১৮০ বার পড়া হয়েছে
বাউল আবেশে রবীন্দ্রনাথ
ড. হাসিনা ইসলাম সীমা
সারসংক্ষেপ: ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ৭ আগস্ট অর্থাৎ ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে পরলোকে লীন হয়ে যান। এই মহামনীষীর প্রয়াণের আশিটি বছর আমরা পার করে ফেললাম। কবির ছোট মেয়ে মীরা। স্বামী নগেন্দ্রনাথ ছিলেন ঘরজামাই। তাদের একমাত্র বংশ প্রদীপ নীতিন্দ্রনাথও ১৩৩৯ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ চলে গেছে পরপারে। প্রিয় দৌহিত্রের মৃত্যুদিবস ২২ শ্রাবণের এই একই দিনে মাত্র নয়টি বছরের ব্যবধানে পরিবারের দু’টো আত্মার বিদায় হয়।
ঋষী কবি রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যের প্রতিটি অভিধায় অভিহিত। বাংলা সাহিত্যাকাশে তিনি নোবেল বিজয়ী বিরল এক প্রতিভাধারী। বাংলা সাহিত্যের অগণিত শাখার যে কোন একটি বিশেষ শাখাতেও যদি তাকে মূল্যায়ণ করা হয় তবে সেই স্থানের উচ্চ শিখরেই তাকে স্থালাভিষিক্ত করা যায় নির্দ্ধিধায়। তার একক প্রচেষ্টায় তিনি বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বদরবারের উঁচু আসনে আসীন করে গেছেন।এই কালজয়ী মনীষীর জীবনের আশিটি বছরই যেমন প্রতিভার যৌবন বয়ে গেছে তেমনই নব নব উদ্যমের বন্যায় ভাসিয়েছেন সারা বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষী সাহিত্যপ্রেমীদের।
যে’কজন মহামনীষীর আগমন পৃথিবীকে শোভিত করেছিল বাণীর বরপুত্র বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি তাঁর কবিতা দিয়ে নৈর্ব্যক্তিক অজানাকে ব্যক্ত করেছেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাহিত্য কবিতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণই হচ্ছে কবিগুরু। তিনি নিজেই লিখেছেন –
“সাহিত্যের ভিতর দিয়ে আমরা মানুষের ভাবের আকুতি অনেক পেয়ে থাকি এবং তা ভুলতেও বেশি সময় লাগে না। কিন্তু সাহিত্যের মধ্যে মানুষের মূর্তি যেখানে উজ্জ্বল রেখায় ফুটে ওঠে সেখানে ভুলবার পথ থাকে না।”
শেকড়বিহীন গাছ যেমন বাঁচেনা; ঠিক তেমনি মাটির সংস্পর্শ ছাড়া মানুষও অসাড় ও নিষ্প্রাণ।এই বিষয়টি সাধক পুরুষ রবীন্দ্রনাথ নবীন বয়সেই অনুভব করেছিলেন।
তরুণ কবি রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন “বাউলের গান” প্রবন্ধটি। সেই থেকেই তিনি বাংলা সাহিত্যের দীক্ষাগুরু হিসেবে সাহিত্য প্রেমীদের মণিকোঠায় স্থান করে নেন।আর তখন থেকেই বাঙালী অনুধাবন করতে শুরু করেন দেশীয় গান,কবিতা ও সাহিত্য সংগ্রহের ব্যাপারটি। বাউল গানের সুরে কবি বরাবরই আনন্দ পেতেন এবং তার মনের সুরের মিল খুঁজে পেতেন।
রবীন্দ্রনাথের বাউল গানের প্রতি প্রথম আগ্রহ প্রকাশ পায় ১৮৮৩-’৮৪ খ্রিস্টাব্দে। যখন তার বয়স সবে মাত্র একুশ বছর। ‘ভারতীয়’ পত্রিকায় সেই সময় তার বাউল ঘরানার লেখাগুলো পর্যায়ক্রমে প্রকাশিত হতে দেখা যায়।
বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ এর মতে, “লোক সঙ্গীতের চেয়ে বাউল সঙ্গীত অনেক বেশি ছন্দময়”। বাউল গান গুলো বেশ আবেগ ঘন ও টানা সুরের। ছন্দের সঙ্গে নৃত্যের তাল ও লয় সেই সঙ্গে আবেগে ভরপুর এই বাউল সম্প্রদায়ের গানগুলো। এই বাউল সাধকেরা সাধারণত পুঁথিগত বা সাঙ্গীতিক শিক্ষায় শিক্ষিত নয়। এজন্য এদের বলা হয় “গাইতে গাইতে গায়েন”। মুসলিম, হিন্দু , বৌদ্ধ ও সুফি ধর্মের সাধকদের সম্মিলনেই বাউল সম্প্রদায়ের সৃষ্টি। তবে ধারণা করা যায়, মুসলিম ফকিররাই বাউল প্রবর্তক ছিলেন। মুহম্মদ মনসুর উদ্দিন ( ১৯০৪-১৯৮৭) ছিলেন বাঙলা লোক সঙ্গীত সংগ্রাহক ও লোক সাহিত্য বিশারদ। তার এগারো খন্ডে সংগৃহীত লুপ্ত ও লুপ্ত প্রায় লোকসাহিত্যের সংকলন “হারামনি”গ্রন্থে এর উদ্ভব নিয়ে বেশ জোড়ালো বক্তব্য রয়েছে।
কবি গুরু সাতাশ বছর বয়সের মধ্যে প্রায় চার শত গান রচনা করে ফেলেছেন। এর মধ্যে একটিও বাউল সুরের গান পাওয়া যায়নি। এরপর ত্রিশ থেকে চল্লিশ বছর বয়সে দেশি সুরে যে গানগুলো রচিত হয় তার মধ্যে বাউল সুরের গান পাওয়া যায় সবে মাত্র দু’টো
* তোমরা সবাই ভালো ……..
* খেপা তুই আছিস আপন খেয়াল ধরে….
এরপর ১২৯৬ বঙ্গাব্দে তিনি ‘বিসর্জন’নাটকের পথ ধরে বাউল বীক্ষণে অগ্রসর হতে থাকেন
* আমারে কে নিবি ভাই……
পূর্ববঙ্গের বাউলদের প্রভাবে আদ্রিষ্ট পেয়ে কবিকে বেশ কয়েকটি বাউল ঢংয়ের গান রচনা করতে দেখা যায়
তোর আপন জনে ছাড়বে তোরে…..
যে তোমায় ছাড়ে ছাড়–ক….
* নিশিদিন ভরসা রাখিস…..
তার মানবিক প্রেমের গান, গীতি নাট্য ও ঋতুসংগীতে বাউল সুরের ব্যঞ্জনা প্রতিভাত হতে দেখা যায়। এছাড়াও বেশ কিছু দেহতত্ত্বের গানও তার দেখতে পাই
* আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে….
* আমি তারেই খুঁজে বেড়াই….
* আমি কান পেতে রই
এগুলো তার খাঁটি বাউল অঙ্গের গান।
বাউল গানের বিশেষ বৈশিষ্ঠ্য হচ্ছে “মনের মানুষ”। এই মনের মানুষই হচ্ছে নারী। রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতা ও গান রয়েছে এই বিশেষ বৈশিষ্ঠ্য নির্ভর। অর্থাৎ কবি একই সঙ্গে মানবীয় প্রেমিক আবার ভাগবত পক্ষীয়। এর প্রতিফলন আমরা বৈষ্ণর্ব কবিতাগুলোতে দেখতে পাই। রবীন্দ্রনাথ জীবন দেবতার প্রভাবে লিখতেন কবিতা। এই জীবন দেবতা হচ্ছে পুরুষের প্রতীক। পরবর্তীতে ‘সোনার তরী’ তে এসে কবি ‘মনের মানুষ’ অর্থাৎ নারীর প্রভাবেও প্রভাবান্বিত হয়ে রচনা করেছেন অসংখ্য কাব্য।
১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে যখন কবিগুরুর ওপর জমিদারী দেখাশোনার ভার ন্যস্ত হয় তখন তিনি সেই সুবাদে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। তারই ধারাবাহিকতার পতিসর, শাহজাদপুর, পাবনার প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাতায়াতের ফলে তার সঙ্গে পরিচয় ঘটে সেখানকার বাউলদের। আর তিনি শেকড়ের গন্ধে সেই মাটির মানুষের সঙ্গে মিশে যান একাকার হয়ে। সুযোগ ঘটে তাদের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক স্থাপনের। সেই সুবাদেই তিনি বাউল গানে বিশেষভাবে বিমোহিত হোন। বাউল দর্শনের মুগ্ধতায় ঘটে আরও সৃজন সাধন
“দেখেছি একতারা হাতে চলেছে গানের ধারা বেয়ে
মনের মানুষেকে সন্ধান করবার গভীর নির্জন পথে।
“কবি আমি ওদের দলে
আমি ব্রাত্য, আমি মন্ত্রহীন।
এভাবে তিনি প্রতিটি শাখার মতো বাউল আবেশেও অর্জন করেন অমরত্ব। সৃষ্টি হয় তার জীবনের আরও নিত্য নতুন বাঁক।সাহিত্যের মূল শেকড় বাউল গানে তিনি ঝুঁকে পড়েন মন্ত্রমুগ্ধের মতো।
“আমি কোথায় পাব তারে
আমার মনের মানুষ যে রে
হারায়ে সে মানুষে তার উদ্দেশে
দেশ বিদেশ বেড়াই ঘুরে।
এই ধরনের বাউল গান রবীন্দ্র মানসকে আরও নিবিড়ভাবে মাটির সংস্পর্শে যেতে বিস্তর প্রভাবান্বিত করে তোলে। রবীন্দ্র বলয়ে বাউল গানের ব্যাপ্তি বিস্তর। এই বাউল আঙ্গিকের গান ও কবিতাগুলো সাহিত্য প্রাণের নিবিড় রস সঞ্চার করে।
লালনের গানে পাই ,
খাঁচার ভিতর অচীন পাখি কেমনে আসে যায়……
ঠিক অপরদিকে কবিগুরুর গানে পাই সেই একই রকম ব্যঞ্জনা
“আমার মন যখন জাগিল না রে,
তোর মনের মানুষ এল দ্বারে…
আবার বাউলের কন্ঠে
তাই তুমিও বাঁধা, আমিও বাঁধা মুক্তি কোথায় পাই…..
অপরদিকে কবিগুরুর কবিতায় পাই-
“মুক্তি?
ওরে মুক্তি কোথায় পাবি?
মুক্তি কোথায় আছে?
আপনি প্রভু সৃষ্টি বাঁধন পরে
বাধা সবার কাছে”।
ভাষা ও ভাবগত দিক দিয়ে কি চমকপ্রদ সদৃশ! কবি নিজেই নিজেকে ‘কবি বাউল’বলে গেছেন। তার নাটকের বাউল চরিত্রে তিনি নিজেই অভিনয় করে গেছেন। যা তাকে ভীষণ রকমের আনন্দ সাগরে নিমজ্জিত রেখেছে। তাঁর স্পর্শে এসে বাউল গানের ঢং হয়ে ওঠেছে বৈচিত্র্যময় ও অধিক প্রাণবন্ত।
“রাঙিয়ে দিয়ে যাও গো এবার”
বাউল সুরের একটি অসাধারণ সৃষ্টি তার এই গানটি। ১৩১৪ বঙ্গাব্দে চারটি প্রবন্ধ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রকাশ করে ফেললেন তার ‘লোকসাহিত্য’গ্রন্থটি।
বাউল, ক্ষ্যাপা, জীবন দেবতা, অচীন পাখি,পরশ পাথর, মনের মানুষ ইত্যাদি বাউল কাব্য থেকে তার শাণিত প্রতিভার নির্যাস পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ এর বাউল আবেশের কাব্য রচনায় প্রকৃতি থেকে যে শব্দ কল্প ধারণ করা হয়েছে তা সত্যই হৃদয় কাড়া ও অপার আনন্দ ধারা সমৃদ্ধ সাহিত্য ভান্ডারের রূপ নিয়েছে।
কুষ্টিয়ার শিলাইদহের গগন হরকরা বা গগন চন্দ্র দাস ছিলেন বিশিষ্ট বাউল গীতিকার ও লোকসঙ্গীত শিল্পী। পেশায় ছিলেন একজন কৃষক। আমাদের জাতীয় সংগীত
“ আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসী ”
এর সুর রবীন্দ্রনাথ সংগ্রহ করেছিলেন গগন হরকরার রচিত “ও মন অসাড় মায়ায় ভুলে রবে” গানের সুর ভেঙ্গে নতুন করে সাজিয়েছিলেন। গগন লালনের খুব ভক্ত ছিলেন আর গগনের গানের খুব ভক্ত ছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্র্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং। তিনি গগনের কন্ঠে গগন ও লালনের গান শুনতেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো। রবীন্দ্রনাথ তার ‘ডাকঘর’ নাটকটি গগন হরকরার জীবনাবলম্বনে রচনা করেন। ‘ঠাকুর’ চরিত্রটি তাই প্রমান করে।
রবীন্দ্রনাথ তরুণ বয়সেই বাউল-মুর্শেদী গান সংগ্রহ, প্রচার, বিচার-বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ণ করেছেন বলে পরিণত বয়সে এসে এই বাউল প্রেমে আত্মসমর্পণ করেন। এভাবেই নিজেকে মাটির সৌরভে বিলিয়ে দিয়ে নিজ অঙ্গে বাউল আবেশ ধারণ করেন। লোকসংগীত প্রিয়তা ও সংগ্রাহক হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আপন বলয়ে দীপ্তমান।
সর্বোপরি সমাজ সংস্কৃতি ও বাউল আবেশে রবীন্দ্রনাথ এর যে অসীম ভাবনা তা সাহিত্যাঙ্গনের এক যুগান্তকারী ধারার স্বাক্ষর বহন করে চলেছে।
কবির বাউল আবেশের গানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য :
* এবার তোর মরা গাঙ্গে বান এসেছে জয় মা বলে ভাসা তরী
* কি দিয়ে পুজিব….
* এই তো ভালো লেগেছিলো….
* বাদল বাউল বাজায় বাজায় বাজায়রে একতারা…..
* জানি নাই গো সাধন তোমার…..
* ভেঙে মোর ঘরের চাবি…..
* দেখেছি রূপ সাগরের মনের মানুষ কাঁচা সোনা….
* আমি কান পেতে রই…..
* যদি তোর ডাক শুনে কেউ…..
* গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙামাটির পথ….
* আমার মন মানে না…..
* আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে….
* বাংলার মাটি বাংলার জল….
* পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে…..
* ও আমার দেশের মাটি…..
* যে তোওে পাগল বলে…..
* ফিরে ফিরে ডাক দেখিরে…..
* তোমার খোলা হাওয়ায়…..
* আমি মারের সাগর…..
* যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন…..
এই ধরনের অসংখ্য বাউল গান ও কবিতা তিনি রচনা করেছেন ।
কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ এর উপলব্দিতে প্রকৃতি প্রাণময়ী ও মমতাময়ী মাতৃরূপিনী। এ প্রকৃতিকে নির্ভর করে লিখেছেন অসংখ্য বাউল গান ও কবিতা।
বাংলায় একটি প্রবাদ আছে,
“মানুষের মন কুমারের চাক
পলকে দেয় আাঠারো পাক”
এই মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে তিনি লিখেছেন অসংখ্য বাউল কবিতা, গান ও গদ্য।
১ Comment
very good job; very good response.