অসম সমীকরণ
— শিরিন শিলা
পার্ট ১
সরকারী দপ্তরের প্রকাণ্ড গেটোর সামনে রিকশা থাকলো। রিকশাওয়ালা বললো মেডাম নামুন আমরা পৌছে গেছি ইমা গেটের উপরের লেখার দিকে তাকালো বড় বড় অক্ষরে লেখা….. জজকোর্ট । ইমা রিকশা থেকে নেমে ভারা মেটানোর জন্য ভেনিটি ব্যাগে হাত দিতেই মখমলে মোড়ানো একটা ছোট বক্সে মুঠোয় চলে এলো। বহু দিন পর ইমা এই ভেনিটি ব্যাগটা নিয়ে বের হয়েছে তাতে যে তার জীবনের সবচেয়ে আনন্দ ও বেদনা ঘৃণা কিংবা ভালোবাসা মাখা সুপ্ত নদীর মত নিরব অনুভূতি মিশে আছে তা তার খেয়ালই ছিলো না। এই ভেনেটি ব্যাগের বয়স আনুমানিক ৩৪ বছর। আমার বিয়ের বয়সের সমান। বিয়ের প্রথম দিকের কেনা অথচ আজও আগের মতই আছে, যত্ন আর ভালোবাসা থাকলে সব কিছুই অক্ষত থাকে সম্পর্ক কিংবা সারবস্তু। ইমা বক্স টা বা হাতে নিয়ে থেকে ৫০ টাকার একটা নোট বের রিকশাওয়ালাকে দিলো লাল বাক্সটি খুলতেই রৌদের আলোয় চিকচিক করে উঠলো তার বিয়ের প্রথম রাতে উপহার পাওয়া ডায়মন রিং, এত দামি একটা জিনিস অথচ কত দিন অযত্নে অবহেলায় পড়ে আছে। ইমা অনেক বছর পর রিং আঙ্গুলে পড়লো। রিকশাওয়ালা তাকে ১০ টাকা ফেরেত দিলো ইমা টাকার নোট ব্যাগে রাখতে রাখতে লোহার গেট পেড়িয়ে ভেতরে চলে গেল। একটু এগুতেই বাঁধানো বট গাছে গোড়ার পাশে টিনের চালার ছাওনির নিচে একটা পান সিগারেট ও টোস্ট বিস্কিটের দোকান তার পাশেই অনেক খানি জাগয়া জুড়ে টিনের ছাওনি তার নিচে ছোট ছোট টেবিলের পাশে ব্যাঙ্চ গুলো ঠাঁসা। গাছ পেড়িয়ে বাম দিক থেকে ডানদিক বরাবর প্রশাসনিক ভবন। শয়ে শয়ে মানুষ আসা যাওয়া করছে। কিছু ভিখারি হাত বাড়িয়ে এর ওর কাছ থেকে জোড়াজুড়ি করে টাকা নিচ্ছে। সাদা শার্ট কালো কোর্ট প্যান্ট পড়া উকিল বাবুরা মাঝারি ধরনের টেবিলের সামনে বসে আছে, তাদের আসে পাশে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে নানা ধরনের লোকজন। এত লোকের মধ্যে তানিমকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। শুনেছি জর্জ কোর্টে উকিলদের মধ্যে তানিমের নাম ডাক আছে একজন সৎ সাহসী পরিশ্রমী ও আদর্শবান উকিল হিসেবে তাকে সবাই জানে। কিন্তু উকিল হলে কি সৎ থাকা যায় নিজের আদর্শের মানদন্ডের শীর উঁচু করে দাড়িয়ে থাকা যায়। সৎ আদর্শ পরিশ্রমী সাথে কি ভালো মানুষের কোন পার্থক্য আছে। নাকি যে মানুষটা বাইরে সৎ সেই মানুষটা নিজের ঘরে অসৎ হয়ে যেতে পারে? নাকি আমার সংজ্ঞার ভালো মানুষকে অন্য শব্দে সংজ্ঞায়িত করা হয়! ইমা খুপরি ঘর গুলোর যে কোন বরাবর দাঁড়িয়ে ছিল তার পাশেই ছোট্ট টেবিলে একজন উকিল বসে আছে তার পাশে দুজন লোক খাতায় লিখছে সামনে দাঁড়িয়ে এক বৃদ্ধ নিচে সরে কি যেন বলছে? তার মুখের রেখা শক্ত, চোখের পাতায় বিষাদ। বুড়ো কথা বলতে বলতে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে? উকিল বাবু বলল যা শিখিয়ে দিয়েছি তা ঠিকঠাক বলতে পারছেন না কেন? বৃদ্ধ মৃদুস্বরে বললো যাদের নামে কেস লেখা হয়েছে আমি তো আমার ছেলেকে ছাড়া আর কাউকে চিনি না । উকিল বাবু উচ্চস্বরে বললেন কাল আপনি কেস লেখালেন আজ বলছেন জানেন না! আমি তো কেস লিখিয়েছি আমার ছোট ছেলের নামে কিন্তু আর বাকিদের নাম গুলো তো আমি চিনি না। তাদের সাথে এই কেসের কি সম্পর্ক কি?
উকিল চেচিয়ে বললো আপনার সুবিধা মত তো কেস লেখা যাবে না। আপনি এসবের কি জানেন? আমাদেরকে আমাদের মত করে কাজ করতে দিন আপনার ছেলে ছাড়া যাদের নাম দেওয়া হয়েছে তারা হলো এলাকার গুন্ডা বদমাশই। আপনার ছেলে সম্পত্তি লিখে নেয়ার জন্য এলাকার গুন্ডা বদমাশ বন্ধুদের নিয়ে আপনাকে শারীরিক মানুষিক নির্যাতন করেছে। মারধোর করেছে এমনকি একদিন আপনার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। মেরে ফেলতে হুমকি ও দিয়েছে। আপনার সব রকম জমানো টাকা জোরপূর্বক ছিনিয়ে নিয়েছে।
উকিল বাবু জিজ্ঞেস করলেন আপনার বড় ছেলে কেমন ব্যবহার কেমন? উকিল বাবু আর বলিয়েন না যার কপাল খারাপ তার এমন পোলা দশটা দিয়াও লাভ হয় না। আপনি কি তার নামেও কেস করতে চান? হায় আল্লাহ এ কি কন? উকিল বিস্মিত হয়ে বললেন, আপনি তো বলেছেন আপনার বড় ছেলে আপনার সাথে অসৎ ব্যবহার করেন, অর্থ সম্পত্তি তার নামে লিখে দিতে বলে! অসুখ বিসুখ হলেও কোন খোঁজ খবর রাখে না এটা সত্যি কিন্তু আমার খাওয়া পড়া তো সেই দেয়। তার নামে কেস করলে সেও আমার খাওয়া পড়া বন্ধ করে দেবে। এই বয়সে কার দাঁড়ে গিয়ে দাঁড়াবো। আজ আপনার নামে টাকা আছে অর্থ সম্পত্তি আছে সেই জন্য দেখছে কাল সব লিখে দিলেই ছুড়ে ফেলে দেবে।
আপনার কেস জিততে হলে সত্য মিথ্যা মিলিয়েই কেস করতে হবে। শুধু সত্যি দিয়ে কখনো কেস জেতা যায় না তার সঙ্গে মিথ্যা মিশিয়ে সত্যি কে আর শক্তিশালী করতে হয়। আর যেহেতু আমার কাছে কেস দিয়েছেন সেহেতু সব দায়িত্ব আমার। টাকা থাকলে অন্য কোন অবলম্বন লাগে না বুঝলেন ভাই , এই জগতে টাকাই মানুষের জীবনের বড় অবলম্বন। উকিল বাবু কথা শুনে বৃদ্ধর গলার সুর পাল্টে গেল সে এখন কিছু বলছে না থতমতো খেয়ে চুপচাপ দাড়িয়ে আছে। আমাদের সবটা দিয়ে আমরা সন্তান মানুষ করি। জীবনের বিনিময়ে বড় করে তুলি। কিন্তু সন্তানেরা কি আমারদের জন্য তাদের জীবনের কোন অংশ কিংবা সময় ব্যায় করে? অথচ তারাও আমাদের মতেই সর্বস্ব দিয়ে তাদের সন্তান মানুষ করছে, করছে না ? নতুন প্রজন্ম উদ্ভাবনে আপ্রাণ প্রচেষ্টা। অথচ পুরনোদের অবগ্যা অবহেলা। তাদের ছেলেমেয়েরাও তাদের সাথে একই ব্যবহার করবে। ইমা পাশে দাঁড়িয়ে এসব শুনছিলো। এতক্ষণ উনাকে যতটা খারাপ মনে হচ্ছিল এখন ততটা মনে হচ্ছে না।উকিলরা কি অল্প। সময়ে মানুষের প্রতি ধারণা বদলে দিতে পারে! এক্সিউজমি! সামনে থাকা লোকটা দাড়িয়ে বললো কিছু বলবেন মেডাম? এডভোকেট তানিম আহমেদ কোথায় বসেন বলতে পারনে? জি অবশ্যই আসুন। ইমা লোকটাকে ফলো করতে করতে করতে এগুলো। সামনে গিয়েই বা দিকের বিশাল গাছের নিছে একটা মাঝারি ধরনের টেবিল পাতা সামনে দুটো চেয়ার। টেবিলে একগাদা ফাইল পড়ে আছে।তানিম নিচু হয়ে খাতায় কিছু একটা লিখছিলেন। তার আশে পাশে গোটা চার এক লোক ভীড় করে দাঁড়িয়ে আছে, ইমা সন্তপর্নে লোক গুলোর পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। তানিম ইমাকে দেখে বিস্মিত চোখে তাকালো। তাদের বিয়ের এত বছর হয়ে গেছে কিন্তু তবুও ইমা কখনো তার কাজের জায়গায় আসেনি। আজ হঠাৎ আকষ্মিক ভাবে তাকে দেখে কিছুটা ধাক্কা খেয়েছে। তানিম নিজের বিস্মিত ভাব কাটিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করল। ইমা তুমি এখানে! এই তো এলাম কোন কাজে এসেছো ! তানিমের প্রশ্নের জবাবে ইমা অপরিচিতার ভঙ্গিতে বলল উকিল ডাক্তার পুলিশদের কাছে নিশ্চয়ই মানুষ প্রয়োজনেই আসে। তানিম একজন ছেলেকে ডেকে বললো এখানে একটা চেয়ার দে তো।
১৬,১৭ বছরের একটা ছেলে এসে চেয়ার দিয়ে গেল। তানিম মৃদুস্বরে বললো বসো, ইমা বললো নো থ্যাংকস বাকি ক্লায়েন্টদের জন্য যে নিয়ম আমার জন্য তাই করা হোক । তুমি নিশ্চয়ই আমার ক্লায়েন্ট নয়। ইমা একটু হাসার চেষ্টা করলো কে জানে হতেও পারি। – ওকে ঠিক আছে আগে বস তারপর না হয় তোমার কথা শুনছি। ইমা বাধ্য মেয়ের মত বসে পড়লো । তানিম বাকি ক্লায়েন্টদের তার জুনিয়রের সঙ্গে পাঠিয়ে দিলেন।এখন টেবিল খালি তানিম আর ইমা ছাড়া কেউ নেই আশেপাশে অনেক মানুষ নিজের কাজে এদিক সেদিক ছোটাছুটি করছে তবে কেউ তানিম আর ইমাকে লক্ষ করছে না। সূর্য মাথার উপর থেকে হেলে পড়েছে, গাছের পাতার ফাঁকে রোদ এসে ইমার মুখে লাগছে। সেই আলোয় চেনা ইমাকে বড্ড অচেনা লাগছে। তার মুখের রেখায় কাঠিন্য চোখের ভাষা অচেনা শব্দ, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। মনে হয় এই ইমাকে তানিম কখনো চিনতো না। তানিম ইমার দিকে টিসু এগিয়ে দিতে দিতে বলল কপালের ঘাম মুছে নাও। ইমা বললো ঘামের মত যদি কপালের সমস্ত দুর্ভাগ্য মুছে ফেলা যেত। – তাহলে পৃথিবীর নাম স্বর্গ হতো । পৃথিবী কোখনো স্বর্গ হতে পারে না, পরিক্ষার হল যেমন তোমার বেডরুম হতে পারে না। এখনে বেঁচে থাকাটাই বড় সংগ্রাম কিংবা সংগ্রহ বলতে পার। সংগ্রাম হচ্ছে জীবন যুদ্ধে টিকে থাকার জন্য যে কোন পরিবেশ যে কোন পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার জন্য, আর সংগ্রহ হচ্ছে পরকালের জন্য নিজের আমল। যদি কেউ এসব মানে তার জন্য। যে মানে না সে পৃথিবীর সব যুক্তি তর্কের বাইরে । এক জীবনে মানুষের আক্ষেপ, পাওয়া না পাওয়া, ক্রোধ কোন্দল ছিলো আর থেকবে এটাই স্বাভাবিক। কারণ এই পৃথিবীটা সাজানো কোন ফুলের বাগান নয়। তানিমের কথার জবাবের কোন প্রত্যুত্তর না পেয়ে ইমা চুপচাপ বসে রইলো। ইমার মুখে রেখায় কাঠিন্য দেখতে পেয়ে তানিমার সহজ হওয়ার চেষ্টা করল না বরং একজন সাধারণ মানুষের মতই বললো আচ্ছা আপনার সমস্যা বলুন?আমি কেস করতে চাই। কি বিষয়ে মামলা করবেন? আই ওয়ান্ট টু ডোর্ভোর্স। আমি তালাকি মামলা করতে চাই। কেন তালাক দিতে চান?? আমার জীবনের পরবর্তী দিন গুলো আমি নিজের জন্য বাঁচতে চাই। শুধু মাত্র নিজের মত বাঁচার জন্য গৃহ ত্যাগ। হুম। আপনি কি আপনার সিদ্ধান্তে অটুট? অবশ্যই জীবনের কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য বার বার ভাবাটাই বোকামি। বরং কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে যত কম ভাবা যায় ততই ভালো।আমি একনিষ্ঠ সংসার ধর্ম পালন করেছি, আমি আদর্শবান সন্তান হয়েছি,আমি নম্র ভদ্র সভ্য বউমা হয়েছি প্রতিব্রতা স্ত্রী হয়েছি, সুপার মাদার হয়েছি, কিন্তু আমি নিজের জন্য কিছুই করিনি। তানিম বললো, নিজের আপন জনের জন্য প্রিয় মানুষদের জন্য কিছু করাটা কি নিজের জন্য করা নয়? একজন পুরুষ তার পুরো জীবন যৌবনের শক্তি সম্পদ তার স্ত্রী ও সন্তানের জন্য ব্যয় করে এটা কি আপনার কাছে অন্যের জন্য করা মনে হয়। এখানে কি তার নিজের জন্য কোন সুখ সমৃদ্ধি কিংবা প্রাপ্তি কিছুই নেই?
অবশ্যই আছে।
কিন্তু আপনার যদি মনে হয় আপনিই শুধু করছেন আপনার জন্য কেউ কিছুই করেনি তখন???
যদি মনে হয় নিজের জীবন বিকিয়ে দিয়ে সবার জন্য করেছি অথচ নিজের জন্য কখনো কিছুই করিনি। প্রাপ্যতার খাতায় শূন্যতা নিয়ে নিজেকে আর শূন্য করতে চাই না। আমি জীনবনের সমস্ত দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত হতে চাই, সংসারের অব্যাহতি চাই। – সংসার ত্যাগ করা মানেই কি মুক্তি? এক সংসার ত্যাগ করলে অন্য সংসার গড়তে হয়। এই মহাবিশ্বই একটা সংসার। কোথায় পালাবেন কিভাবে পালাবেন সংসার থেকে পালানোর কোন উপায় আছে কি? যে যেখানে বাস করে সেখানেই তার সংসার গড়তে হয় পাগলের সংসার রাস্তায় গাছের তলায়, সম্ভান্ত্রের শহরে পাহাড়ে পাহাড়িদের। সংসার থেকে পালানো যায় না।মানুষ কি নিজের থেকে পালাতে পারে ? পারে না! আমি আপনার সাথে তর্ক করতে চাই না৷ কিন্তু আমাকে তর্ক করার জন্যই এখানে বসতে হয়। তো করুন না তর্ক বাট আমার সাথে নয় আই নিড অ্যা মিউচুয়াল ডিভোর্স। অকে অকে আপনি যা চাইছেন তাই হবে। সব ক্ষেত্রেই নয় শুধু কোন কোন ক্ষেত্রে আমি যা চাই তা যদি হত! অন্য কোন ক্ষেত্রে না হলেও এক্ষেত্রে হবে। ডিভোর্সি মামলার ক্ষেত্রে রায় সবসময় মেয়েদের পক্ষে হয়। নারী সংক্রান্ত মামলাগুলো স্ট্রং হয়। আপনি কি আপনার শ্বশুর বাড়ির স্পেসিফিক কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে চান? না আমি শুধু সমঝোতার মাধ্যমে মিউচুয়াল বিচ্ছেদ চাই। আপনি তাকে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত এত দিনে কেন? শেষ বয়সে তো মানুষ তার অবলম্বন খোঁজে বিশ্বস্ত হাতে হাত রেখে শেষ তার জীবনসঙ্গীর বুকে মাথা রেখে মরতে চায়। নিজের সংসার আর বেশি শক্ত করে আঁকড়ে ধরতে চায়। ডিভোর্স কথা প্রথম ভাবছেন নাকি এর আগেও মনে হয়েছিলো?? বিয়ের কিছু বছর পর হয়েছিলো কিন্তু মনে হলেই কাউকে ছেড়ে যাওয়া যায় না। ভুল বুঝবার সময় দিতে হয়। মানুষকে শোধরাবার সুযোগ দিতে হয়, এত তার মানে এত বছর পড় এসে মনে হচ্ছে সে সুযোগ ও সময় দুটোই অতিক্রম করেছে? সে তার সময়ের সিমা অনেক আগেই অতিক্রম করেছে শুধু আমি নিজেকে সময় দিয়েছিলাম সময় দিতেছিলাম স্বযত্নে গড়ে ওটা সংসারটাকে সময় দিয়েছিলাম আমার নবজাত সন্তানকে, সময় দিয়ে ছিলাম আমার নির্বোধের মত নিষ্ঠুর স্বামীকে। ভেবেছিলাম সে হয়তো আমার ভালোবাসা আমার রাগ অভিমান বুঝবে। অথচ এই জীবনে সে আমার মন ছাড়া পৃথিবীর সব কিছুই বুঝেছে। আর কিছু? তানিম বললো আপদত না যখন দরকার হবে তখন নিশ্চয়ই জানতে চইবো। মামলা করতে আপনার কাবিননামা ভোটার আইডির ফটোকপি আর আপনার ছবি লাগবে। ইমা ভেনিটি ব্যাগ থেকে একে একে সব কিছু বের করে তার দিকে এগিয়ে দিলো। তারপর ৫০০০ টাকা টেবিলের উপর রাখে উঠে দাড়ালো, এর চেয়ে বেশী লাগলে আশা করি জানাবেন। তানিম কিছু বলল না ইমা যে পথ দিয়ে এসেছিলো ঠিক সেই পথ দিয়েই হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল। তানিম ইমার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইলো। যেমন অপরিচিত মানুষের মত এতক্ষণ ইমার সাথে কথা বললো ঠিক সে ভাবেই পরিচিত চোখে আজ তাকে বড় অপরিচিত মনে হলো। ইমা যখন তার সামনে বসে এত ভাড়ি ভারি কথা বললো তখন তার কাছে কিছুই মনে হয়নি বাকি লোক জনের মতই সাধারণ মনে হয়েছে। এর আগেও তানিম কতশত ডিভোর্স কেস লড়েছে তার হাত ধরেই কত সম্পর্কের বিচ্ছেদ হয়েছে। অথচ আজ এই দিনটি তার জীবনে না আসলেও পারতো। (২০০)
মানুষের জীবনে কত খারপ দিন এলে নিজের ডিভোর্স কেসে নিজেকেই লড়তে হয় ? চট করে তানিমের মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগলো । আচ্ছা যারা ভালো থাকার জন্য একে অপরকে ছেড়ে গিয়েছে তারা প্রত্যেকেই কি এখন ভালে আছে? ইমা ও কি ভালো থাকবে? এত দিনের অভ্যাস কিংবা বদঅভ্যেস গুলো কি খুব সহজেই ভুলে যেতে পারবে? এই যে এক ছাদের তলায় একজন মানুষের সাথে তার এত বছরের জীবন যাপন এক সাথে খাওয়া ঘুম তার কথা কি খুব সহজে মন থেকে মুছে ফেলতে পারবে। কে জানে! কেউ জানে না। এক জীবনে সে কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে কিন্তু আজকের মত বিচিত্র অভিজ্ঞতা তার আগে কখনো হয়নি। এখন এই মুহূর্তে ইমা চলে যাওয়ার এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করছে তানিম। যদি সত্যি ইমা চলে যায় তখন সেই শূন্যতার পরিমান কতটা ভয়ংকর হবে! সে কি ভাবে থাকবে ইমাকে ছাড়া। এই যে সারাদিনের ক্লান্তি হতাশা নিয়ে বাড়ি ফেরার পর ইমা যখন গেট খুলে সামনে দাঁড়ায় তখন জীবনের সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। আর অনেক বছর বাঁচতে ইচ্ছে হয়। ইমা সত্যি সত্যি চলে গেলে আর কেউ তার ফেরার জন্য অপেক্ষায় থাকবে না। এই যে ইমা আছে যে ভাবেই থাকুক, এই থাকাটাই স্বস্তি দেয় আনন্দ দেয় তাকে বিয়ে করে নিয়ে আসা হয়েছে সে আমার বউ তারপর থেকে আর কখনো মনে হয়নি ও আমাকে ছেড়ে কোথায়ও চলে যেতে পারে। আজ প্রথম যখন ইমার মুখে ডিভোর্সের কথা শুনলো তার কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল। সত্যি কি ইমা তার থেকে ডিভোর্স চায়? কেন চায়? এত বছর তাম মনে এত রাগ ক্ষোভ জমা ছিলো । এত ক্ষোভ নিয়েও সে কত সহজ স্বাভাবিক ব্যবহার করে গিয়েছে। তানিমের পক্ষে আজ আর কোন কাজে মন বসানো সম্ভব নয় সে জুনিয়র কে সব বুঝিয়ে দিয়ে কোর্ট থেকে বেড়িয়ে গেল। আজ বৃহস্পতিবার তার মদপানের দিবস।
তানিমের বদঅভ্যাস বলতে সে সপ্তাহে একদিন মদ খায় তাছাড়া তার আর কোন বদভ্যাস নেই। ইভেন্ট সে সিগারেট পর্যন্ত খায় না। তানিম সপ্তাহে একদিন খায় বলেই সে খাওয়ার সময় কোন লিমিট রাখে না। কিন্তু মদ খেয়ে মাতাল হতে তাকে কেউ কখনো দেখেনি। রাত সারে এগারোটা মদ পান করে তানিম স্বাভাবিক ভাবেই গাড়ি ড্রাইভ করে বাসায় ফিরলেন। কেয়ারটেকার গেট খুলে দিলেন। বিকালের যে ঘটনা তার এতক্ষণ মাথায়ই ছিলো না বাসায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তা মনে পড়ে গেল। তানিম মাথায় এক ধরণের চাপ অনুভব করলো। গাড়ি পার্কিং করার সময় হঠাৎ মাথা একটু চক্কর দিলো। কেয়ার টেকার বললো স্যার ঠিক হুয়া। ইয়া অফকোর্স, সে গাড়ি থেকে নেমে টাই খুলতে খুলতে বললো আমাকে কেউ মাতাল বলবে? নো নো নো মাই ডিয়ার। মদ আমার শরীর সহজ ভাবে গ্রহন করে নিয়েছে। যতই খাই কোন সমস্যা নাই হাহা হা, রফিক মিয়া হবে নাকি একদিন । না ভাইজা। না কেন। মাঝে মাঝে পদ্যপান করা তো স্বাস্থ্যের জন্য ভালো সাধারণভাবে সপ্তাহে ৭ থেকে ১৪ ইউনিট পর্যন্ত মদ্যপানকে ‘পরিমিত’ বলা হয়। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন আমি যতই খাই না কেন আমি হলাম পরিমিত মদ্যপায়ী। ছয় পাউন্ট সাধারণ-শক্তির বিয়ার বা সাত গ্লাস ওয়াইন। আর স্পিরিট অর্থাৎ হুইস্কি, জিন, রাম,ভদকা ইত্যাদির ক্ষেত্রে এই সীমা হচ্ছে সপ্তাহে ১৪ ইউনিট (১ ইউনিট মানে ১টি ‘ছোট পেগ’ এই হিসেবে) ব্রিটেনের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নির্দেশিকায় বলা হয় সপ্তাহে ১৪ ইউনিটের কম নিয়মিত মদ্যপান করলে তার স্বাস্থ্য ঝুঁকি হবে নিম্ন মাত্রার।যারা এর চেয়েও কম খান, তাদের বলা হয় লাইট ড্রিংকার। লাইট ড্রিংকারের খাতায় নাম লেখালে তো কোন সমস্যা নেই। ভাই এককালে হেন প্রকার মদ নাই যে স্বাদ নেই নাই। এখন ওসব বদঅভ্যেস ছেড়ে দিয়েছি। ওহ তাই বলো। জি স্যার ঘরের শান্তি বজায় রাখা জন্য কখনো কখনো বদঅভ্যেসের সাথে সাথে অনেক অভ্যাস ও পরিবর্তন করতে হয়। বদ অভ্যাস না হয় বুঝলাম কিন্তু অভ্যাস কেন? আমি ঘুমোতে খুব পছন্দ করতাম দিনে 17 18 ঘন্টা ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিতে পারতাম। বিয়ের প্রথম দিকে বউ মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে ঘুম পাড়িয়ে দিত। বলতো তোমার ওপর দিয়ে অনেক ধকল যায়। ঘুমাও যতক্ষণ ইচ্ছে ঘুমাও এমনও হয়েছে রাতে ঘুমিয়েছি পরদিন বিকালে বেলা ঘুম ভেঙ্গেছে। কিছুদিন যেতে না যেতেই ঘুমালেই বউ ডাকা ডাকি শুরু করে দেয় ডাকে কাজ না হলে মুখে পানি ঢেলে দেয় সারাদিন পড়ে পড়ে ঘুমালে আমাদের না খেয়ে মরতে হইবো যাও গিয়ে কামাই কাজি কিছু করো। ভরা পেটে না ঘুমিয়ে থাকা যায়। কিন্তু খালি পেটে ঘুমিয়েও থাকা যায় না। বুঝলেন ভাইজান মেয়েদের মন বোঝা বড় কঠিন। তুমি কখনো চেষ্টা করেছিলে?? হুম অনেক। আমার ও বোধয় চেষ্টা করা উচিত তানিম নিচুস্বরে বলতে বলতে উপরে চলে এলো। রফিক মিয়া বুঝতে না পেরেঘার বেকিয়ে অ্যা বলে তানিমের চলে যাওয়া দেখলো। আচ্ছা মেয়েরা কি সত্যিই অদ্ভুত তারা গরিব ছেলের কাছে চায় টাকা আর বড়লোক ছেলের কাছে চায় ভালেবাসা। যার কোনটাই এই দুই শ্রেণির মানুষের কাছে থাকে না। অর্থাভাব যেমন ভালোবাসা বুঝতে শেখায় অতিরিক্ত অর্থের কাছে তেমন ভালোবাসা মূল্যহীন হয়ে যায়। তানিমের শরীর কেমন কেমন লাগছে একটু পর পর ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায় একধরনের অস্বস্তি। মাথার ভেতরটা ভারী হয়ে আছে। শরীরটা ঝিম ঝিম করছে। তানিম রাতের খাবার খেয়ে একটার দিকে শুয়ে পড়েছিলো। কিন্তু তার কিছুতেই ঘুম আসছে না। বহুদিন পর ইমার সাথে রাত জেগে গল্প করতে ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু ইমা বিভোরে ঘুমিয়েছে আর মাঝরাতে একজন ঘুমন্ত মানুষকে জাগানো যায় না। যে আজ তার কাছে ডিভোর্স চেয়েছে সে নিশ্চয়ই ঘুম থেকে উঠে রাত জেগে গল্প করবে না, বারান্দায় দাঁড়িয়ে মৃদু ঠান্ডা বাতাস খেতে খেতে মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকা চাঁদ দেখবে না। যা রোমাঞ্চকর দিনগুলো বহুকাল আগেই আকষ্মিক ভাবে তার মাঝ থেকে এসব অনুভূতি হারিয়ে গিয়েছে আজ কেন সেসব বিষয় নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করছে । নিজের উপর নিজেরই রাগ হলো তানিমের । চাঁদের কথা ভাবতেই তার আর একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। প্রথমবার যখন আমি আর ইমা কক্সবাজার হানিমুনে গিয়েছিলাম তখন মার্চের শুরু হালকা শীত ভরা পূর্নিমার রাত আমার পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকাল, সারা দিনের জার্নতে আমি খুব টায়ার্ড ধবধবে সাদা পরিষ্কার বিছানায় শুয়ে খুব সহজেই তন্দ্রা এসে গেল। রাতে সমুদ্র জোছনায় মাখামাখি চকচকে চাঁদের আলো। ইমা বললো চলো না সমুদ্রের পারে গিয়ে জোছনা মাখা সমুদ্র দেখি। আমি ঘুম ঘুম চোখে বললাম ইমা আমি ঘুমাচ্ছি দেখছো না । তোমাকে কাল সমুদ্র দেখতে নিয়ে যাব। আর ও যখন মাঝরাত ঘুমিও পর। ও জানালার পর্দা টেনে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। আমি ঘুমের ঘোরে অনুভব করলাম ওআমাকে আলিঙ্ক করতে চাইলো তীব্র আকাঙ্খা নিয়ে কাছে আসতে চাইলো ঘুমে বিভোর ক্লান্ত শরীর থেকে একটা শব্দ বেরিয়ে এলো আহ্! ঘুমাতে দাও বিরক্ত করোনা তো আমি খুব ক্লান্ত । ইমার আর কোন সাড়াশব্দ পেলাম না। বোধয় আমার পাশ থেকে সরে গেছে। ভোর রাতে ঘুম ভেঙ্গে দেখি বিশাল জানালার পর্দা সরানো ইমা চেয়ারে বসে ঘুমিয়ে আছে । ওর মাথা চেয়ারের হাতলের দিকে বেঁকানো। পশ্চিমাকাশে ডুবে যাওয়া রাতের শেষ চাঁদের একাংশ তখনো দেখা যাচ্ছে। ইমাকে বিছানায় নিয়ে শুয়িয়ে দিলাম। পরদিন ওর ঘুম ভাঙ্গা দুপুর ১ টায়। লান্স শেষ করে ওকে নিয়ে সমুদ্রের পারে গেলাম ও যেতে চাইছিলো না আমার জোড়া-জাড়িতে শেষমেশ গেল। অনেকক্ষণ মনে মনে খুব অস্বস্তি হচ্ছিলো মায়েটাকে বাড়ি থেকে এত দূর নিয়ে এসে মেয়েটার সাথে বড় অন্যায় করা হয়ে গেল। মানুষের মন আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সাথে কিছু মিল ও বৈসাদৃশ্যতা আছে। প্রকৃতি দেখলে যেমন মন ভালো হয়ে যায়। তেমন মন খারাপ থাকলে পৃথিবীর সুন্দর তম জিনিস ও বিষাদ লাগে বিচ্ছিরী লাগে। তানিম ছাতার নিচে বসেছিলো। ইমা ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো সমুদ্রের দিকে বিচের ধারে রাখা গাড়িগুলোও এক এক করে ছেড়ে যাচ্ছে। শুধু জলে নামার নিষেধ উপেক্ষা করে এই আবছায়াতেও সমুদ্রস্নানে মত্ত কিছু মানুষ। আর হাওয়ায় ফিরে ফিরে বেড়াচ্ছে সমুদ্রশাসনের গর্জন। এমন আদুরে মেজাজ ও মায়াবি পরিবেশের হাতছানি উপেক্ষা করা যান না। তানিম ইমাকে বলেছিলো সমুদ্রের ধরে যাও কিন্তু পানিতে নেমে যেওনা। সমুদ্র যেমন তার সৌন্দর্য দেয় তেমন কেঁড়েও নেয়। এই বিশাল ঢেউয়ে কেউ হারিয়ে গেলে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। ইমা তখন বলেছিলো মন থেকে হারিয়ে গেলে পাশে থাকা মানুষটাকেও আর খুঁজে পাওয়া যায়না, মানুষ যেমন কিছু দেয় বিনিময়ে তার বেশি কেঁড়ে নেয়। দেওয়া নেওয়ার এই টেন্ডেন্সি বহুকাল আগেই মানুষ উদ্ভাবন করেছে শুধু নিজেদের স্বার্থে। পৃথিবীতে বিচরণে শুরুর দিকে মানুষ বিনিময় হিসেবে বিভিন্ন পণ্যদ্রব্য ব্যবহার করত যেমন একটা পণ্যের বিনিময়ে অন্য একটা পণ্য। একটা সেবার বিনিময়ে অন্য একটা সেবা মোটকথা বিনিময়ের মাধ্যমে মানুষের সার্বিক প্রয়োজন মেটানো । ইমা আস্তে করে বলল এই জীবনের সবই প্রায় বিনিময় কিছু দেওয়ার বদলে নেওয়া, নেওয়ার বদলে দেওয়া। স্বর্নের বিনিময়ে ডলার তার বিনিময়ে ডলার একচেঞ্জ হয়ে টাকা । সামঞ্জসতা না আসলেও মোটামুটি একটা পর্যায়ে ফেলা হয়েছে। সম অধিকার সম্মান দায়িত্ব-কর্তব্য ভালোবাসা দেওয়া নেওয়ার ক্ষেত্রে সামঞ্জস্যতা আসেনি। আর কখনো সম্ভব ও নয়। সব সম্পর্কের ক্ষেত্রেই যে কোন একজন সবসময় বেশি এফোর্ট দিয়ে থাকে।কোন সম্পর্কে ছেলে দেয় কোন সম্পর্কে মেয়ে দেয়। কে কাকে কতটা গুরুত্ব দেবে কিংবা কে কার উপর আধিপত্য বিস্তার করবে তা সম্পর্কের প্রথম দিক থেকেই যেন নিরব ভাষায় বলে দেওয়া হয়ে যায়। প্রতিটি সম্পর্কের ক্ষেত্রেই দুর্বল ব্যক্তির উপরই প্রতিপক্ষ আধিপত্য বিস্তার করে থাকে। কোন সম্পর্কে কার অবস্থান কোথায় সেটা তারা মুখে বলে না দিলেও প্রত্যেকেই বুঝে যায়। যেমন ইমা ও তানিম বুঝে গিয়েছিলো। কিন্তু একজন গলা পানি পর্যন্ত নামলে অন্য জনকে তো হাঁটু পানি পর্যন্ত নামতে হয়। একা একটা সম্পর্ক কে কত দিনই বা টেনেটুনে এগিয়ে নেওয়া যায়।ইমা আরো এগিয়ে গেলো একের পর এক ঢেউ আসছে সারি বেঁধে। পারে ধাক্কা খেয়ে নিমিষেই মিলিয়ে যাচ্ছে। ইমা নীল সমুদ্রের দিকে তাকায়ে আনন্দের সাথে সাথে এক ধরনের বেদনা অনুভব করলো এক ধরনের শূন্যতা। যা সে এত বছর ধরে বহন করে আসছে। কোথাও সমুদ্র আলতো করে পাড় ছুঁয়ে গেল, আবার কোথাও বা ঢেউ আছড়ে পড়ছে পাড়েই। ঠিক যেন কবির লেখা কবিতার মত,বিশাল স্নিগ্ধ সুন্দর শূন্যতা। ইমা এগিয়য়ে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই বাঁধ ভাঙ্গা সমুদ্রে দিকে। তানিম ভাবার চেষ্টা করলো ইমার প্রতি অন্যায়ের সূচনা কি এখান থেকেই? যা তানিম সহজ স্বাভাবিক ভেবে এসেছে তাই কি ইমার জীবনে অপমান, অন্যয়। সে কি নিজের অজান্তেই ইমাকে প্রত্যাখ্যান করে গেছে অবহেলা করে গেছে অপমান করে গেছে। ইমা কি চায় এত বছর পরও কি তানিম জানে একজন স্ত্রী হিসেবে স্বামীর কাছে তার কি চাহিদা ছিলো??
পার্ট 2
ইমা ঘুমিয়ে পড়েছে তার ভারী নিঃশ্বাসে শব্দ শোন যাচ্ছে। শাড়ী উঠে গিয়ে নিটোল পা দেখা যাচ্ছে। বুকের কাছের আঁচল সযত্নে সরানো। তানিম ইমার দিকে তাকালো। তার চোখে মুখে স্নিগ্ধ কোমলতা। যেন ঘুমন্ত কোন রাজকুমারী। যার বয়স বেড়েছে। কিন্তু বাড়তি বয়সের ছাপ এখনো তেমন স্পষ্ট চোখে পড়ার মত নয়। তানিম বাথরুমে গিয়ে ঠান্ডা পানির ঝাপটা চোখে মুখে দিলো। তার কেমন নেশা নেশা লাগছে। টাওয়ালে মুখ মুছতে মুছতে তার হঠাৎ মনে হলো সে অনেকদিন পর উজ্জ্বল আলোয় ইমার শরীর দেখলো। ভরপুর শরীর, মসৃণ চামড়া কোথাও বাড়তি মেয়াদ নেই একে বোধহয় যৌবনের মধ্যাহ্ন বলে। এরপর থেকে চামড়া কুচকাতে শুরু করবে হয় রোগা হবেন না হয় মোটা হবে। তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ইমার নরম শরীর ছুঁতে ইচ্ছে করতো। তানিম ইমার পাশে এসে আলতো ভাবে তার হাতের উপর হাত রাখলো। ইমা তানিমের হাতের তালুর উষ্ণতা অনুভব করলো। এই একটু উষ্ণতার জন্য মানুষ কি অপরিসীম কাঙ্গালপনা নিয়ে আজীবন বেঁচে থাকে। মানুষ এখানেই দূর্বল এখানেই অসহায়। জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত একা উপভোগ করা যায় না। শারীরিক মানসিক সেই চাহিদা মেটাতে অন্য কাউকে লাগে, শুধু কেউ নয় বিশেষ কেউকে। এখানেই মানুষের অসহায়ত্ব। উষ্ণতার স্বাদ একদিন নিভে যায় শরীরের এই চাহিদা ফুরিয়ে যায়। তখনো তারা এক সঙ্গে থেকে যায় কেবল প্রেমের জন্য । থেকে যায় একে অপরের হাত ধরে চলার জন্য থেকে যায় জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেয়ে সুখ দুঃখ ভাগাভাগি করে একে অপরের বুকে মাথা রেখে নিঃশব্দে বুড়ো হওয়ার জন্য। থেকে যায় দু দন্ড বসে গল্প করার জন্য থেকে যায় মায়ার জন্য থেকে যায় প্রেমের জন্য । এখানেই সুখ এখানেই শান্তি এখানেই সংসার এখানেই বেঁচে থাকার সমস্ত প্রাপ্তি । কিন্তু এই অনুভব অনুভূতি আর কিছুই যায় আসে না। ইমাকে আর কোন কিছুতেই আঁটকে রাখা যাবে না। কোন ভাবেই না। আগে ইচ্ছে হলেই তানিম ইমাকে কাছে টেনে নয় স্রেপ সে যখন প্রয়োজন অনুভব করতে তখন একটু আকটু তার কথা মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করে খুব হেসে হেঁসে মিনিট দশএক কথা বলে হালকা পাতলা রসিকতা করে যেমন : পার্টিতে এক লোক বসে আছে। একটু পর এক সুন্দরী তরুণী এসে তাকে বলল, ‘আপনি কি নাচতে ইচ্ছুক?’লোকটি উৎফুল্ল হয়ে বলল, ‘অবশ্যই!’মেয়েটি এবার বলল, ‘তাহলে চেয়ারটা ছাড়ুন। আমি একটু বসব!’ তারপর হা হা করে হাসবেন যেন নিজের কথায় নিজেই খুব মজা পেয়েছে। একটু পরই তার ভারি নিশ্বাসের শব্দ শোনা যায। মিথ্যা মিথ্যা সব মিথ্যা। ইমা কিছুক্ষণ পর হাতটা সরিয়ে দিতে দিতে বলল তোমার এই নোংরা স্পর্শে শিহরণে শুধু শরীরে জাগে মন জাগে না। ইমা রাগান্বিত স্বরে বললো মাঝরাতে মদ খেয়ে মাতলামি করতে এসো না৷ এর পর অনেকক্ষণ সব চুপচাপ। তানিম এত বছর ধরে মদ খায় সে কখনো মাতাল হয়নি ইভেন্ট ইমা কখনোই তাকে মাতাল বলেনি। আজ আজ কেন বললো? সে কি সত্যি মাতাল কই না তো তার চিন্তাশক্তি তো লোভ পায় নি, দেয়ালের রং ঠিক আছে, হাতঘড়ি সঠিক সময় দেখতে পারছে চারপাশে তাকিয়ে তানিম নিজেকে শান্ত করারা চেষ্টা করলো প্রমান করার চেষ্টা করলো সে আসলে মাতাল নয় কিন্তু কার কাছে নিজেই নিজের সাথে তাতে কি হয় বা কি হবে? তানিম ইমার কথায় প্রচন্ঠ অপমানিত বোধ করলেন। অথচ এর আগে কত বার কত রাত ইমা যখন আদুরে মেজাজে ঘনিষ্ঠ হতে চেয়েছে সেও তো তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। তাতে কিছু আসে যায় না। বউরের আবদার মেটানো দৈবঘটনা মাত্র সুযোগ পেলে মেটাবে না পেলে মেটাবে না। অথচ স্বামীর আবদার মেটানো স্ত্রীর পরম কর্তব্য। শরীর মন তার জন্য প্রস্তুত থাক কিংবা না থাক তাতে কিছু যায় আসে না। আজ ইমাকে খুব করে বলতে ইচ্ছে করছে ইমা আমি তোমাকে ভালোবাসি। আর এই স্পর্শ নোংরা নয় তোমাকে ভালোবেসে আঁকড়ে ধরতে চাওয়া। আমি তোমাকে ভালোবাসি প্রচন্ড ভালবাসি শুধু এই ভালোবাসা উপলব্ধি করার অনুভূতি টুকু হারিয়ে ফেলেছিলাম। মানুষ যখন চাওয়ার চেয়ে বেশি পায় তখন তার কদর করতে জানে না। ইমা আমি এত কাল তোমার মূল্য বুঝিনি। আমাকে ক্ষমা করে দাও
। মন যখন যে দিকে ছোটে কেউ তাকে আঁটকে রাখতে পারেনা ইমাও মন ছুটে চলেছে কোন অজানা সুখ কিংবা দুঃখকে আঁকড়ে ধরার জন্য।এই সম্পের্ক বাঁধন তার কাছে এখন গলার কাঁটার মত। যা সে গিলতেও পারছে না উগরাতেও পারছে না। আর শরীর শ্যাওলা জমা দেয়ালের মত। ঘসলে চকচকে থাকে আর না হলে ধুঁলো জমে যায় না আমি কখনো ইমার মনের যত্ন নিয়েছি না শরীরের। তানিমের নিজের সাথে নিজের দন্ড যুদ্ধ যেন কিছুতেই থামছে না। যে উপলব্ধি আগে করলে তার সংসার বেঁচে যেত আজ সব হারিয়ে যখন তারা দুজনে এমন একটি সিদ্ধান্তে পৌছেছে তখন এসব চিন্তা করা নিরর্থক। সে সত্যিই জঘন্যতম অপরাধ করেছে। তার বউ আজ তারই কাছে ডিভোর্স চেয়েছে। অথচ সে বাড়ি ফিরে সে প্রসঙ্গে কোন কথাই তোলেনি। কেন এসব বলছো কি চাও সত্যি কি সে এ ব্যাপারে সিরিয়াস কি না এত বছর পর হঠাৎ ডিভোর্সই বা চাইছে কেন কোন প্রশ্নই করা হয়নি ইভেন্ট প্রতিদিন ইমার সাথে যেটুকু প্রয়োজনীয় কথা হয় যেমন শরীর ভালো আছে তো? মেয়ের সাথে কথা হয়েছে? কি ঘুমাবে নাকি শুতে যাবে, তোমার কি লেট হবে? আজ তাও বলেনি। তানিম চুপচাপ খেয়ে নিয়ে নিঃশব্দে টেবিল থেকে উঠে এসেছিলো। তারা দুজনেই পাশাপাশি শুয়ে আছে হাত বাড়ালেই একে অপরের ছোঁয়া যায় । তবুও একই বিছানায় শুয়েও যেন দুজন পৃথিবীর দুই প্রান্তে বসবাস করছে।
ইমা বিছানা ছেড়ে উঠে বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো হালকা ঠান্ডা বাতাস। ইমা আজীবন সব দায়িত্ব পালন করেছে সবার প্রতি সব কর্তব্য নিষ্ঠার সাথে করেছে। কিন্তু কর্তব্য কি শুধু অন্যের প্রতি হয়?? নিজের প্রতি কোন কর্তব্য নেই নিজেকে সুখি করা। আনন্দের রাখা নিজের ইচ্ছে অনিচ্ছের দাম দেওয়া। চাঁদ প্রায় ঢাকা পড়তে বসেছে নক্ষত্র গুলো টিপ টিপ আলো জ্বলছে। পৃথিবীটা দেখতে কি সুন্দরই লাগছে। ইমার মনে পরে গেল বছর কুরি বসয়ের কথা একটা সিদ্ধান্ত জীবনটা কোথা থেকে কোথায় এনে দাড়করিয়ে দেয়। যদি সেই জোছনার রাতে ইমা সবার সিদ্ধান্তে সম্মতি না জানাতো তাহলে কি সে আজ এখানে থাকতো? না কখনোই নয়৷ তাহলে অন্য কোথায় থাকতো? কিন্তু কোথায়?? ইমা কেমন একটা ঘোর ঘোর লাগছে। হঠাৎ করে বুকের ভেতরে স্মৃতির অন্তরায় আস্তরণের নিচ থেকে চোখের সামনে স্পষ্ট হতে থাকলে ফাহাদেট মায়া ময় মুখভয়টা। ভোরের পাখিদের সবে ঘুম ভেঙ্গেছে দু একটা পাখি ট্যা ট্যা করে জানান দিচ্ছে তাদের অস্তিতের কথা। এই সব দুঃখ সুখ ভরা দিনরাত্রি আলো আঁধারের খেলা ছাপিয়ে প্রবলভাবে প্রকোপ হতে লাগলো আমার বিরহ গাথা। চারিধার কত সুন্দর তবুও বিষাদ কোথাও যেন আনন্দ নেই বেঁচে থাকার আক্রোশ নেই কেবল বিরহ ব্যাথা আর হতাশা। ফাহাদ বিয়ে করেছে আমার বিয়ের বছর দেড় বছর পরেই। এখন সে স্ত্রী ও দুই ছেলে মেয়ের সঙ্গে সুইডেন থাকে। যে পরিবারটা তার সেটা আমার হতে পারত। ও যে পরিবারের কর্তা আমি সেই পরিবারের কর্তী হতে পারত। একই সঙ্গে হাতে হাত রেখে কাটিয়ে দিতে পারতাম যুগের পর যুগ। কিন্তু ফাহাদের সঙ্গে বিয়ে হলে পার্সি, প্রতীক কি তার গর্ভে জন্মাত? নাকি অন্য কেউ। যার হাত পা মুখের আদল স্বভাব চরিত্র আলাদা হত। সে সম্পূর্ণ অন্য মানুষ হত অন্য ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কেউ। ইমা আলতো ভাবে তার পেটে হাত রাখলো ইমা তার নিজের জীবনে কিছু করতে না পারলেও তার ছেলে মেয়েদের সে মানুষের মত মানুষ করতে পেরেছে এখানেই তার মাতৃত্বের স্বার্থকতা। সে তার কর্তব্য করেছে এবং সফলও হয়েছে। আর মেয়ে একজন শিক্ষক সে বিদেশি ইউনির্ভাসিটিতে পড়ায় আর ছেলে কানাডায় পড়াশোনা করে। সন্তানের ভবিষ্যতে সে অটুট ছিলো তবুও ব্যক্তিগত জীবনে নিজের জন্য কি কখনো কিছু করেছে??? তিন বেলা রান্না করা আর ঘরের কাজ ছাড়া?? যে মেয়েকে সে সর্বশ্য দিয়ে মানুষ করেছে যার মাঝে নিজের সফলাতা খুঁজেছে তার একলা থাকা দিন গুলো তার নিঃসঙ্গ মনখারাপের সময় গুলোতে মেয়েকেও পাশে পায়নি দুদণ্ড গল্প করে সময় কাঁটাতে পারেনি। জীবন ভর সে একলাই রয়ে গেল। উচ্চ শিক্ষার জন্য ছেলে মেয়েকে বিদেশ পাঠাতে চেয়েছিলো তানিম ইমা রাজি হয়নি? ইমা তানিমকে প্রশ্ন করল আচ্ছা বলতে পারো উচ্চশিক্ষা লাভের পরে দেশে ভবিষ্যৎ কি? কেন আমি তো খুব খারাপ দেখি না ইউনিভার্সিটি গুলো থেকে পাস করে বেরিয়ে তো মানুষ বিসিএস পরীক্ষায় বসছে দেশের বড় বড় সরকারি বেসরকারি চাকরি করছে। আমার ছেলে মেয়েরাও করবে। এই দেশে চাকরি করে জীবনে কিছু হবে না।
ইমা বিরক্ত মুখে বললো দেশে চাকরি বাকরি করেও তো মানুষ বাড়ি করছে দামি গাড়ী চড়ছে। করছে তবে সবই দূর্নীতির টাকায়। তুমি কি বলতে চাইছো এই দেশে সৎ ও আদর্শবানরা বিত্তবান হয় না, কিংবা বিত্তশালীরা আদর্শবান হয় না! তানিম হাসলো যার স্পষ্ট অর্থ সে ইমাকে ব্যঙ্গ করলো, হয় কি ভাবে? সাতাশ আটাশ বছর গেলে যায় গ্রাজুয়েট মাস্টার্স কম্পিলিট করে সার্টিফিকেট হাতে পেতে। আর চাকরি বয়স মাত্র ত্রিশ বছর মানুষ পড়াশোনা শেষ করবে করে চাকুরি করবে কবে আর বিয়ে করবে কবে বাড়ি গাড়ি করবে কবে ? তুমি যেটা বলছো সেটাও ঠিক তবে নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেরা সৎ ভাবে চাকরি করে জীবনে আহামরি কোন উন্নতি ঘটাতে পারেনা। যাদের ফ্যামিলি আগে থেকেই রিচ কিংবা যারা সফল উদ্যোক্তা হতে পারে। ইমা আমি তোমার চেয়ে ভালো বুঝি আমার ছেলে মেয়ের ব্যাপারে তুমি আমাকে বাস্তবতা শিখাতে এসো না সাংসার ছাড়া বাইরের জগৎ টা তো দেখনি তাই বোঝনা বাস্তবতা কতটা কঠিন। দেখিনি সত্যি তবে দেখতে চাইনি তা কিন্তু নয়। বরং দেখতে দেওয়া হয়নি। ওহ আরাম আয়েসে আছো ভালো লাগছে না। যদি রোদে পুরে বিষ্টিতে ভিজে রোগে শোকে অফিস আদালতে গিয়ে রোজগার করে সংসার চালাতে হত তাহলে বুঝতে। বসে বসে খাচ্ছ যা প্রয়োজন তার চেয়ে ঢের পাচ্ছ এত আয়েসি জীবন যাপন তবুও সহ্য হচ্ছে না। আর যারা চাকুরী বাকরি করে তারা চায় তোমার মত আয়সে বসে সংসার করতে আর টাকা উড়াতে। কথায় আছে না নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস, ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস। নদীর ওপার বসি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে; কহে, যাহা কিছু সুখ সকলি ওপারে। যে ভাবে আছ সেভাবেই থাক বাইরের ঝুট ঝামেলা নিয়ে তোমাকে মাথা ঘামতে হবে না তুমি সংসার করছো সেটাই মন দিয়ে কর। যে পরিবারের মেয়েরা চাকুরি করে সেই সংসার টেকে না। তোমার বোন চাকুরী ও করছে আর সংসারও সামলাচ্ছে। শোন বউ দেশ আর বিদেশ এক কথা না। ইমা রাগান্বিত হয়ে বললো সংসার ভাঙ্গার কারণ কখনো চাকুরি বাকরি করা না করার উপর নির্ভর করে না, পুরুষেরা যদি স্ত্রীর সাথে জানোয়ারের মতো মারধোরকরে,স্ত্রীকে ঘরে রেখে বাইরে পরকীয়া করে বেড়ায়, স্ত্রীকে তার প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা না দিয়ে তাকে পায়ের তলায় ফেলে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া তাহলে সংসার টিকবে কি করে। মেয়েরা এখন নিজের সন্মান নিজের আদায় করে নিতে শিখেছে। পুরুষই চায় স্ত্রীরা কুকুরের মত তাদের সব আদেশ নির্দেশ পালন করুক। কিন্তু কোন স্বামী বুঝতে চায় না যে তারাও একজন আলাদা মানুষ তাদের সখ আহ্লাদ আশা আকাঙ্খা পছন্দ অপছন্দ ভালো লাগা মন্দ লাগা থাকতে পারে। যারা চাকরিজীবী তারা তো সনিট্ তাই তারা প্রতিবাদ করতে পারে।সামাজিকীকরণের কারণে তিনি গতানুগতিক পুরোনো সংসারের ধ্যান-ধারণা লালন করতে চান, তাদের মা-মাসি বা দাদি-নানিরা যেভাবে শ্বশুরবাড়ির এবং স্বামীর সব সিদ্ধান্তে সায় দিয়ে সংসারে টিকে থাকতেন, ঠিক তেমনিভাবে এ প্রজন্মের মেয়েটির কাছেও প্রত্যাশা করেন স্বামী পুরুষটি। কিন্তু বর্তমান সমাজের শিক্ষিত, কর্মজীবী নারীর পক্ষে সেই বউ হয়ে ওঠা সম্ভব হয় না। শুরু হয় সংসারে অশান্তি। ফলে অন্যের বাড়িতে চাপের মুখে কিংবা গুমট পরিবেশ থেকে রক্ষা পেতে মেয়েটি সিদ্ধান্ত নেন বিবাহ বিচ্ছেদের।শিক্ষিত নারীদের নিয়ে সংসার পরিচালনা করতে এখনো প্রস্তুত নন ছেলেরা। তারা শিক্ষিত মেয়ের সঙ্গে সংসার করতে চান, কিন্তু শিক্ষিত মেয়ের চাকরি জীবন, তার ব্যক্তি স্বাধীনতা, তাকে কিছু বিষয়ে সহযোগিতা করা—এসবে পূর্ণ স্বাধীনতা বা সহযোগিতা করতে নারাজ স্বামীরা। ফলে একটি শিক্ষিত মেয়ের যখন আত্মসম্মানে আঘাত আসে, তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন ডিভোর্সের। যেহেতু সমঝোতা কেবল নারীকেই করতে হয়। তাই শিক্ষিত স্বনির্ভর নারী কখনোই আত্মত্যাগের সমঝতা আসতে ইচ্ছুক নয় তখনই বিচ্ছেদের চিন্তা আসেন। কিন্তু পুরুষেরা কি এগিয়ে এসে ভরসার হাত বাড়িয়ে দিতে পারে না! পারে কিন্তু তারা দেয় না কারণ একজন বিবাহিত পুরুষের পক্ষে দ্বিতীয় বিয়ে খুব সহজলভ্য।স্বামীর উপর নির্ভরশীল মেয়েরা কেবল যাওয়ার জায়গা নেই বলেই দিনের পর দিন সকল অত্যাচার সহ্য করে নিয়ে মুখ থুঁবড়ে স্বামীর সংসারে পড়ে থাকে। ব্যক্তিত্ব আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে দিলে আর সে মানুষ মানুষ থাকে না। বহু যুগ আগে থেকে মেয়েদের উপর যে অত্যাচার অমানুষিক নির্যাতন নিপিড়ীত ও অবহেলা করে আসা হয়েছিলো নারীরা এখন সে সব কিছু থেকেই বেড়িয়ে আসতে চায় তাই শিরদাঁড়া শক্ত করে যে সব নারীরা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত তাদেরকেই স্বামী ছাড়তে হয় সংসার ছাড়তে হয়। কারণ পুরুষের স্ত্রী ছাড়তে পারে কিন্তু স্ত্রীদের উপর অনধিকার চর্চা ছাড়তে পারবে না। তাই আজকালকার যুগে চাট কামরার কোন ফ্লাটে নিরবে কোন পুরুষ নির্যাতন হওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়। কারণ যে যার উপর পারছে নিজের সবটুকু অনধিকার চর্চা করছে। এখন আর নারী পুরুষ বলে ভেদাভেদ নেই। আজকাল কত পুরুষও নিশ্চুপে নির্যাতন নিপিড়ীত সহ্য করে যাচ্ছে। ইমা বললো দেশ বিদেশ চাকুরীজীবি কিংবা গৃহিণী স্ত্রী বলে কথা না বলে মানুষিকতা নিয়ে কথা বলা দরকার চিন্তা ধারা নিয়ে কথা বলা দরকার। মেয়ের যাওয়ার জায়গা নেই বলে স্বামীর পায়ের কাছে পড়ে থাকবে এটাই যদি আপনার কাছে সুন্দর সমাজ ও সংসারের বৈশিষ্ট্য হয় তবে মেন্টালিটি পরিবর্তন করা দরকার। রোজ রোজ তোমার সাথে কি বিষয় নিয়ে ঝগড়া করতে ভালো লাগেনা। তোমার যা ইচ্ছা হয় তাই করতে পারো। কিন্তু তুমি আমার সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যতের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারো না। তানিমের কথায় ইমা খুব আহত হল সে মা হিসেবে কি চায় না তার ছেলে মেয়ে মানুষের মত মানুষ হোক, তানিম ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল মানুষের মত মানুষ করতে চাই বলেই ছেলেমেয়ে বিদেশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যেন তারা দুধে ভাতে থাকতে পারে। টাকা পয়সা নিয়ে কখনো চিন্তা করতে না হয়, পিছু ফিরে তাকাতে না হয় । কেবল মানুষ হওয়াটা যদি মোটা টাকা মাইনে পাওয়াকে বোঝায় তাহলে ইমা তাকে মানুষ বলতে পারেনা। ইমা বললো একজন সৎ আদর্শবান মানুষ হিসেবে আমি শুধু চাই আমার ছেলে মেয়েরা একটা সুষ্ঠ সুন্দর সাবলীল জীবন যাপন করুক। নিজের দেশকে ভালোবাসতে শিখুক সন্মান করতে শিখুক। আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার এতটা অধঃপতন হয়নি যে প্রত্যেক ঘরে ঘরে সন্তানকে উচ্চশিক্ষার জন্য বিলেত আমেরিকা পাঠাতে হবে। ত্রিশ লক্ষ শহীদের জীবনের বিনিময়ে যেতে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। দেশকে অসন্মান করে সেই শহীদদের আত্মত্যাগ বৃথা করে দিও না। তানিমারও একগাল হাসলো ‘স্বাধীনতা ‘ তুমি কোন স্বাধীনতার কথা বলছো যে পরাধীনতার শৃঙ্খল আমাদের পায়ে পরিয়ে দেওয়া হয়েছে তা থেকে আমরা কোনদিন মুক্ত হতে পারব কি। একদিন আমরা পাকিস্তানের কাছে পরাধীন ছিলাম ব্রিটিশদে কাছে পরাধীন ছিলাম । আর এখন আমরা নিজ দেশের লোকের কাছেই পরাধীন। লাখো লাখো মানুষের আত্মত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে গনতন্ত্র অর্জিত হয়েছে কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয়নি। হয়তো আর কখনো হবেও না। নিজের সিমাবদ্ধতাকে একটা মডেল হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে লোকে অন্যদের উপর প্রভাব বিস্তার করতে চায়। আমরা এখন আর সেই ডাইনোসরের যুগে পরে নেই। সময় বদলেছে দিন পাল্টেছে সময়ের সাথে সাথে আমাদের চিন্তা ধারা কে পাল্টাতে হবে। পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে না পারলে আমরাও একদিন ডাইনোসরের মতো বিলুপ্ত হয়ে যাব অথবা ভাল্লুকের মতো খাবারের অভাবে নিজেরাই নিজেদের মেরে ফেলবো। আমি জানি তোমার কষ্টটা কিসের তুমি চেয়েছ ছেলেমেয়ে তোমার শাড়ীর আঁচলের তলায় মানুষ হোক।আজীবন মাথায় হাত বুলিয়ে বুলিয়ে ঘুমপাড়ানির গান শুনিয়ে তাদের ঘুমপাড়িয়ে দাও। কিন্তু আর কত কাল?? কত কাল তাদের নিজ হাতে খাওয়াবে ঘুমপাড়াবে। তারা প্রতিষ্ঠিত না হতে পারলে এই আদরের মায়া জাল একদিন নিজে থেকেই ছিড়ে যাবে যখন দেখবে ছেলে ছেলের বউ বাপের পয়সায় বসে খাচ্ছে ফুর্তি করছে তখন তার প্রতি তোমারই তিক্ততা বাড়বে। আমি চাই তারা সফল হোক এবং সন্মান নিয়ে বেঁচে থাকুক। এর পরে নিশ্চয়ই তোমার আর কথা থাকে না । ইমা মানুষ আফসোস নিয়ে জন্মায় না কিন্তু আফসোস নেই মানুষ কে মরে যেতে হয়। এক একজনের এক এক বিষয়ের উপর। যারা আর্থিক অভাব দিনমজুর কিংবা রিকশা চালক প্রতিদিন ভাবতে ভাবতে ঘুমোতে যায় অর্থই প্রকৃত সুখের কারণ। তারপর কিছু সময় পর ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু সে জানেনা যে যার অঢেল অর্থ আর অর্থের চিন্তায় সারা রাত আর ঘুম হয় না। আর যারা অঢেল অর্থ সে সব সময় বলবে অর্থ সকল অনর্থের মূল। যার অর্থ নাই তার সামান্য অর্থ হলে সে সুখী হত । আর যার অনেক অর্থ আছে, সে একটু নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে প্রতিদিন ঘুমাতে পারলে সুখী হত। এই সুখ দুঃখ প্রতিটি জিনিসই আপেক্ষিক। মৃত্যু ব্যতিত ধ্রুব সত্য বলতে পৃথিবীতে কিছুই নেই । যা আছে তা কেবল সম্ভবনা যে আর্থক ভাবে সুখী সে যে মানুষিক শান্তিতে আছে সেটা কিন্তু নয়। আ প্রায় এই অনিশ্চিত পৃথিবীতে আমরা কিছু সম্ভাবনা আঁকড়ে বেঁচে থাকতে চাই। সেই সম্ভাবনা থেকে তাকে আমি অসফল করতে চাই না। অর্থাভাবের আফসোস প্রায় সকলের যে জীবন যাপন আমি করেছি যে সংগ্রাম আমার করতে হয়েছে আমি চাই না ওদের সংগ্রামটা ঠিক আমার মত হোক। তারা সংগ্রাম করুক তবে ভিন্ন কিছুর জন্য আমাদের মত দুবেলা দু মুঠো খাবার খেয়ে বেঁচে থাকার জন্য নয় তানিম নির্মম কিছু সত্যি কথা বলতে বলতে থেমে গেল। ,তানিম এর আগে কখনো তার পরিবার নিয়ে কিছু বলে নি আজই প্রথম।স্বামীর অতীত জীবনের কথাগুলো শুনতে তার ভালো লাগছে।
ইমা আর তানিমের সাথে এ নিয়ে তর্কে জড়ায় নি ছেলে মেয়েরা বিদেশ গিয়েছে মানুষের মত মানুষ হয়েছে নিজে যে একলা জীবন ভর সে একলাই রয়ে গেল। সব থেকেও সে যখন একা তখন সব হারিয়ে একলা হতে আর ভয় কিসের। ইমা আগেও বহুবার ভেবেছে যে মানুষ দিন শেষে তার খোঁজ নেয় না যার সাথে ভাল মন্দ মান অভিমানে সম্পর্ক নেই তানিমের জীবনে ইমা থাকা না থাকার যদি কিছু নাই বা যায় আসে তবে গৃহকর্মী হয়ে ঘরের কোণে পরে থাকার কি দরকার? স্বামী সে না হয় পরের ছেলে কিন্তু নিজের ছেলেমেয়ে যাকে সে নিজের হাতে মানুষ করেছে যাদের জন্য নিজের জীবনের সব আরাম আয়েশ ত্যাগ করেছে। যাদের জন্য কোন আত্নীয় বাড়ি কখনো যায় নি, তানিমের জমকালো পার্টির আনন্দ উল্লাস থেকে নিজেকে বঞ্চিত করেছে, মায়ের বাড়িতে যখন সব ভাইবোনেদের পিঠাপুলির উৎসবের মেলা বসেছে তখন ছেলেমেয়ে পড়াশুনার ক্ষতি হবে ভেবে তার যাওয়া হয়নি । নিজেকে সে শুধু বঞ্চিত করে গেছে সব কিছু থেকে। বিনিময়ে ছেলেমেয়ে ভাল আছে ভাল চাকুরী পেয়েছে আয়েসি জীবন পেয়েছে অথচ সেই জীবনের অংশ থেকে মিনিট দশেক টাইম ইমার জন্য বরাদ্দ নেই। চার পাঁচ বছরেও বাড়ি আসার খবর নেই, কখনো ফোন দিয়েও জিজ্ঞেস করে না মা কেমন আছো? ওদের না হয় মা বাবাকে দেখতে মন চায় না কিন্তু যে পুতুলের মত ছোট্ট সন্তানকে গড়ে পিঠে মানুষ করেছে তার তো দেখতে মন চায়। না না এই পৃথিবীর সব চাওয়া পাওয়া কে প্রবদ দেয়া যাবে না। সে এখন আর কারো জন্য কিছু চায় না শুধু নিজের জন্য চায়, সে এখন মুক্তি চায় এই সংসারের ঝুটঝামেলা থেকে মিথ্যা মায়া থেকে। তার আর কোন কিছু প্রতি আগ্রহ নেই কারো প্রতি আক্রোশ ও নেই, আছে শুধু নিজের জন্য সযত্নে তুলে রাখা সহানুভূতি। যা এত দিন আড়াল করে রেখেছে সংসারের মায়াজালে, সে মায়াজাল যত শক্ত হোক না কেন তা ছিড়ে ফেলা একদিন সে ঠিকই বেরিয়ে আসবে।
ইমা একদিন পাহাড়ের চূড়ায় দাড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে বৃষ্টি দেখবে। নির্জন সন্ধায় কান পেতে ঝুম বৃষ্টির শব্দ শুনবে। তার আশে পাশে কেউ থাকবেনা চারিদিকে কেবল অদ্ভুত নিস্তব্ধতা । বৃষ্টির ঝাপটায় নেমে আসা অন্ধকারে নিরব শূন্যতার বুক চিরে কাক ভেজা হয়ে ভিজবে সে। চিৎকার করে কাঁদবে। যে শব্দে জানান দেব পৃথিবীর অস্তিত্ব। কেউ শুনবে না দেখবে না বুঝবে না তার কষ্ট । অঝোর ধারায় ভিজে যাবে জীবনের সমস্ত বোঝাপড়া সমস্ত উপলব্ধি। আহ একজীবনের এত শূন্যতা কোথায় ছিলো। পৃথিবীর কোন প্রান্তে। বুকের মধ্যে মস্ত বড় প্রাচীরের তলায় আটকে ছিলো। অথচ আজ মাথার উপর ছাঁদ নেই, ইটের প্রাচীরে আটকে নেই পা আকাশ পানে উঁকি দিলে গ্রিলে আটকে যান না বুক হাত বাড়ালেই কেবল অসীম শূন্যতা আর অবাধ স্বাধীনতা শুধু একলা একা চেয়ে থাকা ধূসর পৃথিবীর দিকে পরমেশ্বরের পানে। মনুষ্যত্ব জীবনের দাসত্ব শেষে দায়িত্বে শৃঙ্খলা থেকে আমৃত্যুের ছুটি নিয়ে জীব আবাস্থল থেকে মুক্তি পাওয়া সহজ কথা নয়। তবুও তো মানুষ ছুটি চায় বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে। অপার শূন্যতায় বসে বেখেয়ালে শেষ বিকেলে হারিয়ে যায় রৌদ্রময় ছায়া। শ্রাবণের বৃষ্টির চেয়ে কি হৃদয়ের কান্নার পরিমাপ বেশি। ইমা আজ একা তার আর কেউ কেউ নেই কিছু নেই। তার পেছনে অতীত সামনে সূদুর প্রসারিত ভবিষৎ। সে কোথায় যাবে কি করে করবে সে নিজেও জানে না! একটি সর্ষে দানার ওপর দাড়িয়ে আছে তার সম্ভাব্য ময় অজানা ভবিষৎ ।।
_______________________________
শিরিন শিলা
অনার্স ৪ র্থ বর্ষ অর্থনীতি বিভাগ।
মুক্তার পাড়া সিরাজগঞ্জ