বইপড়ুন
দীর্ঘশ্বাসের মতো দীর্ঘ কবিতা এক। ঢাকা শহরের বিচিত্র চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে একটি প্রজন্মের শৈশব-কৈশোর-যৌবন প্রতিবিম্বিত হয়েছে। ব্যক্তিগত দুঃখবেদনা, ভালোবাসা, স্বপ্ন আর স্মৃতি-বিস্মৃতির বর্ণনা যেন ক্ষয়িষ্ণু সমাজের প্রতিনিধি। ১৯৪৭ সালের পর থেকে এই শহরের পথে-ঘাটে-দোকানে-ছাপাখানায়-নাট্যশালায়-রেস্তোঁরায়-ময়দানে পদচিহ্ন রেখে গেছেন বাংলার শ্রেষ্ঠ মানুষেরা, এই কবিতা তারই দলিল। এই কবিতা তাঁদের স্মরণ করা, তাঁদের অভাবকে জাগিয়ে তোলা আর সবশেষে ভবিষ্যৎ-সম্ভাবনার দিকে উন্মুখ চোখে তাকানোর রেশ টানা। কবিতার ধূসর অবয়বে সংগীতে-শিল্পে-সৃজনে-প্রেমে-প্রতিবাদে মুখর শহরটির স্মৃতি থেকে তার কংক্রিটের জঙ্গল হয়ে পড়বার কাহিনি। এ কী স্মৃতিময় গল্প, নাকি রূঢ়-বাস্তব তথ্যে ঠাসা প্রবন্ধ, নাকি আবেগে বিহ্বল হওয়া কবিতা, পড়তে পড়তে ধন্দ লাগে। শিল্পের বিচিত্রতার সীমারেখা অগ্রাহ্য করে এমন শিল্পিত সৃষ্টি হয়ত কেবল তাঁর পক্ষেই সম্ভব। অন্যদিকে, রফিকুন নবীর অলংকরণে চমকপ্রদ।
একটি শহরকে কেন্দ্র করে রাজনীতি আর সমাজের নেতিবাচক পরিবর্তনের স্রোত তাঁকে ব্যথিত করে। চেনা শহরে নতুন সংষ্কৃতির উপনিবেশজনিত গভীর বেদনায় তিনি পাঠককে নাড়া দিতে চান। কত কত ছবি আসে পাঠকের চোখে, যেমন,
‘স্বাস্থমন্ত্রী উদ্বোধন করে চিত্র-প্রদর্শনী নবীন শিল্পীর
এবং শিল্পীটি বড় প্রীত পুরস্কৃত;
আজ আমারই শহর, আর কেউ নয়,
ক্ষমতায় আসীন দলের শ্রেষ্ঠ লেখকের
গলায় পরিয়ে দেয় সোনার পদক;
আজ মন্ত্রণালয়ের সচিবের অপেক্ষায় বসে থাকে বাহাদুর খান
বনানীর জলসায়;
শিল্পীর কোলের পরে রোদনের অপেক্ষায়
একটি সরোদ আজ বড়ো একা
আমার শহরে।’
হতাশার গহ্বর থেকে নিজেকে টেনে তুলে তিনিই আবার স্বপ্ন দেখেন, এই শহরের রাজপথে কোনোদিন প্রতিবাদী স্লোগান বাঁধবে নতুন কোনো কবি, উদ্যানে সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখাবে কেউ, বলতে বলতে নিজেকেই বলেন,
‘বলো তো সৈয়দ হক, তোমার কি সাজে শোক,’
এ যেন পাঠককেও বলা। বাস্তবতার আঘাতে জর্জরিত হয়েও তিনি আশার কথা বলেন, যুগে যুগে পুনরায় স্বপ্নের ধ্বজা উড়িয়ে নবীণ প্রাণের আগমনের কথা বলেন—
‘আমারই মতন সে কি কোনো কুড়িগ্রাম থেকে
ধানের ভিতর দিয়ে হেঁটে হেঁটে
ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র পার হয়ে
এসেছে শহরে?—আমি এখনো জানি না?
আমার মতোই
বেঢপ জামা ও জুতো; ভয়ে ভয়ে; বড় ভুল উচ্চারণ তার;
জীবনের সমস্ত কিছুই
এখনো কি তার কাছে বিস্ময়ের মোড়কে জড়ানো—
একদিন যেমন আমার?’
প্রথম প্রকাশ: ১৯৮৭ (‘রজ্জুপথে চলেছি’)
প্রথম প্রকাশ (একক কবিতার বই): ডিসেম্বর ২০১৯
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন