বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ
লিজি আহমেদ।
এক .
রাজধানীর পান্থপথ এলাকার গরুর খামার বস্তির একটি ঘরে ছোটছেলে মোবারককে নিয়ে বসবাস করেন রমজান আলী ও তার স্ত্রী। তাদের বড় ছেলে থাকে আলাদা। বড় তিন মেয়েকে বিয়েও দিয়েছেন তারা । চারটি গাভী আছে রমজান আলীর। দুধ বিক্রি করেই সংসার চলে। এখন বয়স হয়েছে তার। তাই আর বেশি পরিশ্রম সহ্য হয় না। ছোট ছেলে মোবারকই প্রতিদিন সকালে গ্রাহকদের কাছে দুধ পৌঁছে দিয়ে আসে।
-ও মা,আজগে দুধ বেচতি যাতি ইচ্ছে করতিছে না। না গিলি হবি না ! আর এট্টু ঘুমাতি চাচ্ছিলাম।
ঘর থেকে বেরিয়ে এসে উঠোনে দাঁড়িয়ে
দু,হাতে চোখ কচলাতে কচলাতে তার মাকে বলে মোবারক ।
চোখ দুটো বিস্ফারিত করে মা বলে ওঠেন,
-এ কি অলুক্ষুণে কথা কচ্ছিস তুই ! তুই দুধ না বেচতি গিলি যাবি কিডা,ক’দিনি বাজান ? তোর বাপজান কি এতডা পত হাঁটতি পারে নাকি সাইকেল চালায়ে যাতি পারে সুনা ? সে যদি যাতিই পারতো তালি কি আর তোরে কাজ করতি পাঠাতো ক’ দিনি বাপ !
ফরিদা বেগম ছেলের হাতে পাঁচ /ছয় কেজি দুধের পাত্রটা ধরিয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, যা সুনা, আমি লাল মুরগীডার চারটা ডিম জমা করিছি। আজ কুর্মা রান্দা করবানি। তুই ফিরে আসলি দেখবি রান্দা হয়্যে গিয়েছে । আসলিই পরেই তাড়াতাড়ি ভাত খাতি দিবানে। এক দৌড়ে আয় দেখি বাপ !
দুধের পাত্রটা হাতে অনিচ্ছাসত্ত্বেও বড় রাস্তার দিকে পা বাড়ায় মোবারক । গলির মুখে যেতেই শুনতে পায় ওদিকটায় বেশ হৈচৈ। কি হচ্ছে ওদিকে, কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে যায় সে। কিছুক্ষনের ভেতরেই মিছিলটা স্পষ্ট চোখে পড়ে তার। হাজার হাজার শরীরের একটা স্রোত তরঙ্গের মত ফুলতে ফুলতে কাঁপতে কাঁপতে বড় রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছে। ওদের সাথে এক হয়ে যেতে ওরও খুব ইচ্ছে হয়। হতবাক হয়ে বিস্ফারিত চোখে সেদিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বারো বছর বয়সের কিশোর মোবারক। গ্রীনরোডের সেই পাঁচটা বাড়ীতে আর দুধ পৌঁছে দেয়া হয় না তার।
একখানা দশ,বারো হাত কামরার সামনে এক চিলতে বারান্দা। দুই পা সামনে ছড়িয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে সেই বারান্দায় নির্বাক বসে আছেন ফরিদা বেগম। হাতদুটো নিথর পড়ে আছে কোলের উপর। ঠোঁট জোড়া ফুঁপিয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছে বারবার । চোখ দুটো তার আকাশের দিকে। সে চোখে কোনো অশ্রু নেই,কান্না নেই। বাড়িটার সামনে গোটা গলিপথটায় আশেপাশের মানুষেরা ভীড় করে দাঁড়িয়ে আছে।
উঠোনে পড়ে আছে রক্তাক্ত প্রাণহীন মোবারকের ছোট্ট শরীরটা। মিছিলের উপর পুলিশের অতর্কিত আক্রমনে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় মিছিলের লোকজন। শত শত লোকের মাঝে আটকা পড়ে যায় মোবারক। তারই মাঝে কখন যে পেছন থেকে গুলি এসে তার পিঠের বামপাশ ভেদ করে ঢুকে যায় বুঝতেও পারে না সে। একবার মায়ের মুখখানা মনে পড়ে তার, মা যে কইছিলো, ডিমের কুর্মা রান্দা করতিছে ! মায়ের রান্দা ডিমের কুর্মাডাও যে খাতি খুব ভালো লাগে তার !! তারপর
শুধু একবার মা…….!!! বলে আর্তচিৎকার দিয়ে রাস্তায় ঢলে পড়ে মোবারক।
ভাইয়ের লাশের উপর আছাড়ি পিছাড়ি করে কেঁদে লুটিয়ে পড়ছে মোবারকের তিন বোন। পাশে বসে তার বৃদ্ধ বাবা ক্রমাগত আহাজারি করেই চলেছেন। এতগুলো মানুষের আকাশ -বাতাস কাঁপানো বিলাপ, আর্তনাদ ! চারদিকের এত মানুষের গুঞ্জন !!
অথচ ফরিদা বেগমের কাছে চারদিকটা মনে হচ্ছে কেমন যেনো নিস্তব্ধ ছায়াছায়া অন্ধকার। মনে হচ্ছে কারা যেনো পুরু করে সারা বাড়ীতে মেখে দিয়ে গেছে গা ছমছম করা নির্জনতা। অন্ধকার এক পাথারে তিনি যেনো একা বসে আছেন বুকের উপর এক বিশাল পাহাড় চাপা দিয়ে।
দুই.
“মুই না তোর মাও, তাইলে আগতই মোক কলু না ক্যান তোর কষ্টের কথা?
নাতে কলু না ক্যান তোর বাপোক, বা মিয়াভাই বোনোঘরক !
এমন ঝাঁঝরা বুকের লাশ হয়া ক্যান তুই ফিরি আসলু, এলা মা কয়া মোক কাঁয় ডাকিবে বাপ!”
এ বিলাপ সাঈদ নামের সেই ছেলেটির মায়ের, যে পরিবারের নয় ভাইবোনের ভেতর সবচেয়ে ছোট। দরিদ্র পরিবারের সবশেষের এই ছেলেটি ছিল ভীষণ মেধাবী। বাকী ভাইয়েরা সবাই ভ্যান চালিয়ে আয় রোজগার করলেও ছোট থেকেই সাঈদ স্কলারশীপ পেয়েই পড়াশোনা করে আসছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে পড়ার সুযোগ হয়েছিল তার। ছোট ছেলের টিউশনির টাকায় চলত ওর বৃদ্ধ মা-বাবার সংসার। ছেলেবেলায় এই ছেলেটি ছিল দূর্বাঘাসের মত সহজ, সরল। ধুলোবালির গন্ধ মেখে সন্ধ্যায় যখন ফিরে আসত ঘরে হাত পা,মুখ ধুইয়ে তার শিশুবুকে তেল মাখাতে মাখাতে মা সেখানে পেতো ফুলের সুবাস। আহা সে বুকে কতই না কষ্ট হয়েছে তার মরণের সময়। তখন মা যদি কাছে থাকত,শীতল পাটিতে শুইয়ে নিজের হৃদপিণ্ড থেকে ছেলের বুকে ভরে দিতে পারত বৃষ্টি ভেজা বাতাস।
মায়ের মনে প্রশ্ন, তার ছেলে তো মুক্তই ছিল, কোন শৃঙ্খলে বাঁধাও ছিল না তার হাত পা ! তবু কেন ক্ষত বিক্ষত হলো তার দেহ, ঝাঁজরা হল হৃদপিন্ড, রাজপথে ঝরলো বুকের তাজা রক্ত। অনন্তের ডাক এসে গেলে আর এক মুহুর্তও অপেক্ষা করা যায় না। আজরাইল এসে প্রাণটা ছিনিয়েই নিয়ে যায়। তবে কি অস্ত্রধারী লোকটাই তার আজরাইল ছিল ! তার ছেলে কি আজরাইলকে চিনতে পেরেছিল! বুঝতে পেরেছিল ওর হাতেই আজ তার মরণ ! তা নাহলে সে দাঁড়িয়ে গেলো কেনো দু’হাত প্রসারিত করে বুক চিতিয়ে ! অস্ত্রের মুখে!
এভাবে ঘরে ফেরার নাম কি বলে ঘরে ফেরা!
এখন মা কাদামাটির ছোট্ট ঘরে খুঁজে বেড়ান ছেলের শরীরের সেই ঘ্রাণ। খুলতে পারেন না তার দরজা, জানালা। এমন করে কে এঁটে দিল সে বদ্ধ ঘরের খিল! তবুও তছবী হাতে সেখানেই বসে মা দিনরাত বিলাপ করেন,
“এলা মা কয়া মোক কাঁয় ডাকিবে বাপ !!!!
তিন,
স্বপ্নময় আলোকিত সকাল আসুক, ঘরে-বাইরে,অফিস-আদালতে, মাঠে-ময়দানে, চায়ের টেবিলে প্রগতির কথা হোক, টিভি চ্যানেলে, টক শোতে উঠুক আলোচনা-সমালোচনার তুমুল ঝড় বা ভূমিকম্পে কেঁপে উঠুক সারাদেশ,বিরূপ মন্তব্য পাক্ষিক -বিপাক্ষিক, তর্ক-বিতর্কের ক্ষুদে বার্তায় ভেসে যাক মুঠোফোন,মিছিলে উত্তাল হোক রাজপথ,সংস্কার হোক কোটার,বিচার হোক দূর্নীতিসহ সমস্ত অব্যবস্থার।
তাতে আর কিই বা এসে যায় এগারো বছরের কিশোর সামিরের বাবা-মায়ের ! একমাত্র সন্তানকে দাফন করে ফিরে পাগলপ্রায় এ পরিবারের শুধু একটাই প্রশ্ন, সূনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই কবিতার মত,তুমি মানুষকে ভালোবাসো না,তাহলে দেশকে ভালোবাসো কেনো ???
পরিবারটিতো দেশকে ভালোই বাসত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসত বলেই তো গতবারও সংসার পক্ষকেই ভোট দিয়েছিল তারা। তাদের সন্তানতো এখনও অনেক অবুঝ,পড়ার ফাঁকে প্লাস্টিকের খেলনা নিয়ে খেলার বয়স তার, কোটা বোঝে না,আন্দোলন বোঝে না,সহিংসতা বোঝে না,শত্রু-মিত্র বোঝে না,স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধের সারমর্ম কিছুটা বুঝলেও, বোঝে না রাজনীতির ঘোরপ্যাঁচ। আন্দোলনের সময় সে তো ঘরেই ছিল, নিজের পড়ার টেবিলে। কাঁদুনে গ্যাসের ধোঁয়ায় অস্থির হয়ে নিরাপত্তার জন্য রাস্তার ধারের জানালাটা বন্ধ করতে গিয়েছিল। স্বাধীনতার তেপ্পান্ন বছর পরেও আমাদের শিশুসন্তান তার নিজের শোবার ঘরেও নিরাপদ থাকবে না !! ছিঃ !!
প্রশ্নেরা বারবার পড়ে প্রশ্নের মুখে। নিজেকেই হাজারবার ধিক্কার দেন,সামিরের বাবা। ঘৃণায় বিষিয়ে ওঠে তার অস্তিত্ব ! শক্ত হয়ে ওঠে তার চোয়াল। ভাষা হারিয়ে অসহায়ের মত নিষ্পলক সেদিকে চেয়ে থাকেন সামিরের মা।
চার,
যে শিশুদের হাত-পা ছুড়ে খেলে বেড়ানোর কথা সারাদিন,তারা ক’দিন ধরে রয়েছে বেড়াজালের আবর্তে ঘরেবন্দী। স্কুলে যাওয়া হয় না,হয় না যাওয়া খেলার মাঠে। সঙ্গী -সাথীদের সাথে দেখা নাই কতদিন। একমাত্র শ্বাস নেবার জায়গাটাই তো হলো নিজ বাড়ীর ছাদ। তাই তো রিয়া গোপা নামের ছয় বছর বয়সের ছোট্ট মেয়েটি বাবা-মায়ের অনুমতি নিয়ে ভীষণ খুশী ভরা মন নিয়ে ছাদে গিয়েছিল। আহারে ! একটু হাফ ছেড়ে বেঁচেছিল। সেখানে হয়ত সে পাখির মত ডানা মেলে ওড়ার সাধ নিতে চেয়েছিল। কোন সে অপরাধে তাকে লাশ হয়ে ছাদ থেকে নেমে আসতে হলো ? শিশুটির বাবা-মা এ প্রশ্নের জবাব রাখবে কার কাছে ?
যে শিশু আজ হামাগুড়ি দিচ্ছে তার হাত ধরে উঠে দাঁড় করানো তো মানবতার ধর্ম। এই খুনী কি জানে রক্তেভেজা একটি শিশুসন্তান হিমশীতল হয়ে গাঢ় ঘুমে ঢলে পড়ে যখন তারই পিতার কোলে,তখন সে পিতার কি অনুভূতি হয় !!
শুরুর আগেও যেমন শুরু থাকে,শেষ হবার পরেও
শেষ হয় না সবকিছু। ভাষা না থাকলেও অনুভুতিই একদিন জমে জমে শক্ত কঠিন হয়ে যায়।
জগতের সবচেয়ে ভারী বোঝা নাকি বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ। এ দেশের বাবাদের কাঁধে কাঁধে আজ শত শত সন্তানদের লাশ। ক”জনের নাম বলবো, ক’দিন আগেও তারা জানত না,এ ভার তাদের বহন করতে হবে। জানত না তাদের জন্য অপেক্ষা করছে কঠিন গুজবের মত এমন ভয়ঙ্কর কাহিনী, অপেক্ষা করছে এমন হিংস্র মহাকাল। আজ কেনো সন্তান হারানো মায়েদের চোখ আকাশের দিকে চলে যায়। কি নালিশ জানায় তারা সৃষ্টিকর্তার কাছে! কি বিচার চায় !
এত রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন দেশে এ চিত্র কি বেমানান লাগে না !!
এ দেশের মাটিতে তাদের সন্তানদেরও তো ছিল বেঁচে থাকার জন্মের অধিকার। আমাদের নিশানা কতটা ব্যর্থ,আমরা দাগী আসামী চিহ্নিত করতে পারি না অথচ নতুন প্রজন্মকে খুন করে ফেলতে আমাদের হাত একটুও কাঁপে না, একটুও দ্বিধাবোধ করি না। ভাবতে ভয়ে কেঁপে ওঠে বুক কতটা নিরাশার কুয়াশায় ঢেকে গেছে চারদিক !!
পাঁচ
প্রহসনের এ ইতিহাস লিখব কত আর ! তাতে কি ই বা লাভ ! ঝাপসা দেখি চোখে, জলছবি জমে থাকে চোখের উপর।
তখন মনে হয় চোখে গুলি লেগে অন্ধ হয়ে গেছে যে যুবক তার কথা। যে বাবা তার মেয়ের নাম রেখেছিল পদ্মপ্রিয় সে আর ছোট্ট মেয়েটির কাছে কোনোদিন ফিরবে না। সবার প্রিয় মুগ্ধ,যার মুখে সারাক্ষণ লেগে থাকত শুধুই মুগ্ধ করা হাসি। ওর একজন প্রেমিকা ছিল। তাকে নিয়ে দু’চোখে অনেক স্বপ্ন ছিল,ছিল খুঁনসুটি – মান অভিমানের গল্প। মুগ্ধর পানির বোতল আর বিস্কুট রক্তে মাখামাখি হয়ে পড়ে ছিল রাজপথে। বাতাসে বয়ে বেড়াচ্ছে তার কন্ঠস্বর– কারও পানি লাগবে, পানি………!!
পরপারে চলে যাওয়া মানুষগুলো মেঘের উপর থেকে কি দেখতে পায় নিচের সবকিছু ? ওরা কি দেখতে পারছে কি চলছে এই পাতালে ! আমাদের আপনজনেরা যারা চলে গেছেন তারা তো আর আমাদেরকে কিছুই বলতে আসেন না কোনোদিন !!
কেমন আছেন তারা কোথায়ই বা আছেন !!
কি দোষ ছিল আমাদের সন্তানদের ! তাদেরকে এভাবে পাখির মত করে মেরে ফেলা হলো !
শ্রীপুর জেলার নোহাটা গ্রামের আসিফ ইকবাল, বরইচরা গ্রামের মুত্তাকিন বিল্লাহ, আজমপুর গ্রামের রাজু মোল্লা,গাজীপুরের মিনহাজ,সন্দ্বীপের সাইমন ছাড়াও এই একই বিলাপ একই প্রশ্ন শহর বন্দর গ্রামের আরও শত শত বাবা-মায়ের। তাদের অসহায়ত্ব প্রকাশের মুখের ভাষা ভিন্ন ভিন্ন হলেও বিলাপের ভাষা সবারই এক। একই বুকফাঁটা আহাজারি সবার।
তাই তো শুধু তিলোত্তমা শহরেই না বিরান গাঁও-গ্রামেও যেনো এখন আর কোনো জৌলুস নেই আগের মতো। সুনসান চারদিকে। ওদের আকাশ থেকে সূর্য চূরি হয়ে গেছে। তবুও রোদে পুড়ে ঘরের টিন আগুনের মত হয়ে আছে। ভেতরে গরম বাতাসের ঝাপটা বইছে। পায়ের নীচেও মাটি পুড়ে খাঁক হয়ে যাচ্ছে। তারও চেয়ে বেশি পুড়ছে এসব পরিবারের মানুষগুলোর অন্তর।
সেখানে আকাশ থেকে চাঁদও লুকিয়ে গেছে । তাদের যেনো এক অন্ধকার জীবন,শুধুই ভুল,শুধুই নিস্তব্ধতা। বাবা হাটে গিয়ে ভুল করে কিনে আনছেন হারিয়ে ফেলা সন্তানের পছন্দের প্রিয় ফলটা। ভাই-বোনেরা হাহাকার করছে হারিয়ে যাওয়া ভাইবোনের সাথে কাটানো খন্ড খন্ড অজস্র স্মৃতিময় ছবি বুকে নিয়ে । মায়েরা সকাল -সন্ধ্যায় দু”বেলা ঝাঁড়ু দিয়ে পরিষ্কার করে রাখছেন তাদের ঘরদোর। এখনো তাদের বিছানায় শোয় না কেউ । সাদা শাড়ীর উপর রঙিন ফুলতোলা কাথাটা ধুয়ে শিথানে ভাঁজ করে রাখেন মা প্রতিদিন সন্ধ্যা বেলায়। নির্লিপ্ত চোখে পথের দিকে চেয়ে ভাবছেন,ওরা আসবে আজ অথবা কাল।
শুধু অনেক তারার মিটমিটে আলোয় দেখা যায় দূরে ডোবার পাশে দাঁড়িয়ে আছে নির্বাক খেজুর গাছের সারি। মসজিদের পেছনের পাশটায় বিশাল তেঁতুল গাছের নিচে শুকনো পাতা পড়ে বিছিয়ে থাকে । হাওয়া বইলে শরশর করে পাতাগুলো গড়িয়ে যায় অন্ধকারে। হঠাৎ করেই ডানা ঝটপট করে মাথার উপর দিয়ে চলে যায় রাতজাগা পাখি। ওযু করতে গিয়ে কলপাড়ে বসা মায়ের পরাণ চমকে ওঠে অজানা আশঙ্কায় । দরুদ পড়ে বুকে থুথু দেন মা। বালাই,ষাট!!
এ জগতে ধন-সম্পদ,ক্ষমতা-প্রতিপত্তি এসবের তুলনায় মানুষের মূল্য আসলে খুবই সামান্য। তাই তো একটা প্রাণের জন্য কারও কিছু যায় আসে না। সে কষ্টের জন্য মানুষ খুব বেশি দিন আহাজারি করেও না। পাথর চাপা দিয়ে রেখে দেয় মনের অন্ধকার কোণে। পৃথিবীতে অন্যায়কে অন্যায় জেনেও ভুল জায়গায় দাঁড়িয়ে মানুষ নিজের মতো করে সারাটা জীবন নির্বিঘ্নে,নির্বিকারভাবে পার করে দিতে চায়। দুঃখ-শোক,স্নেহ-মমতা-ভালোবাসা এই সব বিষয়গুলো তাদের কাছে শুধু মাত্র নিজের কাছের মানুষের জন্যই। আর অন্যদের বেলায় কেবল হিংসা- প্রতি হিংসা। অদ্ভুত বিষয়! স্বার্থের দৃষ্টিকোণ ছাড়া এরা অন্ধ। কোনো জাগতিক নিয়মকানুনের ভেতর এসব মানুষদেরকে ফেলা যায় না।
_____________
লিজি আহমেদ