বিচিত্র অভিজ্ঞতা—
সাঈদা আজিজ চৌধুরী
একদা শিক্ষক ছিলাম। ছেলেমেয়েরা একে একে সবাই উচ্চশিক্ষার জন্য বিভিন্ন দেশের ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করতে চলে গেছে।একেবারেই একাকী হয়ে গেলাম। কিছুই ভালো লাগে না। ছেলে পাশ করার পর জবে ঢুকেছে।
ছেলে বললো, ‘আম্মা তুমি এখন ঘুরে বেড়াও। এতোদিন চাকরি করেছো,আমাদের মানুষ করেছো। তুমি এখন লিভ নাও।’
সময় ২০১৪ সাল। তখন লং লিভ নিয়ে প্রথমে পুত্রের কাছে লন্ডনে গেলাম। মাস ছয়েক থাকার পর ছোটো কন্যা তখন আমেরিকায় নর্থ ক্যারোলাইনা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পি এইচ ডি করছে—সেখানে গেলাম।বড় কন্যা থাকে সিডনিতে। সে খুব মন খারাপ করলো। আমি কেনো সিডনিতে যাইনি। ওর চার বছরের একটি কন্যা সন্তান রয়েছে।সপ্তাহে দুদিন অফিস করে। বুঝিয়ে বললাম,লন্ডন ও আমেরিকা ৭/৮ ঘণ্টার ফ্লাইট। সহজেই জার্নি করা যায়। অস্ট্রেলিয়া যেতে হলে আবার বাংলাদেশে গিয়ে ভিসা নিতে হবে।কন্যার ইচ্ছে পূরণের জন্য বাংলাদেশ আসলাম। ভিসা নিতে সময় লাগলো দুমাস।
চায়না এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে চড়ে বসলাম।চীনের জিনজিয়াং এয়ারপোর্টে দুঘণ্টার যাত্রা বিরতি।
আমার পাশে আমার পুত্রের বয়সের একটি ছেলে বসেছে।দেখলাম গ্লাস ভর্তি রেড ওয়াইন নিয়ে একটু একটু করে পান করছে। নাকে ঝাঁজ লাগছে। গন্ধ পাচ্ছি।কখনো এই ধরণের পরিস্থিতির সম্মুখীন হইনি। আমার গায়ে থেকে তখনো শিক্ষকের গন্ধ মুছে ফেলতে পারিনি । তখনো শাসনের দৃষ্টি থাকে জুনিয়রদের প্রতি।
শুনেছিলাম শিক্ষকরা নাকি সবাইকে ছাত্র মনে করেন। এখন অবশ্য আমার এই অনুভূতি অনেকটাই লোপ পেয়েছে। সময়ের উষ্ণ, উদ্ধত ও দ্রুতগতির স্রোতে পা ভিজিয়ে পথে হাঁটতে অনেকটাই অভ্যস্ত হয়েছি।বরং নিজেকে শাসন করি এই বলে যে—‘তোমার মান্ধাতা আমলের সামাজিক অভিভাবকত্বের কথা ভুলে যাও।সময় অনেক পাল্টেছে।মানুষ আধুনিক হয়েছে।ওরা নিজেরাই নিজেদের অভিভাবক।’
বাল্যকাল বা কিশোরী বয়সের কথা মনে পড়ে।অচেনা কোনো মুরুব্বি গোছের মানুষ দেখলে সালাম দিতে হবে—পরিবার থেকে এই শিক্ষা পেয়েছি। তাঁদের যাওয়ার জন্য পথ ছাড়তে হবে,আগে যেনো তাঁরা যেতে পারেন। প্রয়োজনে সাহায্য করতে হবে।
মূল প্রসঙ্গ থেকে অনেক দূরে সরে এসেছি। এখন সেই প্রসঙ্গে আবার বলছি।
ছেলেটির দিকে একবারও তাকালাম না।উইন্ডোর দিকে তাকিয়ে থাকলাম।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি জোহরের নামাজের ওয়াক্ত হয়েছে।সিটে বসে নামাজ সেরে নিলাম। নামাজ শেষ হওয়ার পরে দেখলাম ছেলেটি সিটে নেই।বেশ অনেকক্ষণ সিট খালি পড়ে থাকলো।আমরা ট্রানজিট প্লেসের কাছাকাছি চলে এসেছি। এসময় আবার এসে বসলো। আমি উইন্ডোর দিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখলাম।
হঠাৎ করেই শুনতে পেলাম ‘আসসালামু আলাইকুম’।ঘুরে তাকালাম।ছেলেটি আমার দিকে তাকিয়ে আবার সালাম দিলো।নীচের দিকে তাকিয়ে সালামের উত্তর দিলাম।
জিজ্ঞেস করলো,কোথায় যাবেন?
জানালার দিকেই তাকিয়ে বললাম,সিডনি যাচ্ছি।
একা যাচ্ছেন ? কার কাছে যাবেন?
বললাম,বড় মেয়ে থাকে।
তারপর বললো,আপনি কি জব করেন?
হ্যাঁ, একটি স্কুলে ছিলাম,এখন লং লিভে আছি।
কয় ছেলেমেয়ে,স্বামী সব জানতে চাইলো।
তারপর কিছুক্ষণ নীরবতা।
বললো,আপনার জন্য এই জুস নিয়ে এসেছি।
বললাম, কষ্ট করে আনতে গেলেন কেনো? লাগলে আমি ক্রুদের বলতাম।
দেখলাম দুটি গ্লাস। একটি ওর জন্য।
আমাকে তুমি বলুন—খুশি হবো।আমি আপনার ছেলের মতো।একটু ভাবছি,ছেলেটির কি হলো?
বললাম,আমি কাউকে হঠাৎ করে “তুমি”বলতে পারিনা। চেষ্টা করে দেখবো,বলতে পারি কিনা।
নিজের নাম বললো। নামটি এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। ব্যবসা করে। একটি বারো বছরের মেয়ের বাবা।পুরনো ঢাকার বাসিন্দা।
নিজে থেকেই পারিবারিক অনেক কথা শেয়ার করলো।
দেখতে দেখতে জিনজিয়াং পৌঁছে গেলাম। এখানেই আমাদের দুঘণ্টার ট্রানজিট।
আমার হ্যান্ডব্যাগ ছাড়াও একটি সাত কেজি ওজনের ব্যাগ আছে সঙ্গে।ছেলেটি আমার ব্যাগটি নামিয়ে নিজেই ক্যারি করতে থাকলো।
বললাম,আমি পারবো।
বলে উঠলো,মনে করেন—পথে আপনার এক ছেলের সঙ্গে দেখা হয়েছে—বলে ব্যাগ নিয়ে এয়ারপোর্টের দিকে চলতে থাকলো। একসঙ্গে পৌঁছালাম। আমি বসলাম।
বললো,একটু আসছি। ৫/৭ মিনিট পর কিছু আপেল,কমলা ও জুসক্যান নিয়ে হাজির।
এগুলো আপনার জন্য। আমাকে এখানেই বিদায় নিতে হচ্ছে—এই কথাটুকু বলে পায়ে হাত দিয়ে তাড়াতাড়ি সালাম করলো। মুখে বললো,আমাকে ক্ষমা করবেন। এতক্ষণ যা করেছি,অনুশোচনা থেকে করেছি। আপনি শিক্ষক। আপনার পাশে বসে ড্রিংক করা ঠিক হয়নি। আপনি মুখ ফিরিয়ে উইন্ডোর দিকে তাকিয়েছিলেন—
বলেই খুব তাড়াতহুড়ো করে ইমিগ্রেশনের দিকে চলে গেলো। আমি ওর গমন পথের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
কেনো যেনো পানিতে চোখ ভরে গেলো।
ভাবছিলাম—“ Every soul has some purity, something special from Almighty”
পরিবেশ পরিস্থিতিতে মানুষ বদলে যায়।
৬/৭/২০২৫