শুরুটা ছিল বিশ্বাসে
ফারজানা ইসলাম
১ম পর্ব
প্রেমের শুরু কখন, কীভাবে সেটা আমরা অনেক সময়ই বুঝে উঠতে পারি না। কেউ বলে আকস্মিকতার মধ্যে প্রেম জন্মায়, কেউ বলে দীর্ঘদিনের পরিচয়ের ওপর দাঁড়িয়েই প্রেম শেকড় গাঁথে। আমার ক্ষেত্রে কোনটি সত্যি ছিল? আজ এত পথ পেরিয়ে ফিরে তাকালে মনে হয় প্রেম জন্মেছিল খুব সাধারণ কিছু মুহূর্তে, খুব সাধারণ কিছু কথায়, কিন্তু সেই অতি সাধারণতার মধ্যেই আমি অসাধারণ এক ভবিষ্যৎ দেখে ফেলেছিলাম। হয়তো এটাই ছিল ভুলের শুরু বা হয়তো ভুল ছিলই না, ভুল ছিল সেই মানুষটি, যার হাতে আমি আমার ভবিষ্যৎ তুলে দিয়েছিলাম। আমার মনে হয় প্রথম প্রথম আমি ভরসা নামের যে শব্দটা বুঝতাম, সেটাই ছিল আমার প্রেমের ভিত্তি। আমি কাউকে মন দিয়ে গ্রহণ করি তখনই যখন তাকে বিশ্বাস করা যায়, যখন মনে হয় তার হাত ধরে হাঁটলে পথটা আর ভয়ংকর লাগবে না। সে আমার কাছে ঠিক এইভাবেই এসেছিল একজন শক্ত, সরল, ভরসাযোগ্য মানুষ হিসেবে, যে কথায় কথায় ‘চিন্তা করো না, আমি আছি’ বলত, আর আমি ভেবেছিলাম এর চেয়ে বেশি আশ্বাস আর কিছুই লাগবে না। আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিল একেবারেই অপ্রত্যাশিতভাবে। সেদিন বিকেলে অফিস থেকে ফেরার পথে বৃষ্টি নেমেছিল হুট করে। ছাতা না থাকায় দাঁড়িয়ে ছিলাম এক দোকানের শেডের নিচে। সেখানেই আমার সঙ্গে দেখা। সে এসে দাঁড়িয়েছিল আমার ঠিক পাশে ভিজে ভিজে এক অদ্ভুত হাসি মুখে। সেই হাসিতে কোনও উদ্দেশ্য ছিল না কোনও আগ্রহ ছিল না ছিল শুধু স্বাভাবিক এক উষ্ণতা। আমি তাকাইনি প্রথমে কিন্তু তার হাসিটা যেন পাশ থেকে লেগেই ছিল। কিছুক্ষণ পর সে নিজের ছাতাটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেছিল এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে তো আর বাসা পৌঁছানো হবে না। আমি অবাক হয়ে বলেছিলাম, না ঠিক আছে। ভিজতেই পারি সমস্যা নেই। সে হেসে বলেছিল তাহলে আমারই একটু সমস্যা হবে। আমি যদি জানি আমার ছাতা থাকার পরও আমার পাশের একজন ভিজে কাঁপছে সেটা দেখা কিন্তু আমার পক্ষে কঠিন। এতটাই অচেনা ব্যবহারে আমি কেবল নরম হয়ে গিয়েছিলাম। একটা অদ্ভুত নিরাপত্তাবোধ জেগে উঠেছিল মনে। তখনও জানতাম না সেই নিরাপত্তার অনুভূতিই একদিন আমাকে সবচেয়ে বেশি ভুল পথে নিয়ে যাবে। সেদিনের সেই ছোট্ট ঘটনাই ছিল আমাদের কথাবার্তার শুরু। অফিস বাসা পরিবার স্বপ্ন—সব কিছুই ধীরে ধীরে ভাগ করে নিতে শুরু করেছিলাম। আমি বুঝতেই পারিনি কখন আমার জীবনের প্রতিটি দিনের ভরসা হয়ে উঠল সে। আমি মনে মনে একটা কথা বারবার বলতাম— এই মানুষটা থাকবে সবসময় থাকবে। কিন্তু জীবন কি কখনও আমাদের ভেবেছি সে পথেই হাঁটে? আমার পরিবারেও সে বেশ দ্রুত জায়গা করে নিয়েছিল। আমার মা বলতেন ছেলেটা খুব শান্ত তুমি সুখেই থাকবে। আর বাবা বলতেন মেয়েকে বোঝে এমন মানুষ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। আমি এই বিশ্বাসগুলোকে হৃদয়ে ধারণ করে নিজেকে সঁপে দিচ্ছিলাম তার হাতে। তখনো বুঝিনি মানুষের আসল রূপ সংসারের দেওয়ালের ভেতরেই খোলে প্রেমের মাঠে নয়। আমরা যখন বিয়ের সিদ্ধান্ত নিলাম তখন আমার মনে একটুও সন্দেহ ছিল না তার প্রতি। বরং ভয় ছিল অন্য জায়গায় আমি কি পারবো? আমি কি যথেষ্ট? আমি কি তার পাশাপাশি দাঁড়াতে পারবো সারাজীবন? কিন্তু সে সবসময় বলত তুমি পারবে। আমি আছি তো! তার কথার এই ‘আমি আছি’—ডুবিয়ে দিয়েছিল আমাকে নিরাপত্তার ভ্রান্ত সমুদ্রে। বিয়ের দিনগুলো আমাদের দুই পরিবারের চোখে ছিল উৎসবের মতো। সুখ হাসি আনন্দ সবই ছিল। আমি মনে করেছিলাম এটাই হবে আমার চিরদিনের জীবন। বিয়ের আগের রাতটিতে আমি তাকে বলেছিলাম আমি ভয় পাচ্ছি। এত বড় পরিবর্তন সে আমার হাত ধরে বলেছিল ভয় পাবে কেন? তোমার পাশে আমি আছি। আজ যখন সেই স্মৃতিগুলো মনে পড়ে চোখে জল আসে না বরং এক অদ্ভুত রাগ তিক্ততা ও তীব্র হতাশা জন্ম নেয়। কারণ এখন বুঝেছি সে কখনোই সত্যিকারের আছে ছিল না। তার সেই থাকা ছিল অবস্থান দায়িত্ব নয়। ছিল অভ্যাস ভালোবাসা নয়। আমাদের সংসারের শুরুটা হয়েছিল সুন্দরভাবেই। অন্তত আমি তাই ভেবেছিলাম। প্রথম সপ্তাহগুলোতে সে যথেষ্ট শান্ত মনোযোগী যত্নশীল ছিল বলে মনে হতো। আমি রান্না করলে সে প্রশংসা করত আমি কাজের কথা বললে শুনত আমি অসুস্থ হলে পাশে বসে থাকত। আমি তখন ভাবতাম সুখ হয়তো এমনই হয়, নীরব,সরল, কিন্তু স্থির। কিন্তু সেই স্থিরতা আসলে ছিল ঝড়ের আগে থমকে থাকা বাতাস। আমি বুঝতেই পারিনি সেই প্রশান্তির ভিতরে জমছিল আগামীর দূরত্ব অবহেলা, দায়িত্বহীনতাআর কঠোরতা। আমার জীবনে সুখ যত বেশি বিশ্বাস নিয়ে আসছিল তত বেশি সে আমার ভরসায় অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছিল। আমি খেয়াল করিনি যে ভালোবাসার জায়গায় সে ধরে নিচ্ছে আমি সব সামলে নেব—এটাই আমার কাজ। সে শুধু থাকবে—এটাই যথেষ্ট। বিয়ের পর প্রথম যে বড় পরিবর্তনটা দেখলাম সেটাই আমার মনকে অশান্ত করেছিল। সে আর আগের মতো সময় দিত না। অফিস থেকে ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসে ঠিকই কিন্তু কথা বলত কম। আমি ভাবতাম এটা হয়তো ক্লান্তি অথবা নতুন জীবনের চাপ। তাই কিছুই বলতাম না। বরং আরও বেশি যত্ন নেওয়ার চেষ্টা করতাম। কিন্তু ধীরে ধীরে তার কথাবার্তা কমতে থাকলো হাসি কমলো রাতের পর রাত কথা না বলেই ঘুমিয়ে পড়তে লাগল। আমি অনুভব করতাম সে যেন দূরে সরে যাচ্ছে কিন্তু তাকে হারানোর ভয়ে কিছু জিজ্ঞেস করতাম না। ভালোবাসা কখনো কখনো মানুষকে অদ্ভুতভাবে নির্বাক করে দেয় বিশেষ করে যখন ভালোবাসাটা একতরফা হয়ে যায়। যখনই বলতাম কিছু সমস্যা হয়েছে?” সে ঠান্ডা গলায় বলত নাহ, তুমি এসব নিয়ে বাড়াবাড়ি করো। এতটাই সংক্ষিপ্ত অর্থহীন উত্তর যে মনে হতো আমার অনুভূতিকে সে তুচ্ছ করছে। কিন্তু তখনো আমি আশা ধরে রেখেছিলাম “আজ না হোক কাল সব ঠিক হবে। এই আশা এই অপেক্ষাই ছিল আমার প্রথম ভাঙন। প্রতিদিন সে ঘরে থাকলেও ঘরে যেন তার অবস্থান ছিল না। কথাবার্তা কমে এল স্পর্শে উষ্ণতা হারাল চোখের দিকে তাকানোর সময়েও তার দৃষ্টি যেন কোথাও হারিয়ে যেত। আমি তখনো বুঝতে পারিনি সেই দৃষ্টি অন্য কারও দিকে ঝুঁকে আছে। আমি তখনো বিশ্বাস করতাম এটা একটা সময়ের সমস্যা ঠিক হয়ে যাবে। মানুষ যখন ভালোবাসে, তখন সে নিজেকে অন্ধ বিশ্বাসের দিকে টেনে নিয়ে যায়। আর আমি তা-ই করেছিলাম। আমি খেয়াল করতাম তার মোবাইল লুকিয়ে রাখা ব্যস্ত থাকার অজুহাত দেরিতে বাসায় ফেরা সবই বাড়ছে। কিন্তু আমি জিজ্ঞেস করতাম না। কারণ আমি ভয় পেতাম। হ্যাঁ ভয় পেতাম। যে মানুষ
চলবে…

