১৫০ বার পড়া হয়েছে
নিউইয়র্ক-ফেরৎ দার্শনিক ড. সলিমুল্লাহ খানের প্রিয়দিন-জন্মদিনে, সাবেক স্ত্রী তসলিমা মুনে’র কলমে দাম্পত্যের দাগগুলো:
সালেম সুলেরী
তিনি প্রবল-পান্ডিত্যে মুখর বাংলাদেশের বিরলপ্রজ দার্শনিক। অধ্যাপক ড. সলিমুল্লাহ খান– যিনি স্বনামে সুপরিচিত। প্রকাশনা, টক-শো, স্পষ্টবাদিতা আর যথাস্থানে যথা-কোটেশন প্রদান..। ড. সলিমুল্লাহকে এনে দিয়েছে ‘বিশ্ববাঙালির’ খ্যাতি। জন্ম ১৯৫৮-এর ১৮ আগস্ট, কক্সবাজারের দ্বীপভূমি মহেষখালিতে। সে বিবেচনায় সলিমুল্লাহ খান একজন ‘সমুদ্রসন্তান’ও।
আমি জীবনচক্রে বৃহত্তর রংপুর থেকে ঢাকায় থিত হই ১৯৮১-তে। সে বছর দুটো বই বেরোয় সলিমুল্লাহ খানের। প্রথম কাব্যগ্রন্থ : ‘এক আকাশের স্বপ্ন’। প্রবন্ধগ্রন্থ : ‘বাংলাদেশ : স্টেট অব দ্যা নেশন’। এ-নামটি নিয়েছিলেন জাতীয় অধ্যাপক ড. আব্দুর রাজ্জাকের উদ্ধৃতি থেকে। আলোচনা লিখেছিলেন প্রথাবিরোধী বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফা। ড. রাজ্জাক বিষয়ে সলিমুল্লাহ খানের বিশ্লেষণকে তিনি সমর্থন করেননি। অবশ্য ‘যদ্যপি আমার গুরু’ শিরোনামে আহমদ ছফাও বই লিখেছিলেন। প্রয়াণ-উত্তর সর্বাধিক সম্মান পেয়েছেন সলিমুল্লাহ খানের সামগ্রিক মূল্যায়নে। উল্লেখ্য, আহমদ ছফার প্রথম স্মরণসভায় সভাপতিত্ব করি আমি। প্রধান অতিথি খ্যাতিমান প্রাবন্ধিক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। প্রধান আলোচক ছিলেন হুমায়ূনভ্রাতা ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল।
১৯৭৯ থেকে ‘প্রাক্সিস জার্নাল’– সমাজ-সাহিত্যপত্র করছিলেন সলিমুল্লাহ খান। একাশিতে ঢাকায় থিত হয়ে দেখি– ‘অধ্যয়ন সমিতি’ও করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি’র ‘হাকিম চত্বরে’। কিংবা শাহবাগের ‘সিনোরিটা’য় বসতো অধ্যয়ন-আড্ডা। পাবনার জনৈক আব্দুল বারী’র বিতর্কিত লেখা বেরুলো জার্নালে। তাতে মামলাও হলো, নিষিদ্ধ হয়েছিলো সংখ্যাটি। অতঃপর ১৯৮৬-তে সলিমুল্লাহ খান নিউইয়র্ক প্রবাসী হন।
শিক্ষাজীবনে উজ্জ্বল ইতিহাস পাঠপ্রেমিক সলিমুল্লাহ’র। স্কুল-কলেজের ক্লাশে বরাবর প্রথম হতেন। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষা চাটগাঁ থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এলএলবিতে অনার্স-মাস্টার্স। হলজীবনে ছিলেন কবি মোহন রায়হানের রুমমেট। ‘সঙ্গদোষে’ কিছুদিন জাসদ ছাত্রলীগও করেছেন। ৮৩-৮৪-তে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক ছিলেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ-তে অধ্যাপনা।
আমার ফুপাতো ভাই বিচারপতি মোস্তফা কামালের ভক্ত ছিলেন। তদীয় গীতিকন্যা ড. নাশিদ কামালেরও ছিলেন সতীর্থ-অনুরক্ত। সলিমুল্লাহ প্রায় এক যুগ কাটিয়েছিলেন নিউইয়র্কে। এরশাদ, খালেদা, হাসিনাকালের প্রবাস– ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৯। ‘দ্য নিউ স্কুল ইউনিভার্সিটি’ থেকে পিএইচডি করেন। যুক্তরাষ্ট্রে অভিসন্ধর্বের বিষয়টিও ছিলো অভিনব। ‘ইংল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকিং তথ্য : ১৭৯৩-১৮৭৭’।
মধ্য-আশিতেই নিউইয়র্কে প্রথম বাংলা সংবাদপত্র বেরোয়। ‘সাপ্তাহিক দিগন্ত’– সম্পাদনায় সানু খান, শামস আল মমীন। সলিমুল্লাহ খান এই প্রকাশনায় সহযোগিতা নিশ্চিত করেন। লেখক-অনুবাদক আলম খোরশেদও তখন নিউইয়র্ক প্রবাসী।
প্রায় কুড়িটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খানের। বিশ্বখ্যাতদের লেখনকর্ম অনুবাদেও তিনি ভূমিকা রেখেছেন।। শার্ল রোদলেয়ার, ওয়ান্টার বেঞ্জামিন, মিশেল ফুকো, তালাত আসাদ.. প্রমুখ। সলিমুল্লাহ’র আদর্শ/ মেন্টর কার্ল মার্কস, জ্যাকলাক, আহমদ ছফা।
শুধু সাহিত্য-সংস্কৃতি-ইতিহাস-রাজনীতি-অর্থনীতি নয়। বিজ্ঞান-দর্শন-জাতীয় তথা বৈশ্বিক পরিস্থিতির সফল বিশ্লেষক। উল্টোদিকে কিছু তীর্যক সমালোচকও রয়েছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ‘মুসলিম পৈতা-অলা’ বলে আখ্যাও দেন কেউ কেউ।
সাবেক স্ত্রী শেখ তসলিমা মুনও কিছুটা বিতর্ক তুলেছেন। ‘যদ্যপি আমার গুরুপতি’ নামে বই বেরিয়েছে ২০২০-এ। ‘অনন্যা’ প্রকাশিত বইটি নিউইয়র্ক বইমেলাতেও বিপণন হয়েছে। কার্যত সলিমুল্লাহ ছিলেন তসলিমা মুন-এর দ্বিতীয় স্বামী। মুন বই-এ লিখেছেন, নিজের প্রথম পক্ষের সন্তান ছিলো। সলিমুল্লাহ সেই সন্তানটিকে পিতৃসুলভ ভালোবাসা দিতে পারেননি। বরং ‘লঘুপাপে’ একদিন বেদম পিটিয়েছেন।
তসলিমা মুন-এর বইটিকে হাতিয়ার করে আক্রমণও চলমান। সিনিয়র সাংবাদিক মোস্তফা ফিরোজ দিপু টক-শোতে প্রসঙ্গটি তোলেন। আরেক ঋদ্ধ সাংবাদিক আনিস আলমগীর নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ দেন। বলেন, মুন তার লেখায় লেখক-স্বাধীনতা ভোগ করেছেন। সাবেক স্বামী সলিমুল্লাহ খানের লেখালেখির কিছু সমালোচনা করেছেন। পাশাপাশি স্বামী হিসেবে কিছু ব্যর্থতার কথাও জানিয়েছেন। আসলে ডিভোর্সের পর পরস্পরবিরোধী সমালোচনাটি স্বাভাবিক বাস্তবতা। তবে পূর্বপক্ষের সন্তানকে মেনে না নেওয়াটা কিছুটা অমানবিক। সলিমুল্লাহ খানের সাগরসম গুণাবলী এতে একটু প্রশ্নবিদ্ধ।
প্রায় দু’যুগ সলিমুল্লাহ খানের সাথে আমার যোগাযোগ ছিলো না। বছর পাঁচেক আগে ঢাকায় ফিরে ফোন দিয়েছিলাম। অপর প্রান্ত থেকে উচ্ছ্বাস– আরে সালেম সুলেরী! মানে সেই উত্তাল আশির দশক, কবিতা, সাংবাদিকতা? বিদেশে থাকেন জানি, কবে ফিরলেন, কি লিখছেন?
জ্বি, লেখালেখির বাইরে আমাকে তিনি ভাবতে চান না। বললাম ‘বিগ ব্রাউন’, একটি উপন্যাস লিখছি। সাদা আর কালোকে মিলিয়ে বাদামী রঙ ধারণের প্রস্তাবনা। বাদামী মানে আমাদের দক্ষিণ এশীয় বা বাঙালিদের রঙ। বর্ণবাদ প্রথার মুখে একটি যৌক্তিক সমাধানের নীরব আকুলতা..!
ড. সলিমুল্লাহ বললেন, এতো দেখছি সৃষ্টিশীল এক নতুন ভাবনা। তো উপন্যাসটি নিশ্চয়ই ইংরেজিতেও হবে। এরমধ্যে একদিন ‘ইউল্যাব ক্যাম্পাসে’ আসুন। দীর্ঘবিরতি শেষে দীর্ঘ আলাপ হবে। জানেন তো, ধানমন্ডিতে ‘ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস।’
যাবো যাবো করে আর যাওয়া হয়নি ড. সলিমুল্লাহ সকাশে। ১৮ আগস্ট প্রিয়দিন-জন্মদিনের মাহেন্দ্রতিথি। আটলান্টিক পাড়ের সাগরশুভেচ্ছা– ‘সাগরসন্তানে’র প্রতি।
নিউইয়র্ক, আগস্ট ২০২২