কবি ও কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক ঢাকা শহরে এসেছিলেন আশির দশকে রংপুর থেকে, পণ করেছিলেন লেখক হবেন। প্রখ্যাত লেখকদের অনেক মজার ঘটনার তিনি সাক্ষী। এই নিয়মিত কলামে তিনি বিখ্যাত মানুষদের জীবনের মজার ঘটনাগুলোর স্মৃতিচারণা করেন। অন্য আলো ডটকমে এটি প্রতি মঙ্গলবার প্রকাশিত হচ্ছে।
‘আল মাহমুদের কবিতা’ নামে একটা কবিতাসমগ্র হাতে পেয়েছিলাম কৈশোরেই। তখনো রংপুরেই থাকি। বইটা ছিল বারী ভাইয়ের, মোহাম্মদ বারী, এখন যিনি নাট্যজন হিসেবে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত ও প্রশংসিত। বারী ভাই ছিলেন আমার মেজ ভাই আশরাফুল হকের সহপাঠী, তাঁরা রংপুর জিলা স্কুল, রংপুর কারমাইকেল কলেজে একসঙ্গে পড়তেন। তিনি কবিতা লিখতেন, নাটক লিখতেন। রংপুর জিলা স্কুলের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে মঞ্চে কৌতুক পরিবেশন করে আমাদের হাসিয়ে মেরেছিলেন। নাটক লিখলেন, ‘সূর্যে সাইক্লোন’। রংপুর জিলা স্কুলে সেটা মঞ্চস্থ হলো।
বারী ভাই আমাদের সঙ্গে রংপুর অন্বেষা কচি–কাঁচার মেলা করতেন। বারী ভাই আর আমি একসঙ্গে ঢাকায় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে এসেছিলাম। তাঁর আত্মীয়ের বাড়িতে উঠেছিলাম, টিপু সুলতান রোডে। রাস্তার ধারে পাকা পেয়ার দেখে কিনে খেয়েছিলাম। সাদাকালো টেলিভিশনে প্রথম টেলিভিশন নাটকে আফজাল হোসেন আর সুবর্ণা মুস্তাফাকে অভিনয় করতে দেখেছিলাম। সে ১৯৭৮ সালের কথা। প্রতিযোগিতায় বারী ভাই রচনা লিখে স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন। আমি কিছু না পেয়ে খালি হাতে ফিরে গিয়েছিলাম।
আমার ছোট ভাই মিলন বারী ভাইয়ের কাছে ছড়া চাইল। বারী ভাই লিখে দিলেন:
‘রিম ঝিম ঝিম, রিম ঝিম ঝিম, রিম ঝিম ঝিম ঝিম
বৃষ্টি পড়ে টাপুরটুপুর, বইছে বাতাস হিম
চোখ ঘুম ঘুম, চোখ ঘুম ঘুম, চোখ ঘুম ঘুম চোখ
চুপটি করে পড়ব শুয়ে আমি ভদ্রলোক’
আমার এখনো মনে আছে। আমি আশ্চর্য হই, এই ছড়ার ছন্দ একদম নির্ভুল। অনুকার শব্দে তিন মাত্রাই যে ছড়ায় চার মাত্রার কাজ করে, এটা বারী ভাই ওই বয়সে জানলেন কী করে?
বারী ভাই রচনা লিখে স্বর্ণপদক পেলেন, তিনি হলেন নাট্যজন, আর আমি ডাব্বা মেরে এখন লেখালেখি করে খাই।
বারী ভাইয়ের কাছে আমি কবিতার বই চাইতাম। তিনি আমাকে ঢাকা থেকে কিনে এনে দেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘যেতে পারি, কিন্তু কেন যাব’, বুদ্ধদেব বসুর ‘যে আঁধার আলোর অধিক’। আর তাঁর নিজের সংগ্রহ থেকে পড়তে দেন ‘আল মাহমুদের কবিতা’। সেই বই আমি আর কোনো দিনও তাঁকে ফেরত দিইনি।
আল মাহমুদের কবিতা আমাকে আগে থেকেই মুগ্ধ করে রেখেছিল। সেটা হয়েছিল এক বিশেষ কারণে। আমাদের বাসায় একটা টেপরেকর্ডার ছিল। আমার বড় ভাই (টুটুন ভাই, ডাক্তার আজহারুল হক) রেডিও থেকে গোলাম মুস্তাফার আবৃত্তি টেপ করে রাখেন। সেটা প্রায়ই আমাদের বাসায় বাজানো হতো। কবিতাটা ছিল আল মাহমুদের। কবিতা এমন। এই কবিতা আমার এখনো পুরো মুখস্থ আছে।
‘কবিতা তো কৈশোরের স্মৃতি। সে তো ভেসে ওঠা ম্লান
আমার মায়ের মুখ; নিমডালে বসে থাকা হলুদ পাখিটি
পাতার আগুন ঘিরে রাতজাগা ভাই-বোন
আব্বার ফিরে আসা, সাইকেলের ঘণ্টাধ্বনি—রাবেয়া রাবেয়া—
আমার মায়ের নামে খুলে যাওয়া দক্ষিণের ভেজানো কপাট!
কবিতা তো ফিরে যাওয়া পার হয়ে হাঁটুজল নদী
কুয়াশায় ঢাকা পথ, ভোরের আজান কিম্বা নাড়ার দহন
পিঠার পেটের ভাগে ফুলে ওঠা তিলের সৌরভ
মাছের আঁশটে গন্ধ, উঠানে ছড়ানো জাল আর
বাঁশঝাড়ে ঘাসে ঢাকা দাদার কবর।
কবিতা তো ছেচল্লিশে বেড়ে ওঠা অসুখী কিশোর
ইস্কুল পালানো সভা, স্বাধীনতা, মিছিল, নিশান
চতুর্দিকে হতবাক দাঙ্গার আগুনে
নিঃস্ব হয়ে ফিরে আসা অগ্রজের কাতর বর্ণনা।
কবিতা চরের পাখি, কুড়ানো হাঁসের ডিম, গন্ধভরা ঘাস
ম্লান মুখ বউটির দড়ি ছেঁড়া হারানো বাছুর
গোপন চিঠির প্যাডে নীল খামে সাজানো অক্ষর
কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুল খোলা আয়েশা আক্তার।’
কাজেই আল মাহমুদের কবিতা আমার ভালো লাগার তালিকায় আগে থেকেই স্থান পেয়েছিল। তাঁর ‘কবিতা সমগ্র’ পেয়ে কবিতা পড়তে লাগলাম, বারবার পড়ার ফলে কবিতাগুলো আমার মুখস্থ হয়ে গেল। এখনো আপনারা আমাকে জিগ্যেস করলে আমি আল মাহমুদের কবিতা আপনাদের মুখস্থ শোনাতে পারব। ওই বইয়ের ভূমিকায় আল মাহমুদ লিখেছিলেন, একজন পুরুষ কবির চোখে নারীর চেয়ে সুন্দর আর কিছুই হতে পারে না। কবি সারা জীবন সমস্ত প্রকৃতি তন্ন তন্ন করে নারীর মুখের যোগ্য একটা উপমা খোঁজেন। আমার হাতের কাছে ওই বইটা নাই। কাজেই স্মৃতি থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি।
আল মাহমুদের কবিতা আমাকে গ্রস্ত করেছিল। ‘যত দূর চোখ যায়, সাধ্যমতো মানুষের ঘরবাড়ি’, কিংবা ‘কত দূর এগুল মানুষ?’ এই লাইন আর কে লিখতে পারবে?
আল মাহমুদের কবিতা আমাকে গ্রস্ত করেছিল। ‘যত দূর চোখ যায় সাধ্যমতো মানুষের ঘরবাড়ি’, কিংবা ‘কত দূর এগুল মানুষ?’ এই লাইন আর কে লিখতে পারবে!
কিন্তু ঢাকায় আসার পর আমি জাতীয় কবিতা উৎসবে যোগ দিই। শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, বেলাল চৌধুরী প্রমুখের সঙ্গে মেশার চেষ্টা করি। আর কাজ করি ‘দেশবন্ধু’ ও ‘পূর্বাভাস’ পত্রিকায়। আর আল মাহমুদের সঙ্গে জামায়াতের একটা কানেকশন আছে, এটা টের পাই শহীদ স্মৃতি হলের আবাসিক ছাত্র হিসেবে।
দেখি, শিবিরের কর্মীরা আল মাহমুদের বই ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’ বিলি করছে। তখন আল মাহমুদ আর ‘সোনালি কাবিন’–এর আল মাহমুদ নেই, যিনি বলবেন:
‘শ্রমিক সাম্যের মন্ত্রে কিরাতেরা উঠিয়েছে হাত
হিয়েনসাঙের দেশে শান্তি নামে দেখো প্রিয়তমা
এশিয়ায় যারা আনে কর্মজীবী সাম্যের দাওয়াত
তাদের পোশাকে এসো এঁটে দিই বীরের তকোমা।’
আল মাহমুদ ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’, ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’র মতো কবিতার বই তখন লিখতে শুরু করেছেন। তারপরও ১৯৮৯ সালে যখন আমি বুয়েটে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে দাঁড়াই, অনেক বড় করে বুয়েটের অডিটরিয়াম থেকে ব্যানার ঝুলিয়েছিলাম কয়েকজন কবির কবিতা দিয়ে:
‘যদি নির্বাচন হয় আমিও দাঁড়াব ইনশাল্লাহ…
কবি নজরুল পরাজিত হলে ক্ষতি কার’।
(নির্মলেন্দু গুণ)
পরাজিত নই নারী, পরাজিত হয় না কবিরা
দারুণ আহত বটে আর্ত আজ শিরা-উপশিরা।’
(আল মাহমুদ)
বলাই বাহুল্য, বুয়েটের শিক্ষার্থীরা আমাকে ভোট দিয়েছিল।
আল মাহমুদের বাড়ি আমি কোনোদিন যাইনি। তবে দেখা যাচ্ছে, তাঁর সঙ্গে আমার দুটো ছবি আছে। বেঙ্গল গ্যালারিতে ‘প্রথম আলো’র ঈদসংখ্যার লেখক সম্মিলনীতে। আমি তাঁর পাশে বসে তাঁর সঙ্গে কথা বলছি। আরেকটা বইমেলায়। কোনো একটা বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে আমরা নজরুল মঞ্চে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছি।
তাঁর সঙ্গে কী গল্প করেছি, এখন আর মনে নেই।
তবে তাঁর সঙ্গে আমার একটা কবির লড়াই হয়েছিল।
শামসুর রাহমান আর আল মাহমুদ ২০০৫ সালে শিল্পকলা একাডেমিতে একই মঞ্চে উঠেছিলেন। সেই সহাবস্থানকে স্বাগত জানিয়ে আমি একটা কলাম লিখেছিলাম। সেটা পড়ে আল মাহমুদ ‘আমার দেশ’ পত্রিকায় একটা জবাব লিখেছিলেন। খুবই সুন্দর জবাব।
প্রথমে আমি ২০০৫ সালের ‘প্রথম আলো’য় ‘অরণ্যে রোদন’ কলামে প্রকাশিত আমার লেখাটা থেকে তুলে ধরি:
কবির লড়াই এবং পরমতসহিষ্ণুতা
আনিসুল হক
কবি শামসুর রাহমান আর কবি আল মাহমুদ সম্প্রতি একই মঞ্চে হাজির হয়েছিলেন কবিতা নিয়ে। ঢাকা বইমেলা উপলক্ষে শিল্পকলা একাডেমিতে আয়োজিত এক কবিতার আসরে তাঁদের হাজির করে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র। অবশ্য সাম্প্রতিককালে তাঁদের দুজনের একসঙ্গে একই মঞ্চে বক্তৃতা এই প্রথম নয়। সম্প্রতি আরও দু-একটা অনুষ্ঠানে তাঁদের দুজনকে একসঙ্গে দেখা গেছে।
তার আগে দীর্ঘদিন তাঁদের একসঙ্গে এক মঞ্চে হাজির হওয়া তো দূরের কথা, মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ ছিল। ‘কাব্যহিংসা’ নয়, তাঁদের এই বৈরিতার মূলে ছিল আদর্শের দ্বন্দ্ব। সত্যি কথা বলতে কি, আল মাহমুদের রাজনৈতিক অবস্থান ও বক্তব্য এখন খুবই বিপজ্জনক। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মতো স্বৈরাচারী শাসকের ছাতার নিচে অবস্থান নেওয়া থেকে শুরু করে স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের ছাতা বয়ে বেড়ানোর মতো নানা কাজ আমরা তাঁকে করতে দেখেছি। তাঁর একটা প্রবন্ধ সংকলন আমি পড়ে দেখেছি, এই রকম ঘোরতর সাম্প্রদায়িক ও বিদ্বেষপূর্ণ লেখা একজন কবির কলম থেকে বের হতে পারে, ভাবতে বিস্ময় লাগে! কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর কবিতা ও তাঁর অনেক ছোটগল্প, এককথায় বলা যায়, অসাধারণ। আল মাহমুদের কবিতা পড়লে একটা অনির্বচনীয় অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হতে হয়, এই সেই অনুভূতি, যা দিতে পারে কেবল কবিতাই। একটা নির্দিষ্ট মতবাদে একজন লোকের বিশ্বাস থাকতেই পারে, মতবাদের বদলও তিনি ঘটাতে পারেন বারবার, পরিবর্তন তো মানুষের জীবনেই ঘটে, তাতে তাঁর সৃষ্টির বা কবিতার লাভ-ক্ষতি হতে পারে, না–ও পারে। এসব নিয়ে আমরা খুব বেশি রক্ষণশীল মনোভাব দেখানোর পক্ষপাতী নই। কিন্তু কেউ যদি ভালো কবিতা লেখেন, তাঁর কবিতা পড়লে যদি ভালো লাগার অনুভূতিতে হৃদয়-মন আচ্ছন্ন হয়, তখন তাঁর কবিত্বশক্তির প্রশংসা না করে পারা যায় না। আল মাহমুদ আমাদের প্রধান কবিদের একজন। এ স্বীকৃতির জন্য তাঁকে কারও সার্টিফিকেটের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না।
প্রধান কবি শব্দটা কিন্তু সাহিত্যিক। একটা সময়ে একটা ভাষায় অনেক প্রধান কবি থাকতে পারেন। যেমন তিরিশের প্রধান বলতে আমরা জীবনানন্দ দাশ, সুধীন দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তীদের বুঝে থাকি। প্রধান কবিরা কবিতা ধারার গতিপথ বদলে দেন, আর গৌণ কবিরা প্রধানদের দেখিয়ে দেওয়া গতিপথ ধরে অনুসরণ করতে থাকেন। সন্দেহ নাই, শামসুর রাহমান বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও অন্যতম প্রধান কবি। কিন্তু তার মানে এই নয়, তিনিই দেশের একমাত্র প্রধান কবি।
শামসুর রাহমান কীভাবে প্রধান ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলেন?
শামসুর রাহমান এবং সৈয়দ শামসুল হক, আরেকটু আগে আবুল হোসেন, আহসান হাবিব, পরবর্তী সময়ে শহীদ কাদরী প্রমুখ বাংলা কবিতাকে আধুনিকতার সঙ্গে যুক্ত করেন। এই দলে আল মাহমুদও আছেন। দুই অর্থে এই আধুনিকতা। এক, আধুনিকতা বলতে শিল্প-সাহিত্যে একটা নির্দিষ্ট লক্ষণকে বোঝানো হয়। যেটা কবিতায় বোদলেয়ার বা এলিয়টে আছে। বাংলাদেশে এই ধারার প্রধান পুরুষ শামসুর রাহমান। ১৯৪৭ সালের পরে পূর্ব বাংলার কবিতা ছিল অনাধুনিক, অনেক সময় গ্রাম্য। আর অনেকেই ব্যস্ত ছিলেন পাকিস্তান-বন্দনায়। কবিতার ভাষা, ছন্দ—সবই ছিল রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল ইসলামের প্রতিভাহীন ব্যর্থ অনুকরণ। অবিভক্ত বাংলায় বুদ্ধদেব বসুদের নেতৃত্বে বাংলা কবিতা যে বদলে গেছে, সেই খবর তাঁরা রাখতেন না। শামসুর রাহমানরা সেই জায়গায় আধুনিকতাকে প্রতিষ্ঠা করেন। আর চেতনায় পাকিস্তানবাদের বদলে তারা গ্রহণ করেন উদার, অসামপ্রদায়িক, বিশ্বজনীন এক আদর্শ।
আর শামসুর রাহমান প্রধানত এ দেশের মধ্যবিত্ত চেতনার রূপকার। মধ্যবিত্ত কথাটা এখানে ইতিবাচক অর্থে নিতে হবে। সারা পৃথিবীতেই শিল্প-সাহিত্য-চলচ্চিত্র নিয়ন্ত্রণ করে মধ্যবিত্ত। বাংলাদেশে নগরকেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত আরেক বিশাল ব্যাপার ঘটাতে থাকে, তারা নেতৃত্ব দিতে থাকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে, ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে যার সূচনা। তারা প্রত্যাখ্যান করে পাকিস্তানি মনোভাব ও আদর্শ; স্বপ্ন বুনে চলে এক স্বাধীন বাংলাদেশের—উদার মানবিক সম্প্রীতিময় এক বাংলাদেশের। আর সেই আন্দোলনের বাঁকে বাঁকে শিল্পী-কবিরা নেমে আসেন জনতার কাতারে। শামসুর রাহমানের কবিতায় আধুনিক নগরবাসী মানুষ খুঁজে পায় তাঁদের আকাঙ্ক্ষা আর বিক্ষোভ। প্রেম ও প্রণয়।
আল মাহমুদ সবচেয়ে বিখ্যাত তাঁর ‘সোনালী কাবিন’ কাব্যগ৶ন্থের জন্য। এই বইয়ের সনেটগুলোয় তিনি সাম্যবাদী সমাজ গঠনের পক্ষে প্রকাশ্যে ওকালতি করেছেন বলে মনে হতে পারে। ওই কারণেই তাঁর গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছিল। আমার নিজের কাছে কবিতাগুলোকে প্রবন্ধ ধরনের মনে হয়। বরং সনেটগুলো বাদ দিয়ে অন্য কবিতাগুলোকে মনে হয় অপূর্ব। কাজেই তাঁর যে গ্রহণযোগ্যতা, অন্তত আমার কাছে, তা তিনি একসময় বাম ছিলেন বলে নয়, তিনি বাম-ডান যখনই যে অবস্থানে থাকুন না কেন, অনেকগুলো ভালো কবিতা ও কিছু ভালো গল্প লিখেছেন বলে। আর তাঁর ছোটদের পদ্যগুলো, আমি কি সাহস করে বলেই ফেলব, বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিশু বা কিশোরপদ্য। আল মাহমুদ এক সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন, ‘যাঁরা আমাকে অপছন্দ করেন, আমার সমালোচনা করেন, তাঁদের অনেকেরই অন্তত আমার কয়েকটা কবিতার লাইন মুখস্থ।’ এ কথায় সত্যতা আছে। অনেকেই আছেন, যাঁরা আল মাহমুদের রাজনৈতিক মতবাদ পছন্দ করেন না, কিন্তু তাঁর কবিতা পছন্দ করেন।
না। আমি আল মাহমুদকে তাঁর মতবাদ বদল করতে বলার জন্য এই লেখাটা লিখছি না।
একটা সমাজে একেকটা লোক একেক মতবাদ ধারণ করবে, বিশ্বাস করবে, প্রচার করবে, এটাই স্বাভাবিক। শত ফুল ফুটতে দিতে হবে। কিন্তু বিশ্বাসের ভিন্নতা কেন ব্যক্তিগত রেষারেষি তৈরি করবে? কেন আমরা আমাদের বিরোধী বিশ্বাসের লোকের সঙ্গে এক পঙ্ক্তিতে বসতে পারব না? এক ঘাটে জল খেতে পারব না?
আমাদের দেশের একটা প্রধান সমস্যা হচ্ছে, ভিন্ন মতের লোককে সহ্য করতে না পারা। তাঁদের সঙ্গে সামাজিক সৌজন্যও দেখাতে না পারা। এটা কোনো সুস্থ সমাজের লক্ষণ নয়। রাজনৈতিক বিরোধিতা থাকবে না, তা বলছি না। কিন্তু একটা মতবাদ আরেকটা মতবাদকে কেন নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাইবে? শুধু মতবাদকে নয়, মতাবলম্বীকেও কেন আমরা নিশ্চিহ্ন করতে চাই? এ রকম অসুস্থ ও অনাধুনিক অশিক্ষিত সমাজে ভালো কিছু আশা করা সত্যিই মুশকিল।
পরমতসহিষ্ণুতার বড় অভাব আমাদের মধ্যে। এই জায়গা থেকে আমাদের সরতে হবে—যদি জাতি হিসেবে আমরা দাঁড়াতে চাই, সামনের দিকে যেতে চাই।
আল মাহমুদ আর শামসুর রাহমানের এক মঞ্চে ওঠাটা, অবশ্যই কবিতার মঞ্চ, রাজনীতির নয়, আমাদের জন্য এক নতুন যুগের সূচনা হয়ে উঠতে পারে। তার মানে দেশে এই রকম একটা পরিস্থতি তৈরি হচ্ছে। এ রকম একটা আবহ, যাতে শামসুর রাহমান আর আল মাহমুদ এক মঞ্চে উঠতে পারেন। এই প্রক্রিয়া যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে তীব্র রাজনৈতিক বা আদর্শগত পার্থক্য নিয়েও আমরা শান্তিতে একে অপরের পাশে বসবাস করতে পারব এবং দেশের কাজে লাগতে পারব।
সম্ভবত তখন নরকের বাংলাদেশি কড়াইয়ে প্রহরী রাখার প্রয়োজন পড়বে।’
(প্রথম আলো ১১ জানুয়ারি)
এরপর প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান আমাকে বলেন, ‘তোমার লেখার একটা প্রতিক্রিয়া আল মাহমুদ লিখেছেন “আমার দেশ” পত্রিকায়। ভালো লিখেছেন। তিনি বলেছেন, “সোনালি কাবিন” প্রবন্ধের মতো নয়, বরং লিরিক। পড়ো।’
আমি মতিউর রহমান ভাইয়ের এই আদেশ পালন করিনি। কারণ, সামনে বইমেলা। আমার বইমেলার লেখা শেষ হয়নি। আমি মগ্ন হয়ে আছি বইয়ের পাণ্ডুলিপিতে। এখন যদি আমি আল মাহমুদের লেখা পড়ি, তাহলে আমার মনে ঝড় উঠবে। আমি আরেকটা লেখা লিখব। পরে তিনি আরেকটা লেখা লিখবেন। অন্যেরা এসে এই আলোচনায় যোগ দেবেন। আমার আর বইমেলার লেখা সম্পন্ন করা হয়ে উঠবে না। পরে পড়া যাবে বলে আমি আল মাহমুদের লেখাটা আর পড়িনি। তারপর সেই কথা আমি একেবারেই ভুলে যাই।
এ বছর ২০২২ সালে পিআইবি থেকে জাফর ওয়াজেদ ভাইয়ের সহযোগিতায় আমি আল মাহমুদের লেখাটা উদ্ধার করি। নিচে সেই লেখার পুরোটাই তুলে ধরছি:
(চলবে)