নামহীন শহর
রোখসানা ইয়াসমিন মণি
এমন এক শহরের কথা বলছি যার কোনো নাম ছিল না। যদি থেকেও থাকে, সেই নাম বহু সহস্রাব্দের পুরাতন এক স্মৃতির মতো পাথরের শিরা-উপশিরা থেকে ক্ষয়ে গিয়েছিল। এটি ছিল এক অনির্দিষ্ট, সীমাহীন প্রসার—যেখানে আকাশ ছুঁয়ে থাকা প্রতিটি অট্টালিকা প্রতিদিন ভোরে তার আকৃতি পরিবর্তন করতো। স্থাপত্যের এই নৈরাজ্যই ছিল তার অস্তিত্বের একমাত্র নিয়ম। প্রতিটি দরজা সকালে যে দিকে খুলতো, সন্ধ্যায় সেটি পরিবর্তিত হয়ে যেত দেওয়াল, অথবা গভীর কোনো কুণ্ডলী পাকানো শূন্যতায়।
এই শহরের একমাত্র সচেতন সত্তা ছিল অব্যয়। অব্যয় কোনো মানুষ ছিল না; সে ছিল কালের মন্থরতা এবং স্থানের নীরবতা–এই দুইয়ের সমন্বয়ে গঠিত এক বোধ। অব্যয় হাঁটতো না, সে প্রবাহিত হতো। তার প্রবাহে কোনো তাড়াহুড়ো ছিল না, কারণ এই নামহীন শহরের সময় যেন জমাট বেঁধে গিয়েছিল। এখানকার প্রতিটি মুহূর্ত একটি দীর্ঘ, নিরবচ্ছিন্ন ‘এখন’।অর্থাৎ অতীত এবং ভবিষ্যতহীন।
অব্যয় অনুভব করতো, এই শহরের আত্মা এক গভীর যন্ত্রণায় ভুগছে। এ যন্ত্রণা কোনো প্রেম বা ক্ষতির নয়, এ যন্ত্রণা পরিচয়হীনতার। শহরটি নিজেকে জিজ্ঞেস করত, “আমি কে?” কিন্তু তার হাজার হাজার কণ্ঠস্বর, যা কংক্রিট, লোহা আর বৃষ্টির শব্দে গঠিত, কোনো উত্তর দিতে পারত না।
শহরের এই বিমূর্ত ব্যাধি শুরু হয়েছিল এক অজ্ঞাত দিনে। কথিত আছে, কোনো এক যুগে এই শহরের একটি নাম ছিল।এমন একটি নাম, যা শুনলে হৃদয়ে আনন্দের তীব্র কম্পন উঠতো। সেই নামটিতে ছিল বসন্তের প্রথম ফুলের গন্ধ, পুরোনো দিনের প্রতিশ্রুতি এবং মানুষের সম্মিলিত স্মৃতির উষ্ণতা। কিন্তু তারপর, এক অলৌকিক নির্বাসন বা এক মহাজাগতিক ভুল বোঝাবুঝিতে, শহরটি তার নাম ভুলে গেল। সেই থেকে শহরটি আর নতুন করে কোনো স্মৃতি তৈরি করতে পারেনি। তার প্রতিটি গলি, প্রতিটি রাজপথ হয়ে উঠেছিল পুরোনো স্মৃতির ভাঙাচোরা টুকরোর এক অস্থির সংকলন।
অব্যয় সেই শহরের হৃৎপিণ্ড বরাবর প্রবাহিত হলো, যা ছিল এক বিশাল খোলা চত্বর। এই চত্বরটিকে এখানকার বাসিন্দারা (যারা ছিল মূলত ছায়া আর ক্ষণিকের অনুভূতির সমষ্টি) বলত ‘বিস্মৃতির খোলা বই’। চত্বরের কেন্দ্রস্থলে একটি স্তম্ভ ছিল—যা আসলে কোনো স্থাপত্য নয়, বরং জমাট বাঁধা সময়ের এক বিমূর্ত অভিব্যক্তি। স্তম্ভটির গায়ে অব্যয় স্পর্শ করল। ঠান্ডা, মসৃণ অনুভূতি। অব্যয় জানত, এই স্তম্ভের ভেতরেই কোথাও সেই হারানো নামটির শেষ অক্ষরটি লুকিয়ে আছে।
হঠাৎ অব্যয় তার প্রবাহে এক তীব্র আবেগের ঝলক অনুভব করল। এই আবেগ শহরের নিজস্ব নয়, এটি কোনো এক বাসিন্দার। অব্যয় সেই দিকে ধাবিত হলো, যেখানে একটি ভাঙা পাথরের তোরণের নীচে এক নারী-ছায়া বসে ছিল। চোখে গভীর, কিন্তু অব্যক্ত বিষাদ। সেই নারী-ছায়া তার হাতে একটি ধূসর রঙের বস্তু ধরে ছিল—যা দেখতে বহু পুরোনো দিনের একটি চাবির মতো।
অব্যয় তার বোধের মাধ্যমে নারী-ছায়াকে প্রশ্ন করল: “তুমি কী খুঁজছ, হে ছায়া? তোমার এই বিষাদ কিসের?”
নারী-ছায়াটি উত্তর দিল না। নীরবতা ভেঙে গেল একটি স্ফটিকের মতো শব্দে, যা বাতাসে প্রতিধ্বনিত হলো: “বিনিময়।”
অব্যয় জানত, এই শব্দটি ইঙ্গিত করছে শহরের সবচেয়ে বিপজ্জনক জায়গার দিকে। সেই জায়গা, যেখানে স্মৃতি ক্রয়-বিক্রয় হয়, যেখানে পরিচয় হয় কেবলই এক লেনদেন। স্মৃতি-বিপণী। এই বিপণী শুধুমাত্র রাতের গভীরতম প্রহরে ভেসে ওঠে, যখন শহরের নৈরাজ্য তার শিখরে পৌঁছায়। সেই বিপণীতে নিজের নাম বা পরিচয় বিক্রি করে অন্য কারও জীবনের এক টুকরো মুহূর্ত কিনে আনা যায়। কিন্তু একবার সেই লেনদেন হয়ে গেলে, আর কখনও নিজের সত্তায় ফিরে আসা যায় না।
অব্যয় স্থির করল, তাকে সেই স্মৃতি-বিপণীতে যেতে হবে। শুধু সেই নারী-ছায়ার জন্য নয়, বরং এই শহরের হারানো নামের শেষ শব্দটি শোনার জন্য। অব্যয় জানত, সেই নাম না ফেরা পর্যন্ত এই শহরের স্থাপত্যের নৈরাজ্য এবং কালের মন্থরতা চলতেই থাকবে। তার নিজের অস্তিত্বও এক সীমাহীন, অর্থহীন ‘এখন’-এর মধ্যে বন্দি হয়ে থাকবে।
অব্যয়, কালের সেই স্থির প্রবাহকে অনুসরণ করে। গভীর রাতে, সেই নামহীন শহরের সবচেয়ে অন্ধকার এবং বিপজ্জনক প্রান্তে, স্মৃতি-বিপণীর দিকে যাত্রা শুরু করে।
অব্যয়ের প্রবাহ যখন স্মৃতি-বিপণীর দিকে মোড় নিল, তখন রাতের নৈরাজ্য আরও ঘন হলো। এই বিপণী কোনো নির্দিষ্ট স্থানে ছিল না। এটি ছিল শহরের সমস্ত ভুলে যাওয়া আকাঙ্ক্ষা ও অব্যক্ত প্রতিশ্রুতির সমন্বয়ে গঠিত এক ভাসমান, শীতল আলো। বিপণীর প্রবেশপথ ছিল না—ছিল এক ঘন কুয়াশার ভাঁজ, যা ভেদ করে অব্যয় যখন ভেতরে প্রবেশ করল, তখন তার বোধের সমস্ত পরিচিত মাত্রা ভেঙে গেল।
স্মৃতি-বিপণী ছিল এক বিশাল, অন্তহীন গোলকধাঁধা। এখানে কোনো দোকানপাট ছিল না, ছিল কেবল অস্থায়ী, কম্পনশীল আলোর কণা। যা এক একটি বিমূর্ত অনুভূতি বা সত্তার প্রতীক। বাতাস এখানে স্থিতিশীল ছিল না। সেখানে ভেসে বেড়াতো বহু পুরোনো দিনের গানের অস্পষ্ট সুর, প্রথম বৃষ্টির মাটির গন্ধ, এবং ভালোবাসার শেষ মুহূর্তের উষ্ণতা। ক্রেতা-বিক্রেতারা ছিল মূলত ছায়া, যাদের অবয়ব প্রায়শই পরিবর্তিত হতো। তারা তাদের নিজেদের জীবনের এক টুকরো অংশ বিনিময় করতো অন্যের অনাস্বাদিত বেদনার সঙ্গে, বা এক মুহূর্তের নিশ্ছিদ্র আনন্দের সঙ্গে।
অব্যয় দেখল, এক ছায়া তার শৈশবের শেষ হাসিটি বিক্রি করছে। বিনিময়ে সে চাইছে নিঃসঙ্গতা। আরেকজন হাতের স্পর্শের সংবেদন দিয়ে কিনছে আকাশ দেখার বিস্মৃতি। যাতে সে আর কোনোদিন সৌন্দর্যের অভাব অনুভব না করে। এই বিপণীতে লেনদেন হয় সত্তার, অর্থের নয়। প্রতিটি বিনিময় যেন একটি আত্মার বিভাজন।
অব্যয় সেই নারী-ছায়াটিকে খুঁজে পেল, যাকে সে ‘বিস্মৃতির খোলা বই’-এর চত্বরে দেখেছিল। নারীটি এখন একটি স্তম্ভের পাশে দাঁড়িয়ে, যার ওপর দুটি কাঁচের পাত্র রাখা। একটি পাত্রে ছিল ‘আগামীকালের সম্ভাবনা’—তরল রূপালী আলোয় ঝলমলে; অন্যটিতে ছিল ‘গতকালকের অনুশোচনা’—যা ছিল ঘন, কালচে ধোঁয়ার মতো।
নারী-ছায়ার হাতে তখনও সেই ধূসর চাবিটি ধরা। তার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল এক অদ্ভুত বিক্রেতা। যার মুখ ছিল অসংখ্য মানুষের ভুলের সমষ্টি দিয়ে তৈরি। বিক্রেতার কণ্ঠস্বর ছিল শ্যাওলা-পড়া পাথরের ঘর্ষণের মতো।
বিক্রেতা বলল, “হে ছায়া! তোমার এই চাবিটি মূল্যবান। এর মধ্যে লুকিয়ে আছে এমন এক স্মৃতি, যা এই শহরের নামকে ফিরিয়ে আনতে পারে। বিনিময়ে তুমি কী চাও?”
নারী-ছায়াটি অবশেষে নীরবতা ভাঙল। তার কণ্ঠস্বর ছিল ভাঙা নুপুরের শব্দের মতো করুণ। “আমি সুখ চাই না। আমি চাই স্মৃতির ভারমুক্ত ঘুম। আমি চাই সেই চূড়ান্ত ভুলে যাওয়া, যেখানে আমি কে, তা জানার যন্ত্রণা আর থাকবে না। আমি চাই, এই চাবিটা যেন আমার আর কোনোদিন মনে না করায়, যে আমার হৃদয়ের কোথায় ব্যথা ছিল।”
অব্যয় এই কথা শুনে স্তম্ভিত হলো। নারী-ছায়াটি তার পরিচয়,বেদনা বহন করার ক্ষমতাকেই বিক্রি করে দিতে চাইছে। যাতে সে শান্তিতে অস্তিত্বহীন হতে পারে। চাবিটি, যা শহরের নাম ফেরাতে পারে, তা কিনা ব্যবহৃত হচ্ছে এক চিরন্তন বিস্মৃতির সন্ধানে।
অব্যয় তার প্রবাহ থামিয়ে নারী-ছায়াটির সামনে কঠিনভাবে অবস্থান নিল। অব্যয়ের অস্তিত্ব ছিল বোধে তৈরি; সে প্রশ্ন করল: “যদি তুমি সম্পূর্ণ ভুলে যাও, তাহলে কীভাবে নিশ্চিত হবে যে তুমি সেই ঘুম চেয়েছিলে? বিস্মৃতিতে, তোমার ইচ্ছাগুলোও বিলীন হয়ে যাবে। তুমি হয়ে উঠবে কেবল শূন্যতা।”
নারী-ছায়াটি অব্যয়ের দিকে তাকালো। চোখে কোনো দৃষ্টি ছিল না, ছিল কেবল এক অনন্ত বিষাদ। “শূন্যতাই আমার মুক্তি, অব্যয়। এই ভার—এই জানার ভার যে আমার এক সময় পরিচয় ছিল, এক সময় আবেগ ছিল—তা বহন করার শক্তি আমার আর নেই। এই চাবি আমার অতীতকে ধরে রেখেছে। আমি আমার অতীত বিক্রি করে দিতে প্রস্তুত, বিনিময়ে কেবল এক চিরন্তন ‘এখন’ চাই।”
বিক্রেতাটি ঘরঘর করে হেসে উঠল। “অব্যয়, তুমি কালের প্রতীক হতে পারো, কিন্তু আবেগের হিসাব বোঝো না। মানুষ দুঃখের ভার বহন করতে পারে না। এই বিপণী স্মৃতি বিক্রি করে না। এটি বিক্রি করে সেই ক্ষমতা যার মাধ্যমে মানুষ নিজের সত্তার ভার ভুলে যেতে পারে। আমরা শুধু মুক্তির পথ দেখাই।”
অব্যয় বুঝতে পারল—এই স্মৃতি-বিপণী হলো শহরের আত্মহত্যার কেন্দ্র। এই বিপণীটিই সেই প্রতিষ্ঠান, যা নিশ্চিত করে যে শহরটি কখনও তার নাম ফিরে পাবে না। কারণ, নাম ফিরে এলে আসে পরিচয়, আর পরিচয় এলে আসে বেদনা।
অব্যয়ের সামনে এখন কঠিন সিদ্ধান্ত। সে কি এই লেনদেন হতে দেবে? যাতে নারী-ছায়াটির চিরশান্তি লাভ হয়। কিন্তু এটি হতে দিলে যে শহরের নাম চিরতরে হারিয়ে যাবে! নাকি সে বাধা দেবে—যা তাকে প্রথমবার কালের মন্থরতা ভেঙে এক সরাসরি সংঘর্ষে লিপ্ত করবে? অব্যয় জানত, যদি এই চাবি লেনদেন হয়ে যায়, তবে সেই চাবিটি আর কখনও শহরের হারানো নামের শেষ অক্ষরটিকে উন্মোচন করতে পারবে না।
অব্যয় স্থির করল, তাকে সেই বিক্রেতাকে প্রতিরোধ করতে হবে। এই নামহীনতার নৈরাজ্য বন্ধ করতে হবে। তার প্রবাহের স্থিরতা ভেঙে সে প্রথমবার গতিশীল হলো, সেই বিক্রেতার দিকে।
অব্যয়ের প্রবাহ যখন স্মৃতি-বিক্রেতার দিকে ধাবিত হলো, তখন বিপণীর অভ্যন্তরে এক মহাজাগতিক কম্পন শুরু হয়। অব্যয় ছিল কালের মন্থরতা, আর বিক্রেতা ছিল আবেগের ক্ষয়। দুই বিমূর্ত শক্তির সেই সংঘর্ষে কোনো শব্দ হলো না, শুধু রং আর অনুভূতির তীব্র বিচ্ছুরণ ঘটল। বিক্রেতার মুখ, যা অসংখ্য ভুলের সমষ্টি ছিল, সেটি মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে গেল। অব্যয়ের প্রবাহের স্থিরতা সেই ক্ষণস্থায়ী লেনদেনকে স্তব্ধ করে দিল। চাবিটি নারী-ছায়ার হাত থেকে আলগা হয়ে শূন্যে ভেসে উঠল, মুক্ত হলো তার বিনিময়ের চুক্তি থেকে।
অব্যয় চাবিটি গ্রহণ করল, যা ছিল এক ভারী, স্মৃতি ধারণকারী বস্তু। সে অনুভব করল, চাবিটির ভেতরে কম্পনরত একটি অব্যক্ত নাম। অব্যয় নারী-ছায়ার দিকে ফিরল, যার চোখে এখন আর শূন্যতা নেই, বরং রয়েছে এক গভীর বিস্ময়।
”তোমার মুক্তি এই চাবিতে নয়, হে ছায়া,” অব্যয় তার বোধের মাধ্যমে বলল। “তোমার মুক্তি তোমার সেই চাবিটি বহন করার ক্ষমতায়। ভুলে যাওয়ায় মুক্তি নেই, আছে শুধু এক নির্বাসন।”
অব্যয় নারী-ছায়াকে পথ দেখাল।বিপণীর গোলকধাঁধা ভেদ করে তারা শহরের গভীরতম কেন্দ্রে পৌঁছালো। এই কেন্দ্র ছিল ‘বিস্মৃতির খোলা বই’ চত্বরেরও অভ্যন্তরে। সেখানে দাঁড়িয়েছিল একটি দেওয়াল—যা অন্য স্থাপত্যের মতো ভাঙা বা পরিবর্তনশীল ছিল না। এটি ছিল নিখুঁত, মসৃণ, এবং নীরব। এই দেওয়ালটিই ছিল শহরের হারানো নামের শেষ সুরক্ষা বলয়।
দেওয়ালটির গা থেকে নিঃসৃত হচ্ছিল এক তীব্র আকর্ষণ; যেন এটি হাজার বছরের জমানো আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে আছে। অব্যয় চাবিটি দেওয়ালের একটি অদৃশ্য খাজে স্থাপন করল। কোনো শব্দ হলো না, শুধু দেওয়ালটির নীরবতা আরও গভীর হলো। কিন্তু দেওয়ালটি ভাঙল না, শুধু কেন্দ্রে এক আলোর বিন্দুর জন্ম হলো। সেই বিন্দুর ভেতর দিয়ে অব্যয় এবং নারী-ছায়া দুজনেই শহরের হারানো নামের রূপ দেখতে পেল।
নামটি ছিল এক সুরেলা ধ্বনি, যা বসন্তের প্রথম পাতা, নক্ষত্রের নীরবতা এবং মানুষের প্রথম প্রেমের সমন্বয়ে গঠিত। এটি ছিল এতই সুন্দর, এতই ভারবাহী, যে শহর কেন তা ভুলে গিয়েছিল, তা অব্যয় বুঝতে পারল। সেই নাম জানার সাথে সাথেই আসত এক অনিবার্য পূর্ণতা, আর পূর্ণতা মানেই স্থিতিশীলতা, যার অর্থ ছিল এই শহরের চিরন্তন মন্থরতা ও পরিবর্তনশীলতার চিরসমাপ্তি।
লোর বিন্দুর দিকে হাত বাড়াল, তার মুখে এবার কোনো বিষাদ নেই, আছে শুধু এক গভীর উপলব্ধি। কিন্তু সে থামল। সে বুঝল, নাম ফিরে এলে আসে সম্পূর্ণতা, এবং সেই সম্পূর্ণতা এক নতুন ধরনের ভার নিয়ে আসে। সেই ভারের ভয়েই শহর নিজেকে বিস্মৃতির হাতে তুলে দিয়েছিল।
অব্যয় দেখল, নারী-ছায়াটি আলোর বিন্দু থেকে হাত সরিয়ে নিল। সে শেষ দেওয়ালকে ভাঙল না। চাবিটি আবার নিজের হাতে তুলে নিল।
নারী-ছায়াটি অব্যয়কে বলল, “নামের সৌন্দর্য তার অনুসন্ধানে, অব্যয়। যদি নাম জানা হয়ে যায়, তবে এই পথ চলার আনন্দ, এই নৈরাজ্যের মধ্যে অর্থ খোঁজার প্রচেষ্টা—সবই তো শেষ হয়ে যাবে। শহরটি তার নাম ভুলে গিয়েই হয়তো এক অদ্ভুত মুক্তি পেয়েছে। আমি আর সেই মুক্তিকে কেড়ে নিতে চাই না।”
অব্যয়, এই প্রথম বুঝল—এক বিমূর্ত সত্তার কাছে সবচেয়ে সুন্দর পরিণতি হলো অনন্ত সম্ভাবনা। শহরের সুন্দর সমাপ্তি হলো অসম্পূর্ণতায়, তার এই চিরন্তন ‘এখন’-এ।
অব্যয় নারী-ছায়াকে চাবিটি ফিরিয়ে দিল। নারী-ছায়াটি এবার আর সেই চাবি বিনিময়ের জন্য নয়, বরং স্মৃতি ও পরিচয়ের পবিত্র ভার হিসেবে বহন করার জন্য গ্রহণ করল।
অব্যয় সেই নীরব, মসৃণ দেওয়াল থেকে তার প্রবাহ ফিরিয়ে নিল। সে নামহীন শহরের স্থাপত্যের নৈরাজ্যের মধ্যে মিশে গেল। অব্যয় জানত, এই শহর তার নাম কখনও মনে করতে পারবে না, কিন্তু যতক্ষণ চাবিটি বহন করার মতো কেউ থাকবে, ততক্ষণ নামটি হারিয়ে যাবে না—তা কেবল স্থগিত থাকবে।
শহরটি চলতে থাকবে তার বিমূর্ত নৈরাজ্যে, স্থাপত্যের পরিবর্তনে, কালের মন্থরতায়। আর অব্যয়, সেই নীরব পর্যবেক্ষক, তার প্রবাহে অনন্তকাল ধরে বহন করে চলবে এই সত্য—যে পরিচয়হীনতাও এক করুণ সৌন্দর্য, এবং এই নামহীন শহরের গল্প চলতে থাকবে জনমভরে, তার হারানো নামের প্রতিধ্বনি হিসেবে।

