১৯৫ বার পড়া হয়েছে
পান্ডুর চোখে ভোরের কারুকার্য
[বকুল আখতার দরিয়া]
গতরাতে শরীর খারাপের ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিল সুহানা । টিনটিনটাও একই বিছানায় ওর বুকের কাছটি ঘেঁষে ঘুমিয়েছিল। একটা দুঃস্বপনের তলদেশ থেকে উঠতে গিয়ে ঘুম ভেঙে গেলো তার। জেগে দেখে
ঘরের প্রত্যেকটি রুমে আলো জ্বলছে। টিভিও চলছে।
আড়মোড়া দিয়ে টের পেলো, প্রকৃতি তাকে ডাকছে। ওয়াশ রুমের দরজা ঈষৎ ঢিলে রাখে সে। ঢিলে রাখলে টিনটিনটা ওয়াশ রুমে ঢোকার জন্য উন্মুক্ত হয়ে থাকে। একটানা ম্যাও ম্যাও করেই চলে। টিনটিন একটা মেয়ে বিড়াল ছানা, ওয়াশ রুমের দরজার ফাঁক গলে টিনটিনও ওয়াশ রুমে ঢুকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে সুহানার নিন্মাগ্নের গহিনে। লাজুক স্নানঘরের প্রতিটি ইটের ভাঁজও যেন সেই লাজুক দৃশ্য দেখে হেসে লুটোপুটি খেতে থাকে! সুহানা টিনটিনকে আচ্ছা করে বকে দেয়।
ইদানীং শরীরটা বড্ড বেয়াড়া হয়ে গেছে। শাসন বারণের বালাই নেই বললেই চলে। তাছাড়া , মেঘে মেঘে বেলাও যে গড়িয়ে গেছে। উনপঞ্চাশ কি এমন বয়স তার! তারওপর বাড়িতে সে একাই থাকে। ওর একাকীত্বের বেদনা ওকে সাহসী হতে শিখিয়েছে। শিখিয়েছে, কি করে ভালো থাকা যায়। শিখিয়েছে কি ভাবে প্রাত্যহিক ঝঞ্ঝাটময়
রুগ্নতাকে রুখে দেয়া যায়। মানিয়ে নেয়াতেই যে সুখ নিহিত এটা সুহানা বুঝতে পারে। মানিয়ে না নিলেও যে নিস্তার নেই এ জীবন থেকে এটাতো সত্যি! তাই সে এ জীবন অভ্যস্হ করে নিয়েছে বেশ!
ওর বড় বোন স্কুলের প্রধান শিক্ষক। গেলো মাসে তিনবোন একত্র হয়েছিল। সুহানা আড়চোখে বড় বোনদের ত্বকের বাহারি ঝিলিক দেখে নিয়েছিলো। কি সুন্দর ত্বক তাদের! সুহানা বড়বোনদের সৌন্দর্যের প্রশংসাও করতে পারেনি। পাছে নিজের রুগ্নতার যাতনার বর্ণনা দিতে হয়! সুহানার অসুস্থতার ইতিবৃত্ত ওরা জানলেও সে কখনো মুখ ফুটে বলেনি যে, সে ইদানীং খুব ভালো নেই।
সুহানা সকালে ঘুম থেকে উঠে লক্ষ্য করলো, অন্য একটি রুমের দরজা খোলা। ওই দরজা দিয়ে ওর বাড়ির আঙিনায় যাওয়া যায়। শয়ন কক্ষে এসে মোবাইল হাতে নিয়ে সময় দেখতে গিয়ে দেখলো চার্জ নেই। গতরাতে নেটে ছিলো সে। কিছু লিখতে চেষ্টা করছিলো । কখন যে ঘুমের নগরে ডুবে গিয়েছিলো টেরই পায়নি!
আজকের স্বপ্নটার কোনো দৃশ্যই তার মনে পড়ছে না এখন। তবে স্বপ্নের প্রেক্ষাপট যে, ভীতিকর ছিলো তা অনুধাবন করতে পারছে। যাগগে, স্বপ্ন টপ্নো নিয়ে আজকাল ওর তেমন মাথাব্যথা হয়না। আগে এমন একটা সময় ছিলো যে, কোনো রাতে স্বপ্ন না দেখলে ঘুম থেকে উঠে ওর মন খারাপ হয়ে যেতো! তখনকার স্বপ্নগুলো বড্ড রঙিন প্রচ্ছদে মোড়ানো ছিলো! আকাশে পাখির মতো ডানা মেলে উড়ে চলা, গাছের মগডালটাকে সাইকেল বানিয়ে চালানো , নদীতে সাঁতার কাটা, প্রিয় বান্ধবী লিপিকা আর বড়বোন রাখির সাথে খুনসুটিতে মেতে থাকা! আরও কতো রকম সেসব স্বপ্ন!
তার স্বপ্নের ঘোরে নদীতে সাঁতার কাটার ব্যাখ্যা ওর মনের অপ্রাপ্তির বেদনাকে ভুলিয়ে দিয়েছিলো অনেকটা। আগের চেয়ে এখনকার স্বপ্নগুলো অন্য রকম। রঙের ছোঁয়া নেই! মাথার ওপর ছেঁড়া ছেঁড়া কালো কালো মেঘ উড়ে যায়! সাথী হারা বলাকা উড়ে যায় দূর পাহাড়ের গা ছুঁয়ে। অথচ কোথায় তার গন্তব্য রয়ে যায় অবলোকনের অন্তরালে। বাগিচায় ফুটন্ত গোলাপ ফুলগুলো নিমিষেই বিবর্ণতার আঁধারে হারিয়ে যায়। স্বপ্নগুলো কখনো কখনো জল থইথই থেকে জলোচ্ছ্বাস হয়ে প্লাবিত বনভূমিতে ধ্বংসাত্মক আলোড়ন সৃষ্টি করে দেয়, আবার কখনো দমকা হাওয়ায় পরিপাটি করে রাখা আশা জাগানিয়া অনাবাদি জমিকে ক্ষত-বিক্ষত করে দেয়। রাত শেষে ঘুমভাঙা চোখে সেসব স্বপ্নের ধুসর স্মৃতি মনে করতে চেষ্টা করে সুহানা, কিন্তু সে স্মৃতি বড্ড অধরা হয়ে যায়! কিছুতেই মনে আনতে পারেনা সে। তখন বড্ড বেশি মন খারাপ হয় ওর! স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে সে একটা স্বপ্নে তাবির নামে বই কিনেছিল। স্বপ্ন দেখলেই সকালে সেই বইখানায়
স্বপ্নের ব্যাখ্যা খুঁজতে হুমড়ি খেয়ে পড়তো। তখন নদীতে সাঁতার কাটার স্বপ্নের ব্যাখ্যাটা সত্যি হয়েছিলো। সুহানা বিদেশ থেকে পুরষ্কার অর্জন করেছিলো। এছাড়া এ জীবনে আর কোন স্বপ্নই সত্যি হয়নি। যা কিছু পেয়েছে তা না চেয়েও অনায়াসে পেয়েছে আর যা চেয়েছে তা অধরা থেকে গেলো!
ওয়াশ রুম থেকে রান্না ঘরে ঢুকলো সে। চুলা জ্বালাতে গিয়ে দেখলো গ্যাস নেই। শীত আসলে ঠিক সাতটায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। ওটসের পায়েস রান্না আজ আর হলো না।
ভারী কোনো খাবার সে সকালে গ্রহণ করে না। বাড়ির পাশের দোকান থেকে পাউরুটি এনে শুধু এক কামড় খেয়েই রেখে দিয়েছে। ঘনঘন পানি পান করছে সে। মোবাইলে চার্জ সত্তর পার্সেন্ট হয়ে গেছে। গতকাল একটা গল্প লেখায় হাত দিয়েছিল। লেখায় বিঘ্ন ঘটলে আর মন বসাতে পারে না। আজ শেষ করতে হবেই মনস্থির করলো। ডক্স এপ্সে না ঢুকে প্রথমে ফেইসবুকে ঢুকলো। একটা নোটিফিকেশনে চোখ পড়তেই অস্থির হয়ে উঠেছে তার মন। আজ তার বড় ছেলে আয়ানের জন্মদিন! প্রতি বছরের নভেম্বর মাস এলেই রাত বারোটার পর ও আয়ানকে ফোন করে কিম্বা স্ট্যাটাস দিয়ে উইশ করে। গতরাতে শরীর খারাপের ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিল বলে সেটা আর হয়ে উঠেনি। তড়িঘড়ি করে একটা স্ট্যাটাস আপলোড করলো। আয়ান চাকরি করে। বউ বাচ্চা নিয়ে ঢাকা থাকে। সুহানাকে ঢাকায় ওদের সাথে থাকতেও বলে, কিন্তু সুহানার মন টেকেনা বন্ধ ঘরের একঘেয়ে জীবন চৌহদ্দির অভ্যন্তরে । ছেলে এবং বউ ওকে বোঝায়, এই অসুস্থতা নিয়ে একা থাকা ঠিক নয়। তবুও সে বাড়িতে থাকতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। সে একজন প্রগতিশীল চিন্তার মনমানসিতার মানুষ। লেখালেখি, সংগঠন পরিচালনা, পত্রিকা সম্পাদনা সহ আরও অনেক কাজ তার। মুলতঃ লেখালেখিটাই ওর একাকীত্বকে ভুলিয়ে দেয় অনেকটা।
আজকাল কিছুই মনে থাকে না তার। স্বামীর মৃত্যুটা তাকে এতোটাই
অপ্রস্তুত করে দিয়েছিল যে, সেটা সামাল দিতে আজও সে দিশেহারা হয়ে যায় । বুকের ভেতর জীবন্ত একটা লাশের কফিনের মুখ বন্ধ করার হাতুড়ির আঘাতের মতো শব্দ শুনতে পায়। সে শব্দ অন্য কেউ শুনতে পায় না । রাতের নির্জনতা ভেদ করে সেই শব্দ ঘুরপাক খায় সুহানারই শয়ন কক্ষে! হামাগুড়ি দেয় ওর বিছানায় এবং মেঝেতে ! ওর সর্বাঙ্গে হাত বুলিয়ে দেয় অহরাত্রী, অথচ সুহানার চোখ দু’টো সেই রাতের নৈঃশব্দতাকে খানখান করে দিয়ে একটা নুতন ভোরের আবহে স্নান করার স্বপ্নে বিভোর হয়। তার ধুসর পান্ডুর চোখ দুটো চকচক করে জ্বলে ওঠে সেই নুতন ভোরের প্রত্যাশায়। সেই ভোরের কারুকার্যে সে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে উজাড় করে দেয়ার নিটোল স্বপ্নে বিভোর হয়ে ওঠে
১ Comment
congratulations