খয়রুজ্জামান খসরু’র
ঋণের নামতা
ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি জন কীটস বলেছেন, ‘কবিতা মুগ্ধ করবে তার সুক্ষ্ম অপরিমেয়তায়, একটি মাত্র ঝংকারে নয়। পাঠকের মনে হবে এ যেনো তারই সর্বোত্তম চিন্তা, যা ক্রমশ ভেসে উঠছে তার স্মৃতিতে।’ কবিতা তেমনি মনের অগোচরে এক গোপন ঘরে কাজ করে। সেখানের পঙ্কিলতা, কলুষতা, নিচুতা, হিংস্রতায় আস্তে আস্তে পরিবর্তনের মুকুর ফুটিয়ে তোলে। ভেতর থেকে একটি শুদ্ধ প্রাণের জন্ম দেয়। ইঙ্গিতের পর ইঙ্গিত রেখে যায় সুন্দর পথের। যেখানে মানুষের গন্তব্য মনোরম ও অনুপম। জাগতিক যাপন-চেতনার বাইরে এক বাউলিয়া বাতাস তখন বয়ে যায় হৃদয়ের অলিন্দে অলিন্দে। সেখানে ফুল ফোটে, পাখি গান গায়। আর ঝর্ণাতলায় নেচে উঠে চঞ্চল হরিনীর দল। এমনই এক কবিতা অরণ্যের কবি-তপস্বী খয়রুজ্জামান খসরু। যাপনের পরাকাষ্ঠা রেখে যিনি কবিতায় মগ্ন হতে পারেন, মগ্ন করতে পারেন পাঠকের আগ্রহের ধ্যান। এবার মেলায় বেরিয়েছে তার দ্বিতীয় কাব্য গ্রন্থ “ঋণের নামতা”। বইটি প্রকাশ করেছে স্বনামধন্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান নাগরি। বইটির প্রচ্ছদপতে ধ্রব এষের যাদুকরী শিল্প পাঠকের চোখ আটকে রাখে। ভেতরের কবিতাও আছে সত্য-সূর্যের উদ্ভাসন।
গ্রন্থটির তৃতীয় কবিতায় লেখক বলেন, “পোড়ামাটির গন্ধ আজ পৃথিবীর দেশে দেশে।” তিনি এক দাবানলপোড়া আমাজন চোখের ভেতরে রেখে পর্যবেক্ষণ করে সমকালীন বিশ্বপরিস্থিতি। নিরাপদ জীবনের জন্য মানুষের দিনরাত খেটে চলা ব্যর্থ হয়ে যায় বারুদের উন্মাতাল ধ্বংসযজ্ঞে। তারপরও আমরা নিজেদের বাহাদুর বলে পরিচয় দিতে দ্বিধাবোধ করি না। কবি বলেন, “মানুষগুলো বিবেক হারিয়েছে।” হারিয়েছে কতকিছুই। এতোসব হারানো ভিরে কবিকণ্ঠ যেনো থেকে যেতে চায় আঁচলের মায়ায় মাটির কাছাকাছি। তাই কপোতাক্ষনদের মধুসূদনের মতো কবিও স্বজনের কাছে “মিনতি” করেন তাকে যেনো ভুলে না যায়- “তুমি-নি রাখবায় মোরে স্মরণে তোমার/…..তুমি নি পড়বায় সখি কবিতা আমার।”
কাব্যগ্রন্থটির নামকবিতা ঋণের নামতায় যেখানে চোখ আটকে যায়, সেখানে কবি আঁকেন প্রকৃতির পরাপাঠ। মাটির সহজ কোরক থেকে তুলে এনে শিশিরের ভাষা, কবি সাজান তার ভাষা। অপরূপ বাংলার প্রেমছবি ভেসে উঠে ক্যানভাসে দক্ষ হাতের তুলির যত্নশীল রেখাপ্রবাহে। যেখানে আমরা দেখতে পাই কবির ধ্যান সেখানেই, যেখানে তার হৃদয়ের ঋণ অপরিশোধ্য স্তব্ধতায় বাস্তবতার কঠিন মুখোমুখি স্মৃতিকাতর করে তোলে। তার ভাষায়– “কার্তিকের ভোরে শিশিরঝরা শিউলিতলায়/ প্রেয়সীর বকুলের মালায় আমার প্রথম প্রণয়।”
বন্ধুত্ব সম্পর্কে মহামতি আলবার্ট আইনস্টাইন বলেন, “আমাদের রহস্যময়তার পরীক্ষণে প্রাপ্ত সবচেয়ে সৌন্দর্যময় জিনিসগুলো হলো শিল্প, বিজ্ঞান এবং বন্ধুত্ব।” কিন্তু সেই বন্ধুত্ব এখন কোথায়। স্বার্থের টানে ভেসে গেছে সম্পর্ক সব। সব ছায়া মুছে গেছে তীব্রদাবদাহে। সব শিল্প নষ্ট হয়েছে আত্মগত লোভের ব্যাকরণে। আর বিজ্ঞান, সে তো অন্ধকারের অজ্ঞতায় এখনো সম্যকভাবে আলো ফেলেনি। ফলে আমাদের যে হৃদ্যতা, তা শুধু মেকি আর ভয়াবহ রকম সন্দেহজনক। তাই তো কবি খয়রুজ্জামান খসরু তার নক্ষত্র পতন কবিতায় বলেন, – “বড়ো অসময়ে তুমি বন্ধুত্ব চাইলে/ বিশ্বাসের পরিধি প্রশ্নবোধক/……অবক্ষয়ের চিত্রে সয়লাব/ জীবনানন্দের ধানক্ষেত।’’
একটি বিকল্পিত কবিতা প্রয়াস “চূর্ণগুচ্ছ” এর একটি স্তবকে কবি খয়রুজ্জামান খসরু লিখেন –“অ/ অসুখ/ সবখানে।/ আ/ আনন্দ/ উধাও উজানে/ ই/ ইঁদুর/ গৃহকোণে।” এখানে কবি কবিতার এক নতুন স্বর নির্মাণের চেষ্টা করেছেন। জাপানি কবিতা ক্যাটালগ হাইকুর আদলে এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কথা পাঠক মনে ব্যাপক আলোড়ন তুলতে পারে। আবার “চাঁদ জলে ডুবে আমরা নির্বিকার” কবিতায় লেখক সমাজের সকল স্তরে, সকল পর্যায়ে পচন দেখে কার জন্য লিখবেন দ্বিধায় থরোথরো। তার ভাষায়-“সবকিছু মিলিয়ে একটা/ ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে পৃথিবীর মানুষেরা।” তাইতো তার মানবতার বাণী উপচে পড়েছে “ঋণের নামতা” শীর্ষক কবিতাগ্রন্থে।
কবিতা কখনো কখনো মানুষকে পেয়ে বসে। এই কবিতা পেয়ে বসাতেই জীবনান্দ হাজার বছর হেঁটেছেন অবলীলায়। আরণ্যক লেখার সময় সবুজের ভেতর সমারোহে প্রবেশ করেছেন বিভূঁতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। অবারিত হেঁটেছেন তার মহাকাব্যিক উপন্যাসে। মূলত শিল্পের ধর্মটাই এমন, তা হোক কবিতার, হোক তা ছবি আঁকার, কিংবা কথাসাহিত্যের শ্রুতিমধুর কথাপ্রবাহে। এই শিল্প পেয়ে বসলে মানুষের আর তখন কিছু করার থাকে না। এক অবিরাম বিরামচিহ্নের ভেতর কেবলমাত্র ঘুরপাক খাওয়া, কেবল মাত্র পথহীন গন্তব্যহীন একা। কবি খয়রুজ্জামান খসরু “ফিরা না ফিরা” এরকম শিল্পের ভেতর, কবিতার ভেতর নান্দনিক চলাচল উপস্থাপন করেছেন। তার কবিতাটি পড়া যাক – “ধীর পায়ে ফাঁকা বাড়ির দিকেই হাঁটছি/ বাড়ি ফেরা হয়নি/ বাড়ির রাস্তা যেন প্রলম্বিত হচ্ছে/ সারাদিন হাঁটছি/ বাড়ির রাস্তা কারও কারও প্রলম্বিত হয়/ সব পাখি নীড়ে ফিরে না/ পথই গন্তব্য।” মার্সেল প্রোস্তু গন্তব্য নিয়ে লিখেছেন –“আমার গন্তব্য এখন কোনো জায়গা নয়, বরং নতুন গন্তব্য হলো অন্যভাবে পৃথিবীকে দেখা।” কবি খয়রুজ্জামান খসরুর কবিতায় তেমনি আমরা অন্য এক গন্তব্যের সন্ধান পাই। তিনি যখন বলেন, “পথই গন্তব্য।” তখন সত্যিই আমাদের যাত্রারম্ভ এবং পথচলার দূরত্ব একে অপরের কাছে প্রশ্নবোধক হয়ে পড়ে।
“জীবন হচ্ছে মৃত্যুর ঘনিষ্ঠ সঙ্গী” -বলেছেন এস টি কোলরিজ। কবি খয়রুজ্জামান খসরু তার কবিতায় বলেছেন – “জীবন/ জীবন তুমি/ জীবন তুমি নদী/ জীবন তুমি নদীর ঢেউ।” এরকম অজস্র দার্শনিক ভাষ্য আর কাব্য মধুরতায় ভরপুর “ঋণের নামতা” পাঠক মনে ভিন্ন এক কাব্যিক জগত নির্মান করতে সক্ষম হবে। “ঋণের নামতা” পাঠে পাঠকারীর মানসলোকে ভেসে উঠবে চিরায়ত বাংলার অপরূপ সৌন্দর্য, সেই সাথে মানবতার বোধের স্ফুরণ। ঝকঝকে ছাপায় মাইল্ড অফসেটে পরিপাটি বইটিতে মোট তিপ্পান্নটি ছোটবড় কবিতা রয়েছে। চারফর্মা ৬৪ পৃষ্ঠার বইটির গায়ের মূল্য ২২০ টাকা, অনলাইন পরিবেশক রকমারি ডটকম।