প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য
। শিরীন হোসেন ।
আমেরিকা ঘুরে এসে লিখেছেন বরেণ্য লেখক: শিরীন হোসেন
এশিয়া থেকে ইউরোপ, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দু’টো ভিন্ন পরিবেশ, ভিন্ন আবহ, ভিন্ন কালচার। তবু কোথায় যেন একটা মেলবন্ধন ঘটেই যায়। পুরো বিশ্ব যখন ইথারে ভেসে বেড়ায় তখন অচেনাও অনেক চেনা হয়ে যায়। আসলে ঘরের কাছেও অনেক জায়গা আছে যা আমরা দেখিনি, সেইসব জায়গার আবেদনও কম নয়। কিন্তু , আমরা তো বাউন্ডলেস বাউন্ডুলে। তাই পোটলা গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ি আবিষ্কারের নেশায় বুঁদ হয়ে। জানতে চাই যা কিছু অজানা।
উপমহাদেশে ঘুরে বেড়ানো আমার অনেক পুরোনো অভিজ্ঞতা, তারপর পাশ্চাত্যও টেনে নিল আমাকে। কোলকাতার পথে পথে, কিংবা শিমলা, পুনে, মুম্বাই, হিল্লি-দিল্লী করেছি যখন তখন কৈশোরের পড়া উপন্যাসের চরিত্রগুলো সামনে হেঁটে বেড়িয়েছে যেন। আবার নেপাল বা শ্রীলঙ্কা কিংবা থাইল্যান্ড-মালয়শিয়া-ইন্দোনেশিয়াতেও পেয়েছি মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়ে বেড়ানোর মজা ও আলাদা আলাদা অভিজ্ঞতা। আসলে সুন্দর এ পৃথিবীতে দেখার কোনো শেষ নেই।
উপমহাদেশের উষ্ণতা ছাড়িয়ে উড়ে যেতাম কনকনে শীতল রাজ্যে। সেখানে পেয়েছি সুশীতল শান্তিময় দিন-রজনী।
আমি ভ্রমণের জন্য গৃহত্যাগী যোগিনী হয়ে যাই অনায়াসে। আমি একটু উষ্ণতার জন্য খুঁজে ফিরি প্রকৃতির চাদর।
আমেরিকা যাওয়ার প্রিপারেশন নিচ্ছি।
মাস টা ছিলো অক্টোবর ২০০৯।
ভিসা পেলাম,
স্বপ্নের শহর দেখতে যাবো।
ভিষণ ভাবে অস্থিরতা কাজ করছিল।
টিকেট কেটে ফেললাম এমিরেটসে।
জনাব জুনায়েদ আমাকে অনেক সাহায্য করলেন, এয়ারপোর্টে।
জুনায়েদ ছিলেন এমিরেটস এর স্টেশন ম্যানেজার।
যাত্রা শুরু, প্লেনে তুলে দেয়ার জন্য ছেলে ,
মেয়ে , ভাগনী লুবনা , অলি সহ সানু আমাদের
বড় আদরের ছোট বোন।
উঠে গেলাম এয়ার এ।
বন্ধুত্ব গড়ে তোলা আমার ছোট বেলার অভ্যাস,
কাজেই ফ্লাইটে উঠে এয়ারহোস্টেজ ও এয়ার ক্রু রা হয়ে গেলো আমার বন্ধু।
দুবাই তে ট্রানজিটের পরেই, আমাকে
বিশেষ কনসিডারেশনে বিজনেস ক্লাসে বসার সুযোগ করে দেওয়া হলো।
গিফট দিলাম, গিফট পেলাম
হ্যান্ডক্যারি ব্যাগ হয়ে গেল আরও ভারি।
ভ্রমণ সময় হয়ে গেলো সংক্ষিপ্ত ।
সাত সমূদ্দুর-তেরো নদী পেরিয়ে গেলাম নিমিষেই , উড়ে।
যেন আমি বিশাল বড়ো এক গাঙচিল!
এখানেই বিস্ময়ের শেষ নয়।
বিস্ময়ের ডালা সাজিয়ে আপন কিছু মুখ অপেক্ষা করছিলো জে এফ কে- তে।
মুগ্ধ হলাম!
অভিভূত আমি ! পূর্ব থেকে পশ্চিমে প্রবেশ করেও
জে এফ কে থেকে ব্রুকলিন পর্যন্ত
ছবির মতো সাজানো পথটুকু
আমার কাছে এতোটুকুও অচেনা মনে হয়নি।
মনে হচ্ছিলো যেন কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্ট থেকে সিটিতে যাচ্ছি।
ব্রুকলিনের বাড়িতে পৌঁছেও বিস্ময়!
ফুলের পাপড়ি আর ভালবাসা মিলেমিশে
অভ্যর্থণার পথটা রক্তিম করে তুলেছিলো।
আমার জন্য এটি ছিলো এক লাল গালিচা।
অনেক দিন পর একত্রিত হলাম চার বোন।
এরপর মাখামাখি হলো ভালবাসা ও চোখের জল,
লুটোপুটি খেলো
আবেগ ও অভিমান,
আর আমরা খেলাম
অনেক রকম মুখরোচক খাবার।
পরদিন থেকে ছুটে চলা-
এয়ারপোর্ট জে এফ কে থেকে
লসএঞ্জেলস, ক্যালিফোর্নিয়া,
সানফ্রান্সিসকো, লাস ভেগাস,
হলিউড থেকে বোস্টন, কানেক্টিকাট,
আটলান্টিক সিটি, এরপর আবার ব্রুকলিন।
আমাদের ছুটে চলা ছিল দুর্বিনীত , গতি ছিল অশ্বের। কেটে গেল তিন টি মাস পলকে। অকাতরে ঘনিয়ে এলো ফিরবার সময়। আমি তো বাউন্ডুলে, অবাধ্য । আমি তো যাযাবর-হিপ্পি , আমি তো দুর্বার তৃষ্ণার্ত। এখানেই আমার চলা কিন্তু শেষ হলো না। এখানেই আমার পথও ফুরোলো না ।
আমি এখনো ছুটে যাই যখন যেমন খুশি, একা বা অনেকে মিলে। ঘর আমাকে যেন টানেই না।
শিরীন
১১/১১/২০২২