আসাদ চৌধুরী ষাট দশকের অন্যতম প্রধান কবি। সামাজিক পরিপার্শ্ব তাকে লিখতে অনুপ্রাণিত করে। সাহিত্যের সব শাখাতেই তার পদচারণা। মনোগ্রাহী টেলিভিশন উপস্থাপনা ও দরাজ কণ্ঠের অনবদ্য আবৃত্তির জন্য তিনি সমধিক জনপ্রিয়। ষাটের দশকের নিজস্ব ভাষা ভঙ্গি থেকে তিনি নিজেকে আলাদা করতে পেরেছেন। খুব সহজে স্বকীয়তার পরিচয় দিয়েছেন। প্রচলিত ধারার বাইরে থেকে সাহিত্য ভুবনে তার সদাপট বিচরণ। ছোটবেলায় তিনি প্রচুর কবিতা পড়তেন। স্কুলের অনুষ্ঠানে অনেক ছড়া, কবিতা পড়েছেন। পেট্রিস লুলুম্বার মৃতু্যর পর তাকে নিয়ে তিনি কবিতা লেখেন, এটা ছিল তার দ্বিতীয় কবিতা। সময়টা ছিল পঞ্চাশ দশকের শেষের দিকে। আসাদ চৌধুরীর ভাই ‘চিত্রাকাশ’ নামের একটা পত্রিকা চালাতেন। ক্লাস নাইনে পড়ার সময় আসাদ চৌধুরীর উপলব্ধি হলো তিনি কবিতা লিখতে পারেন, লিখলেন একটা কবিতা। এটা ছিল তার প্রথম কবিতা। কবিতা লেখার শুরুর গল্পটা তার এরকম।
কবিতা ছাড়াও তিনি বেশকিছু শিশুতোষ গ্রন্থ, ছড়া, জীবনী ইত্যাদি রচনা করেছেন। কিছু অনুবাদকর্মও তিনি সম্পাদন করেছেন। ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে তার রচিত ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়।
তার কবিতা গীতিময় এবং ছন্দোদ্ভাসিত। তার ব্যঙ্গার্থক কবিতা ‘সত্য ফেরারী’ একটি জনপ্রিয় পদ্য। সভ্যতার প্রযুক্তিগত উন্নয়নের পাশাপাশি গত কয়েক দশকে মানবিক মূল্যবোধের যে করুণ অধঃপতন, তারই প্রেক্ষাপটে একটি কবিতায় তিনি আক্ষেপ করেছেন :
কোথায় পালালো সত্য?/দুধের বোতলে, ভাতের হাঁড়িতে! নেইতো/রেস্টুরেন্টে, হোটেলে, সেলুনে,/গ্রন্থাগারের গভীর গন্ধে,
টেলিভিশনে বা সিনেমা, বেতারে,/নৌকার খোলে, সাপের ঝাঁপিতে নেই তো।/গুড়ের কলসি, বিষের কৌটো,/চিনির বয়াম, বাজারের ব্যাগ,/সিগারেট কেস, পানের ডিব্বা,/জর্দার শিশি, লক্ষ্ণীর সরা,/নকশী পাতিল, চৌকির তলা,/সবি খুঁজলাম, খুঁজে দেখলাম নেই তো!/সাংবাদিকের কাঠের ডেস্কে,/কাগজে, কেতাবে, পুঁথিতে, কলমে,/ইনজেকশনে, দাঁদের মলমে,/ভ্যানিটি ব্যাগে বা পকেটে, আঁচলে/ড্রয়ারে, ব্যাংকে, আয়রন সেফে/সত্য নামক মহান বস্তু নেই তো!/কবিতায় নেই, সংগীতে নেই/রমণীর চারুভঙ্গিতে নেই/পাগলের গাঢ় প্রলাপেও নেই/নাটকের কোনো সংলাপে নেই/শাসনেও নেই, ভাষণে নেই/আঁধারেও নেই, আলোতেও নেই/রেখাতেও নেই, লেখাতেও নেই,/উত্তরে নেই, প্রশ্নেও নেই/লেবাসে নেই, সিলেবাসে নেই/পারমিটে নেই, বোনাসেও নেই/হতাশায় নেই, আশাতেও নেই/প্রেম-প্রীতি ভালোবাসাতেও নেই/এমন কি কালোবাজারেও নেই/কোথায় গেলেন সত্য?
তিনি সফলভাবে নিজস্ব ভাষাভঙ্গি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। প্রকৃতি প্রেম সামাজিক অবস্থান তার কবিতার বিষয় আশয়। তার লক্ষ্য ছিল পুরনো ধারায় না লেখার। নতুন ধারায় লেখার প্রবণতা থেকে তার ভাষাভঙ্গির উন্মেষ ঘটে। তিনি এগিয়ে যান নতুন ধারার পথে। নগরে বাস করার অর্থ যদি নাগরিক কবি হওয়া হয়, তাহলে তিনি নাগরিক কবিও বটে। তার মধ্যে নগরের পাশাপাশি চর থাকে, গ্রাম থাকে, নদী থাকে। তিনি নাগরিক জীবনের সঙ্গে গ্রামীণ জীবন সংস্কৃতিকে একাত্ম করেছেন। সহজবোধ্য শব্দ চয়নের পাশাপাশি সরল বাক্য গঠন তার কবিতায় দেখতে পাওয়া যায়। এটা তার নিজস্বতা হলেও তার ভক্ত পাঠক-শ্রোতা সবাই এমন বক্তব্য বুঝতে পারেন খুব সহজে, পাঠকদের কাছে সহজবোধ্য হয়, তিনি যা বলতে চান। আসাদ চৌধুরী আন্তরিকভাবে এটাই চেয়েছেন সব সময় যে তার লেখা সবাই পড়ুক, বুঝুক। তবে তিনি ইচ্ছে করে সহজভাবে লেখেন না। যা আসে ভেতর থেকে তিনি সেভাবেই লেখেন। তিনি তৈরি করেন না, যা আসে, যেভাবে আসে সেভাবেই লেখেন। সেভাবেই তাইই লেখেন। বানান না কিছু। কিন্তু কখনো কখনো তিনি কবিতার জন্যে কঠিন শব্দের প্রয়োজন বোধ করেন। প্রয়োজন হলে তিনি কঠিন শব্দ প্রয়োগ করেন নির্দ্বিধায়। তবে সরলতার জন্য লেখেন না। কবিতার নতুন নতুন নীরিক্ষায় নিমগ্ন থাকেন তিনি। তার অনেক দিনের চেষ্টা মন্ত্র, লোককাহিনী, লোকগীতি সংগ্রহ করার। শুধু এ দেশের নয়, বিদেশেরও। সে কারণেই বোধ হয় আসাদ চৌধুরীকে বলা হয় শেকড় সন্ধানী কবি। তার কবিতায় নীরিক্ষা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ষাটের দশকের অন্য কবিদের থেকে তাকে সহজেই আলাদা করা যায়। ষাটের দশকের উত্তাল সময়ে অবস্থান করেও তিনি দৃষ্টিপাত করেছেন লোকজীবন ও লোকসংস্কৃতির অন্তর্গত বাউল জারি সারি লালন মুর্শিদ মাইজভান্ডারী প্রভৃতির দিকে।
১ Comment
congratulations