বাংলাদেশের লোক সাহিত্য
রবীন জাকারিয়া
ভূমিকা: বাংলাদেশের লোক সাহিত্য বাংলা সাহিত্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। যদিও এর সৃষ্টি ঘটেছে গ্রমীণ জনগোষ্ঠির মাধ্যমে এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রসার ঘটেছে মৌখিকভাবে, তথাপি বাংলা সাহিত্যকে এ লোক সাহিত্য ব্যাপ্তি প্রদান করেছে, করেছে সমৃদ্ধ। পৃথক পৃথক ব্যক্তি-বিশেষের সৃষ্টি পরিণত হয়েছে জনগোষ্ঠির ঐতিহ্যে যার মাধ্যমে প্রকাশ ঘটেছে ভালোবাসা, আবেগ, অনুভূতি ও চিন্তা চেতনার।
লোকসাহিত্য:
লোকসাহিত্য মৌখিক ধারার সাহিত্য যা অতীত ঐতিহ্য ও বর্তমান অভিজ্ঞতাকে আশ্রয় করে রচিত হয়। একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক পরিমন্ডলে একটি সংহত সমাজমানস থেকে এর উদ্ভব। সাধারণত অক্ষরজ্ঞানহীন পল্লিবাসীরা স্মৃতি ও শ্রুতির ওপর নির্ভর করে এর লালন করে। মূলে ব্যক্তিবিশেষের রচনা হলেও সমষ্টির চর্চায় তা পুষ্টি ও পরিপক্কতা লাভ করে। এজন্য লোকসাহিত্য সমষ্টির ঐতিহ্য, আবেগ, চিন্তা ও মূল্যবোধকে ধারণ করে। বিষয়, ভাষা ও রীতির ক্ষেত্রে প্রচলিত ধারাই এতে অনুসৃত হয়। কল্পনাশক্তি, উদ্ভাবন-ক্ষমতা ও পরিশীলিত চিন্তার অভাব থাকলেও লোকসাহিত্যে শিল্পসৌন্দর্য, রস ও আনন্দবোধের অভাব থাকে না।
লোকসাহিত্য লোকসংস্কৃতির একটি জীবন্ত ধারা; এর মধ্য দিয়ে জাতির আত্মার স্পন্দন শোনা যায়। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একে ‘জনপদের হূদয়-কলরব’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। লোকসাহিত্যকে প্রধানত লোকসঙ্গীত, গীতিকা, লোককাহিনী, লোকনাট্য, ছড়া, মন্ত্র, ধাঁধা ও প্রবাদ এই আটটি শাখায় ভাগ করা যায়।
লোকসঙ্গীত ঐতিহ্যগতভাবে বিশেষ সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত গান; সাধারণত পল্লীর অনক্ষর জনগণ এর প্রধান ধারক। বিষয়, কাল ও উপলক্ষভেদে এ গানের অবয়ব ছোট-বড় হয়। ধুয়া, অন্তরা, অস্থায়ী ও আভোগ সম্বলিত দশ-বারো চরণের লোকসঙ্গীত আছে; আবার ব্রতগান, মেয়েলী গীত, মাগনের গান, জারি গান, গম্ভীরা গান ইত্যাদি আকারে অপেক্ষাকৃত বড় হয়। কবির লড়াই, আলকাপ গান, লেটো গান এবং যাত্রাগান হয় আরও দীর্ঘ, কারণ সারারাত ধরে এগুলি পরিবেশিত হয়।
লোকসঙ্গীতের গায়করা পেশাদার ও অপেশাদার উভয়ই হতে পারে। পেশাদার কোনো গায়েন বা বয়াতি দল গঠন করে অর্থের বিনিময়ে গান গায়; কবিয়াল দলবল নিয়ে কবির লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করে। আলকাপ গানের ছোকরা এবং ঘাটু গানের ঘাটু পেশাদার নটী ও গায়ক; উদাস বাউল নিজেই গান করে তার অধ্যাত্মপিপাসা নিবৃত্ত করে। বৈরাগী-বৈরাগিণী বা বোষ্টম-বোষ্টমী গান গেয়ে ভিক্ষা করে। বিবাহাদি অনুষ্ঠানে মেয়েলি গীত গাওয়ার জন্য পেশাদার গিদাল থাকে; তবে সাধারণ মেয়েরাও গান গায়। ক্ষেত-খামারে কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষ, মাঠে-ঘাটে রাখাল এবং নদী-হাওরে মাঝি-মাল্লারাও চিত্তবিনোদন, অবসরযাপন বা শ্রম লাঘবের জন্য গান গায়।
বাংলা লোকসঙ্গীত নাম ও প্রকারভেদে বিচিত্র; অঞ্চলভেদে এর প্রায় শতাধিক নাম রয়েছে এবং প্রকারভেদে প্রায় পঞ্চাশোর্ধ্ব শ্রেণির গান চিহ্নিত করা যায়। কেউ কেউ আঞ্চলিক ও সর্বাঞ্চলীয়, আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক, সাধারণ ও তত্ত্বপ্রধান, তালযুক্ত ও তালহীন এরূপ স্থূলভাবে ভাগ করে সেগুলির আবার নানা উপবিভাগ করেছেন। আশুতোষ ভট্টাচার্য লোকসঙ্গীতকে আঞ্চলিক, ব্যবহারিক, আনুষ্ঠানিক (ritual), কর্মমূলক ও প্রেমমূলক এই পাঁচটি ভাগে ভাগ করেছেন। বিষয়গত দিক থেকে একে প্রেম, ধর্ম-আচার-সংস্কার, তত্ত্ব ও ভক্তি, কর্ম ও শ্রম, পেশা ও বৃত্তি, ব্যঙ্গ ও হাস্যকৌতুক এবং মিশ্র এরূপ সাতটি ভাগ করা যায়।
বিস্তৃতি:
বাংলাদেশের লোক সাহিত্য লোক সাহিত্যের প্রচলিত সকল শাখায় নিজেকে বিস্তার করেছে। এগুলো হচ্ছে গল্প, সংগীত, ধাঁধা, প্রবাদ বাক্য, কুসংস্কার ও মিথ।
লোকগীতি:
বাংলাদেশের সংগীত মূলত কাব্যধর্মী। এদেশীয় সংগীতে বাদ্যযন্ত্রের চেয়ে মৌখিক সুরের দক্ষতার উপর অধিক নির্ভরশীলতা লক্ষ করা যায়। লোকগীতিকে আমরা সাতটি শ্রেণীতে বিন্যস্ত করতে পারি। এগুলো হচ্ছেঃ প্রেম, ধর্মীয় বিষয়, দর্শন ও ভক্তি, কর্ম ও পরিশ্রম, পেশা ও জীবিকা, ব্যাঙ্গ ও কৌতুক এবং এসবের মিশ্রণ। অন্যদিকে এদেশীয় লোকসাহিত্যে আমরা গানের বিভিন্ন শাখা দেখতে পাই। এগুলো হচ্ছেঃ বাউল গান, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, গম্ভীরা, কবিগান, জারিগান, সারিগান, ঘাটু গান,যাত্রা গান ,ঝুমুর গান, জাগের গান প্রভৃতি।
বাউল গান:
বাউল শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে মতান্তর রয়েছে।ইতিহাসবিদদের মতে, সতেরো শতকে বাংলাদেশে বাউল মতের উদ্ভব হয়। এ মতের প্রবর্তক হলেন আউল চাঁদ ও মাধববিবি। বীরভদ্র নামে এক বৈষ্ণব মহাজন সেই সময়ে একে জনপ্রিয় করে তোলেন। লালন সাঁইয়ের গানের মধ্য দিয়ে বাউল ব্যাপক পরিচতি লাভ করে। ২০০৫ সালে ইউনেস্কো বিশ্বের মৌখিক এবং দৃশ্যমান ঐতিহ্যসমূহের মাঝে বাউল গানকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করে।
সিলেটের মরমী সাহিত্য:
বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন লোকঐতিহ্যের অনবদ্য ফসল মরমী সঙ্গীত বা মরমীবাদের গান। প্রাচীন লোকসাহিত্য বা লোকঐতিহ্যের একাংশের রুপান্তর মরমী সাহিত্য। উল্লেখ্য যে, মরমী সঙ্গীত ও বাউল গানকে অধুনা যুগে যদিও এক করে ভাব হয়, কিন্তু এর ইতিহাস সন্ধানি সৈয়দ মোস্তফা কামাল ও অন্যান্যদের কাছে এর ভাবধারায় ভিন্নতা রয়েছে বলে অভিমত পাওয়া যায়।
ভাওয়াইয়া:
ভাওয়াইয়া গানের আকরভূমি রংপুর। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের নদী-নালা কম থাকায় গরুর গাড়িতে চলাচলের প্রচলন ছিল। আর গরুর গাড়ির গাড়োয়ান রাত্রে গাড়ি চলাবস্থায় বিরহ ভাবাবেগে কাতর হয়ে আপন মনে গান ধরে। উঁচু-নিচু রাস্তায় গাড়ির চাকা পড়লে তার গানের সুরে আধো-ভাঙ্গা বা ভাঁজ পড়ে। এই রকম সুরে ভাঙ্গা বা ভাঁজ পড়া গীতরীতিই ‘ভাওয়াইয়া’ গানে লক্ষণীয়। এসকল গানে স্থানীয় সংস্কৃতি, জনপদের জীবনযাত্রা, তাদের কর্মক্ষেত্র, পারিবারিক ঘটনাবলী ইত্যাদি পরিলক্ষিত হয়।
ভাটিয়ালি:
ভাটিয়ালী বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চলের জনপ্রিয় লোকগীতি। বিশেষ করে নদ-নদী পূর্ণ ময়মনসিংহ অঞ্চলের ব্রহ্মপুত্র নদের উত্তর-পূর্ব দিকের অঞ্চলগুলোতেই ভাটিয়ালী গানের মূল সৃষ্টি, চর্চাস্থল এবং সেখানে এ গানের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। বাউলদের মতে ভাটিয়ালী গান হলো তাদের প্রকৃতিতত্ত্ব ভাগের গান। ভাটিয়ালী গানের মূল বৈশিষ্টা হলো এ গানগুলো রচিত হয় মূলত মাঝি, নৌকা, দাড়, গুন ইত্যাদি বিষয়ে।
গম্ভীরা:
বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা ও পশ্চিমবঙ্গের মালদহ অঞ্চলে গম্ভীরার প্রচলন রয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা অঞ্চলের গম্ভীরার মুখ্য চরিত্রে নানা-নাতি খুব জনপ্রিয়।সনাতন ধর্মালম্বীদের অন্যতম দেবতা শিব। শিবের অপর এক নাম‘গম্ভীর’। শিবের উৎসবে শিবের বন্দনা করে যে গান গাওয়া হত- সেই গানের নামই কালক্রমে হয়ে যায়‘গম্ভীরা’। শিব> গম্ভীর> গম্ভীরা। পালা-গম্ভীরায় অভিনয়ের মাধ্যমে এক একটা সমস্য তুলে ধরা হত। চৈত্র-সংক্রান্তিতে পালা-গম্ভীরা পরিবেশন করা হত।
কবিগান:
কবিগান বাংলা লোকসংগীতের একটি বিশেষ ধারা। এই ধারায় লোককবিরা প্রতিযোগিতামূলক গানের আসরে অংশগ্রহণ করে থাকেন। কবিগান সাধারণত দুটি দলের দ্বারা গীত হয়। প্রত্যেকটি দলের নেতৃত্বে থাকেন একজন “কবিয়াল” বা “সরকার”। তার সহকারী গায়কদের বলা হয় “দোহার”। এঁরা সাধারণত নেতার কথাগুলিই পুণরাবৃত্তি করেন।
জারিগান:
জারি শব্দটির অর্থ বিলাপ বা ক্রন্দন। এ শব্দটির উৎস-মূল ফার্সি ভাষা। তবে, বাংলায় এসে শব্দটি অর্থ ব্যাপকতা লাভ করেছে। বাংলাদেশে মহররমের বিশেষ দিনে কারবালার শোকাবহ ঘটনা অবলম্বনে নৃত্যগীত সহকারে যে কাহিনী পরিবেশিত হয় তা সাধারণভাবে জারিগান বলে পরিচিত। ১৭শ শতক থেকে বাংলায় এই গানের ধারা প্রচলিত।
মৈমনসিংহ গীতিকা:
ময়মনসিংহ অঞ্চলের প্রচলিত পালাগানগুলোকে একত্রে মৈমনসিংহ গীতিকা বলা হয়। এই গানগুলো প্রাচীন কাল থেকে মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত হয়ে আসছে। তবে ১৯২৩-৩২ সালে ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন এই গানগুলো সম্পাদনা করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে প্রকাশ করেন। বর্তমান নেত্রকোণা জেলার আইথর নামক স্থানের আধিবাসী চন্দ্রকুমার দে এসব গাঁথা সংগ্রহ করছিলেন।
পূর্ববঙ্গ-গীতিকা:
পূর্ববঙ্গ অঞ্চলের প্রচলিত লোকসাহিত্যকে একত্রে পূর্ববঙ্গ গীতিকা বলা হয়। প্রাচীন কাল থেকে মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত হয়ে আসা পালাগুলি বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। ১৯২৬ সালে ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ সাহায্যে পালাগুলো সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন। পরে ১৯৭১-১৯৭৫ সালে ক্ষিতীশচন্দ্র মৌলিক ও সাত খণ্ডে প্রাচীন পূর্ববঙ্গ গীতিকা প্রকাশ করেন।
সিলেট গীতিকা:
সিলেটের লোকমানুষের রচিত মৌখিক কেচ্ছা, কাহিনী, যাত্রা-পালা ইত্যাদি লোকভাণ্ডারকে এক সাথে সিলেট গীতিকা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। সিলেট অঞ্চলের প্রাচীন লোকমানুষের দৈনন্দিন জীবনধারা, আদিবাসী মানুষের জীবন-জীবিকা, সামন্ততান্ত্রিক শাসন প্রণালী, গ্রামীণ লোকচার, আবেগ অনুভূতি, প্রেম-বিরহ, যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং মানবিকতা সম্মেলিত গাঁথাকেই সিলেট গীতিকার উৎস বলে ধরা হয়। অধ্যাপক আসদ্দর আলীর পদত্ত তালিকা অনুসারে ১২০টি লোকগাথাকে সিলেট গীতিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে [৯] এছাড়া চৌধুরী গোলাম আকবর সাহিত্যভূষণ ১৯৬৮ সালে বাংলা একাডেমী থেকে ১০ টি গীতিকা নির্বাচন করে একত্রে সিলেট গীতিকা নাম দিয়ে প্রকাশ করেন।
লোকগল্প:
লোকগল্প হচ্ছে সেসমস্ত গল্প মানুষের মুখে মুখে প্রজন্মের পর প্রজন্ম পাড়ি দিচ্ছে। এগুলো গদ্য আকারে রচিত এবং সরল কিংবা জটিল হতে পারে। বিষয়, অর্থ এবং গঠনের উপর ভিত্তি করে লোকগল্প হতে পারে রূপকথা, মিথ, অ্যাডভেঞ্চার গল্প, বীরত্বের গল্প, ঐতিহাসিক গল্প, মনীষীদের গল্প। এদেশীয় গল্পের চরিত্রগুলো মূলত ভাগ্যনির্ভর এবং গল্পগুলোতে জ্ঞান, বুদ্ধির বদলে জাদুকরী শক্তির প্রাধান্য দেখা যায়।
উপসংহার: বিশ্বায়নের ফলে আজ মানুষ বিদেশি বিশেষ করে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের জীবনাচরণে অভ্যস্থ হয়ে পড়ছে৷ কিংবা এটাই এখন স্টাইল হিসেবে উপস্থাপন করছে৷ যার ফলে আমরা ভুলে যাচ্ছি নিজেদের অতীত৷ অরিজিন৷ এখনই সময় সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে আমাদের লোক সাহিত্য রক্ষা করা৷ পাশাপাশি প্রাত্যাহিক জীবনে তার প্রয়োগ করা৷
তথ্যসূত্র:
– উইকিপিডিয়া৷
– বাংলাপিডিয়া৷
– www.myallgarbage.com
– ফেসবুক
– অন্যান্য
২ Comments
Thanks
অভিনন্দন