পায়রা বিবি
যুথিকা জ্যোতি, টরোন্টো, কানাডা
কয়েক বছর আগে এক জলসায় গিয়েছিলাম। সেদিন ছিল, ‘ভ্যালেনটাইনস ডে’। ঘরোয়া পরিবেশ হলেও পার্টি হলের সোনালী রঙের ঝুলন্ত সুদর্শন ঝাড়বাতির ঝিকিমিকি আলোর কণায় বেশ রোমান্টিক লাগছিল। দেখলাম, তখনও থোকায় থোকায় লালরঙের হার্টসেফের বেলুন আর সুবর্ণ আলোর মালায় চলছে ডেকোরেশনের পর্ব। তার ঘন্টাখানেক পরই শুরু হয় চমকপ্রদ প্রসাধনের বাহার ছড়িয়ে, আতরের গন্ধ উড়িয়ে, হাসির ফোয়ারা তুলে বাহুবেষ্টিত যুগলবন্দী কপোত-কপোতীর পালা করে আগমন, কথোপকথনের গুঞ্জরণ, হাসির কলতান।
ধীরে ধীরে বেশ আনন্দোৎচ্ছল সমারোহে ছেয়ে গিয়ে সৃষ্টি হয় এক মনোরম রোমাঞ্চকর পরিবেশ। বেশ উপভোগ্যই বটে! ক্ষীণ শব্দে গ্রামোফোন রেকর্ডে বাজজে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের অপূর্ব মূর্ছনা। অন্যদিকে আগন্তুক অতিথিরাও উন্মুক্ত চিত্তে কুশল বিনিময়ে মশগুল। পাশেই বিরাটাকারের একটি বিস্তৃত টেবিল জুড়ে সাজানো রয়েছে রকমারি আহারের চমৎকার বন্দোবস্ত। তার সাথে হুইস্কি, বীয়ার, ব্র্যাণ্ডি এবং সফ্ট ড্রিংক্সও আছে।
হঠাৎ দেখি, এক উর্বশী যুবতী রমণী ধুমকেতুর মতো আর্বিভূত হয়েই তার ডাগর চোখের অদ্ভুত দৃষ্টি মেলে কাকে যেন খুঁজজে।
শুভ্র মসৃণ তার অনাবৃত উর্দ্ধাংশের চটকদারী বেশভূষা আর চেহারায় মনে হয়েছিল যেন এক স্বপ্নপরী স্প্যানিশ কন্যা।
তার পরেই দেখি, ভ্রু-যুগলের ঢেউ তুলে, চোখেমুখের বিচিত্র ইশারায় কাকে যেন কী একটা সংকেত প্রেরণ করতে করতে গ্লাসে বিয়ার ঢালছে। ঢেলে গ্লাসটা হাতে নিয়ে ফিল্মী হিরোইনদের মতো প্রাণবন্ত চঞ্চলতায় রহস্যাবৃত চাহনি মেলে চোখদুটো ওর চড়কির মতো ঘুরছে চারিদিকে।
ফূর্তিতে হৃদয়ের দুকূল যেন একেবারে ভেসে যাচ্ছে ওর।
স্বাভাবিক কারণে উপস্থিত মন্ডলির প্রত্যেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সেদিকে। তাতে ওর প্রাধান্য অনেক বেড়ে গেল। যা ওর ছন্দময় পদাচারণে অনায়াসে বোধগম্য হচ্ছিল।
ওর মসৃণ কোমর ও নিতম্বখানি দুলিয়ে ইউরোপীয় ষ্টাইলে ছোট্ট-ছোট্ট চুমুক দিয়ে পান করতে করতে একটা সোফার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। দাঁড়াতেই দেখি, ভিড়ের মধ্যে থেকে পাগড়ি পরিহিত লম্বাটে সুঠাম, সুদর্শন চেহারার এক তরুণ যুবক এসে ওর গা-ঘেষে দাঁড়ায়। সেও উচ্ছ্বাসে একেবারে উতল।
৫৫৫ সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে পুরুষালি ইমেজে লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে-ছাড়তে তার মুগ্ধ চোখের দৃষ্টি মেলে আস্বাদন করতে থাকে, হৃদয়াকর্ষক সৌন্দর্যের পারিজাত ঐ উর্বশী রমণীর বাঁধ ভাঙ্গা উত্তাল যৌবনের চমকপ্রদ রূপ আর রঙ।
ইতিমধ্যে হারানো দিনের একটি গান দিয়ে শুরু হয় জলসার প্রথম পর্ব। তার পরেই সমগ্র উপস্থিত মন্ডলী সকলকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সেই উর্বশী রমণীর মনোমুগ্ধকর একটি নৃত্য পরিবেশনায়।
সেটি ছিল আশি দশকের একটি বাংলা ছায়াছবির গান। “গা ছম ছম কি হয় কি হয়/থমথমে রাত যতই বাড়ে/খুব সাদা পায়রা বিবি/নজর কখন ছোবল মারে/ম্যায় হুঁ পায়রা পায়রা বিবি পায়রা পায়রা বিবি হাম।”
ক্ষীণ আবছা অন্ধকারে সুবর্ণ ঝিকিমিকি আলোর কণায় মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল, নৃত্যটি যেন রঙ্গিন পর্দায় প্রদর্শীত হচ্ছে। উৎসুক্য হয়ে সমগ্র উপস্থিত মন্ডলী সবাই মুগ্ধ দৃষ্টিতে একেবারে উন্মত্ত চিত্তে নৃত্যটি উপভোগ করতে থাকে। কিন্তু জোরালো করতালি সহ একরাশ প্রশংসা কুড়িয়ে মন্ত্রের মতো হঠাৎ চোখের পলকে ওরা দুজনে (উল্লেখিত তরুণ যুবক) কোথায় যে উধাও হয়ে গেল, সেই রাতে ওদের আর দর্শন পাওয়া যায়নি।
তার মাস ছয়েক পরের ঘটনা। সেদিন আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন। চারদিক নিঝুম, নিস্তব্ধ। বৃষ্টিও পড়ছিল গুরি গুরি। তাই দৌঁড়ে যাচ্ছিলাম বাস ধরবো বলে। ইতিপূর্বে ট্রাফিক সিগন্যালের গ্রীন লাইটটা জ্বলে উঠতেই বাসটি দ্রুত পাস করে চলে গেল। আর তক্ষুণি মহিলা কণ্ঠস্বর কর্ণগোচর হতেই আমি থমকে দাঁড়াই। -‘আও ব্যাহেন আও, ইধার আও!’
পিছন ফিরে দেখি, একজন অচেনা অপরিচিত যুবতী মহিলা। কাঁচের তৈরী বাস ষ্টপেজের ছোট্ট শ্যাল্টারে বসে আছে। ওর আশেপাশে কেউ নেই। বৃষ্টির ছাপটায় সুস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছিল না। খানিকটা বিস্ময় নিয়ে এগিয়ে গেলাম। -কে এই মহিলা?
চোখে চোখ পড়তেই হাতের ইশারায় আমার ডাকলো। ওর কাছাকাছি পৌঁছাতেই ঠোঁটের কোণে অস্ফূট একটা বিষন্ন হাসি ফুটিয়ে বলল, -“হায়, হাউ আর ইউ? পহেচানা? ম্যায় রোহিনী, পায়রা বিবিকো এয়াদ হ্যায়?”
পায়রা বিবি? এ কি বলে! এমন নাম হয় না কি কারো! এ নামেতো কাউকে চিনিনা! কে এই মহিলা? ভাবতে ভাবতে ওর আপাদমস্তক নজর বুলাতেই আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই বিস্ময়ে। -এ কি, এ তো সেই উর্বশী রমণী। এ কি হাল হয়েছে ওর! জরাজীর্ণের মতো নিথর, নিস্তেজ শরীর। চোখমুখ শুকিয়ে একেবারে গর্তে ঢুকে গিয়েছে। একদম কঙ্কালের মতো দেখাচ্ছে। কোনো বিকার নেই। উচ্ছ্বাস নেই। সাজ-সজ্জার বালাই নেই। কেশ-বিন্যাশ এলোমেলো। প্রসাধনের অবস্থাও তদ্রুপ। পরনের পোশাকটি দামী হলেও মলিনতার ছাপ প্রকট।
ইত্যবসরে নাকের ডগা দিয়ে তীব্রবেগে চলে গেলো আরো দু’টো বাস। অথচ বাড়ি ফেরার কোনো তাগিদই বোধ করছে না রোহিনী। মনে হচ্ছিল, প্রবল ঝড়ের মুখে উড়ে আসা মুমূর্ষু পাখীর মতো নির্জনে চুপটি করে বিমূঢ় ভারাক্রান্ত মনে বসে আছে। সংসারে কেউ নেই ওর। বাড়ি ফেরার কোনো তাড়া নেই। ইচ্ছেও নেই। আর সময় মতো না ফিরলে বাড়িতে চিন্তা ভাবনা করবে, সেদিকেও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই! ব্যাপারটা কী! কিছু ঘটেনি তো! ভাবলাম মনে মনে।
হ্যাঁ, ঠিক তাই। অনুমান মিথ্যে নয়। ওর সন্নিকটে গিয়ে দাঁড়াতেই আমায় জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে ওঠে রোহিনী। সাশ্রুনয়নে বলে,-“ম্যায় লুট গয়ি ব্যাহেন, ম্যায় লুট গয়ি। বরবাদ হো গয়ি। সব খতম হো গয়া। মেরি জিন্দেগী অব খতম হো গয়ি।’’
তারপর ধীরে ধীরে সাশ্রুনয়নে উন্মোচন হতে লাগলো রোহিনীর প্রতারিত জীবনের করুণ কাহিনী।
প্রায় বছর দশেক আগে নব-পরিণীতা রোহিনী ইমিগ্র্যান্ট হয়ে কানাডায় পাড়ি দিয়েছিল প্রিয়তম স্বামী সিদ্ধার্থের হাত ধরে। জাতিতে ওরা দুজনেই মারাঠী। কোলকাতায় একই কলেজে পড়তো দু’জনে। সিদ্ধার্থের পিতা ছিলেন একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। তৎকালীন কোলকাতা শহরের পলিটিক্যাল পার্টির একজন বিশিষ্ট নেতা। উচ্চবিত্ত, সম্ভ্রান্ত ও ব্রাহ্মণ পরিবারের বংশধর। তারই সুপুত্র সিদ্ধার্ধ যোগলেকর। কিন্তু সিদ্ধার্ধ ছিল পিতার সম্পূর্ণ বিপরীত। রাজনীতির অঙ্গন থেকে একেবারে আলাদা। পড়াশোনার পাশাপাশি যন্ত্র সঙ্গীতে খুব পারর্দশী ছিল। গীটার প্লে করতো। ষ্টেজে পারফর্ম করতো। যাতে ওর পিতার প্রচন্ড অমত ছিল। আর সে কারণে পিতার সাথে সিদ্ধার্ধ সম্পর্ক ভালো ছিল না। ইকোনমিক্সে মাস্টার্স করে মাতা-পিতার অজ্ঞাতসারে রোহিনীর সাথে কোর্ট ম্যারেজ করে পাড়ি জমায় কানাডার ভ্যাঙ্কুভার শহরে।
তখন একদম কচি বয়স রোহিনীর। আবেগে, উচ্ছ্বাসে একেবারে উতলা। আকস্মিক নিজস্ব গণ্ডি ছেড়ে বাইরের রঙ্গিন পৃথিবীতে পর্দাপণ করে ধাঁধাঁয় পড়ে গিয়েছিল। ভেবেছিল আকাশের চাঁদটাই বুঝি পেয়ে গিয়েছে ওর হাতে। নাগাল পায় কে! খুশির পাল তুলে মুক্ত-বিহঙ্গের মতো জীবন জোয়ারে একাই ভাসতে থাকে। বিদেশী পর্যটকের মত প্রচণ্ড বিস্ময় ও উৎসুক্য নিয়ে শহরের নানাবিধ মনোহরা দর্শনীয় স্থানগুলি একে একে ঘুরে দেখতে লাগলো। যখন রামধনুর মতো ওর হৃদয় আকাশে আবির্ভূত হয়েছিল উজ্জ্বল গৌরবর্ণের সুঠাম, সুদর্শন চেহেরার তরুণ যুবক চিরঞ্জিত সিং।
ততোদিনে সিদ্ধার্থের কাঙ্ক্ষিত বাসনাগুলিও একে একে সব পূরণ হতে লাগলো। মর্যাদাসম্পন্ন উচ্চপদস্থ সরকারি চাকুরি, দেশীয় ষ্টাইলে আলিশান বাড়ি, গাড়ি, বিলাসবহুল আসবাবপত্র, অর্থ-বিত্ত-ঐশ্বর্য, দামী শাড়ি-গহনা, সব পরিপূর্ণ। যখন স্বর্গসুখ ছিল রোহিনীর হাতের মুঠোয়।
ইতিমধ্যে সুযোগ্য পুত্র সিদ্ধার্থর আশাতীত সাফল্যের সুসংবাদে মনের ক্ষোভ, অভিমান, অভিযোগ, অনুযোগ সব অপসারিত করে ওর মাতা-পিতা ভিজিট করতে চলে আসেন কানাডায়। যা স্বপ্নেও কোনোদিন কল্পনা করতে পারেনি।
কিন্তু বিধিই বাম! খণ্ডাবে কে! যোগলেকর পরিবারে আশাতীত এতো সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, আনন্দ মঞ্জুর হলো না বিধাতার। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো একদিন হঠাৎ মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় সিদ্ধার্থ মৃত্যু বরণ করে। ওর অপমৃত্যুতে নিভে গেল রোহিনীর ভালোবাসার প্রদীপ। ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল ওর সোনার সংসার, ভালোবাসার রাজপ্রাসাদ। অচিরেই ওর জীবনে ঘনিয়ে আসে অমাবস্যার মতো ঘোর অন্ধকার। চোখে পথ দ্যাখে না। ক্রমে ক্রমে জীবন-নদীর খেয়া ওকে নিয়ে চলে অনিশ্চিত মোহনার দিকে। যেখানে কূল নেই, কিনারা নেই, নেই বেঁচে থাকার কোনো উপাদান। যা কোনদিন ভাবতে পারেনি রোহিনী, তাই ঘটে গেলো ওর জীবনে।
সদ্য স্বামী হারানোর শোকে কাতর মুহ্যমান রোহিনীর উপর অমানবিকভাবে শুরু হয় শ্বশুর-শাশুড়ির শারিরীক ও মানসিক নির্যাতন, দুর্ব্যবহার, মিথ্যে কলঙ্ক-অপবাদ লেপন। নিষ্ঠুর নির্দয়ের মতো তাঁরা প্রতিনিয়ত শুধু বলতেন, -“ডাইনি, পোড়ামুখী, রাক্ষসী, আমাদের ছেলেটাকে তো খেয়েছিস। বংশে বাতি দেবার কেউ রইলো না। পেটেও ধরতে পারিস নি! কুলাঙ্গার, কুলক্ষণা! তুই দূর হ এখান থেকে। তোর মুখদর্শণ করলেও আমাদের অমঙ্গল হবে। তোর কেউ নেই এখানে। দুর হ তুই।”
অথচ ওনারা একবারও ভেবে দেখলেন না যে, অকাল বৈধব্যে তারুণ্যকে জলাঞ্জলি দিয়ে উনত্রিশ বছরের একটি যুবতী মহিলা একা কোথায় যাবে! কোথায় থাকবে! কিভাবে জীবনযাপন করবে! দূরদেশে যার কেউ নেই, সে কোন্ সাহারায় বেঁচে থাকবে!
তখনি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসে চিরঞ্জিত সিং। যাকে মনে-প্রাণে ভালোবেসে ওকে বিশ্বাস করে সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছিল রোহিনী। আর সুকৌশলে সুযোগের সদ্ব্যবহার করে, মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে রোহিনীর অন্ধকার জীবনে আলোর পথ দেখাতে চিরঞ্জিতই ভ্যাঙ্কুভার থেকে ওকে নিয়ে এসেছিল টরোন্টো শহরে। যদিও ওর অন্তরাত্মা সাড়া দিচ্ছিলো না, তবে বিবেকের দংশনের বিপরীতে নিজেকে শান্তনা দিয়ে সেদিন রোহিনী মনে-মনে ভেবেছিল, দিনকাল বদলে গিয়েছে, বদলে গিয়েছে মানুষের রুচি, ধ্যান-ধারণা। সতীদাহ প্রথাও উচ্ছেদ করে দিয়েছেন রাজা রামমোহন রায়। তারুণ্যে বিধবার পূণর্বিবাহের রেওয়াজও বহুকাল থেকেই প্রচলিত। পাপ-পূণ্যের দোহাই দিয়ে, নিজের সাধ-আহ্লাদ, কামনা-বাসনাগুলিকে বিসর্জন দেবার চেয়ে জীবনকে নতুন রঙে নতুন ঢঙ্গে সাজিয়ে তোলাই ঢের ভালো!
কিন্তু নারীর মন বড়ই নাদান। মতলবী পুরুষমানুষের ভণ্ডামী সহসা নারীর মনের আয়নায় ধরা পড়ে না। উপরন্তু, আবেগের বশীভূত হয়ে, দৃঢ় বিশ্বাসে ভর করে ভালো-মন্দ যাচাই না করেই অন্ধের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে ভালোবাসার গহীন সমুদ্রে। যার কূল নেই, কিনারা নেই, নেই গন্তব্যর কোনো ঠিকানা।
রোহিনী মনস্থির করে, লেখাপড়া শুরু করবে। টরোন্টো ইউনিভার্সিটিতে যাবে। স্বাবলম্বী হবে। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে।
শুনে খুব খুশি হয় চিরঞ্জিত। উৎসাহিত করে রোহিনীকে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে ওযে কী মতলব আঁটছিলো, তা ঘূণাক্ষরেও টের পায়নি রোহিনী।
প্রতিদিন আর্লি মর্নিং-এ দুজনে একসাথে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতো। আবার বিকেলের দিকে যথাসময়ে একসাথেই বাড়ি ফিরতো।
সেদিন যথারীতি রোহিনী বাড়ি ফিরে এসে দ্যাখে, ঘরের দরজাটা আলতোভাবে খোলা। ভাবলো, চিরঞ্জিত এসে পড়েছে। এখুনিই চা-নাস্তা তৈরী করতে হবে।
এইভেবে দ্রুত ঘরের ভিতরে ঢুকেই মাথায় যেন ওর বজ্রাঘাত পড়ে। -এ কী! ঘর-দুয়োরের এ অবস্থা কেন? ঘরের জিনিসপত্র সব এলোমেলো! চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কোথায় চিরঞ্জিত? ওতো এখনো আসেই নি! তবে কি বাইরের কেউ ঘরের ভিতর ঢুকে ছিল? সর্বনাশ!
বিচলিত হয়ে পড়ে রোহিনী। কি করবে দিশা খুঁজে পায় না। দ্রুত এ-ঘর ও-ঘর নজর বুলিয়ে দ্যাখে, চিরঞ্জিতের পরনের জামা-কাপড়, কোট-টাই, দামী স্যুট কিছু নেই। লেদারের বড় একটা স্যুটকেস ছিল, সেটাও নেই। তার মধ্যেই সযত্নে রাখা ছিল রোহিনীর কিছু দামী শাড়ি, গহনা, টাকা পয়সা, ল্যাডিং পেপার, কানাডিয়ান সিটিজেনশীপ পেপার, পাসপোর্ট সব। শুধুমাত্র পড়নের কাপড় আর হাতের বালা দু’টিই ছিল ওর একমাত্র সম্বল। একটা সূতো পর্যন্তও অবশিষ্ট ছিলো না রোহিনীর।
অথচ তখনও ওর একবারও মনে হয়নি যে, এসব চিরঞ্জিতের কাজ। ওযে কখন এসে সব হাতিয়ে নিয়ে গিয়েছে, রোহিনী ঘূণাক্ষরেও টের পেলো না। এমনকী যে বাড়িতে ওরা থাকতো, সেবাড়িটাও অন্যের মালিকাধীনে চুক্তিবদ্ধ করে অস্থায়ীভাবে গচ্ছিত রেখে গিয়েছে।
তার পরেও সরলমনা রোহিনী উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় চিরঞ্জিতের অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে থাকে! ওর দৃঢ় বিশ্বাস, চিরঞ্জিত ফিরে আসবেই! কিন্তু কোথায় চিরঞ্জিত?
সন্ধ্যে পেরিয়ে ক্রমশ রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। ওর কোনো পাত্তা নেই! ওকে কল করলে সুইচ অফ্ বলছে।
দুঃশ্চিন্তা দুর্ভাবনায় রোহিনী অস্থির হয়ে ওঠে। মনে বিভীষিকা। কিন্তু কতক্ষণ! রাত পোহাতেই উদ্ভ্রান্ত রোহিনীর মনের মধ্যে ধীরে ধীরে একটু একটু করে সন্দেহের দানা বাঁধতে শুরু করে। তবু কিছুতেই ওর বিশ্বাস হয় না। মন মানতে চায় না। উলটে অন্ধ ভালোবাসার মায়া মোহের বশীভূত হয়ে দৃঢ়ভাবে নিশ্চিত হয়, নিশ্চয়ই চিরঞ্জিত কোথাও ফেঁসে গিয়েছে। অথবা কোনো বিপদে পড়েছে। ফিরে ও’ আসবেই।
কিন্তু চাকুরির ইন্টারভিউ দেবার বাহানায় ঊষার প্রথম প্রহরে ঘন কূয়াশায় গা-ঢাকা দিয়ে বাড়ি থেকে সেই যে বেরিয়ে গিয়েছে আর ফিরে আসেনি চিরঞ্জিত।
অথচ মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধান! অন্যান্য দিনের তুলনায় সেদিন নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল চিরঞ্জিত। কিছুদূর গিয়ে পিছন ফিরে বেশ কিছুক্ষণ রোহিনীর মুখপানে পলকহীন নেত্রে তাকিয়ে ছিল। তখন মনে হয়েছিল, কোনো প্রয়োজনেই বোধহয়! কিন্তু অন্যদিনের তুলনায় দৃষ্টিটা একটু ব্যতিক্রম মনে হতেই ঘর থেকে ছুটে বাইরে বেরিয়ে এসেছিল রোহিনী।
ইতিপূর্বে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই চিরঞ্জিত মুখ ফিরিয়ে মায়া মরীচিকার মতো চোখের নিমেষে মিলিয়ে গেল ঘন কূয়াশার মাঝে। তখন কি একবারও ভাবতে পেরেছিল রোহিনী, চিরদিনের মতো বিচ্ছিন্ন হয়ে চিরঞ্জিত ওর জীবন থেকে একেবারেই অদৃশ্য হয়ে গেল।
কয়েক পক্ষকাল কেটে যেতেই রোহিনী দৃঢ়ভাবে নিশ্চিত হয়, চিরঞ্জিত ওকে ধোকা দিয়েছে। ওকে ইউজ করেছে। ওকে প্রতারিত করেছে। রোহিনী চিৎকার করে ওঠে, -“চিরঞ্জিত তুমি একজন ফ্রড, প্রতারক। বন্ধুত্বের বাহানায় আমার সাথে ছলনা করেছ, বিশ্বাসঘাতকতা করেছ। আমাকে ঠকিয়েছ। ভালো তুমি কখনোই বাসোনি। তোমার মতো মানুষ কখনো ভালোবাসতে পারো না। মেয়েদের মন নিয়ে ছিনিমিনি খেলাই তোমার পেশা। আমার ইমোশান নিয়ে তুমি খেলা করেছ, আমাকে আঘাত করেছ। দীর্ঘ তিনটি বছর ছেলের হাতের মোয়া দেখিয়ে আজ আমার জীবনের শেষ সম্বলটুকুও তুমি ছিনিয়ে নিয়ে গেছ। আমাকে একেবারে নিঃশ্ব করে দিয়ে গেছ। কিছুই অবশিষ্ঠ রাখোনি। ভগবান তোমায় কোনো দিনও ক্ষমা করবে না। জীবনে তুমি কোনোদিন সুখী হতে পারবে না।”
রোহিনী আজ পথের ভিখিরী। অনুতাপ আর অনুশোচনার আগুনে দগ্ধ হতে হতে জীবনের সব চাওয়া-পাওয়া, বড় হওয়ার স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্খা, বিশ্বাস-ভালোবাসা, ভালোবাসার ইচ্ছা-আবেগ-অনুভূতি, কামনা-বাসনা জ্বলে পড়ে সব ছাই হয়ে গিয়েছে। মরে গিয়েছে ওর বেঁচে থাকার সাধ। কোনো কিছুতেই ওর আগ্রহ নেই, উৎসাহ নেই। কানাডার মতো দেশে থেকেও সেদিন রোহিনীকে দেখে মনে হয়েছিল, শুধু প্রাণটা নিয়েই এতিমের মতো শহরের অলিতে-গলিতে অপদস্থ হয়ে অস্তগামী সূর্য্যের মতো প্রহর গুনছে মৃত্যুর অপেক্ষায়।
টরোন্টো, কানাডা
২ Comments
দিদি চমৎকার লেখা। এই ম্যাগাজিনে আমার কিছু লেখা শেয়ার করতে চাই।
আপনার মন্তব্যের জন্য অশেষ ধন্যবাদ আপনাকে।
আপনি আপনার লেখা এই ম্যাগাজিনে শেয়ার করতে চান। সম্পাদক সাহেবের সাথে যোগাযোগ করুন।