বিজয় দিবস উপলক্ষে
বিজয়ের মেডেল।
দিলু রোকিবা
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে।
স্বাধীন খেলার মাঠ থেকে বাসায় ফিরেছে কেবল।
স্কুল বন্ধ আজ।
ওর বেশিরভাগ সময় কাটে দাদুর সাথে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনে আর মাঠে বন্ধুদের সাথে ক্রিকেট খেলে।
লেখাপড়ায় বেশ ভালো রেজাল্ট করছে বরাবর।
ওর দাদু একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা।
তাঁর এক পা নেই।
দাদু আজ ওকে রাতের পড়া, ও খাবার পর মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনাবে।
সেই অপেক্ষায় আছে স্বাধীন।
দ্রুত গতিতে সব শেষ করে দাদুর ঘরে ঢুকে বিছানার পাশে দাদুর কাছে বসলো,
দাদু একটা হাই দিয়ে চোখে এক উৎকন্ঠা নিয়ে নাতির খুব কাছে ঘেঁষে বসে বললো,দাদু ভাই আজ তোকে আমার এক পা হারানোর গল্প বলবো।
খুব মনোযোগ সহ শোন।
দাদু তার একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলা শুরু করলেন।
তখন তার বয়স বিশ- একুশ।
তরুন ছেলে।
১৯৭১ সনের জুলাই মাসের শেষের দিকে দাদু বাড়ি থেকে লুকিয়ে পাড়ার বন্ধুদের সাথে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।
শুধু ছেলেরা না,সাথে একদল মেয়েরাও,হিন্দু মুসলিম, বৌদ্ধ,খ্রিষ্টান সবাই।
আগস্ট মাসের বিশ তারিখ সম্ভবতঃ সারাদিন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল।
তিনি ও আরো সাতজন সহযোদ্ধা অবস্থান করছেন তখন ঐ সুবর্ণপুর গ্রামের এক ক্যাম্পে।
তাদের সেদিন অপারেশনে যাবার কথা। তাদের টার্গেট সুবর্ণপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের পাকিস্তানী ক্যাম্প। এগিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে সাতজন। কাছাকাছি পৌঁছে রুবেল ছুঁড়ে দিল একটি গ্রেনেড। তারপর শুরু হলো মুখোমুখি সংঘর্ষ যুদ্ধ।
কিন্তু পাকিস্তানি সেনাদের ভারী ভারী অস্ত্রশস্ত্রের মুক্তিবাহিনীরা কোণাঠাসা হয়ে পড়েছে
এরমধ্যে মিন্টু ও স্বপন মারা গেছে।
তোর দাদু একটু সিনিয়র ছিল এদের চেয়ে, আর আমার বরাবর একটু সাহসী মনোভাব ছিল রে…
দাদু সবাইকে সরে যেতে বললেন কিন্তু সবাই রাজি হলোনা।
কিন্তু তিনি তার সিদ্ধান্তে অটল । যে কোন উপায়ে ওদেরকে ঠেকিয়ে রাখবেন তিনি।
এটাই তার প্রতিজ্ঞা।
অগত্যা সবাই সরে গেল।
দাদু এল,এম ,জি থ্রি নট থ্রি দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীদেরকে কৌশলে ঠেকিয়ে রাখলেন।
কিন্তু বারুদ, গুলি শেষের দিকে।
আর কিছু না ভেবেই দু ‘টি গ্রেনেড হাতে নিয়ে অব্যর্থ লক্ষ্যে ছুঁড়ে দিলেন।
বিধিবাম, দুর্ভাগ্য পাকিদের পুঁতে রাখা মাইনেতে তাঁর ডান পা ছিন্ন- বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ….সঙে সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে পড়েন।
ঐ অবস্থায় সহযোদ্ধারা ছিলবলেই ঐ সময় তাঁকে এনে সু চিকিৎসা দেবার ব্যবস্থা গ্রহণ করে আরো অনেকের সাথে একটি সুরক্ষিত ক্যাম্পে।
শরীরে জ্বর ও তীব্র ব্যথায় কোঁকড়াচ্ছে তিনি।
হঠাৎ করেই কানে আসে ,সেদিন তার ঐ অব্যর্থ নিশানায় ছোঁড়া গ্রেনেডেই ঐ পাকিরা সব মারা যায়।
২০ আগস্ট ভরা বর্ষায় সুবর্ণপুর গ্রাম হানাদার মুক্ত হয়। আল্লাহ কে স্মরণ করে বললো,হে আল্লাহ তুমি কবুল কর এই বান্দাদের ফরিয়াদ, একদিন এদের জন্য দেশ স্বাধীন হবেই….
একটি পা হারান চিরতরে তোর দাদু।
একটি পা নেই তার জন্য কোনো আফসোস বা দুঃখ নেই দাদুর।
রাস্তা ঘাটে কত লোকের পা নেই, তারাও চলছে সংগ্রাম করে বৈ কি দাদু.. কিছু বল তুই।
গল্প শুনতে শুনতে স্বাধীনের চোখ ভিজে আসে আর জল গড়িয়ে পড়ছে টের পেলাম হাতের ওপর জলছোঁয়াতেই …
তখন দাদু বলেন,তুই কাদঁছিস কেন?
আমাদের মতো শত শত মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েছিরে ভাই।
তাই তোর দাদু তোকে ” স্বাধীন বলেই ডাকে।
আর মনে রাখবি সবসময়ই যে,আমি সহ ৭১ এর সকল বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করতে কখনোই ভুলবিনা কেমন? বলে দাদু চোখের কোণে জল গামছা দিয়ে মুছে নিল নিরবে ….
—- স্বাধীন খুব ভালো গল্প বলতে পারে অনর্গল।
এটা গড গিফ্টেড।
সে মনে মনে ঠিক করলো সামনে ১৬ ডিসেম্বর মাসে ঢাকায় তার এক গল্প বলার প্রতিযোগিতা আছে,সেখানে দাদুর এই পা হারানোর গল্পটি বলবেই। যাবার আগে দাদুকে সালাম করে দোয়া চেয়ে নিল সে।
দাদু বললো, ফি আমা নিল্লাহ। তুই একমাত্র পারবিরে দাদু ভাই আমার মান রাখতে,যা আর দেরি করিস না।
ঠিক বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে বাবার সাথে ঢাকায় রওনা হলো ট্রেণে করে।
প্রতিযোগিতার দিন তার নাম ঘোষনা করার সাথেই সে মঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে দাদুর পা হারানোর গল্পটা চমৎকার ভাবে বললো।
বিচারক থেকে উপস্থিত অতিথি, দর্শক শ্রোতাদের চোখ কান্নায় ভিজে গেল,সারা মিলানয়তন পিন পতন,স্তব্ধ হয়ে গেল…
সবাই তুমুল কড়তালির মাঝে ওকে প্রধান অতিথি কাছে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন তোমার দাদুকে আমার সংগ্রামী স্যালুট জানাচ্ছি।
এর মধ্যে আমি তোমাদের ঐ গ্রামে গিয়ে উনার সাথে দেখা করে আসবো।
উপস্থাপক লাউড স্পিকারে ” স্বাধীন প্রথম পুরস্কার হিসেবে সম্মানিত বিচারকদের চূড়ান্ত রায়ে স্বাধীন কে একটি ” স্বর্ণের মেডেল পড়িয়ে দেবার জন্য এখন মঞ্চে উপস্থিত হবেন আজকের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি,
সন্ধ্যার ট্রেণে বাড়ি ফেরার পথে চিন্তা করলো যে ,এই স্বর্ণের মেডেলটা তার দাদুর গলায় সে পড়িয়ে দেবে।
এটা উনার প্রাপ্য।
দাদুর মতো আরো অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধাও আত্মত্যাগীরা আর বীরাঙ্গনারাই তো সত্যিকারের এই সবুজ শ্যামল বাংলা দেশের নায়ক।
—- বাড়ি এসে দেখে অনেক মানুষের ভীড়!
ও কিছু বুঝতে না পেরে দাদুর ঘরে দাদু বলে ডেকে বলে,দাদু দেখ কি নিয়ে এসছি তোমার জন্য .. দাদুকে খুঁজে খুঁজে হয়রান কোথাও নেই তার দাদু।
—- যার পা হারানোর গল্পের জন্য আজ এই মেডেলটা আর উনার দেখার সৌভাগ্য হলো না।
আর কখনও দাদু ঐ না ফেরার দেশ থেকে আসবেনা ও গল্প ও শোনাবেনা।
মেডেলটা সবাই দেখতে থাকে এক এক করে।
হে আল্লাহ আপনি আমার দাদুকে জান্নাতের শ্লেষ্ঠ মাকাম দান করুন আমীন।
—— স্বাধীনের চোখের জলে গাল ভাসিয়ে অবিরত ঝরছে আনন্দ ও কষ্টের নোনাজল…আর হাতে ঐ স্বর্ণের মেডেলটা লাল ফিতায় ঝুলতে থাকে …
ঢাকা মোহাম্মদপুর
( স্বয়ং সংরক্ষিত)
১১।১১।২১
৪ Comments
মুক্তি যুদ্ধের গল্প অনেক লেখকের ছোট গল্প পড়েছি।
আপনার টি ও ভালো লাগলো,,, শ্রদ্ধেয়া।
খুবই ভাল গল্প
সকল গল্প গল্পই নয়,,কিছু গল্প হচ্ছে জীবন পরিচালনার শক্তি,
অসাধারণ শব্দ চয়নে দারুণ অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ প্রিয় কবি প্রিয় জন।
বীর মুক্তিযোদ্ধার প্রেরণা ময়ী
congratulations.