হিমালয়ের কোলে সৌন্দর্যময়ী রহস্যময় গ্রাম, মালানা:
দীপক সাহা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।
বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ ভারতবর্ষের আনাচে কানাচে বিস্ময়কর কিছু অজানা অচেনা জায়গা আছে। এ’রকম একটি বিস্ময়কর জায়গা মালানা। হিমাচল প্রদেশের কুল্লু অঞ্চলের উত্তর-পূর্বে পার্বতী উপত্যকার চন্দারখানি এবং দেও টিব্বা পর্বতের মধ্যে মালানা গ্রাম আজও পৃথিবীর মূলস্রোত থেকে অনেকাংশেই বিচ্ছিন্ন। সমুদ্রতল থেকে ২৬৫২ মি. ( ৮৭০১ ফুট) উচ্চতায় মালানা নদীর পাশে অবস্থিত চারিদিকে বরফাচ্ছাদিত পর্বতের মাঝে সবুজ বনে ঘেরা, স্পর্শে নিষেধাজ্ঞা এই গ্রামের সঙ্গে ভারতের অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মিল নেই। দুর্গম পথ অতিক্রম করে এই রহস্যময় গ্রামে পৌঁছতে হয়। এমনকি এই গ্রামের মানুষ নিজেদের মধ্যে ভাব বিনিময়ের জন্য স্বতন্ত্র এক ভাষার জন্ম দিয়েছে, যাকে বলে ‘কানাসি ‘ ভাষা। ‘কানাসি’ ভাষার সাথে বিশ্বের আর কোন ভাষার মিল নেই। কানাসি ভাষা ইন্দো-আর্য ভাষা থেকে স্বতন্ত্র। গবেষণার বিষয়। রহস্যময় তাদের ধর্মবিশ্বাসও, পৃথিবীর অন্য ধর্মের সাথে সাযুজ্য নেই। তাদের দেবতা জলমু ঋষির পুজো বা উপাসনার রীতি নেই। তবে উৎসবে তাকে সর্বশক্তিমান দেবতা হিসাবে স্মরণ করা হয়। সবার ঘরে ঘরে তাঁর আধ্যাত্মিক বাণী সংরক্ষিত আছে। মালানা গ্রাম পরিচালনা ক্ষেত্রে এই জমলু ঋষির প্রভাব অত্যধিক। সমাজের একজন ‘ গুরু’ আছেন যিনি এই ঋষির প্রতিনিধি। সমস্ত গ্রাম গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হলেও গুরুর সিদ্ধান্তের গুরুত্ব থাকে সর্বাধিক। পৃথিবীর অন্য যেকোন জনগোষ্ঠী থেকে তারা নিজেদের উচ্চ ও পবিত্র মনে করে এবং সেজন্য তারা নিজেদেরকে অন্যদের থেকে পৃথক রাখে। মালানা অধিবাসীরা মনে করে তারা গ্রীক সম্রাট আলেকজাণ্ডারের উত্তরসুরি। মালানা গ্রাম বিশ্বের প্রাচীনতম গণতান্ত্রিক গ্রাম। সেজন্য মালানাকে বলা হয় ‘ হিমাচলের এথেন্স ‘। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৬ অব্দে বিপুল সংখ্যক সৈন্য নিয়ে ভারতবর্ষ অভিযানে আসেন। প্রায় ১৯ মাস তিনি ভারতবর্ষে অবস্থান করেন। যখন তিনি ভারতবর্ষ ত্যাগ করে করেন সৈন্যদের একটি অংশকে হিমালয়ের পাহাড় বেষ্টিত গ্রাম মালানায় বসবাস করার আদেশ দেন। সেই থেকে মালানা গ্রামের পথ চলা ।
পুজোর ছুটিতে হিমাচল ভ্রমণে ছোট গাড়িতে মানালী থেকে মণিকরণ যাওয়ার পথে এই রহস্যময় গ্রামকে স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণ করার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না। পথে জরি বলে একটা জায়গা, তারপর গাড়ি চলাচল বন্ধ। সেখান থেকে এক ঘণ্টা পায়ে হেঁটে পৌঁছলাম মালানা গ্রামের দ্বারপ্রান্তে। ওয়েলস নৃবিজ্ঞানী কলিন রজার ১৯৫২ খ্রীস্টাব্দে প্রায় ৪৫ কিমি দুর্গম পর্বত জঙ্গল অতিক্রম করে মালানা গ্রামে উপস্থিত হোন। আর এখন তুলনায় অনেক কম ও সহজ পথ। মালানা গ্রামের আগে মালানা হাইড্রো পাওয়ার স্টেশন, যেটি পার্বতী উপত্যকার কুমারী সৌন্দর্যকে খানিকটা হলেও বিনষ্ট করেছে। গ্রামে ঢোকার মুখে চেকপোস্ট, ভারতীয় সেনা কর্তৃপক্ষ দ্বারা তল্লাশি, জিজ্ঞাসাবাদ। সঠিক উত্তর দিতে না পারলে ফিরে আসতে হবে খালি হাতে। মালানার পৃথিবী বিখ্যাত মাদক দ্রব্যের জন্য এত কড়াকড়ি। অদ্ভুত বিচিত্র রহস্যাবৃত গ্রাম। এই গ্রামে কোন কিছুতে স্পর্শ করা যাবে না। যদি ভুল করেও স্পর্শ করেন তাহলে আপনাকে জরিমানা দিতে হবে। দোকানদার আপনাকে অদূরে টাকা রাখতে বলবে এবং স্পর্শ না করে আপনাকে জিনিস দেবে। বহিরাগত ট্যুরিস্টরা কেউ কোন গাছে নখের ছাপ দিতে পারবে না। প্রচলিত বিশ্বাস তাহলে গাছ নষ্ট হয়ে যাবে। গাছ কাটাও মানা , জ্বালানির জন্য গাছের শুকনো ডালপালা ব্যবহার করা হয়। বনের জীবজন্তু হত্যা করা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। বাইরের কোন আইন মালানায় প্রযোজ্য নয়। চলে তাদের নিজস্ব আইন, যা ভারতবর্ষের প্রচলিত আইন থেকে ভিন্ন। কোন একটি বিতর্কিত বিষয়ে যখন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় না তখন বিবাদমান দু’পক্ষ তাদের ভেড়ার ডানপায়ের অগ্রভাগ দেড় ইঞ্চি গভীর করে কেটে বিষ মাখিয়ে সেলাই করে দেয়। যে পক্ষের ভেড়া আগে মারা যায়, সে পক্ষ বিচারে পরাজয় স্বীকার করে। বিশ্বাস তাদের দেবতার দ্বারা এ’বিচার স্বীকৃত। মালানা গ্রাম দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদীয় রীতিনীতি দ্বারা পরিচালিত। নিম্ন কক্ষের নাম কনিশথাঙ্গ এবং উচ্চকক্ষের নাম জয়েশথাঙ্গ।
গ্রামে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। ১০০ পড়ুয়া এবং ১ জন শিক্ষক, নিবাস কুল্লু। ওনার কাছ থেকে মালানা গ্রামের অনেক অজানা কাহিনী জানতে পারলাম। গ্রামের অর্থনীতি নির্ভরশীল মূলত হাসিস (চরশ) বা গাঁজা চাষের উপর যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসছে। মালানায় উন্নতমানের গাঁজা চাষ ও গাঁজা-জাত পৃথিবী বিখ্যাত বিভিন্ন মাদক তৈরি করা হয়। চরশ নিয়ে নানা কিংবদন্তী কথিত আছে, ক্রুসডের সময় একদল দুর্দ্ধর্ষ যোদ্ধাদের হাসিস খাওয়ানো হতো যাতে তারা শত্রুপক্ষকে নির্দ্ধিতায় হত্যা করতে পারে। আর এই হাসিসের প্রলোভনে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মাদক সম্রাটরা এখন মালানায় ভিড় করেন। মালানার অধিবাসীরা এসব মাদক উৎপাদন পদ্ধতি গোপন রাখেন। কিন্তু নব্বইয়ের দশকে একবার মালানা গ্রামে রহস্যজনক ভাবে একসাথে ১২ জন পর্যটকের মৃতদেহ পাওয়া যায়। অনেক মনে করেন, পর্যটকরা মালানায় উৎপাদিত বিভিন্ন মাদকের ফর্মুলা গোপনে বা জোর করে জেনে নিতে চেয়েছিলেন। তারই পরিণতি এই হত্যাকাণ্ড। গ্রামবাসীরা কোন মতেই গোপন ফর্মুলা প্রকাশিত করতে চায় না।। পাহাড়ে ঢালে ঢালে ভুট্টা ও আলুর চাষও চোখে পড়ল। হাঁটতে হাঁটতে দর্শন পেলাম গ্রামের মাঝখানে জমলু মন্দির যার কাঠের দেওয়াল অপূর্ব ‘কথকুনি শৈলীর’ কারুকার্যে পূর্ণ এবং গোটা মন্দির চত্ত্বর শিং বিশিষ্ট হরিণের মাথা দ্বারা শোভিত। মালানা গ্রামের বাড়িগুলো অদ্ভুত। দোতলা বা তিনতলা এবং প্রত্যেক তলার একটি নির্দিষ্ট নাম এবং মানে আছে। নীচের তলাকে বলা হয় খুডাং যেখানে গবাদি পশু, জ্বালানি এবং গবাদি পশুর খাবার থাকে। দোতলাকে বলা হয় গেয়িং যেখানে খাবার, উল এবং পশম মজুত রাখা হয়। সর্বোচ্চ তলায় আছে ঝুলন্ত বারান্দা যা পাতি নামে পরিচিত। সর্বোচ্চ তলা বসবাসের জন্য।
আস্তে আস্তে পশ্চিম দিকে পাহাড়ের কোলে নরম সূর্য ঢলে পড়ছে। এই গ্রামে বহিরাগতদের রাত্রিবাস নিষিদ্ধ। মালানা গ্রামের বাইরে রাত্রিবাস করার জন্য কয়েকটি তাঁবু বা থাকার ব্যবস্থা আছে। আমরাও গুটি গুটি পায়ে গ্রাম থেকে বেরিয়ে আসলাম একরাশ অদ্ভুত রোমাঞ্চকর অনুভুতি নিয়ে।
ছবিঋণ – লিপিকা বিশ্বাস সাহা
কিভাবে যাবেন – দিল্লী বা চন্ডীগড় থেকে ভুনতার। সেখান থেকে কাসোলের পথে জরি। জরি থেকে মালানা।
কখন যাবেন – গ্রীষ্মকালে মনোরম আবহাওয়া আর উৎসব। অক্টোবর মরসুমও দারুণ।
থাকার ব্যবস্থা -ভুনতারে বিভিন্ন বাজেটের হোটেল আছে।
১ Comment
Congratulations