তাল পাপ।
বিপ্লব মৈত্র।
ভাদ্র মাসের তাল। নাম শুনেই জিহবাতো জল আসে। ছোট বেলার কথা মনে পড়ে। সে সময় ঠাকুমা, মা, এর হাতের নারকেল মিশিয়ে তৈরি তাল খির, তালের রুটি, তালের বড়া তা আবার রসে ভেজানো- আহাঃ এখনো মনে আসতেই স্বাদটা চলে আসে।সে সময় বাড়িতে পাকা তাল আনা মানে এক উৎসবের সূচনা করা। যদিও খাতকের মনে আনন্দ, যারা এটা প্রসেজ করে তাদের মনে হয় অতোটা হয় না।কারণ তাল ছাড়ানো,পিঁড়িতে পেটানো,কাঠের তৈরি তাল ডলুনিতে ডলা, এরপর গামছায় পেঁচিয়ে সারারাত ঝুলিয়ে রাখা, পরদিন ঝুনো নারকেল ছুলে, কুড়িয়ে,কখনো মিহি করে বেঁটে তালের সাথে মেশানো, পরিমান মত আখের গুড় মেশানো, অল্প আঁচে জাল দেয়া,তাতে আবার ঘন জালের দুূধ মেশানো, কম পরিশ্রম ও ধৈর্যের কথা না!
এরপর সুগন্ধ ছড়িয়ে পরে সারা বাড়িতে। বাচ্চাদের উুঁকি ঝুঁকি,খাওয়ার বায়না,কান্নাকাটি। কি অম্ল মধুর ছিল দিনগুলো।
আজকের ডিজিটাল যুগে কোন বাড়িতে এমন হবে ভাবাই যায়না। প্রথমতঃ যিনি কিনবেন, তিনি বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথে শুনতে পাবেন “এগুলো করবে কে শুনি? হয় নিজে করবে না হয় তোমার পিঠে ওটা পেটানো হবে “।তাল ডলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত পাড়ার মেয়েছেলেরা যেই বাড়ির পাশ দিয়ে যাক না কেন, কখনো ডেকে দাঁড় করিয়ে বলা হব ” আমার উনি আজ তাল কিনি এনেছে।আচ্ছা বলেন তো আমার কি এই বয়সে অতো করার মতো ধৈর্য আছে না সময় আছে? তালের বড়া পিঠে খির সবই তো এখন কিনতে পাওয়া যায়! শুধু শুধু সংসারে ঝামেলা পাকানো না! ” এমন নানা কথা চলতেই থাকে।
বেচারা কত্তা সবে অফিস থেকে ফিরেছে।এমন ঘাঁনর ঘাঁনর শুনতে শুনতে নিজেই লেগে যায়। শেষ করে ছাড়ানো, পেটানো, ডলার কাজ।অন্তত পুরনো দিনের গন্ধ টা একটু পাওয়ার আশা ভেবে সব মনে নেয়। তবে এসময় শুনতে পায় না পরামর্শ বা উপদেশ।যেমন এভাবে না এভাবে ছাড়াও, এভাবে নয় এভাবে পেটাও,একটু জল দাও, নাহলে তো রস বেড় হবে না।অবশেষে আসে ডলা পর্ব।গ্রামের মতো শহরে ডলুনি মিলবে কেমন করে? এজন্যও চলে নানা কটাক্ষ। কত্তা বুদ্ধি খাটিয়ে একটা প্লাস্টিকের ঝুড়ি খুজে পায়,ফুটোওয়ালা। তার উপর কাজ সাড়ে।এতোও আপত্তি। আঁটির সাথে কত তাল লেগে আছে। পয়সা দিয়ে কিনতে হয়নি।বেশ মন মুগ্ধকর পরিবেশ, উৎসব উৎসব ভাব না! অনেকটা আমাদের রাজনৈতিক পরিবেশের মতো,আমি পারি না, অপর কেউ পারুক, তাও চাই না। কিন্তু ভুল ধরতে পারি।
তাল ডলার পর্ব শেষ। কত্তা আর নারকেলের রিস্ক নেবে না,অনেক হয়েছে। শুরু হলো, বলি গ্যাসে কি এসব করা যায়! নাড়বে কে বসে? কত্তা নীরব,কারণ ওটা সে জানেনা।গিন্নি গজ গজ করতে করতে অশ্রদ্ধা ভরে হলেও করে।নিরানন্দ মুখে চেখে দেখে- এবার প্রকৃত হাসি আাসে মুখে, বেশ সুন্দর তাল তো, কি মিস্টি। একটু গুড় বা চিনিও দেই নি, তোমার সুগারের কথা ভেবে। একটু খাও প্লিজ,কত কষ্ট করে জাল দিলাম।
কত্তা বুঝে ফেলেন, বাড়ির অন্য কেউ এটা খাবেনা।তাকে একাই খেতে হবে সবটুকু, কম পক্ষে সাতদিন লাগবে ফুরাতে। সকালের টিফিন আর অফিস ফেরত নাস্তায় এটা চলবে।
এবার গিন্নীর মুখে খই ফুটছে সুন্দর সুন্দর কথার।প্রতিবেশী দেখলে, বা জানলা দিয়ে ডেকে বলছে।অমুকের বাবা কাল তিনটে হাড়ে তাল (বড় কালো তাল) এনে ছিল। নিজই সব করেছে, আমি, জাল দিয়েছি, কি সুন্দর মিস্টি, একটু দেবো! কত্তা বোঝেন, তবে আর ফুরাতে বেশি দিন লাগবে না আর বারোটা বাজলো প্রতিবেশীর স্বামীর।তবে মনে হয় কালই ফুরাবে।
বাংলার ঐতিহ্য টা প্রতিটি বাড়িতে ধরে রাখা বোধ হয় হবে না। পরবর্তী প্রজন্ম তোমরা মনে হয় এগুলো খাওয়া জুটবে না। আমরা না হয় মা ঠাকমার কথা মনে করে এগুলো করছি। তোমরা তো শুনতেই পাবে না। কত্তা এসব ভাবতে ভাবতে হেঁটে বাসায় ফিরে দেখে, নাস্তার টেবিলে বিতরণ পরবর্তী অবশিষ্ট তালাংশ, খুবই সামান্য।
হাত মুখ ধুয়ে চেয়ারে বসলো।গিন্নি হেসে বলল আজ তাল পাওনি, অফিসে নিয়ে গিয়েছিলাম, সবাই কে খাইয়েছি,ওরা আর একদিন খেতে চাইছে গো। কত্তা মৃদু হেসে বলে আনবো না মানে, কার ঘারে কয়টা মথা আছে যে তোমার আদেশ অমান্য করে বিশৃংখলা ডেকে আনবে?
কত্তা তালের শেষ অংশ মুখে দিয়ে আপন মনে বলতে থাকেন, এইচ এস সি তে পড়েছিলাম অন্ন পাপ,আর আমি করেছিলাম তাল পাপ।