয়ে যায় খুবই দ্রুত। তখন জ্ঞান জগতের উচ্চ মান আর ধরে রাখা যায়না। মধ্যম বা তার পরবর্তী তৃতীয় স্তরের লোকদের হাতে জ্ঞান জগতটি ক্রমশঃ চলে যেতে থাকে।
আমাদের এক লেখক বন্ধু আক্ষেপ করেই বললো, সে তার একটি ইংরেজী কবিতার বই কমপক্ষে পঞ্চাশ জনকে উপহার দিয়েছে কিন্তু কেউই গঠনমূলক কোন ক্রিয়া বা প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করেনি। তার কাছ থেকে জানতে চাইলাম কি ধরনের প্রতিক্রিয়া বা ক্রিয়া তুমি আশা করছিলে? সে মোটামুটি একটি যুক্তিসঙ্গত বিবরণ দিলো।
শোন, আমাকে কেউ কোন বই উপহার দিলে আমি কি করি, শোন। আমি এটি পাঠ করে অনুভূতি প্রকাশ করে রিভিউ ছাপি। অতো সময় দিতে না পারলে, ফেইসবুকে সচিত্র ধন্যবাদ জানাই। কবিতার বই হলে একটু আবৃত্তি করে সোশাল মিডিয়ায় দিয়ে দেই। লেখার মধ্য থেকে দুচারটা হাঁসূচক বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে লেখককে উৎসাহ দেই। ন্যূনতম সৌজন্য প্রকাশে আমি কার্পণ্য করিনা।
আমি বললাম, সাহিত্যিক ভাই, শোনো, এই যে এতোক্ষণ তুমি যা বললে, এটুকু মগজ ও মননে ধারন করে এরকম মানুষ ষোল কোটির মধ্যে কয়জন আছে, তা কি ঠিক করে বলতে পারো? খুব কম, খুবই কম, ভাই, মনে কষ্ট নিওনা, চলো যাই, মনের দুঃখ ঝেড়ে ফেলে চলো, দুজনে দু কাপ চা খাই। কি করবে জ্ঞান দিয়ে? বিএ এমএ পাশ করে চাকরী পাবেনা, চাকরী পেলে বেতন পাবেনা, ঔদ্ধত্ত দেখিয়ে পার পাবেনা। অন্য দিকে, বিশেষ বিশেষ ভাইয়ের পেছনে ঘুরতে হলে বিদ্যা লাগেনা আর অল্প সময়ে বিত্তশালী হওয়া যায়। সুতরাং তোমার বিদ্যা, জ্ঞান, সৌজন্য এগুলোর পেছনে মানুষ কেনো সময় ব্যয় করবে? তুমি হয়তো বলবে, এতো এক রকমের জ্ঞানবৃক্ষ কর্তনের মতো অবস্হা। আমি বলি, নিঃসন্দেহে ঠিক বলেছো কিন্তু আমি কর্তিত বৃক্ষের গোড়া থেকে শাখার সৃষ্টি ও বিস্তার দেখেছি আর সেই শাখাতেই ফল ধরতে দেখেছি।
লেখক: আমেরিকান প্রবাসী কবি ও কলামিস্ট, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
১ Comment
আপনার কথার কথকতা ভালো লাগলো।আপনার আলোচনার ভাষা সহজ সরল সাবলীল।ব্যাকরন জাহির করা অর্থাৎ কবিতার শরীর কাটাছেড়া করা অলংকার শাস্ত্রবিদদের যথেষ্ট প্রাজ্ঞবোধে উদ্বুদ্ধ করার উত্তম প্রয়াশ যদি তারা গ্রাহ্য করেন।
উক্ত বিষয়ের ওপর আপনার লেখা বই যদি পেতাম তাহলে পড়ে ধন্য হতাম।আপনার মত জ্ঞানীগুনিজনের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ।ভাল থাকুন সুস্থ থাকন।