১৪০ বার পড়া হয়েছে
নিউইয়র্ক বইমেলার খণ্ডচিত্র
বাংলা সাইনবোর্ড আর খানাখাদ্যের বিপুল সম্ভারে কালিজিরা জিলিপির মুচমুচে উপস্থিতি
লুৎফর রহমান রিটন
নিউইয়র্ক বইমেলায় গেলে একসঙ্গে অনেক বন্ধুর দেখা মেলে। এক ঢিলে বহু পাখিকে মুঠোবন্দী করা যায়। পুরনো বন্ধুর সঙ্গে রিইউনিয়নের সুযোগ হয়। এবং বন্ধু তালিকায় যুক্ত হয় অনেকগুলো নতুন নাম, নতুন মুখ। এবারের ৩১ তম বইমেলায় গিয়েও ঠিক তেমনটাই হলো।
বহু বছর পর দেখা হলো অনুজপ্রতিম অর্থনীতিবিদ বিরূপাক্ষ পালের সঙ্গে। বাংলাদেশে খ্যাতিমান বিতার্কিক বিরূপাক্ষ ছিলো বিতার্কিকদের নেতা। ডিবেট ফেডারেশনের কর্মকর্তা। দেখা হলো মৌসুমী দাশ পুরকায়স্তর সঙ্গে। কৈশোরে মৌসুমী ছিলেন খেলাঘরের সদস্য আর আমি কচি-কাঁচার মেলার। তিরিশ-চল্লিশ বছর পর আমাদের দেখা। বইমেলায় মৌসুমী এসেইছিলেন আমার সঙ্গে এক ঝলক দেখা এবং স্মৃতি হাতরানোর উদ্দেশ্যে। ফেসবুকে আমার গদ্য-পদ্য যে কোনো লেখা আপলোড করার পর শাহানা বেগম নামের একজন মানবিক পাঠক সেটা পাঠ করেন এবং আমাকে প্রাণিত করেন তাঁর হার্দ্যিক উচারণে। তিনি এসেছিলেন কন্যাসমেত। কন্যার নাম সুমাইয়া। এই নামের একটা মেয়েকে নিয়ে ফেসবুকে একটি ছড়া লিখেছিলাম। সেখানে মন্তব্যের ঘরে শাহানা জানিয়েছিলেন তাঁর কন্যার কথা। সেই কিশোরী কন্যা সুমাইয়াকে নিয়ে এসেছিলেন তিনি ‘রিটন মামা’র সঙ্গে দেখা করিয়ে দিতে। ফারজিন রাকিবার প্রতিভাবান সন্তান যাকে তিনি বলেন তাঁর ‘পুতলা’, সেই কাব্য আমার বহু ছড়া আবৃত্তি করেছে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। নৃত্যেও দুর্দান্ত সে। পুতলাটার সঙ্গে দেখা হলো। বড় হয়ে যাচ্ছে খুদে পুতলাটা।
ঢাকা কলেজের ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের সাবেক চেয়ারম্যান প্রোফেসর নিলুফার আখতারের সঙ্গে দেখা হলো। তিনি আমার বিশেষ প্রীতিভাজন শামীম শাহেদের ছোটভাইয়ের শাশুরি। আমার ছড়া নিয়ে তাঁর উচ্ছ্বাস দেখে প্রাণিত হলাম। বহু বছর আগে লেখা আমার ‘হ্যান করেঙ্গা ত্যান করেঙ্গা’ ছড়ার কয়েকটা পঙ্ক্তি তিনি শুনিয়েও দিলেন নগদে। ভালো থাকবেন আপা। আশীর্বাদ করবেন। আমি আপনার ঢাকা কলেজেরই ছাত্র!
০২
মীম নামের পিচ্চি একটা মেয়ে বাংলা একাডেমির একুশের বইমেলায় আসতো। মেলার একজন খুদে লেখক হিশেবে ওর প্রতি বছর সদ্য প্রকাশিত নতুন বইটা হাতে নিয়ে সে আসতো আমার উপস্থাপিত ‘বইমেলা সরাসরি’ অনুষ্ঠানে সাক্ষাৎকার দিতে। প্রতি বছরই নতুন একটা বই বেরুতো ওর। আর আমিও সেই বইটিসহ ইন্টারভিউ করতাম প্রতিবার। ভালোবেসে মেয়েটা আমাকে ‘বাবা’ সম্বোধন করতো। দিন যায়। মেয়েটা একটু একটু করে বড় হয়। কয়েক বছর পর একুশের বইমেলায় এক সন্ধ্যায় ওর ফোন কল এসেছিলো–বাবা আমি আসছি প্লিজ আপনি চলে যাবেন না যেনো। আমার খুব জরুরি একটা কাজ ছিলো। তাগাদা আসছিলো সেখান থেকে। আমি তাই কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর মীম নামের মেয়েটাকে বলেছিলাম, আজ দেখা হচ্ছে না। আমাকে চলে যেতে হচ্ছে। অপর প্রান্ত থেকে মেয়েটার আকুতি ঝরে পড়ছিলো–প্লিজ বাবা, এর একটু অপেক্ষা করুন আমি পৌঁছে গেছি প্রায়। কাল আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষা। আজ প্রথম শাড়ি পড়লাম তো। শাড়ি পরা আমাকে একটু দেখবেন না বাবা!
সেদিন আমি আমার জরুরি কাজটা বাতিল করে অপেক্ষা করেছিলাম জীবনে প্রথম শাড়ি পরে মেলায় আসা মেয়েটার জন্যে। সেই মীমের সঙ্গে দেখা নেই অনেক বছর। আমি নিউইয়র্ক বইমেলায় যাচ্ছি জেনে সে ইনবক্সে জানতে চাইলো–বাবা আপনি কোন্দিন কখন থাকবেন? আমি আসবো আপনার সঙ্গে দেখা করতে। আমি এখন পেন্সিলভানিয়ার গেটিসবার্গ শহরে থাকি। আব্রাহাম লিংকনের সেই বিখ্যাত গেটিসবার্গ এড্রেস। আমেরিকার সিভিল ওয়ারের গেটিসবার্গ।
আমার জানা ছিলো না মেধাবী ছাত্রী মীম নোশিন নাওয়াল খান ওখানে পড়াশুনা করছে। নিউইয়র্ক থেকে তিন/চার ঘন্টার ট্রেন যাত্রার দূরত্ব। মীমের সহপাঠী আমেরিকান বন্ধু চার ঘন্টার দীর্ঘ পথ ড্রাইভ করে এবং ঘন্টা খানেকের বাস যাত্রার পর মীমকে দুপুর বেলায় নিয়ে এসেছে আমার সঙ্গে দেখা করাতে। অনেক বছর পর পিতা-কন্যার মিলন দৃশ্য মুগ্ধ নয়নে অবলোকন করছিলো ব্রেইডেন নামের লাজুক এবং হাসিখুশি লম্বু ছেলেটা। মেসেঞ্জারে লিখেছিলো মেয়েটা–লাঞ্চ করে ফেলেছেন বাবা? না হলে আপনার সাথে লাঞ্চ করতে আসছি।
দুপুরে বইমেলায় বিশ্বজিৎ সাহার সঙ্গে ওদের পরিচয় করিয়ে দিলাম। বিশ্বজিৎ আমাদের সঙ্গেই লাঞ্চ করার আমন্ত্রণ জানালেন ওদের। শাদা পোলাও আর ছাগমাংসের ভুনা খুব আগ্রহ নিয়ে খেলো মীমের বন্ধু ব্রেইডেন। কিছুদিন আগে, ছুটিতে মীম বাংলাদেশে চলে গেলে মীমের সঙ্গে দেখা করতে ওর এই বন্ধুটি চলে গিয়েছিলো বাংলাদেশে। ওর সঙ্গে কথা বলে জানলাম বাংলাদেশে ওর খুব প্রিয় ছিলো সিঙ্গারা ফুচকা চানাচুর আর মিষ্টি। মীম বললো–এক বসায় কয়েক প্যাকেট চানাচুর সে হাপিস করে দেয়। ঝাল তার খুবই প্রিয়।
(অনেক আশীর্বাদ আমার কন্যাটিকে। ব্রেইডেনের সঙ্গে তোমার জীবনটা খুব আনদে কাটুক মেয়ে। অনেক দূরের দেশ আমেরিকায় এসে তুমি তোমার কাঙ্খিত বন্ধুটিকে আবিস্কার করেছো। অন্য একটি মহাদেশে তোমার অপেক্ষাতেই ছিলো সে। তোমরা সুখি হও।)
০৩
এবার বইমেলায় অনেকগুলো অনুষ্ঠানে আমার অংশগ্রহণ ছিলো। অনেকবার আমাকে মঞ্চে উঠতে হয়েছে। প্রতিবারই বিপুল আনন্দ নিয়ে মঞ্চ থেকে নেমে এসেছি। আমার প্রতি সম্মিলিত মানুষের সীমাহীন ভালোবাসা দেখে আপ্লুত হয়েছি বারবার। শনিবার সন্ধ্যায় ‘আমার ছড়ার জার্নি’ শীর্ষক একক বক্তৃতায় ছড়ার সঙ্গে আমার ব্যক্তিজীবনের গভীর সম্পর্কের যোগসূত্র যখন বয়ান করছিলাম অকপটে, তখন মিলনায়তন ভর্তি মানুষ অশ্রুসজল করতালিতে প্রীতি বর্ষণ করেছে আমার প্রতি। ছড়ার সঙ্গে আমার গাঁটছড়ার সংঘাতময় অনুষঙ্গগুলোয়, আমার সমস্ত অপমান অসম্মান বঞ্চনা আর প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির আনন্দ-বেদনার সংগ্রামমুখরতার
বিষয়সমূহে তাঁদের অকুণ্ঠ সমর্থন তাঁরা প্রকাশ করেছেন অশ্রু করতালি আর আলিঙ্গনের মুহূর্মুহু প্রকাশের মাধ্যমে। এই সময়টায় মিলনাতনের দর্শক সারিতে নিউইয়র্কের ডাকসাঁইটে দুই সম্পাদক মঞ্জুর আহমেদ ও কৌশিক আহমদের আশেপাশেই দেখেছি প্রিয় বর্ষিয়ান ব্যক্তিত্ব ডক্টর নূরুন নবী ফেরদৌস সাজেদিন ও নিনি ওয়াহেদকে। দেখেছি চেনা অচেনা আরো অজস্র আন্তরিক টলটলে চোখ আর ঝলমলে মানুষের ভালোবাসার প্লাবনকে।
জেমাইকা সেন্টার ফর আর্টস এন্ড লার্নিং মিলনায়তনের এই সন্ধ্যেটা আমার জীবনের এক স্মরণীয় সন্ধ্যা হয়ে থাকলো।
০৪
শেষদিন অর্থাৎ ৩১ জুলাই রোববার লাঞ্চের আগে দুপুর বারোটায় ছিলো জম্পেশ আড্ডার একটি পর্ব, আমার সঞ্চালনায়। এই পর্বে আমার সঙ্গে মঞ্চে আসীন ছিলেন নূরুন নবী, ফেরদৌস সাজেদীন, আবেদিন কাদের, লিজি রহমান, আহমাদ মাযহার, নিনি ওয়াহেদ, ফাহিম রেজানূর, জসিম মল্লিক, শিব্বির আহমেদ, মনজুর কাদের এবং হাসানুজ্জামান সাকী। শেষ মুহূর্তে শামিল হয়েছিলেন আসাদঅ মান্নানও।
আমার বন্ধু কথাশিল্পী ও চলচ্চিত্র নির্মাতা আনোয়ার শাহাদাত, মাথায় সুন্দর হ্যাট ও সাসপেন্ডার সম্বলিত স্বেতশুভ্র চমৎকার একটি প্যান্ট এবং শাদা স্নিকার পরে এসেছিলেন। আড্ডার পুরোটা সময় তিনি মঞ্চেই ছিলেন আমাদের সঙ্গে কিন্তু পূর্বাহ্নেই আমাকে অনুরোধ করেছিলেন যেনো তাঁকে কিছু বলতে না হয়। আমি আমার বন্ধুর অনুরোধ রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর ছিলাম।
০৫
চতুর্থ দিন সন্ধ্যায় ফেরদৌস সাজেদীনের সঞ্চালনায় ‘কেনো লিখি’ পর্বে কথক ছিলেন সুইডেন থেকে আসা দেলওয়ার হোসেন, আসাদ মান্নান, অমর মিত্র এবং লুৎফর রহমান রিটন। শহিদ পরিবারের সদস্য দেলওয়ার হোসেনের পরিবারে ঘটে যাওয়া একাত্তর এবং তার পরবর্তী শোক ও বিপর্যয়ের কাহিনি শুনতে শুনতে বেদনার্ত হয়েছি। তিনি তাঁর ‘৭১-এ সন্তানহারা এক মায়ের আত্মাহুতি, মোর নয়া মিয়া আর ফিরি আসপে না’ নামের বইটি লেখার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেছেন ফোঁপানো কান্নাকে সঙ্গী করে। নয়া মিয়া হচ্ছেন দেলওয়ারের বাবা। একাত্তরের বাবা হারানো মা হারানো কিশোর দেলওয়ার লেখক হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের কথা লিখবেন বলেই।
কেনো লিখি পর্বটি শুরু হবার সময় দেলওয়ার হোসেন তাঁর বক্তৃতা দিতে রস্ট্রামের দিকে যাত্রা শুরুর সময়ই ঘটে ছন্দপতন। এই সময় মিলনায়তনে প্রবেশ করেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন, ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এবং জাতিসংঘে স্থায়ী প্রতিনিধিসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা।
অনুষ্ঠান থামিয়ে তাঁদের তিনজনকে মঞ্চে নিয়ে আসা হয়।
‘কেনো লিখি’ পর্বে সেদিন মঞ্চে আমাদের পাশেই আসীন হয়েছিলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন, রাষ্ট্রদূত শহীদুল ইসলাম এবং জাতিসংঘে সদ্য যোগ দেয়া স্থায়ী প্রতিনিধি আবদুল মুহিত।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর নিজের ১২টি বইসহ তাঁর স্ত্রীর একটি বই বিশ্বজিৎ সাহা ও বইমেলার আহবায়ক গোলাম ফারুক ভুঁইয়ার হাতে তুলে দেন। এই সময় তিনি প্রতিটি বই সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য এবং লেখার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেন। তাঁর এবং দুই রাষ্ট্রদূতের বক্তৃতার পর ফের শুরু হয় মুলতবী হয়ে যাওয়া ‘কেনো লিখি’ পর্বটি।
পুরো পর্বটা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিত্ব করা তিনজন ব্যক্তিত্ব মঞ্চে আমাদের পাশে বসেই কাটিয়েছেন।
অনুষ্ঠানের সৌন্দর্য বিনষ্ট করে এই বিশিষ্ট ব্যক্তিত্রয় মাঝপথে মঞ্চ ও মিলনায়তন ত্যাগ করলে চলমান অনুষ্ঠানটির অঙ্গহানী ঘটতো। সেটা করেননি বলে আন্তরিক ধন্যবাদ তাঁদের।
০৬
বইমেলার দিনগুলোয় হলিডে ইন-এ অবস্থান করছিলাম আমি। এখানে আমার প্রতিবেশী হিসেবে পেয়েছিলাম চমৎকার কয়েকজন মানুষকে। হোটেল ক্যান্টিনে সকালের ব্রেকফাস্ট আড্ডায় সস্ত্রীক নূরুন নবী, জিয়াউদ্দিন আহমেদ ও গোলাম ফারুক ভুঁইয়া এবং রোকেয়া হায়দার, ও আবদুন নূরের সঙ্গে দুর্দান্ত সব স্মৃতির মার্বেল বিনিময় করেছি প্রতিদিন।
এককালে বাংলাদেশ টেলিভিশনের বিখ্যাত নিউজ প্রেজেন্টার পরবর্তীতে ভয়েস অব আমেরিকার সুপরিচিত কণ্ঠ রোকেয়া হায়দার আপাকে নতুন করে পাওয়া হলো এবার। রোকেয়া আপার ব্যক্তিত্বে একজন বড় আপার প্রবল উপস্থিতি টের পেলাম।
০৭
একক সঙ্গীতানুষ্ঠানে প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার অপরূপ পরিবেশনা নিউইয়র্কের দর্শকদের কাছে নতুন কিছু নয়। এবারও মাতিয়ে রেখেছিলেন তিনি মিলনায়তনপূর্ণ বিপুল দর্শকশ্রোতাকে।
অস্ট্রেলিয়া থেকে আসা প্রীতিভাজন নিরুপমা চৌধুরীর পরিবেশনার সঙ্গে একেবারেই পরিচিত ছিলেন না দর্শকশ্রোতারা। প্রথমবার এসেই আসর মাৎ করেছে নিরুপমা। মানুষ মুগ্ধ বিস্ময়ে শুনেছে নিরুপমার গান।
দুই শিল্পীর সঙ্গে যন্ত্রানুষঙ্গে অংশ নেয়া শিল্পীরাও ছিলেন উচ্চমানের। সব মিলিয়ে একক গানের অনুষ্ঠান দু’টো ছিলো মনোমুগ্ধকর।
০৮
কতো কতো প্রিয় প্রিয় মানুষের সঙ্গে যে দেখা হলো!
টুকরো টুকরো কিংবা ব্যাপক আড্ডা হলো বাংলাদেশের প্রখ্যাত নৃত্য ও অভিনয় শিল্পী লায়লা হাসান, জার্মানির নাজমুননেসা পিয়ারী, নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ঠিকানা, সাপ্তাহিক বাঙালি, সাপ্তাহিক পরিচয়, সাপ্তাহিক আজকাল সম্পাদক ফজলুর রহমান, কৌশিক আহমেদ, নাজমুল আহসান এবং মঞ্জুর আহমেদের সঙ্গে।
ঢাকা থেকে প্রকাশিত প্রচার সংখ্যায় শীর্ষে থাকা দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজামের সঙ্গেও দেখা হলো এক বিকেলে। আমেরিকায় ওর কন্যা পড়াশুনা করছে।
দেখা হলো আরিফা রহমান রুমা, ফাহমিদুল হক, বন্যা মির্জা, খাইরুল ইসলাম পাখি, কৈশোরের বন্ধু আমিনুল হক হিরু, রওশন হাসান, রওশন হক, মাকসুদা আহমেদ, সাবিনা নিরু, নিউইয়র্ক পুলিশের পোশাক পরা প্রীতিভাজন মোস্তাফিজুর রহমান, রানু ফেরদৌস, মিশুক সেলিম, তাজুল ইমাম, রাগীব আহসান, বেলাল বেগ, ফকির ইলিয়াস, ওবায়দুল্লাহ মামুন, হুমায়ুন কবীর, ফারহানা ইলিয়াস তুলি, পলি শাহানা, সোনিয়া কাদির, আনওয়ার ইকবাল, শাহাব আহমেদ, আনিসুজ জামান, আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু, আল্পনা গুহ, রেখা আহমেদ, শিরীন বকুল, হোসনে আরা, পারভীন সুলতানা, সউদ চৌধুরী, মৃদুল আহমেদ, তানভীর রাব্বানী, প্রতাপ দাশ, শ্যামল কর, আদনান সৈয়দ, তাপস গায়েন, গোপাল সান্যাল, শওকত আকবর রবীন, শেখ আরিফুজ্জামান, নশরত শাহ, শেলী জামান খান, উদিতা, মনিজা রহমান, মৌ মধুবন্তী, পলি শাহিনা, কাজী জহিরুল ইসলাম, লুৎফুন নাহার লতা, কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার পুত্র মুহম্মদ রিশাদ হুদা, সজল আহমেদ, বিমল সরকার, রেজা অনিরুদ্ধ, দিমা নেফারতিতি, সালেহউদ্দীন, আবু তাহের, আমানউদ্দৌলা, আনিস আহমেদ, রোমেনা লেইস, ভায়লা সালিনা, রিমি রুম্মান, সুলতানা ফেরদৌসী, ফাহিম রেঝা নূর, জাকিয়া ফাহিম, আকবর হায়দার কিরণ, শিব্বির আহমেদ, ডক্টর নজরুল ইসলাম, মোহাম্মদ মাসুম, আনু মোহাম্মদ, সনতোষ বড়ুয়া, রওনক আফরোজ, লনু হক, লুত্ফা হাসীন রোজী, ফারাহ নাজ আহমেদ জিনিয়া, জিন্নাহ চৌধুরী, দর্পন কবীর, শামীম আল আমীন, শাহীদ রেজা নূর, শিবলী সাদেক, শরীফ মাহবুবুল আলম, সালেম সুলেরী, খালেদ শরফুদ্দীন, সজল আশফাক, শিমুল, শামস আল মমীন, শামসাদ হুসাম, এবিএম সালাহউদ্দীন, সাখাওয়াত হোসাইন সেলিম, লাবলু আনসার, এজাজ মামুন, কুলদা রায়, সাঈদ উর রব, ইব্রাহীম চৌধুরী এবং হাসান ফেরদৌসের সঙ্গেও।
কিন্তু চারদিনের অনুষ্ঠানে একদিনও দেখা হয়নি আমার শৈশবের ছড়াবন্ধু সুফিয়ান আহমদ চৌধুরীর সঙ্গে।
সেমন্তী ওয়াহেদ আমি যার মামা ভাই, কী যে পরিশ্রম করেছে চারটা দিন! প্রতিটি অনুষ্ঠান শুরু হবার আগে এবং শেষ হবার আগে ওর ত্রস্ত ছোটাছুটি শুরু হয়ে যেতো অংশগ্রহণকারীদের সঠিক সময়ে মঞ্চে হাজির করতে। সেমন্তীর মতো ভালোবাসাপূর্ণ নতুন প্রজন্মের আরো কিছু ছেলেমেয়েকে বইমেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পারলে বইমেলার আগামী দিনগুলো আরো মসৃণ হয়ে উঠবে।
জেমাইকা পারফর্মিং আর্টস সেন্টারের বৃক্ষশোভিত বহিরাঙ্গনটি ছিলো চমৎকার, খোলামেলা। এখানেই ছিলো বইয়ের স্টলগুলো। পড়ন্ত বিকেলে কিংবা সন্ধ্যায় সেখানে বসন্ত সমীরনের মতো স্নিগ্ধ বাতাস বইতো। উন্মুক্ত একটা স্টেজও ছিলো সেখানে। ঢাকা নাট্যম-এর সদস্যরা নেচে গেয়ে স্টেজটাকে মাতিয়ে রেখেছিল। সুমাপ্তি সন্ধ্যায় শাদা পাঞ্জাবি এবং শাদা ধুতিতে লাল নকশা করা দৃষ্টিনন্দন সাজ-পোশাকে সজ্জিত কয়েকজন তরুণ একজোট হয়ে আনন্দ উল্লাসে মাতিয়ে রেখেছিলো বহিরাঙ্গনটি। নতুন ভ্যেনুতে জ্যাকসন হাইটসের মতো লোক সমাগম হবে কী না সে বিষয়ে কেউ কেউ সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু সেই সন্দেহটি অমূলক ছিলো।
বিপুল সংখ্যক মানুষের হাস্যোজ্জ্বল প্রাণবন্ত উপস্থিতি বইমেলাটিকে একটি মিলন মেলায় পরিণত করেছিলো।
বইমেলার একটি সেমিনার ধর্মী অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমির সাবেক কর্মকর্তা বন্ধু জালাল ফিরোজও অংশ নিয়েছেন। তাঁর স্ত্রী দীনা আমার ছোট বোন। ওদের কন্যা আমিরা এখন যুক্তরাষ্ট্রেই পড়াশুনা করছে। ছোটবেলায় আমিরা আমার ছড়া পড়তে ভালোবাসতো। জালাল এবং দীনার সঙ্গে দেখা হলো দু’তিন বছর পর।
কথাশিল্পী অমর মিত্রের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিলো না। নিউইয়র্কেই প্রথম দেখা। একই হোটেলে ছিলো আমাদের অবস্থান।
রাব্বানী আমাদের দু’জনকে নিয়ে গেছিলো জ্যাকসন হাইটসে। ইত্যাদি নামের রেস্টুরেন্টে রাতের ডিনার করেছি আমরা। রুই মাছের বড়সড় একটা পিস খুব পছন্দ করেছিলেন তিনি।
সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি তাঁর নদী হারানোর গল্পের ছলে সাতচল্লিশের দেশ ভাগের বেদনাটা সঞ্চারিত করেছিলেন।
চারদিনের বেশ কিছু ইভেন্টে আমরা দু’জন মঞ্চে ছিলাম পাশাপাশি।
আমার বক্তৃতার পর প্রতিবারই তিনি তাঁর উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন– রিটন ভাই আপনি বলেন খুব ভালো।
তাঁর বক্তৃতাগুলোও আমি খুব মনোযোগ দিয়ে শুনেছি।
সব কিছু ছাপিয়ে তাঁর সারল্য আমাকে মুগ্ধ করেছে।
প্রকাশক মনিরুল হক আমার জন্যে ঢাকা থেকে বয়ে এনেছিলেন সাড়ে আটশো পৃষ্ঠার ইয়া মোটা স্বাস্থবান লিটল ম্যাগ ‘মাদুলি’র আবিদ আজাদ সংখ্যাটি। একুশের বইমেলায় সংখ্যাটা আমার জন্যে কিনেছিলো মাযহার। মাযহার ওটা দিয়েছিলো কবি দুলালকে। দুলাল ওটা দিয়েছিলো আরেকজনকে। কিন্তু নানান জটিলতার কারণে ওটা আমার হাত অবধি পৌঁছুতেই পারছিলো না। অবশেষে দুলাল সেটা পৌঁছে দিয়েছেন মনিরুল হককে। আবিদ আমার পছন্দের কবি। সংখ্যাটা পেয়ে আমি আনন্দিত। নিউইয়র্কের বইমেলায় অঙ্কুরের মেসবাহ, নালন্দা ও ইত্যাদির দুই জুয়েল, কথাপ্রকাশের জসিম, অন্বয়ের ঢালীর সঙ্গে দেখা হওয়ায় পুরনো ভালোবাসার সম্পর্কটা ফের ঝালাই হলো।
বইমেলায় প্রথম আসা কবি প্রকাশনীর স্টলে দেখতে পেলাম ‘আবোল তাবোল’সহ সুকুমার রায়ের বেশ কয়টা বইয়ের প্রথম সংস্করণের হবহু সংস্করণ। উদ্যোগটা চমৎকার। এখান থেকে নির্মলেন্দু গুণের ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ বইটি সংগ্রহ করলাম। নালন্দায় রোজ বসতেন অনুবাদক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু। তাঁর অনুদিত ‘রুমিস লিটল বুক অব উইজডম’ বইটাও সংগ্রহ করেছি।
এক দুপুরে প্রতাপ দাশের নেতৃত্বে পানসী নামের একটা রেস্টুরেন্টে আমাদের গ্রুপ লাঞ্চ ছিলো। নানা রকম ভর্তা আর ভাজির সমাহার ছিলো মেন্যুতে। ছিলো পাঙ্গাস আর কাচকি মাছও।
আশির দশকে বাংলাদেশে বিপুল জনপ্রিয়তা পাওয়া ব্যান্ড ‘চাইম’-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য আল আমিন বাবু এখন নিউইয়র্কের বাসিন্দা। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পক্ষশক্তির সাহসী এক্টিভিস্ট। ওর সম্পাদনায় প্রকাশিত মাসিক ‘অন্যদেশ’ পত্রিকায় নিয়মিত লিখি আমি। বইমেলায় সে আমার জন্যে নিয়ে এসেছিলো চমৎকার একটি উপহার–কাঠের একপিঠে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি অপরপিঠে পিতলের প্লেটে মুদ্রিত নিয়াজীর আত্মসমর্পনের দলিল সম্বলিত প্লাক।
ফেসবুকে আমার লেখা গরুর মাংসের ওপর লেখাটা দেখলাম বহু মানুষকে স্পর্শ করেছে। নিউইয়র্কেই কতোজন যে গরুর মাংস খাওয়াতে চেয়েছেন এবার! ইশতিয়াক রূপু আমাকে সাতকরা দিয়ে গরুর মাংস রান্না করে খাওয়াতে চেয়েছিলেন পূর্বাহ্নেই, তাঁর স্বভাবসুলভ আন্তরিক উচ্ছ্বাসে। রাজিও হয়েছিলাম। কিন্তু শেষমেশ আমি আর সময় করে উঠতে পারিনি। আমার ওপর খুব ক্ষেপেছেন হান্ড্রেড পার্সেন্ট সিলটি এই আবেগী বন্ধুটি।
আমার সঙ্গে দেখা করতে এবং সময় কাটাতে দূরের শহর হোপওয়েল জংশন থেকে দেড় ঘণ্টা ড্রাইভ করে পর পর তিন দিন বইমেলায় ছুটে এসেছে ছোট ভাই মানিক রহমান। খুব ভালো ছড়া লেখে মানিক। ওর বড় ভাই ছড়াকার নাসের মাহমুদ আমার প্রিয় বন্ধু ছিলো। মানিকের সঙ্গে এবার নেহারী যোগে আটার রুটি খাওয়া হলো এক সকালে। আমি আর জসিম মল্লিক এবার অনেক আনন্দময় সময় কাটিয়েছি মানিকের সঙ্গে ।
নিউইয়র্ক বাংলা বইমেলাড় ৩১ বছর চলছে। শুরু থেকে এর আয়োজনের নেপথ্যের প্রধান মানুষটি বিশ্বজিৎ সাহা এখনো একজন সাধারণ কর্মীর মতোই খাঁটাখাটুনি করেন। প্রথম দিনের বইমেলা শেষ হলে দেখলাম, ঘর্মাক্ত তিনি বইমেলার স্টল গুলো থেকে চেয়ার টেবিল সরাচ্ছেন ক্লান্তিহীন তৎপরতায়।
বইমেলার শেষ হলে ০১ আগস্ট পুরো একটা দিন আমি কাটিয়েছি পরিকল্পনাহীন আড্ডা ও খানাখাদ্যের পেছনে। জ্যাকসন হাইটসে সেদিন দুপুরে আমাদের পূর্ব নির্ধারিত দ্বিপ্রাহরিক আহারের নিমন্ত্রণ ছিলো বিশ্বজিতের প্রযত্নে নবান্ন রেস্টুরেন্টে। সেদিন কন্যার সঙ্গে দেখা হবার কথা বিশ্বজিতের। তিনি সেটা বাতিল করেছেন আমাদের সঙ্গে সময় কাটাবেন বলে।
বইমেলা নিয়ে সময় টিভি আর একাত্তর টিভিতে সচিত্র সংবাদ প্রচারিত হয়েছে। রিপোর্টার যথাক্রমে হাসানুজ্জামান সাকী এবং শামীম আল আমিন। দুজনেই আমার বিশেষ প্রীতিভাজন। শামীমের রিপোর্টটা সঠিক ছিলো না। মেলার সমাপ্তি দিনের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন না আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি মেলা পরিদর্শনে এসেছিলেন ভালোবাসার টানে।
০৯
নিউইয়র্ক বইমেলায় এসে আমি খুচরো কিছু খানাখাদ্যের সন্ধান ও এস্তেমাল করি। খাওয়াটা আমার জীবনের খুব জরুরি অনুষঙ্গ। আগেরবার গুড়ের জিলিপি খাওয়া হয়নি। এবার তাই প্রধান টার্গেটেই ছিলো আইটেমটা। বোনাস হিশেবে দ্বিতীয় দিনেই পেয়ে গেলাম বিস্ময়কর আরেকটা জিলিপির। দুপুরে ভর্তা আর ছোট মাছের তরকারী দিয়ে ভাত খাবো জেনে কেন্দ্রের অনুজপ্রতিম বন্ধু রবীন আমাকে নিয়ে গেলো জেমাইকার মতিন সুইটস নামের একটা রেস্টুরেন্টে। ওখানকার খাদ্যসম্ভার আমাড় তেমন পছন্দ হলো না। বললাম–জ্যাকসন আহাইটসে চলো। রবীন মাথা নাড়ালো তথাস্ত। ফিরে আসার সময় কাউন্টারে দেখলাম সদ্য ভাজা সসপেন ভর্তি চকচকে হালকা হলুদ জিলিপি আমাকে ডাকছে–আমাকেও পছন্দ হলো না তোর হতভাগা!
বিস্ফারিত চোখে আমি দেখলাম–কালিজিরা জিলিপির সৌন্দর্যে ঝলমল করছে চারিদিক। কেনা হলো দ্রুত। চলন্ত গাড়িতে বসেই টপাটপ সাবরে দিলাম পাঁচ ছটা। রবীন আমাকে থামাতে চাইলো–আপনি না বললেন ভাত খাবেন! জিলিপি খেয়ে খিদেটা নষ্ট হবে না?
আমি বললাম, আরে মিয়া খিদে নষ্ট হবে কী করে! আমি তো খাচ্ছিই। ভাতের জায়গায় কয়টা জিলিপিই না হয় খেলাম।
জেমাইকার এই আইটেমটা এবার আমার হৃদয় হরণ করে প্রথম স্থান অধিকার করে নিয়েছে। দ্বিতীয় স্থানে নেমে গেছে গুড়ের জিলিপিটা!
জ্যাকসন হাইটস এলাকায় এসে চারিদিকে বিপুল সংখ্যক বাংলা সাইনবোর্ডের বর্নিল উপস্থিতি দেখলেই মনটা কী রকম প্রসন্ন হয়ে ওঠে।
আহারে নিউইয়র্ক! বাংলা সাইনবোর্ড আর বাংলা খাবারের এমন অপরূপ সমাবেশ পৃথিবীর আর কোথাও কি আছে?
১০
ঘুংঘুর নামে একটি লিটল ম্যাগ প্রকাশিত হয় নিউইয়র্ক থেকে। এর সম্পাদক হুমায়ুন কবীর পেশায় চিকিৎসক। ‘ঘুম’ নামে তাঁর লেখা একটি ইন্টারেস্টিং বই আমার সংগ্রহে আছে। একটি রেস্টুরেন্টে আমার সঙ্গে দেখা হলে তিনি আমাকে নিমন্ত্রণ করলেন ঘুংঘুরের নতুন সংখ্যা প্রকাশ ও ঘুংঘুর সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে, ০১ আগস্ট সন্ধ্যায় নবান্ন রেস্তোরাঁয়। আমন্ত্রণ গ্রহণ করলাম যখন জানলাম এবার সম্মাননা জানানো হবে মুক্তিযোদ্ধা লেখক নূরুন নবীকে। নবী ভাই আমার খুব প্রিয় মানুষ। হলিডে ইন-এ এক সঙ্গেই কয়েকটা দিন আমরা কাটিয়েছি। শেষদিন সকালে ব্রেকফাস্ট আড্ডায় তিনিও আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন–তুমি তো থাকছোই আরেকটা দিন। কাল যদি ঘুংঘুরের অনুষ্ঠানে আসো আমি খুব খুশি হবো।
শেষ সন্ধ্যা আর রাত্রিটা আমাদের কাটানোর কথা ম্যানহাটনের আলোঝলমল টাইমস্কয়ারে। নবী ভাইয়ের কারণে সমস্ত পরিকল্পনা বাতিল করে চলে গেলাম নব্বান্নতে।
অনেক লম্বা সময় ধরে চললো অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের দু’টি পর্ব। ঘুংঘুরের ওপর আলোচনা। তারপর মুক্তিযোদ্ধা নূরুন নবীকে সম্মাননা প্রদান। ওই পর্বে আমিও অন্যতম আলোচক হিশেবে মঞ্চে নবী ভাইয়ের পাশে আসন পেলাম। এই অনুষ্ঠানে এসে অনেকদিন পর দেখা হলো আমাদের দেশের বিখ্যাত শিল্পীদম্পতি প্রীতিভাজন বিপাশা হায়াত ও তৌকির আহমেদের সঙ্গে। ওরা এখন নিউইয়র্কেই বসবাস করছে সন্তানদের নিয়ে।
খুব দীর্ঘ একটা বক্তৃতা দিলেন সম্পাদক হুমায়ুন কবীর। নুরুন নবী সম্পর্কে বিস্তারিত বললেন কৌশিক আহমেদ এবং ফকির ইলিয়াস। লিটল ম্যাগের চরিত্র ও চারিত্র্য নিয়ে মোটামুটি বিস্তারিত আলোচনা করলেন আহমাদ মাযহার এবং আবেদীন কাদের। এই দুইজনের আলোচনা ছিলো কঠিন বুদ্ধিবৃত্তিক ও পাণ্ডিত্যে সয়লাব। মিলনায়তনটা প্রায় ক্লাশরুম হয়ে উঠলো যেনো!
আমার এই দু’জন বন্ধুর সীমাহীন মেধা প্রজ্ঞা আর বিপুল পঠন পাঠন বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এই দুই ওস্তাদ তুড়ি মেরে প্রায় উড়িয়ে দিলেন চলমান বাস্তবতাকে। তাঁদের নিষ্ঠুর ব্রাশ ফায়ারে নিউইয়র্কের ‘শয়ে শয়ে কবি’র স্থান হলো হাসপাতালের আইসিইউতে। তাঁরা দু’জন বলতে গেলে ‘কোমা’য় পাঠিয়ে দিলেন কবিদের।
আমি মস্করার ছলে এই দুই হিমালয়কে ধ্বসিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা এঁটে বসে থাকলাম। কিন্তু আমাকে ডাকেই না। মাযহারকে বললাম, কি মিয়া! সন্ধ্যা থিকা রাইত হইয়া গেলো। দর্শক তো সব যাইবো গিয়া। মাযহার ফান করলো–তুমি তো বিশেষ আকর্ষণ। তোমারে দিবো সবার শেষে।
উপস্থাপক শিরীন বকুল অবশেষে আমাকে রস্ট্রামে ডাকলো বলতে গেলে একেবারেই শেষের দিকে। তখন আর মাত্র দু’জন বক্তা বেলাল বেগ ও তাজুল ইমাম বাকি।
একজন সাহিত্যকর্মী হিশেবে আবেদিন কাদের ও আহমাদ মাযহার নামের দুই বুদ্ধিজীবীর আক্রমনে কোমায় চলে যাওয়া কবিদের সচল সজীব অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে আমি বদ্ধপরিকর।
রস্ট্রামে দাঁড়িয়েই সেদিন উড়াধুরা এমন ব্যাটিং শুরু করলাম যে মিলনায়তনভর্তি দর্শক কিছুক্ষণ পর পর করতালি দিতে দিতে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে। লক্ষ্য করলাম দর্শকদের সঙ্গে হাসতে হাসতে পেরেশান অবস্থা আমার সেই দুই প্রাজ্ঞ ওস্তাদেরও!
ঊনিশ শ একাত্তরে মাতৃভূমিকে রক্ষা করতে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করার সংকল্পে বুলেটের সামনে বুক পেতে দাঁড়িয়েছিলেন অকুতোভয় দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধারা। রণাঙ্গনের যোদ্ধারা একে একে হারিয়ে যাচ্ছেন। অল্প ক’জন এখনো বেঁচে আছেন। অন্ধকারের বিরুদ্ধে এখনো তাঁরা আলোর পথের যাত্রী। নূরুন নবী তাঁদের মধ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একজন। তাঁকে সম্মাননা জানিয়ে ঘুংঘুর খুব চমৎকার একটি কাজ করেছে।
অশ্রুসজল নবী ভাই তাঁর বক্তৃতায় সহধর্মীনি ডক্টর জিনাত নবীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছিলেন। দর্শকদের দাবির মুখে জিনাত নবীও রস্ট্রামে এসে স্বামীর পাশে দাঁড়ালেন। মিলনায়তনভর্তি আমরা সকলে তখন দাঁড়িয়ে করতালি আর করতালিতে মুখর হয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি দু’জনকে। নবী ভাই জিনাত ভাবীকে এবং জিনাত ভাবী নবী ভাইকে পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে থাকলেন কিচ্ছুক্ষণ, অশ্রসজল নয়নে। দু’জনার সজল চোখ সহসা প্লাবিত হলো। কান্নার গমকে কেঁপে কেঁপে উঠছেন তাঁরা দু’জনেই। তাঁদের আবেগ অবলোকন করে কাঁদছি আমরাও।
এমন অভূতপূর্ব দৃশ্য খুব বেশি নির্মিত হয় না পৃথিবীতে।
১১
শেষ করার আগে একটু পেছনে যাই।
বইমেলার তৃতীয় দিন শনিবার বিকেলে জেমাইকা সেন্টার ফর আর্টস এন্ড লার্নিং মিলনায়তনে একটা ছড়ার আসর ছিলো মনজুর কাদেরের সঞ্চালনায়। আমি ছিলাম অতিথির আসনে। নিউইয়র্কের ছড়াবন্ধুদের ছড়া শুনেছি খুব আগ্রহ নিয়ে। প্রখ্যাত ছড়কার সুনির্মল বসুর পুত্র অভীক বসুর ছড়া আমি খুব উপভোগ করেছি সেদিন। অভীকের পড়ার ঢংটি ছিলো চিত্তাকর্ষক। মজা পেয়েছি মিনহাজ আহমেদের ছড়াতেও। সেদিন ছড়া পড়েছেন সজল আশফাক, হুমায়ুন কবীর ঢালী, শওকত রিপন, শাহ আলম দুলাল, শামস চৌধুরী রুশো, শাহীন ইবনে দিলওয়ার ও আলম সিদ্দিকী।
সেই বিকেলে অতিথির বক্তৃতায় আমি বলেছিলাম–একজন ছড়াকার হচ্ছেন মায়ের মতো। গভীর মমতায় একজন মা তাঁর শিশু সন্তানকে আধো আধো বোলে কথা বলতে শেখান ছড়ার(কিংবা ছড়াগানের) মাধ্যমে। সেই বিবেচনায় একটি শিশুর প্রথম পাঠ হচ্ছে ছড়া। শিশুর মুখের প্রথম ভাষাই হচ্ছে ছড়া। কথা বলতে শেখার আগেই বর্ণমালা বা অক্ষর চেনার আগেই একটি শিশু তার মায়ের মুখে শুনে শুনে মুখস্ত করে ফেলে ছড়া। একজন ছড়াকারের দায়িত্বটা তাই মায়েরই মতো।
আমার এই উপলব্ধিটা মিলনাতনের দর্শকদের সঙ্গে শেয়ার করার পর আমি চলে এসেছিলাম বইমেলার স্টলগুলোর সামনে। জায়গাটা তখন বিপুল মানুষের সমাগমে গম গম করছে। এখানে আমার জন্যে অপেক্ষা করছিলো অভাবনীয় একটা ঘটনা।
উৎসাহী ও কৌতুহলী বিপুল সংখ্যক মানুষের সঙ্গে আমার সৌহার্দ বিনিময় চলছে। এমন সময় ভিড় ঠেলে আমার দিকে এগিয়ে এলো লাইলা-আদিত্য শাহীন দম্পতি। ওদের প্রথম টুইন সন্তান আঁকা এবং লেখার জন্ম বছর তিনেক আগে, এই নিউইয়র্কেই। সেদিন ওরা লেখা নামের পিচ্চি মেয়েটাকে নিয়ে এসেছিলো আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে। শাহীনের কোলে শাদা ফ্রক পরা ছোট্ট এইটুকুন একটা পরি। এখনো কথা বলতে পারে না। অদ্ভুত মায়াবী দু’টি চোখ ওর। মুখে অপরূপ হাসি। ওর গালে হাতে আলতো একটু আদর করে দিচ্ছি এমন সময় শাহীন আর লাইলা ওকে বললো–লেখা, আবদুল হাই ছড়াটা এই আংকেলকে শুনিয়ে দাও তো!
বলা মাত্রই আমার দিকে মিষ্টি লাজুক হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে, আমার হাতের রঙিন ব্রেসলেটগুলোয় ওর বুড়ো আঙুলটা ছোঁয়াতে ছোঁয়াতে পাখির মতো মিহি সুরেলা কণ্ঠে মনোমুগ্ধকর উচ্চারণে গড়গড় করে বলতে শুরু করলো পিচ্চিটা–আবদুল হাই কলে খাই খাই এক্খুনি খেয়ে বলে কিচু খাই নাই! লাউ খায় শিম খায় মুলগিল ডিম খায়……মুহূর্তেই আমার করোটির ভেতরে সহস্র ঊর্মির সম্মিলিত কোরাসের সিম্ফনি। বুকের মধ্যে একশো একটা হামিং বার্ডের ডানার কম্পন। এখনো তিন বছর পূর্ণ না হওয়া একটা বাচ্চার পবিত্র কণ্ঠে আমার ছড়ার পঙ্ক্তিকয়টা কেমন শিহরণ বইয়ে দিলো। আবেগাপ্লুত আমি আদর করে দিচ্ছি ওকে। চশমার কাঁচের আড়ালে আমার চোখে তখন টলমল করছে ভালোবাসা। কণ্ঠস্বরে তখন আবেগের ঝর্ণার তিরতিরে স্রোত। অলৌকিক সেই স্বর্গীয় দৃশ্যগুলো তখন মোবাইল ফোনের ক্যামেরাবন্দী করছে লাইলা।
আহা, এক জীবনে ছড়া আমাকে কম কিছু দেয়নি!
অনেক বড় হও আমার ছোট্ট বন্ধুটি।
লাভ ইউ বইমেলা।
লাভ ইউ নিউইয়র্ক।
অটোয়া ১০ আগস্ট ২০২২
১ Comment
congratulations