১৭৫ বার পড়া হয়েছে
বাংলা কবিতায় ফররুখ আহমদের ভিন্ন চিন্তা:
মোহাম্মদ খয়রুজ্জামান খসরু
বাংলা কাব্যের শ্রেষ্ঠ মৌলিক কবিদের মধ্যে ফররুখ আহমদ অন্যতম। বিগত শতাব্দীর চল্লিশ দশকে তাঁর কাব্য প্রতিভার স্ফূরণ ঘটে। কবি হিসেবে তাঁর আবির্ভাবের সময়কালটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ প্রতিভা রবীন্দ্রনাথের (১৮৬১-১৯৪১) তখন জীবনাবসান ঘটেছে। বাংলার বিদ্রোহী কবি, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৩) তখন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে নীরব নিস্তব্ধ (১৯৪২)। রাজনৈতিকভাবে পরাধীনতার জিঞ্জির ছিন্ন করে স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রাম তখন তুঙ্গে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানে দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাসে তখন লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন বিপন্ন।
জাতীয় জীবনের এ মহাক্রান্তিলগ্নে স্বাধীনতা, নবজাগরণ ও মানবতাবোধের উজ্জ্বল প্রতীক হিসেবে তখন বাংলা সাহিত্যে ফররুখ আহমদের বর্ণাঢ্য আবির্ভাব। তিনি একদিকে স্বাধীনতা, নবজাগরণ অন্যদিকে বিপন্ন মানবতার স্বপক্ষে ভিন্ন স্বাদ, রূপ ও রসে সমৃদ্ধ অসাধারণ বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল কবিতার অপরূপ আবরণে বাংলার কাব্য-মালঞ্চ সাজিয়ে তুললেন। নজরুলের পরে সমকালীন কাব্য রসিকদের নিকট তিনিই ছিলেন উজ্জ্বল আকর্ষণ। ইংরেজি সাহিত্যের অভিনিবেশী পাঠক হওয়া সত্ত্বেও ফররুখ আহমদ ছিলেন ঐতিহ্য সচেতন কবি। তার লেখায় স্বীয় ইতিহাস ঐতিহ্যের নিবিড় প্রাণস্পন্দন অনুরণিত। তাঁর কাব্যের ভাব, বিষয়, উপকরণ, ভাষা, অলংকরণ ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে ইতিহাস ঐতিহ্যবোধের স্বচ্ছন্দ-সবল প্রকাশ। এ কারণে তার কবিতা কাব্যানুরাগীদের বিমোহিত করা ছাড়াও বাংলার মুসলমানদের মনে জাগরণের প্রবল সাড়া সৃষ্টি করে। অধঃপতিত মুসলিম জাতিকে নতুন স্বপ্ন, কল্পনা ও আকাঙ্খায় উদ্বুদ্ধ করে তোলে। সাধারণত কোন কবির কবিতা ব্যক্তি-মানুষের মনকে সাড়া দেয়, তবে কোন কবির কোন কোন কবিতা একটি সমাজ বা জাতির অন্তরে সাড়া জাগায়। ফেরদৌসী, ইকবাল, নজরুল, ফররুখ ছিলেন তেমনি এক একজন মহৎ কবি। তাই ফররুখ আহমদ জাতীয় জাগরণের কবি, আমাদের আশা- আকাঙ্খা, স্বপ্ন-কল্পনা-সম্ভাবনার মহত্তর জীবন-শিল্পী। তাঁর কবিতা আমাদের সত্তাকে জাগরিত করে, হৃদয়কে উদ্বোধিত করে, জীবনকে নতুন প্রাণ-স্পন্দনে উজ্জীবিত করে। সে কারণে ফররুখ বাংলা কাব্যের এক অনন্য সাধারণ কবি। বাংলা কাব্য সাহিত্যে তিনি রেনেসাঁ বা পুনর্জাগরণের কবি। ফররুখ কাব্যের ভাব-বিষয়-বক্তব্য যেমন স্পষ্ট, তার ভাষাও তেমনি বৈশিষ্ট্যমণ্ডি ও স্বকীয়তায় উদ্ভাসিত।
মুসলিম শাসনামলে পরিগঠিত ও বিকশিত আমাদের নিজস্ব ভাষার ঐতিহ্যকে নজরুল যেমন বাঙময়ভাবে তাঁর কাব্যে তুলে ধরেছেন, ফররুখও তেমনি পরম মমতায় স্বকীয় স্বাতন্ত্র্যে সে ভাষার ঐতিহ্যকে লালন করেছেন। নিজস্ব কবি-ভাষা সৃষ্টির ক্ষমতা খুব অল্প সংখ্যক কবির মধ্যেই বিদ্যমান। এদিক দিয়ে তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শক্তিমান কবি।
ইসলামি পুনর্জাগরণের কবি ফররুখ আহমদ কী অবদান রেখেছেন তা মূল্যায়ন করতে হলে ফররুখের সমকালীন উপমহাদেশের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা একান্ত প্রয়োজন। তবেই তাঁর কাব্য সাধনায় কীভাবে মুসলমানদের মাঝে রেনেসাঁ বা পুনর্জাগরণের সৃষ্টি হয়েছিল তা অনুধাবন করা যাবে। উপমহাদেশের মুসলমানদের স্বাধীনতা লাভের আকাঙ্খার সাথে তাদের জাগরণের ইচ্ছাটি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ছিল। কিন্তু সত্যিকার স্বাধীনতা কী? স্বাধীনতা বলতে প্রকৃতপক্ষে কী বোঝায় এ বিষয়টি কেবল সাধারণ মুসলমানই নয়- অনেক শিক্ষিত মুসলমানের ধারণায় অস্পষ্ট ছিল।
রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামের মূল আদর্শটি গণতান্ত্রিক সমানাধিকার তথা সাম্যবাদের; কিন্তু হযরত আলী (রা.) এর মৃত্যুর পর এবং বিশেষ করে কারবালায় হযরত হোসাইন (রা.) এর শাহাদাতের পর ইসলামি রাষ্ট্রের সেই মৌল আদর্শ ধূলিসাৎ হয়ে যায়- তার স্থান দখল করে নেয় রাজতন্ত্র। এই রাজতন্ত্রের স্বেচ্ছাচারী শাসন দীর্ঘকাল ধরে ইসলামের মুখপাত্র হিসেবে দুনিয়ায় রাজত্ব করেছে, যার সঙ্গে ইসলামের ন্যায় ও মানবতাবাদী আদর্শ ধর্মের আদৌ কোন সম্পর্ক নেই। এজন্যে ইসলাম সম্পর্কে কেবল ভিন্নধর্মী মানুষেরাই নয়, স্বধর্মীরাও ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে। ফররুখ এই ভুলটিকে চিনতে পেরে ইসলামের মানব প্রেমের আদর্শকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে চান। ফররুখ মানসকে চিনতে হলে এ ব্যাপারটি ভালোভাবে উপলব্ধি করতে হবে।
কবিতার একটা ভিন্ন কৌতূহলোদ্দীপক জগৎ আছে, যার অনেকখানি সম্পর্ক স্বপ্নের সঙ্গে কল্পনাকে যা খাদ্য যোগাতে সাহায্য করেছিল। তাঁর সেই জগতে আমরা ভ্রমণকারী অভিযাত্রী সিন্দবাদকে দেখি, দেখি জাহাজকে, নাবিক আর মাল্লাদের, দেখি জ্বীন পরীদের আর পরীর মুল্লুক কো’কাফকে। তাঁর কবিতায় ব্যবহৃত হয়েছে ব্যতিক্রমধর্মী ফুল, তার রূপ-গন্ধ, সেই সঙ্গে ঘ্রাণ উদ্দীপ্তকারী রন্ধনকর্মে ব্যবহৃত মসলা-এলাচি, লবঙ্গ, দারুচিনি প্রভৃতি; ব্যবহৃত হয়েছে দৃষ্টি সম্মোহনকারী হরেক রকম উজ্জ্বল রঙ্গীন পাথরের নাম আর এভাবেই এক অভূতপূর্ব কবিতার জগৎ তিনি তৈরি করেছেন যার সাথে আধুনিক বাংলাভাষী পাঠকের পূর্ব পরিচয় ছিলনা। কবি এসব উদাহরণের মধ্য দিয়ে ডেকেছেন জাতির ঘুমন্ত নাবিক তথা নেতাকে। তার অসাড় সত্তায় জাগিয়েছেন শিহরণ। যেমন- ‘সাত সাগরের মাঝি’ কবিতায় তিনি লিখেছেন-
এবার তাহ’লে বাজাও তোমার যাত্রার জয়ভেরী
আসুক যাত্রী পথিক, হে মাঝি, এবার কোরোনা দেরী।
দেরী হয়ে গেছে অনেক, জানো না তো তুমি,
ফিরে গেছে কত জাহাজ-ভাসানো দরিয়ার মৌসুমী।
কত এলাচের দানা উড়ে গেছে ঝড়ে,
দারুচিনি শাখা ভেঙ্গেছে বনান্তরে।
মেশ্কের বাস বাতাস নিয়েছে লুটি
মৃত্যু এখন ধ’রেছে তোমার টুটি।
দুয়ারে জোয়ার ফেনা,
আগে বহু আগে ঝ’রেছে তোমার সকল হাসনাহেনা।
হে মাঝি! এবার তুমি পেয়োনা ভয়,
তুমি কুড়াও হেরার পথিক তারকার বিস্ময়
ঝ’রুক এ ঝড়ে নারাঙ্গী পাতা, তবু পাতা অগণন,
ভিড় করে যেথা জাগছে আকাশে হেরার রাজ-তোরণ।
প্রত্যেক কবির একটা ব্যক্তিগত আদর্শ আছে, সে আদর্শ থাকলেই যে তিনি সংকীর্ণ হবেন এ ধরনের ধারণার মধ্যে কুটিল উদ্দেশ্য নিহিত থাকে। ইসলাম মানবতাবাদী ধর্ম; সুতরাং কবির আদর্শ মানবতাবাদ হলে ইসলামি আদর্শে অনুপ্রাণিত হওয়ার মধ্যে সংকীর্ণ বিশেষণটি তার প্রতি কেন প্রযুক্ত হবে? তথাকথিত প্রগতিশীল লেখকগণ শিল্পীর পক্ষে এ রকম একটি বিশেষ আদর্শের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে থাকা শিল্পধর্ম নয় বলে প্রচার করেন। ইসলাম প্রকৃতপক্ষে আর দশটি ধর্মের মত নয়- যা সামাজিক আর সমস্ত বিষয় থেকে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে, সংসার ও সমাজের প্রতি উদাসীন হয়ে কেবল নিয়মিত আল্লাহ্র ধ্যানে নিমগ্ন থাকতে বলে, যা মানবিক সমস্যা সম্বন্ধে মানুষকে চিন্তা করবার সুযোগ দেয় না।
ইসলাম তেমনই একটি ধর্ম, যে মানুষের সব রকম সমস্যার সমাধান দিয়েছে। মানুষের জীবনের প্রতিটি ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সমস্যার প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ সমাধান সে দিয়েছে; বিশেষ করে সমাজ ও মানবকল্যাণের সমাধান। যে সমাধানের দ্বারা মানুষের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। মানবকল্যাণের এই সমাধান আছে বলেই ফররুখ ইসলামকে তাঁর জীবন এবং তাঁর সাহিত্যের দর্শন হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন। বস্তুত ফররুখের ইসলাম-প্রীতির কারণ তাঁর মানবপ্রীতি। ফররুখ মানুষকে ভালোবেসেছিলেন বলেই ইসলামকে ভালোবেসেছিলেন। কারণ ইসলামের সমস্ত শিক্ষাই মানুষকে ভালোবাসার শিক্ষা।
ইসলামের বিশাল, উদার জীবনাদর্শের প্রভাবে তাঁর মাঝে ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদ প্রশ্রয় পায়নি। তাঁর কাব্যের সর্বত্র ফুটে উঠেছে মানবজীবনের প্রতি অসীম দরদ, অকৃত্রিম সমবেদনা। এ অঞ্চলের সরস পরিবেশ থেকে উপমা উদাহরণ নিলেও সংকীর্ণ জাতীয়তার অন্ধ মোহকে কোথাও তিনি প্রশ্রয় দেননি। ‘সাত সাগরের মাঝি’ কাব্যগ্রন্থ কবির জীবনের প্রথম পর্যায়। এ যুগে, শতাব্দীর এ অভিশাপ কবির প্রাণে আঘাত হেনেছে প্রচ-ভাবে। তিনি ‘লাশ’ কবিতায় গভীর মর্মাহত হয়ে প্রশ্ন তুলেছেন-
এ কোন্ সভ্যতা আজ মানুষের চরম সত্তাকে
করে পরিহাস?
কোন ইবলিস আজ মানুষেরে ফেলি মৃত্যুপাকে
করে পরিহাস?
কোন আযাযিল আজ লাথি মারে মানুষের শবে?
ভিজায়ে কুৎসিত দেহ শোণিত আসবে
কোন প্রেত অট্টহাসি হাসে?
মানুষের আর্তনাদ জেগে ওঠে আকাশে আকাশে!
এ সভ্যতা সত্যিকার মানুষের সভ্যতা নয়- এ প্রশ্নটি সম্বন্ধে কবি সম্পূর্ণ ওয়াকিফহাল। তাই তার ধ্বংস তিনি কামনা করেছেন বিপ্লবী ভাষায়-
আজ এই উৎপীড়িত মৃত্যু- দীর্ণ নিখিলের অভিশাপ বও:
ধ্বংস হও
তুমি ধ্বংস হও।।
মানব জীবনের যে চরম দুর্দিনে এ দুনিয়ায় মহানবী (সা.) এর আবির্ভাব হয়েছিল।’ তাঁর এক সুস্পষ্ট ছবি এঁকে তাঁরই পাশে দাঁড় করিয়েছেন নবীজীর কল্যাণধর্মী মানবিক দিক ‘সিরাজাম মুনীরা’ কাব্যগ্রন্থে। তৎকালীন জীবনস্রোতের ‘জোড়াতালি দেয়া’ সমাজ সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, সে হালকা ঠুনকো সভ্যতা যে তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে যাবে তাতে বিস্মিত হবার কিছুই নেই। সে সমাজের বুনিয়াদ সত্যিকার জীবনের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল না। সে ছিল মানব জীবনের এক বিকারগ্রস্থ মানবিক রূপ। তার আসল রূপ চিনতে পেরেই কবি ছুটে চলেছিলেন নবীজীর সুমহান আদর্শের পতাকাতলে পূর্ণ বিকশিত জীবনের স্বাদ পেতে। নবীজীর প্রদর্শিত পথে জীবন বিকাশের জন্যে যারা আত্মোৎসর্গ করেছিলেন তাদের অমিয় জীবনকথা কবি আবার তুলে ধরেছেন বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের সামনে। নবীজীর আদর্শের প্রেরণায় তার অনুসঙ্গীগণ কোন সংকটেই বিচলিত হননি কোনদিন। তাঁদের প্রত্যেকের মাঝেই ফুটে উঠেছিল নবী জীবনের এক একটি বিশিষ্ট দিক। খুব স্বাভাবিকভাবেই তিনি উচ্চারণ করেন-
গলেছে পাহাড়, জ্বলেছে আকাশ, জেগেছে মানুষ তোমার সাথে
তোমার পথে যাত্রীরা কভু থামেনি চরম ব্যর্থতাতে,
তাই সিদ্দিক পেয়েছে বক্ষে অমন সত্য সিন্ধু দোল
তাই ওমরের পাতার ডেরায় নিখিল জনেরও কলরোল,
তাই ওসমান খুলে গেলো দ্বার অতুলন দিল মণি কোঠার
তাইতো আলীর হাতে চমকায় বাঁকা বিদ্যুৎ জুল্ফিকার,
খালেদ, তারেক ঝা-া ওড়ায় মাশুকের বুকে প্রেমের টান,
মহাচীন মুখে ফেরায়ে কাফেলা জ্ঞানযাত্রীরা করে প্রয়াণ।
ফররুখ আহমদের ‘সিরাজাম মুনীরা’ কাব্যগ্রন্থে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের তথা মহান চার খলিফার জীবন, সংগ্রাম-সাধনা, আদর্শ ও শিক্ষা সম্পর্কে রচিত দীর্ঘ কয়েকটি কবিতা ছাড়াও, ‘গাওসুল আজম’, ‘সুলতানুল হিন্দ’, ‘খাজা নকশবন্দ’, ‘মুজাদ্দিদে আলফেসানী’ প্রভৃতি কবিতা অন্তর্ভুক্ত। এসব কবিতার স্তবকে স্তবকে প্রেমিক হৃদয়ে ঝড় তোলে মহাজাগরণের। কবি বলেন-
চলেছে ধ্যানের জ্ঞান-শিখা ব’য়ে জিলানের বীর, চিশতী বীর
রংগীন করি মাটির সুরাহি নকশবন্দের নয়নে নীর
জ্ঞানের প্রেমের নিশান তুলেছে হাজার সালের মুজাদ্দিদ
রায়বেরেলির জঙ্গী দিলীর ভেঙ্গেছে লক্ষ রাতের নিদ
ওরা গেছে বহি তোমার নিশান রেখে গেছে পথে সেই নিশানি
তবু সে চলার শেষ নাই আর, কোনদিন শেষ হবে না জানি
লাখো শামাদান জ্বলে অফুরান রাত্রি তোমার রশ্মি স্মরি
সে আলোক বিভায় মুখ তুলে চায় প্রাণ পিপাসায় এ শর্বরী!
আমাদের নবীজী ছিলেন ‘ওসওয়াতুন হাসানা’। মানবজীবনের পূর্ণ বিকাশ তার পক্ষে সম্ভব হয়েছিল বলে তিনি সর্বাবস্থায় মানুষের আদর্শ হতে পারেন। তার জীবনের সারল্য তার জীবনের আদর্শনিষ্ঠা ফুটে উঠেছে প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর (রা.) এর জীবনে। তাই-
অনুপ্রাণিত সে মহা আদর্শে চিত্ত যে তার সুরভী ‘লালা’
সব প্রেমিকের সাথে সে সমান খলিফা মহান ফেরিওয়ালা!
মানব জীবনের সে পূর্ণ আদর্শ থেকে বিচ্যুতির ফলেই দুনিয়ায় দেখা দিয়েছে কত অবিচার-অনাচার। দুনিয়া আজ বিত্তবান ও বিত্তহারা দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে গেছে। কবির চিত্ত তাতে বেদনাবোধ করেছে তীব্রভাবে। এই অনাচার অবিচারকে দুনিয়ার বুক থেকে চিরতরে উৎখাত করার জন্যে দ্বিতীয় খলিফা ওমর (রা.) এর মত নিবেদিত প্রাণ পরীক্ষিত কিছু মানুষের আবির্ভাব। কবি তাই বলেছেন-
আজকে ওমর পন্থী পথীর দিকে দিকে প্রয়োজন
পিঠে বোঝা নিয়ে পাড়ি দেবে যারা প্রান্তর প্রাণ-পণ,
উষর রাতের অনাবাদী মাঠে ফলাবে ফসল যারা
দিক-দিগন্তে তাদের খুঁজিয়া ফিরিছে সর্বহারা!
যাদের হাতের র্দোরা অশনি পড়ে জালিমের ঘাড়ে,
যাদের লাথির ধমক পৌঁছে অত্যাচারীর হাড়ে,
আগুনের চেয়ে নিষ্কলঙ্ক, উদ্যত, লেলিহান
যাদের বুকের পাঁজরে পাঁজরে বহে দরদের বান।
নবী জীবনের ত্যাগের আদর্শে উদ্বুদ্ধ ছিলেন তৃতীয় খলিফা হযরত ওসমান (রা.)। ব্যক্তিগত মালিকানা তিনি বিলিয়ে দিয়েছেন মানব সমাজের কল্যাণে। এরূপ মানবদরদীর কুৎসা কোন এক ঐতিহাসিক গ্রন্থে দেখতে পেয়ে তিনি অস্থির হয়ে পড়েন। এরপর লেখেন-
যার অফুরন্ত দানে জনপদে বেড়েছে সুষমা
জীবনের শেষ কড়ি প্রয়োজনে রাখেনি যে জমা
বায়তুল মাল থেকে করেনি যে ব্যয় কপর্দক
কুৎসা গাহে তার নামে আজ কোন হীন প্রবঞ্চক?
চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রা.) ছিলেন নবীজীর তথ্য জ্ঞানের কোষাধ্যক্ষ। তাঁর জ্ঞান সম্বন্ধে নবীজীর প্রশংসনীয় বাণী মুসলিম জাহানে সুপরিচিত, ‘আমি ইলমের শহর আলী তার দরওয়াজা’। হযরত আলী (রা.)-ই ছিলেন শেরে খোদা। আসাদুল্লাহ্হিল গালিব। তাঁর দু’ধারী জুলফিকারের আঘাতে কত অত্যাচারী পাষণ্ডের মস্তক হয়েছে ধূলায় ধুসরিত। কোমল ও কঠোরের এমন অপূর্ব সমাবেশ নবীজী ব্যতীত আর অন্য কোন মানুষের জীবনে দেখা যায়নি। ঐতিহ্যের নব-রূপকার কবি ফররুখ আহমদ তাঁর চরিত্রের এ বৈশিষ্ট্য অপূর্ব ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন এভাবে-
পাহাড়ে পাহাড়ে তার গর্জন, জাগে মরু প্রান্তর
আলী হায়দর! আলী হায়দর! আসে আলী হায়দার।
সিংহ-নখর ছিঁড়ে ফেলে যথা ভীরু দুম্বার ঝুটি
জানি খায়বর প’ড়েছে তেমনি তোমার আঘাতে লুটি
তিমির প্রান্তে দেখি হেলালের নবীন অভ্যুদয়
দ্বীন ইসলাম প’ড়েছে ছড়ায়ে নিখিল বিশ্বময়,
আরবী তাজীতে কায়েদ ছুটেছে নাই তার অবসর,
রুদ্ধ দুর্গ দুয়ার ভেঙ্গেছে মহাবীর হায়দর,
তার পথ দিয়ে আসিছে খালেদ, আসিছে তারেক, মূসা,
সুবেহ সাদিকের বন্দরে ভেসে আসিছে রক্ত ঊষা।
উপমহাদেশের আজাদী আন্দোলনে এবং পরবর্তী সকল ইসলামি আন্দোলনের নবীন প্রবীণ প্রতিটি কর্মীর মনে ফররুখের এসব অন্তর জাগানিয়া কবিতা অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছে।
কবি ফররুখ আহমদ শুধুমাত্র ইংরেজি সাহিত্যেরই একজন একনিষ্ঠ ছাত্র ও বড় পাঠকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন ইসলামের ইতিহাসেরও একনিষ্ঠ পাঠক। ইসলামের পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয় বরং বন্ধুর। এ পথে এগিয়ে যেতে প্রতি পদে আসে চরম বাধা ও বিপত্তি। কিন্তু স্বচ্ছ ঈমান ও সুদৃঢ় শপথ নিয়ে এগিয়ে যেতে হয় ইসলামি আন্দোলনের কর্মীদের। পথে আসে শাহাদাত লাভের সুকঠিন পরীক্ষা। তবুও আল্লাহর বিধান কায়েমে নবীজীর সাহাবীদের মত হাসিমুখে বরণ করে নিতে হয় সবকিছু। একজন প্রকৃত সেনানায়কের মত কবি ফররুখ জিহাদের, শাহাদাতের এ পথকে অত্যন্ত তাৎপর্যময় করে তুলেছেন তাঁর কাব্যসম্ভারে। কবি ‘কাফেলা’ কাব্যগ্রন্থে লিখেছেন অনেকগুলো জিহাদী কবিতা। তারই একটি নিম্নরূপ
জীবনের চেয়ে দৃপ্ত মৃত্যু তখনি জানি
শহীদী রক্তে হেসে উঠে যবে জিন্দীগনি।
নতুন সফর শুরু হোক আজ জীবন সেই
মুক্ত প্রাণের রোশনিতে ভয় শঙ্কা নেই।
কাবা কেন্দ্রিক জীবনের এই পরিক্রমা!
ক্লান্ত রাতের সংশয় মনে রেখো না জমা,
সব দরিয়াকে বাঁধবে তোমার ইত্তেহাদ,
সব প্রতিরোধ ভাঙবে তোমার এই জেহাদ।
জিহাদের মাঝে জানি শুধু আছে জিন্দীগানি,
চলো সেই পথে মুক্ত প্রাণের হে সন্ধানী!
পাড়ি দাও স্রোত কঠিন প্রয়াসে অকুতোভয়,
এই নিশীথের তীরে হবে ফের সূর্যোদয়।
বাধার পাথারে কিশতী ভাসানো স্বপ্নসাধ,
পূর্ণ করেন মালিক আল্লাহ্ আল আহাদ।
কবি ফররুখ আহমদ আমাদের চেতনার অতলান্তে বিচরণ করেছেন। তিনি সুতীব্র আত্মপ্রত্যয়ে বলীয়ান হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। অসত্য তাঁকে বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি। আদর্শচ্যুত করতে পারেনি তাঁকে কোন অপশক্তি।
তাঁর জন্ম হয়েছিল এক উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারে। তার পিতা খান বাহাদুর সৈয়দ হাতেম আলী ছিলেন বৃটিশ ভারত সরকারের পুলিশ বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। ছোটবেলায় তিনি লালিত হয়েছেন ধনীর দুলালরূপে। এতদসত্ত্বেও উপার্জনক্ষম হবার সাথে সাথেই তিনি দারিদ্র্যকে আপন করে নেন। জীবন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসেন এক স্বতন্ত্র অঙ্গন নির্মাণে। সত্যের প্রতি অবিচল, অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীন এই কবি জাগরণের বাণী শুনিয়ে একদিন মহান প্রভুর ডাকে সাড়া দিয়ে পৃথিবীর হতে বিদায় গ্রহণ করেন ১৯ অক্টোবর, ১৯৭৪ সালে।
এই খাঁটি দেশপ্রেমিক কবি তৎকালীন সরকার থেকে পায়নি একটুও সহানুভূতি। পায়নি কবরের জন্য দু’গজ মাটি। যতদিন বাংলা সাহিত্য থাকবে, যতদিন বাংলা ভাষা থাকবে কবি ফররুখ আহমদের কবিতা, গান উচ্চারিত হবে মানুষের মুখে মুখে। নতুন গবেষণায় প্রস্ফুটিত ফররুখের অমর সৃষ্টি।
লেখক: লন্ডন প্রবাসী
১ Comment
পড়লাম। অনেক কিছু জানতে পারলাম ইসলামী রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ সম্পর্কে। তথ্যবহুল এই প্রবন্ধটি লেখার জন্য মোহাম্মদ খসরুজ্জামান খসরু ভাইকে অভিনন্দন জানাই।এ রকম প্রবন্ধ আমরা পাঠকমহল আরো বেশি প্রত্যাশা করি। প্রতিবিম্বপ্রকাশ ডটকম’কে ছাপানোর জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি।