একটি ফুলের ভাঙা স্বপ্ন
জাকিয়া সুলতানা শিল্পী
স্কুলের ঘণ্টা বাজলেই আকাশ চোখে চোখ রেখে মেঘলার দিকে তাকাত। মেঘলা, যে সবসময় ফুলের বাগানের কোণে দাঁড়িয়ে থাকত, যেন সেখানেই তার জীবন গাঁথা। সে যখন হাঁটত, আকাশের মন যেন এক অদৃশ্য সেতু দিয়ে তার দিকে ছুটে যেত।
একদিন, বাগানের পাশে আকাশ বলল—
“মেঘলা, তোমার চোখের এই আলোটা… যেন ফুলের গন্ধের মতো।”
মেঘলা হেসে বলল, “তুমি কি আমাকে ফুলের সঙ্গে তুলনা করছো?”
“হ্যাঁ, কিন্তু শুধু তুলনা না। তোমাকে দেখে মনে হয়, ফুলও তোমার মতো ভাসে হাওয়ার সঙ্গে।” আকাশের চোখে এক অদ্ভুত লাজ, এক অদ্ভুত উচ্ছ্বাস।
“তুমি বড় মিষ্টি কথা বলো,” মেঘলা হেসে চোখ নামিয়ে নিল।
তাদের মধ্যে সেই প্রথম অনুরাগের নিঃশব্দ সূচনা। চিঠি লেখা শুরু হলো। স্কুলের লাইব্রেরিতে, কক্ষে বসে, দুজনেই একে অপরের প্রতি গভীর ভালোবাসা মিশিয়ে লিখে যেত।
“আকাশ, আজকের পরিক্ষার পরে তুমি কি বাগানে আসবে?” মেঘলার চিঠি আসে।
“হ্যাঁ, আর এবার আমি গিয়েই শুধু তোমাকে দেখব, কিন্তু কেউ যেন না দেখে।” আকাশ লিখে।
দুইজন দিনের পর দিন স্কুল পালানোর নানা কৌশল তৈরি করলো। কখনও এক বন্ধুর কাছে সময় নিত, কখনও লাইব্রেরির ভেতর লুকিয়ে। বাগানের সেই নিরিবিলি কোণ ছিল তাদের ছোট পৃথিবী।
একদিন, আকাশ হেসে বলল—
“মেঘলা, যদি আমরা এই বাগানেই চিরকাল থাকতাম?”
মেঘলা চোখে জল ধরে বলল, “কিন্তু আমাদের বাস্তব জীবন তো আছে, আকাশ। আমরা তো কেবল ফুলের মতো মৃদু স্বপ্নে বাঁচতে পারি।”
“স্বপ্নই কি সবসময় মিষ্টি হয়?” আকাশের ভেতরের প্রশ্ন।
“না, কিন্তু স্বপ্ন ছাড়া জীবনও তো শূন্য।” মেঘলার সরল, কিন্তু গভীর উত্তর।
কয়েক বছর পর, আকাশের পরিবার জানালো—“তোমার বিয়ে হবে আমাদের আত্মীয়ের মেয়ের সঙ্গে। এটা আমাদের সামাজিক দায়িত্ব।”
আকাশের মন ভেঙে গেল। সে নিজেকে সাহসী মনে করলেও, এই ধাক্কা সামলাতে পারল না। সে মেঘলাকে বলতে পারল না।
মেঘলাও বুঝতে পারল, আকাশের হঠাৎ দূরত্ব, তার হুলস্থুল চোখ।
“আকাশ, তুমি কি আমাকে ভুলে গেছো?” সে কণ্ঠে হেসে হলেও কেঁদে উঠতে চাইছিল।
“না, মেঘলা… কিন্তু কখনও কখনও মানুষ নিজের শক্তি খুঁজে পায় না।” আকাশের চোখে আছড়ে পড়া বেদনামিশ্রিত সত্য।
এই মধ্যবর্তী সময়ের চাপ, সামাজিক বাধা, পারিবারিক দায়িত্ব—সব মিলিয়ে তাদের স্বপ্ন ভেঙে গেল।
একদিন, মেঘলার হৃদয় হঠাৎ ব্যাথায় ভেঙে পড়ল। চিকিৎসকরা বললেন—ব্রেনস্ট্রোক।
কিছুই আর করা গেল না। মেঘলা চলে গেল।
আকাশের ঘর, তার স্কুলের বাগান, তার চিঠি—সব কিছু যেন মৃত হয়ে গেল। সে নিজের ভেতরের চুপচাপ কোণে কেবল একাকীত্বের সঙ্গী হয়ে রইল।
“মেঘলা, আমি তোমাকে বাঁচাতে পারিনি,” সে বলল, নিজের অন্তরের কাছে।
“আমার সাহস কম ছিল, জীবন বড় জটিল।”
চোখের কোণে জল জমল, কিন্তু সে জানতো—মেঘলা কখনও তাকে ভুলবে না।
বেশ কয়েক বছর কেটে গেল। আকাশ কাজ করল, সংসার করল। কিন্তু মাঝে মাঝে নিঃশব্দে সে বাগানে ফিরে যেত। সেই বাগানের সেই কোণ, যেখানে মেঘলা দাঁড়িয়ে থাকত—সেখানে বসে সে শুধু মনে করত।
একদিন, আকাশ বসে হেসে বলল নিজের সাথে—
“মেঘলা, তুমি আমার জীবনের সেই ফুল, যা কখনও আমি ছুঁতে পারিনি। কিন্তু তোমার স্মৃতি আমাকে বাঁচায়, আমাকে শেখায়, আমাকে তৈরি করে।”
তখন সে বুঝল—সত্যিকারের ভালোবাসা কখনও শেষ হয় না। শুধু হৃদয়ের কোনোটায় স্থান নেয়।
মেঘলার চোখের গভীরতা, হাসির রেশ, চিঠির শব্দ—সবই আজও আকাশের জীবনকে ম্লান না করে, নতুন রঙে রাঙায়।
“আমি বাঁচবো, মেঘলা। তোমার স্মৃতিতে বাঁচবো।”
একটা সন্ধ্যায় আকাশ চুপচাপ বাগানে বসে ভাবলো—
“ভালোবাসা কেবল পাওয়ার জন্য নয়। ভালোবাসা অনুভব করা, মনে রাখা, জীবনে তার রেশ বাঁচিয়ে রাখা—এইটিই প্রকৃত ভালোবাসা।”
সে বুঝল, মেঘলার মৃত্যু তার ভালোবাসাকে শেষ করতে পারল না। বরং, সেই ভালোবাসা তাকে শক্তি, অনুভূতি, এবং জীবনের গভীরতার উপলব্ধি দিচ্ছে।