২১৯ বার পড়া হয়েছে
দূরের তারা
(আখতার জাহান শেলী)
(আখতার জাহান শেলী)
————-
কী যে কখন কেমন করে কার কাছে স্মরণীয় হয়ে যায় , তার কোনও যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা প্রায়শই খুঁজে পাওয়া যায়না। জীবনের অনেক উল্লেখযোগ্য ঘটনা ,সময়,মুছে যায়।অথচ দু একটি অনুজ্জ্বল অধ্যায় টিম টিম করে জ্বলতে থাকা তারার মতো মানসপটে স্থান করে নেয় । বহুদিন পর কোনও অবসরে, প্রয়োজনে স্মৃতির পাতা উল্টালে দেখা যায়, ওইসব অনুজ্জ্বল অধ্যায় বিবর্ণ হয়নি মোটেও। আশ্চর্যজনকভাবে নিভে গেছে অনেক উজ্জ্বল দ্যুতিময়, বর্ণময় সুগন্ধি স্মৃতি, কিন্তু ওই অনুজ্জ্বল টিমটিমে স্মৃতিরা টিকে গেছে । ওরা জ্বলছে স্মৃতির আকাশে দূর আকাশের তারারই মতো।
সেনবাগ – ঊনসত্তর , আমার যাপিত জীবনে রইলো অনুজ্জ্বল অথচ স্থির তারার আলোর মতো। খু উব ছোট বয়সে আমরা যখন চট্বগ্রাম শহরে থাকতাম, তখন গ্রামে নানাবাড়ি বেড়াতে আসতাম সেনবাগে লালপুর গ্রামে। বটতলী স্টেশন থেকে ট্রেনে চড়ে ফেণী পর্যন্ত এসে সেখানে রাতটা কাটিয়ে, সকালে বাসে চেপে এসে নামতাম কল্যান্দী (রাস্তার মাথা সেনবাগ) ।ফেণীতে রেলওয়ে গার্ড জনাব দীন মোহাম্মদ সাহেব ( আমার পাতানো স্বশুর মশাই) যিনি আমার বাবার বন্ধু , তাঁদের বাসায় কখনো শুধুই রাতটা নয়,দু একটা দিন থেকেও আসতাম। সে সময়টাতে ফেণী স্টেশনের কাছেই বিরাট দীঘির পাড়ে , লাল ইটের দালানের ফেণী পাইলট স্কুল,আরো কোথায় কোথায় যেন ঘুরতে যেতাম। বেশির ভাগ সময়ই এটা সম্ভব হতো দীন মোহাম্মদ সাহেবের জ্যেষ্ঠ পুত্র আজকের ক্যাপ্টেন শফিকুল ইসলামের কল্যাণে। ও আর আমিও ছিলাম শৈশব বন্ধু । এখনো আছি। আজকের সেনবাগের সুযোগ্য সন্তান ব্যারিষ্টার -তাজরুল– তাঁরই আপন ভাগ্নে।
তো যা ই হোক, এই সুখপ্রদ যাত্রাবিরতির পর আমরা বাসে চড়ে পৌঁছতাম সেনবাগ রাস্তার মাথা কল্যান্দী তে। সরাসরি বাসে করে না এসে এই সপ্তকান্ড রামায়ন রচনা হতো শুধুই আমার জন্য। শুধু আমি বাসভ্রমণ করতে পারতামনা। প্রচন্ড বমি করতে করতে সংজ্ঞাহীন হয়ে যেতাম,ইত্যাদি,ইত্যাদি।রাস্তার মাথায় আমাদের জন্য অপেক্ষা করতো আমার মামাদের কেউ, কিংবা আমার সেজচাচা।কখনো কখনো আমার ফুফা,চাঁদপুর নিবাসী তখনকার সেনবাগের মান্যবর ব্যক্তিত্ব জনাব মকবুল আহাম্মদ মাস্টার। তাঁর বড়ভাই সেনবাগ হাইস্কুলের শিক্ষক ছিলেন জনাব আলী আহাম্মদ মাষ্টার। আমার যতদূর মনে পড়ে আমরা নৌকায় করেই সেনবাগ পৌছাতাম । আমাদের নৌকা স্বচ্ছ কালোজল কেটে কেটে দুপাশের ঘন নিবিড় সবুজের বুক চিরে চিরে এগিয়ে যেতো মৃদুমন্দ বাতাস গায়ে মেখে। আমার স্থান হতো গলুই এ, নয়তো দুই ছইয়ের মাঝখানের ফাঁকা জায়গায়। কারণ আমি ছইয়ের ভেতর গেলেই গা বমি বমি লাগতো। রঙ নাকি তারপিনের এক ধরণের গন্ধ পেতাম। গলুই এ বসে দেখতাম মাথার ওপর ঘননীল আকাশে সাদা টুকরো টুকরো মেঘ। স্বচ্ছ কালোজলে নাম নাজানা সবুজ শ্যাওলা আগাছা‘রা সাদা বেগুনী ফুল ফুটিয়ে চেয়ে চেয়ে দেখতো যেন তার বুক চিরে চলে যাওয়া আগন্তুক দের। ওপরে বৃষ্টি ধোয়া নীলাকাশ,নীচে জলের সামন্তরালে জেগে থাকা বাড়িঘর,কখনো শুধুই সবুজ অরণ্য, কখনো তেজালো রোদে ঝিকিয়ে উঠত টিনের নতুন চাল, চেয়ে চেয়ে দেখতাম। অর্ধ জলমগ্ন বাড়িঘর কোনও কোনও টি থেকে শুকোতে দেয়া ভেজা খড় , ধান, কাঠকুটোর অদ্ভুত একটা গন্ধ আসতো ।
আমার ফুপাজান মকবুল মাষ্টার সাহেব বেশি বেশি বলতেন মীরগঞ্জ বাজার।আমি অর্বাচীনের বুঝতে সময় লাগতো সেনবাগ এবং মীরগঞ্জের পার্থক্য। জানার খুব আগ্রহ থাকলেও কখনো জিজ্ঞাসা করা হয়ে উঠতোনা। তখনতো বয়োজ্যেষ্ঠ এবং বয়ঃকনিষ্ঠ দের মধ্যে বিদ্যমান থাকতো আদব কায়দা, ও ভয়ের দুর্ভেদ্য প্রাচীর । পরে অবশ্য জেনেছিলাম আমার বাবার কাছে।
এসবই আজকাল রুপকথার মতো মনে হয়। আজকের কোনও শিশু কিশোর, সদ্য যুবার সঙ্গে এসব গল্প করলে তারা অনেক ধৈর্য ধরে এই রুপকথার গল্প (তাদের কাছে ) শোনে । গাড়ি চলাচলের রাস্তা একেবারেই ছিলো না (১৯৬৫,১৯৬৬), সেনবাগ বাজারের গুদাম সংলগ্ন নাওঘাটা- যেখানে শতাধিক নৌকা একসাথে অপেক্ষমান দেখেছি হাটবারে, অর্জুনতলার দিকে বয়ে যাওয়া খালের গতিপথ কতটা নাব্য ছিলো,ব্রীজের ওপর থেকে দেখতে কত নীচে অতল মনে হতো ওই খাল,আজকের মরে যাওয়া নালাটির দিকে তাকালে এসব রপকথার গল্পই মনে হবে। অথচ বহুবার ওই খালপথেই পশ্চিম দিকে অনেকটা দূর গিয়ে লালপুরে আমার নানাবাড়ি গিয়েছি। রাস্তার মাথা থেকে সেনবাগ বাজার পর্যন্ত প্রবাহিত আজকের শীর্ণ নালাটি কত পরিপূর্ণ জলভান্ডারে সমৃদ্ধ হয়ে পশ্চিমের ‘গনেশা জলা ‘র অবারিত জলভান্ডারের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতো ,সেটাও আজ প্রায় বিস্মৃত রুপকথা ।

আমার সজ্ঞান সম্পৃক্ততা সেনবাগের সাথে উত্তাল ঊনসত্তুরে । সেনবাগ হাইস্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে একবছর পড়া । রবীন্দ্রনাথের ভাষায়- জীবনের ধন কিছুই যায়না ফেলা—। আজ বুঝি রবিঋষির এই চরণটি কতটা ধ্রব সত্য। সেনবাগেরই সে সময়ের সাময়িক বাসিন্দা কাওসার খান,যে আমার সহপাঠী বন্ধু ছিলো (এখনো আছে ) , এখন সে আমেরিকান নাগরিক।আটলান্টায় বাইশ বছর ধরে বসবাস করছে। তার আগে সে সাংবাদিকতা করেছে অনেকদিন আনন্দ বিচিত্রা য়। চরম প্রগতিশীল চিন্তাধারার ধারক এই ব্যক্তি সেনবাগ কে সবসময় বলে সুন্দরী সেনবাগ।তার পিতা (নাম মনে পড়ছেনা) ৬৯’ এর সেনবাগের কুখ্যাত এমদাদ দারোগার পরেই এস আই হিসেবে সেনবাগে কর্মরত ছিলেন কিছুদিন। তো কাওসার আমাকে প্রায়ই জিজ্ঞেস করে সেনবাগের কথা। আমি বলি, তোমার সেনবাগ এখন আর সেই গ্রাম্য সহজ শ্যামাসুন্দরী টি নেই বন্ধু । সে একন ভালো পার্লার থেকে নিখুঁত সেজে ওঠা শহুরে সুন্দরী। সে বলেছে ওই সহজ শ্যামাসুন্দরী ই তার হৃদয়ে লালিত থাকবে চিরদিন! আমিই জানি সে শহুরে সুন্দরী এখন নাগরিক সমস্ত চাকচিক্য সুবিধার সাথে সাথে অবধারিত কিছু অপসংস্কৃতির ও ধারক, বাহক।
সেই দূর দূরান্ত থেকে খালিপায়ে হেঁটে আসা সেনবাগ হাইস্কুলের সিনিয়র , জুনিয়র্, সমবয়সী, সহপাঠীরা অনেকেই পরলোকে পাড়ি জমিয়েছেন। যারা আছেন তারা কেউ কৃতি , প্রতিষ্ঠাবান, গন্যমান্য-কেউবা বর্ণহীন লেন্স লাগানো চোখে, জারাজীর্ণ দেহমন নিয়ে ‘গেদু দপ্তরী ‘র বাজানো ছুটির ঘন্টা শোনার অপেক্ষায় । সেই ঝুঁকে ঝুঁকে চলা স্কুল অন্তপ্রান ( একটু হিসেবী ) প্রধান শিক্ষক মান্যবর হাবিবুল্ল্যা চৌধুরী, বি টি স্যার, এম আই স্যার, মমতাজুল হক স্যার, শফিউল্যা মৌলবি স্যার, ভট্বেশ স্যার, ধীরেন্দ্র স্যার, প্রমুখ আপাত নাম বিস্মৃত স্যারেরা এইসব বয়সী সাবেক শিক্ষার্থী দের ক্ষীণ জ্যোতি চোখগুলোতেই দীপ্তি ছড়ান। তাদের চোখে ওনারা এখনো বেঁচে থাকেন, ক্লাস নেন– সুনীতি, মূল্যবোধ, আর শুভ্র শ্বেত নীতিকথামালার !
আমার কাছে সেনবাগের সংযোগ সড়ক সেতু সর্বজন শ্রদ্ধেয় জনাব আবু তাহের (‘ তাহের ভাই’)। আমার কিশোরী বেলায় ওনারা টগবগে প্রতিবাদী সংগ্রামী তরুণ। আল্লাহ অনাকে সুস্থতা সহযোগে দীর্ঘজীবী করুন। সেনবাগ ওনার কাছে একটি জীবন্ত সচল জীবনগাথা হয়ে থাকুক বহুদিন, দীর্ঘদিন।
একজন অখ্যাত রমণীর কথা বলব। তাকে খুব মনে পড়ছে। আমি সেনবাগ হাইস্কুলে পড়াকালীন সময়ে সে আমার একক্লাস জুনিয়র ছিল। সেনবাগ হাইস্কুলের একটি পুনরমিলনীর ম্যাগাজিনে আমার একটি লেখা’ চলিতে চলিতে পথে ‘পড়ে সে আমার সাথে ফোনে যোগাযোগ করে।বলেছিলো সে খুবই অসুস্থ। আমাকে দেখতে চায়।আমি যেন বাবার বাড়ি (জামাল্পুর ) আসা যাওয়ার পথে তাকে একটু দেখে আসি। পরে আমি তাহের ভাইয়ের কাছ থেকে জানতে পারি ও (জাহানারা) ক্যান্সারে ভুগছে।জীবনের ধরন যেমন হয়– আমার তাকে দেখতে যাওয়া হয়নি। যখন মনে পড়েছে,তখন সে অন্যলোকের বাসিন্দা। ও সেখানে ভালো থাকুক। প্রবাহমান মহাকালের বহমান অমোঘ স্রোতে জাহানারা একটি ছোট্ব ঢেউ মাত্র । তবুও মনে হলেই কষ্ট পাই।কেন যাওয়া হলো না?
ভালো থকুক সুন্দরী সেনবাগ। ভালো থাকুক সেনবাগ সম্পৃক্ত সবাই,সকল শুভ কর্মকাণ্ড । উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ আমার জনকের প্রিয় বিচরণ ভূমি সেনবাগ।
১ Comment
congratulations