জমিদার গিন্নীর এপিটাফ
সাহানা সুলতানা
গতকাল ঘুরে এলাম
মোহিনী বসাক লেনের পুরোনো বাড়িটিতে,
আদি জরাজীর্ণ জমিদার বাড়ি।
পুরাতন, কালের সাক্ষী হয়ে আছে
বয়সের ভারে মূহ্যমান।
গলির মাথায় ঢুকতেই, কেউ একজন
আড় চোখে দেখছিল আমায়,
মুখে কিছু, না বললেও মনে হলো
ওর চোখ কিছু বলছে, বলুক আমার কি!
দোকানীগুলি আজ যেন সালাম দিতে ভুলে গেল,
গেটে কড়া নাড়তেই একজন পথাচারী বলে উঠলো
এখানে কেউ থাকে না, দেখছেন না- তালা ঝুলছে।
ওহ্ হ্যা! সত্যিই তো একটি নয়, দুটি তালা
দুইজন জমিদারের- দুটি,
যেন একের বিপরীতে অন্যজনের প্রবেশাধিকার নিষেধ।
হায়রে, বাড়িটির প্রাচীর বলে দেয়
কত অবহেলা, নিযার্তন সহ্য করেছে গেল কমাস
সবুজ শ্যাওলাগুলি কালচে হয়ে গেছে,
বটের পাতাগুচছ গজিয়েছে স্থানে স্থানে,
যেন জানান দিচ্ছে,তুমি নাইতো কি আমরা আছি।
একটা চামচিকে উড়ে গেল সামনে দিয়ে
উঠানখানা বেশ বড়।
দেখলে মনে হয় পুরাতন জমিদার
শাসন কার্য চালাতেন এখানে।
হঠ্যাৎ চোখ পড়ল উঠানের দেয়ালে
কয়লার কালিতে লিখা কিছু বর্ণ,
মনে পড়েছে -আমার বড় ছেলের কাজ
নতুন লিখা শিখার সময় কি কৌতূহলই না ছিল!
পুরা বাংলাদেশ ছিল তার লিখার ক্যানভাস
যেখানে যা পেত, তাতেই লিখা শুরু।
আজ বাড়ীটা ভুতুড়ে মনে হচছে
দড়িতে একটা ওড়না ঝুলছে, আমার।
একটি জলচৌকি পড়ে আছে উঠানে
শেষবার আমিই বসেছিলাম।
পুরনো জমিদাররা রান্না ঘরকে বাবুর্চিখানা বলত
বাবুর্চিখানায় বড় বড় পাতিল থরেথরে সাজানো
আমায় দেখে ওরা নড়েচড়ে উঠলো
একটা ভাঙা সাইকেল দাড়িয়ে
আমার ছোট ছেলের, কিনেছিলো
চালাতে পারতো না, ঐটার স্থান সবর্দা এখানেই
জায়গায় জায়গায় ময়লা আবর্জনা স্তুপাকারে পড়ে আছে।
আর সহ্য হচছিল না, বের হবো।
হঠ্যাৎ কান্নার শব্দ, কোথায়, কে কাদেঁ?
কেউ না, গা ছমছম করে উঠলো
আর দুপা বাইরের পথে দিতেই
সেই কান্নার ধবনি। এবার মনে পড়ল আর কেউ না,
কাঁদছে আমার শূন্যঘর খানি
আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকছে,
চলে আয়, আর কতদিন, আর কতদিন থাকবি ওখানে
নিজেকে সামলে নিলাম,
জমিদার বাড়ীর দেয়াল কথা বলে, শুনতাম আজ তা দেখলাম।
এইসব দেয়াল থেকে রাতের অন্ধকারে
নুপুরের আওয়াজ, নারীর কান্নার ধ্বনি গুন্জিত হয়
এই বাড়ীটি থেকেও হয়তো রাতে
কান্নার ধ্বনি শুনতে পায় আশেপাশের লোকজন
পাবেই এত কান্নার জল বৃথা যাবে না।
তা আমিও জানি।
এসব প্রাচীর সাক্ষী হয়ে আছে যুগ যুগ
ফটকে পা দিতেই নিজেকে জমিদার গিন্নী মনে হলো
খুব সেজে গুজে, শান শওকতে থাকার দিনগুলি
রাতের অন্ধকারে নিরবে নিভৃতে কেঁদে যাওয়া।
জমিদারের ভোগ বিলাসিতায় দাসীদের অংশগ্রহণ, সব, সব, সব।
হঠ্যাৎ মেয়ের ডাকে চৈতন্য এলো,
ঝলঝল চোখ দুটি কিছুই বলছে না
ওর কান্না দেখে আমি বললাম
কিরে কাদঁছিস কেন, মায়া হয়, চলে আসবি এখানে,
কান্নার বাধঁ ভেঙে গেল যেন,
চোখ দুটি বড় বড়, লাল হয়ে গেছে এতক্ষণে
শুধু মাথা নেড়ে অসম্মতি জানালো,
বুঝতে কষ্ট হল না এইটুকুন একটা বাচ্চা মেয়ে
কোন অতীতের অতলে ডুবে গেছে।