ভারতে একদিন
শিরীন হোসেন
দেশের বাইরে এই প্রথম। হঠাৎ করে ঠিক হলো ইন্ডিয়া যেতে হবে। পত্রিকার কাজ, অনেক ঘুরতে হবে। অনেক দিগ্বজ ব্যক্তিদের সাথে দেখা হবে। ইন্টারভিউ হবে। আমি খুব এক্সাইটেড !
এর আগে দেশের ভেতরে ঘুরেছি,
এই প্রথম বাইরে যাবো।
আমার অনুভূতিটা এমন ছিলো যে,
ভিসা, ডলার সব মিলিয়ে মেয়েকে সাথে নিতেই হবে। কারন ও তখন অনেক ছোট।
কার কাছে রেখে যাবো,
তাই নিয়ে নিলাম সঙ্গে। মা-মেয়ে বেড়িয়ে পড়লাম বিশ্বজয় করতে।
সব গুছিয়ে নিয়ে রওয়ানা হলাম ।
সাল টা ১৯৯২ ,
এর আগে এয়ারপোর্টে গিয়েছিলাম কাউকে
বিদায় দিতে।
আমার প্রথম ফ্লাইটে চড়া , যেন রকেটে করে চাঁদে যাচ্ছি। সে কী ভাব!
ভিষণ এক্সাইটেড , নতুন মানুষ , নতুন জায়গা।
সবই আমার কাছে নতুন,
এমন কি প্লেন এ উঠাও নতুন। ঢাকা থেকে কলকাতায় পৌঁছে অবাক হলাম-
ইমিগ্রেশন অফিসার এর কাছে মনে হলো মেয়ে টা আমার না। কী ক্যাঁচাল ! হেনস্তা !
পুরো একঘন্টা সময় ধরে কথোপকথন,
এরপর ওদের বিশ্বাস হলো, আমরা মা মেয়ে। চুপিচুপি বলে রাখি , আমিও অনেক ছোট ছিলাম তাই ওরা বিশ্বাস করেনি। ওদের দোষ নাই।
যাত্রা শুরু ভিন্ন দেশ ভিন্ন মানুষ।
কোলকাতায় যাওয়ার আগে ,
আসাদুজ্জামান নূর ভাই এর মাধ্যমে পরিচয় হয়েছিলো কোলকাতার বিখ্যাত আবৃত্তিকার প্রদীপ ঘোষ বাবুর সাথে।
উনি বলেছিলেন, যদি কখনো কোলকাতায়
যাই তাহলে যেন ওনার সাথে অবশ্যই যোগাযোগ করি।
সময় এবং সুযোগ দুই টা-ই হলো।
তাই দেরি না করে ওনাকে কল দিলাম।
প্রদীপ ঘোষ বাবুর কথা মতো চলে গেলাম রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে, রবীন্দ্রসরণিতে।
প্রদীপ’দা ওখানকার গাইড পার্থ সারথি’র
সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
পার্থ আমাকে ঘুরে ঘুরে দেখালো,
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যবহৃত খাওয়ার টেবিল, খাট, বিশাল লম্বা বারান্দা; মুগ্ধ বিষ্ময়ে দেখলাম !
সেখান থেকে কাজের লোকেরদের সাথে,
কি ভাবে দুষ্টামি করতেন !
এরপর চলে গেলাম,
আনন্দ বাজার প্রত্রিকা অফিসে।
সেই সময় আমি ছিলাম ‘ডেইলি আজকের কাগজ’ এ।
আমার এসাইনমেন্ট ছিলো তাসলিমা নাসরিন এর আনন্দ পুরুষ্কার প্রাপ্তি নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করা।
সেই বছরই এ ঘটনা ঘটে।
তাই সব লেখক দের কাছ থেকে মতামত জানতে
প্রথমে ছুটে গেলাম শ্রী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে।
এরপর শ্রী সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু
মুখার্জি , সমরেশ মজুমদারের কাছে।
স্বপ্নে বিচরণ করা মানুষগুলো জ্বলজ্যান্ত রক্ত-মাংসের হতে পারে ! অভিভূত হলাম !
একদিন হঠাৎ উপন্যাস রচয়িতা মণিসঙ্কর মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের সাথে দেখা ও পরিচয়।
এরপর চলে গেলাম কলেজ স্ট্রীট এ সেই বিখ্যাত ‘কফি হাউজ’ এ !
চোখের সামনে ছবির মতো ভেসে আসছিলো
মান্না দে’র সেই গান।
তারপর পার্থ আমাকে নিয়ে গেলো
আমার হোটেলে।
আরেকটা যাত্রার প্রস্তুতি শুরু হলো।
আজমির, দিল্লি ,আগ্রা, মুম্বাইয়ে।
বেশ লম্বা সফর।
রাজধানী ট্রেন এ চলে গেলাম দিল্লি,
পথে ঝগড়ার সুবাদে পরিচয় হয় সুব্রতর সাথে। হবে না? আমার সিটে বসে ছিল। পরে আবার বন্ধুত্ব হয়ে গেল সুব্রতর সাথে।
ওর শুধু যাওয়ার কথা ছিলো দিল্লিতে।
পরে আমাদের সাথে দিল্লি , আজমির, মুম্বাই , আগ্রা, জয়পুর ঘুরে বেড়ালাম একসঙ্গে ।
সুব্রত কলকাতার ছেলে ও ব্যবসায়িক কাজে,
দিল্লি যাচ্ছিলো,
দিল্লি তে সকাল ১০ টায় পৌঁছলাম।
হোটেলে উঠে চেঞ্জ করে,
চলে গেলাম নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার মাজারে,
জিয়ারত করে বেরিয়ে পড়লাম।
রেডফোর্ড ইন্ডিয়া গেট ঘুরে এলাম।
পরের দিন আগ্রা ৫ ঘন্টা ড্রাইভে পৌঁছে
গেলাম ভালবাসার শহর আগ্রায়। ঐতিহাসিক তাজমহল দেখে ভাবছিলাম-
ভালোবাসার জন্য বাদশাহ হয়ে ওঠেন শিল্পী, প্রেমের জন্য পরাক্রম হার মানে কবিত্বের কাছে। কিছুক্ষণের জন্য প্রেমিক মন জেগে উঠলো , বিরহভারে ব্যথিত হলাম। আমিও কারো মমতাজ হতে চেয়েছিলাম কখোনো।
সেখান থেকে চলে গেলাম, জয়পুর।
জয়পুর, পিঙ্ক সিটি, জলমহল, স্টিডিও
গার্ডেন, হাওয়া মহল। কতো যে প্রশান্তিময় স্বর্গীয়
স্থান ছড়িয়ে আছে ভারতবর্ষে ! আমি অভিভূত !
এরপর চলে গেলাম কাংখিত আজমির।
ওখানে খাজা মাইনুদ্দিন চিশতী (রা) এর মাজার
জিয়ারত করে , ঘুরতে বেড়িয়ে পরলাম।
আনারকলি নদী, যোধপুর, মানে রাজস্থান
দেখে, ভেসে, আকুল হয়ে মুগ্ধতা নিয়ে
আবার বেরিয়ে পরলাম মুম্বাইয়ের উদ্দেশ্যে।
মুম্বাইয়ে অপেক্ষা করছিলো আরও
সুন্দর জায়গা।
জুহু বিচ, বান্দ্রা, হোটেল তাজ অবেরয়।
ঠিক উল্টো পাশে ইন্ডিয়া গেট, উফফ ! সে কী অবাক বিষ্ময়ে দেখার মতো ছিলো।
“ফেরারী পাখিরা কূলায় ফেরে না” – হায়! তবু ফিরতে হলো কোলকাতায়, আবার ।
বুকে তৃপ্তি, চোখে মায়া, মগজে একগাদা স্মৃতি নিয়ে ফিরে এলাম ।
শিরীন
২৯/১১/২০২২