ড. আসিফ নজরুল-এর ‘পিএইচডির গল্প’ বইয়ের আলোচনা:
ভাল লাগতে পারে আপনাদের।
পিএইচডির গল্প নামের ১১৯ পৃষ্ঠার এই বইটা এর থেকে পারফেক্ট করে লেখা যেত না। নিজের গল্প এইভাবে নিজে বলতে পারাটা সহজ না। কোনো কিছু অতিরিক্ত বলা হয় নি, কোনো কিছুকে আলাদা করে গ্লোরিফাই করার চেষ্টা করা হয় নি, সবকিছু নিয়ে ঠিক যতটুকু বলা যথেষ্ট ঠিক ততটুকুই বলেছেন লেখক। অল্প কথায়ই বলা হয়ে গেছে অনেক কিছু। তার নিজের ভাষায়ই বলি – “এই গল্প মানুষের জিতে যাওয়ার গল্প। এমন বিজয় আমাদের সবার জীবনে যদি নাও থাকে, তাকে ভালোবাসে না এমন মানুষ বোধহয় নেই একজনও।” আমার সবসময় মনে থাকবে এমন একটা বই এটা।
এসএসসিতে স্ট্যান্ড করা আসিফ নজরুল ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে। তার বাবার ইচ্ছায়। পিএইচডির গল্প বইয়ে তিনি বলেছেন তার লালবাগের বাসা, বাবা-মা-ভাই-বোন-আত্মীয়দের গল্প, কলেজের গল্প, সাংবাদিকতার গল্প, বিচিত্রায় লেখালেখির কথা, বিসিএস দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে মাত্র ৩৬ দিন চাকরির কথা। একঘেয়ে লাগায় সেই চাকরি ছেড়ে তিনি যোগ দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের প্রভাষক হিসেবে। তার মাত্র নয়দিন পর যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে। ততদিনে বই প্রকাশ হতে থাকে তার। এরই মধ্যে কমনওয়েলথ স্কলারশিপে পিএইচডি করতে যান ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডনে। পড়াতে পছন্দ করতেন, লিখতে পছন্দ করতেন। পিএইচডি করার খুব একটা ইচ্ছা তার ছিল না। দেশ ছেড়ে যাবার সময় তাই মন খারাপও হল। কিন্তু পরিবারের কথা ভেবে গেলেন শেষ পর্যন্ত।
এই বইয়ে তিনি বলেছেন তার সাড়ে চার বছরের পিএইচডির সূচনাপর্ব, মেহনতিপর্ব আর মরিয়াপর্বের কথা। বলেছেন লন্ডন হাউজের গল্প, বেবিসিটার হওয়ার গল্প, গুজ প্লেসের বাসার গল্প, তার সুপারভাইজার ফিলিপের কথা, যিনি একেবারে শুরুর দিকে বিস্মিত হয়েছিলেন তার গবেষণার নিম্নমান ও অগভীরতায়, তার প্রবল তাচ্ছিল্যে লন্ডনের ফুটপাতে বসে কাঁদার কথা। শেষে ফিলিপের প্রতি কৃতজ্ঞতাও জানিয়েছেন তিনি।
আসিফ নজরুলের পিএইচডির টপিক ছিল আন্তর্জাতিক নদী আইন। ১৯৯৪ এ তার পিএইচডি থিসিস শুরুর দিকে ভারত বাংলাদেশের মধ্যে কোনো চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে না ধরে নিয়ে গঙ্গা নদীর ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইন দূর্বল এমন একটা সেন্ট্রাল থিমের ওপর পিএইচডি থিসিস লেখা শুরু করেন তিনি৷ ১৯৯৬ এর ডিসেম্বরে দু’দেশের মধ্যে গঙ্গা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে তার৷ আগের সেন্ট্রাল থিম বদলাতে হয়, লিখে ফেলা চ্যাপ্টারগুলো অনেক পরিবর্তন করতে হয়। তখন তার স্কলারশিপও শেষের দিকে৷ সময় খুব কম।
শেষদিকে তার ছিন্নভিন্ন মানসিক অবস্থায় তার পাশের বাড়িতে ওঠেন তার কলিগ, আইন বিভাগের শিক্ষক লিয়াকত আলী সিদ্দিকী। তার সাথে আসিফ নজরুল চলে যান লিডসের একটি মসজিদে তবলিগে। তারপর এসে শুরু করেন অমানুষিক কষ্ট৷ তার মা চলে যান হজে। ছেলের জন্য প্রার্থনা করতে। ১৯৯৯ এর ২৬ মে তার ডিফেন্সের দিন তার সুপারভাইজার তাকে বলেন “লুক নাজরুল, দিস ইজ ইওর থিসিস, ইয়োর ডিফেন্স। ইফ ইউ ক্যান্ট মেক দিস, দিস ইজ নট মাই ফল্ট।” তার ডিফেন্সের ফলাফল কী হয়? ডিফেন্স শেষে তার সুপারভাইজার তাকে জড়িয়ে ধরে বলেন “ইউ হ্যাভ ডান এক্সট্রিমলি ওয়েল। আই এম প্রাউড অফ ইউ।” আসিফ নজরুল ভুলে যান সাড়ে চার বছরের অপমান আর অবহেলার কথা। মাকে আর স্ত্রীকে রেজাল্ট জানিয়ে ছুটে যান গুজ স্ট্রিটের মসজিদে, সেজদায় পড়ে শুরু করেন কান্না।
তার একজন সিনিয়র তাকে একবার বলেছিলেন “তোর যখন পিএইচডি হবে তখন এইসব দিন মিস করবি। আমাকে যদি আবার কেউ ফান্ড দেয় আমি খুশি হয়ে আরেকটা পিএইচডি করব।” তার গা জ্বলে যেত এইসব শুনে। এখন এত বছর পরে আসিফ নজরুলেরও তাই মনে হয়। পিএইচডি শেষ করে আর লেখাপড়ার ধারেকাছেও যাবেন না এমন সংকল্প করার পরও তাই জার্মানি আর ইংল্যান্ডে কাজ করেছেন পোস্ট ডক্টরাল ফেলো হিসেবে। তার পিএইচডির গল্প বইয়ে তিনি বলেছেন তার আশেপাশের এই মানুষগুলোর মমতার গল্প, বলেছেন অনেকের অবহেলা আর তাচ্ছিল্যের গল্প। বলেছেন সাহস আর ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প। এই গল্পটা নিজের উপর অগাধ বিশ্বাসের, এই গল্পটা আত্মঅনুসন্ধানের। আবার বলি – এই বইটা এর থেকে পারফেক্ট করে আর লেখা যেত না।
বই : পিএইচডির গল্প
লেখক : Dr. Asif Nazrul
প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা
প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০২১
প্রকাশক : বাতিঘর
মূল্য : ২১৩
১ Comment
congratulations.