একজন আরাধ্যার জন্ম
রেশমা আক্তার
পর্ব-৫
পুতলা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে। এ ক’টা দিন আবু আর বাবু হাপিত্যেস করে বসে থাকতো হাসপাতাল চত্বরে। তারা জানে, তাদের বইনের বেজায় অসুখ। বোন কে এখানে রেখে তাই তারা কিছুতেই বাড়ি যাবে না। রাহেলা রাতের বেলা দুই ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালের বারান্দাতেই শুয়ে থাকতো। দুশ্চিন্তায় ঘুমাতে পারতো না তারা। আবু বলতো
– আম্মা, বইনে কী সুস্থ হইবো না আর?
– হইব, বাপ। আল্লায় তারে নিশ্চয় সুস্ত করবো।
ছোটোটা কিছুটা অবুঝ, সে ফুঁপিয়ে কাঁদতো। বলতো
– আম্মা, বইনের শ্বাস নিতে বেজায় কষ্ট। আমার সহ্য হয়না। কান্দন আসে আম্মা,
রাহেলা বাবুকে কাছে টেনে নিয়ে, বলত
– কান্দন আসলে কান্দো বাপ। তার জন্য আমরা আর কী করতে পারি? খালি কানতে পারি।
দুই ছেলে দু’ পাশ থেকে তাদের মাকে জড়িয়ে ধরে নিঃশ্বব্দে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। রাহেলা তাকিয়ে থাকে শূণ্যে। সে মনকে প্রবোধ দেয়। এ সবই মায়া… অনন্ত মায়া। এর কোন মাপজোখ নেই, ব্যাখ্যা নেই। তবে জগতে এ মায়ার কোনো মূল্যও নেই। মায়ার মূল্য যার যার, তার তার। মায়া দিয়া মাগনা দুধ পাওয়া যায় না। মায়া দিয়া দামী ঔষধ কিনে চিকিৎসা করা যায় না। এমন কি, শুধু মায়া দিয়ে সন্তানের মাও হওয়া যায় না। সুতরাং এসব মায়া অর্থহীন, বেহুদা।
পুতলা বাড়ি ফিরেছে। পুতলার পাশে সারাদিন বসে থাকে আবু আর বাবু। বিছানার পাশে কাঠের বাক্সের ওপর অনেক ছোট বড় ঔষধের শিশি। পুতলাকে সময় ধরে ধরে ঔষধ খাওয়াতে হয়।
ইদানিং উকিল বউ ঘনঘন আসে তাদের বাড়ি, রাহেলার বিছানায় এসে বসে, পুতলারে কোলে নেয়। পুতলার জন্য নতুন নতুন কাপড় নিয়ে আসে। আবু আর বাবু এখনও এসবের কারণ বোঝে না। পুতলার জন্য এখন উকিল বাড়ি থেকে রোজ হাফ লিটার দুধ আসে বোতলে। উকিল বউ মাঝে মাঝে পুতলার ওজন পরখ করে, রাহেলাকে বলে
– বাচ্চার ওজন মাশাল্লাহ ভালোই আছে।
রাহেলা মুখ কালো করে তাকিয়ে থাকে। মুখ খুলতে সাহস হয় না। তার মনে হয়, কেনার আগে যেন মাল যাচাই চলছে। মুখ ঘুরিয়ে নিজের কাজে মন দেয় রাহেলা। উকিল বউ পুতলাকে কোলে নিয়ে নানান মজার কথা বলে। কিন্তু অপরিচিত মানুষের কোলে পুতলা খানিক বাদে ঠোঁট বেকিয়ে কান্নার আয়োজন করে। আবু আর বাবু অসহায় চোখে মায়ের দিকে তাকায়। রাহেলা কাজ ফেলে, হাত ধুয়ে এগিয়ে আসে
– দেন ভাবীসাব, তারে আমার কাছে দেন।
উকিল বউ পুতলাকে তুলে দেয় রাহেলার কোলে। রাহেলা পরম মমতায় তাকে পিঠ চাপড়ে আশ্বাস দেয় মাতৃত্বের। পুতলা, রাহেলার কাঁধে মাথা দিয়ে পরম নির্ভরতায় চোখ বন্ধ করে।
রাহেলা নিজেকে অনেক বুঝিয়েছে। পাগলীর মেয়ে তার কাছে আছে, এ তল্লাটে তা সবাই জানে। এই মেয়ে বড় হবে এসব শুনতে শুনতেই। লোকজন তাকে ঘৃণা করবে। সমাজে তার পিতৃপরিচয় থাকবে না। আগুনের মত রূপ নিয়েও সে কারো ঘরের বউ হতে পারবে না, সন্মান পাবে না। রাহেলা আর তার ছেলেরা তাদের বুকের সমস্ত মায়া উজার করে ঢেলে দিয়েও প্রমান করতে পারবে না যে, পুতলা তাদের পরিবারেরই একজন। তাই সে পুতলাকে দিয়ে দিতেই রাজি হয়ে গেলো। মাত্র তিন, চার মাসই তো। এ মায়া তারা নিশ্চই পারবে ভুলে যেতে।
পুতলা এখন রাহেলাকে তার মা ভাবে। কাজ থেকে ফিরলে তাকে দেখে হাসে। কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আবু আর বাবুর সাথে খেলে। মাটির ব্যাংক ভেঙে আবু তার বোনের জন্য একটা ঝুনঝুনি কিনেছে। সেটা নাড়ালে, পুতলা খিলখিল করে হাসে। মায়া ঝরে ঝরে পড়ে তার সে হাসিতে। রাহেলার একবারও মনে হয় না, এটা পাগলীর বেটি। মনে হয় তার নাড়ী ছেড়া ধন। কিন্তু রাহেলা শেষ পর্যন্ত পারবে তো পুতলাকে দিয়ে দিতে?
উকিল বউ তাড়া দেয়, বলে
– কিরে রাহেলা, বাচ্চাতো এখন পুরা সুস্থ। এবার যে যেতে হয়। ওদিকে আমার বোন একটা বাচ্চা পাবে শুনে আর তর সইেছে না। দিনে তিনবেলা ফোন দেয় আর মেয়ের গল্প শোনে।
রাহেলা ইতস্তত করে, বলে
– পুতলারে দিমু ভাবীসাব, তয় আমার শর্ত আছে। আমার কোন টাকাপয়সা চাই না। কিন্তু আমি স্বচক্ষে দেখতে চাই, বাচ্চাডা সঠিক জায়গায় পড়ল কিনা।
উকীল বউ রহস্য করে বলে
– তোর কী আমারে বিশ্বাস হয় নারে রাহেলা…?
– বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথা না ভাবীসাব। নিজের দিলের কাছে পরিষ্কার থাকতে চাই। এরে আমি মায়ের পেট থেইক্যা পালছি। আমার পেটে জন্ম না নিলেও সে আমার সন্তান। দুনিয়ার সবাই অস্বীকার করলেও, সে আমার সন্তান। অভাব আর সমাজের দায়ে তারে অন্যের হাতে দিলেও আমার একটা দায়িত্ব থাহে। সে যদি সঠিক মাইনষের কাছে জায়গা পায়, তাইলে আমার কোনো আপত্তি নাই। আমি আগে দেখতে চাই, তারে কোথায়, কার কাছে নিতে চান আফনে…
উকিল বউয়ের মুখে এক চিলতে হাসি ফুটলো। বলল
– ও এই কথা…? ঠিক আছে চল, তরে দ্যাখাইয়া আনি।
উকিলের বউ রাজি হয়ে যায়। রাহেলাকে সে চেনে। মেয়েটার মুখ খারাপ হলেও মনটা সাফ। ওদিকে রুবিরও আর তর সইছে না। রুবিকে বহুদিন থেকেই সে বলে আসছে , একটা বাচ্চা যোগাড় করে দিবে। কিন্তুুু আজও সেটা সম্ভব হয়নি। কিন্তু পাগলীর বাচ্চাটার ব্যাপারে সে ভাবেনি। এমন পরিচয়হীন বাচ্চা ওরা নিবে কিনা স্বন্দেহ ছিল তার। কিন্তু রুবি বাচ্চার কথা শুনেই রাজি হয়ে গেলো। এই বাচ্চার খোঁজ পেয়ে সে এবার এতই মরিয়া হয়ে উঠেছে যে বাচ্চার জন্ম পরিচয় এখন তার কাছে কোন ব্যাপার না।
নির্দষ্ট দিনে উকিল বউ রাহেলাকে নিয়ে রওয়ানা হলো। রাহেলার মনটা ভালো নেই। ছেলেদের বলেছে, তাদেরকে প্রতিবেশীর ঘরে রেখে পুতলাকে নিয়ে সে দূরে কোথাও যাবে, দু’ দিনের জন্য। কিন্তুু তার ছেলে দুইটা প্রশ্নে প্রশ্নে জেরবার করে দিতে থাকলো তাকে
ছোট ছেলে বাবু প্রশ্ন করে,
– বইনেরে কই লইয়া যাইবা আম্মা? বইনে কী বেড়াইতে যায়?
রাহেলা চোখের পানি মোছে আর মাথা ঝাঁকায়।
আবু সব বোঝে, তাই তাকে সে সব বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করেছে
– বাপজান শোনো, বইনেরে তুমি কেমন ভালোবাসো কও তো? কম নাকি বেশী?
মায়ের অদ্ভুত প্রশ্নে হাসে আবু। বলে
– বইনেরে আমি বেজায় মায়া করি গো আম্মা…। জিগাও ক্যান..? কি হইছে আম্মা…?
রাহেলা আড়ালে চোখ মুছে বলে
– খালি মায়া দিয়া জগতে কিছু হয় নারে বাপধন। মায়া দিয়া তো তারে আমরা বাঁচাইতে পারবো না…
– এইসব কি কও তুমি মা? আমি বুজি না…
রাহেলা আবুর মাথায় হাত বোলায়, বলে
– তোমরা চাও না, তোমাগো বইনের নিঃশ্বাসে কষ্ট পাইলে তার চিকিৎসা হউক?
আবু ভাবে, হ্যা সে চায় তো। সেদিন মধ্যরাতে পুতলার কাশি বাড়লো, নাক বন্ধ হয়ে গেলো। আস্তে আস্তে নিশ্বাস ভারী হয়ে শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। বৃষ্টি বাদলার রাত, পুতলার চোখ মুখ কেমন নীল হয়ে গেলো। চোখ বড় বড় হয়ে কেমন যেন করছিলো পুতলা। মায়ে আর তারা দুই ভাই তার কষ্ট দেখে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকলো। মায়ে শেষমেশ পুতলারে কাপড়ে পেঁচিয়ে হাসপাতালে রওয়ানা হলো। আবু একটা ভাঙা ছাতা দিয়ে মায়ের মথাটা আড়াল করার চেষ্টা করছিলো। রাত বারোটা নাগাদ ভিজে চুপচুপা হয়ে তারা সবাই হাসপাতালে পৌঁছেছিলো।
হাসপাতালের ডাক্তার বলল
– বাচ্চার তো জীবন শেষ করে নিয়া আসছো।
পুতলার কষ্ট দেখে তারা দুই ভাই হাউমাউ করে কেঁদেছিলো সে রাতে। অমন কষ্ট যেন তাদের বোন এ জীবনে আর না পায়। ভাগ্যিস ও বাড়ির খালাম্মা টাকা দিয়েছিলো তার মাকে। তাইতো এ যাত্রায় বেঁচে ফিরেছে পুতলা। কিন্তু মা এখন এসব বলছে কেনো?
– বাপজান শোনো, পুতলা আমাগো সক্কলের আদরের। কিন্তু আমরা হইলাম গরীব। আমরা তারে ভালো খাওন, ভালো জামা, ঔষদ কিছুই দিতে পারবো না। ভাবীসাব টাকা না দিলে তারে কী বাঁচাইতে পারতাম, কও…?
আবু দু’দিকে মাথা নাড়ে। রাহেলা বলে
– এইজন্য, সে যাতে সব কিছু পায়, সুখে শান্তিতে থাকে। অনেক বড় মানুষ হয় সেই ব্যাবস্থা তো আমাগোই করতে হইবো, তাই না? পুতলারে আমরা এক বড়লোকের বাড়িতে নিয়া যাবো। সেইখানে সে বড়লোক এক আম্মা পাইবো, আব্বা পাইবো। সুখে থাকবো সে। তোমরা চাও না, সে সুখে থাউক?
মায়ের এই অবিশ্বাস্য কথায় আবু শব্দ করে কেঁদে ওঠে, পুতলাকে দু’হাতে আগলে নিয়ে বলে
– না , এইডা তো আমাগো বইন , তুমি না কইছিলা সে আমাগো নিজের বইন? ও কোত্থাও যাইবোনা আম্মা। তুমি এইসব কী কও? আমি আমার বইনেরে কোত্থাও যাইতে দিব না। সে আমাগো না দেখলে কষ্ট পাইবো আম্মা। সে আমাগো ছাড়া থাকতে পারবো না।
রাহেলা, আবুর কোল থেকে পুতলাকে টেনে নেয়। বলে
– শোনো বাজান, ওই বাড়ির ভাবীসাবের এক বইন তারে নিবে। উনারা অনেক বড়লোক। তোমাগো বইনে ভালো থাকবো সেইখানে। ভাবীসাব পয়সা না দিলে পুতলা বাঁচতো না। তুমি তো সবই বুঝো..?
আবু কান্না থামিয়ে হঠাৎ স্থির হয়। গম্ভীর গলায় বলে
– আমি তার জন্য কাজ করব আম্মা। আমার ইস্কুল বাদ দিয়া কাজ করবো। তারে নতুন জামা কিইন্যা দিব, তার জন্য মাটির ব্যাংকে পয়সা জমাবো। উকিল বাড়ি থেইক্যা দুধ কিইন্যা খাওয়াবো আম্মা। ওরে দিও না তুমি।
রাহেলা দিশেহারা বোধ করে। বোঝানোর চেষ্টা করে। বলে
– শোনো বাজান, এইসব দিয়া আমরা তারে ভালো রাখতে পারবো না। সে পাগলীর বেটি, এইটা সবাই জানে। বড় হইলে সবাই তারে লজ্জা দিবো, খারাপ কথা বলবো। তার জীবন নষ্ট হইবো…
আবু এসব জটিল কথা অত বোঝে না। কে কার সন্তান, তার জন্য কি কি হতে পারে, ওসব সে বুঝতে চায় না। সে জানে, পুতলা তার বইন, নিজের বইন। রাগে, স্থির কন্ঠে সে বলল
– তুমি বইনেরে বেঁইচা দিতাছো আম্মা? তুমি কী তাগোর কাছ থেইক্যা টাকা নিছ আম্মা?
ঠাস করে আবুর গালে একটা চড় মারে রাহেলা।
নিশ্বব্দে কাঁদছে আবু। রাহেলার চোখ থেকে আগুন ঝরে। কিন্তু পর মুহূর্তেই সে অগ্নিদৃষ্টি তীব্র মায়ায় দ্রবীভূত হয়। এক হাতে আবুকে জড়িয়ে ধরে বলে
– নারে বাপ, পয়সা দিয়া আমি কী করবো? আমার এই ভাঙ্গা ঘরে পয়সা কোথায় রাখবো আমি? আমার সাত রাজার ধন মানিক দিয়া তার বদলে কী ধন নিবো আমি?
হু হু করে কাঁদলো কিছুক্ষণ রাহেলা। আবুও শান্ত হয়ে আসলো। জগতের মারপ্যাঁচ সেও খানিক বুঝতে পারে এখন। মাকে জড়িয়ে ধরে পুতলার গালে, মুখে চুমু খায় সে আর কাঁদে।
বাসা থেকে বের হবার সময়, বাচ্চার কাপড়, দুধ , ফিডার সবকিছু এক জায়গায় জড়ো করছিল রাহেলা। এগুলো নিবে না সে। পুতলার জন্য ও বাড়ি থেকে নতুন জামা, জুতা, দুধ এসেছে। পুরানো কিছু নিয়ে যাওয়া নিষেধ।
আবুর কান্না থেমেছে। পুতলাকে সে সকাল থেকে কোলে নিয়ে বসে আছে। বোঝেনা বাবু, সে জানতে চায়
– বইনেরে নিয়া কই যাইবা আম্মা? বইনে আবার আইব তো আম্মা?
রাহেলা এবার ওদের কাছে ডেকে বলে
– নারে বাপ, তোমাগো বইনে আর আইবো না। বইনে আরেক আম্মা পাইব, সেইহানে থাকবো। তোমরা বইনেরে আদর কইরা দেও।
ছেলেরা তার অঝোরে কাঁদছে। রাহেলাও কাঁদে। তার এই অভাবের সংসারে এত মায়া কেন দিল মালিক? সে কিছুতেই এই অবুঝ ছেলে দুটাকে বুঝাতে পারে না যে, জগতে মায়ার বিপরীতে আরও কত বিদঘুটে ব্যাপার আছে, যা সামাল দেবার শক্তি রাহেলার নেই। তার কেবল মায়া আছে। আর মায়ার মূল্য দুই পয়সা।
অনেক কষ্টে ছেলেদের কাছ থেকে পুতলাকে কেড়ে নিলো রাহেলা। বলল
– তোমাগো বইন একদিন মস্তবড় মানুষ হইবো। তোমরা কী চাও না সে ভালো থাকুক?
দুই ভাই কাঁদতে কাঁদতেই মাথা নাড়ে এবং বোনকে ছেড়ে দিয়ে এবার দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে আকুল হয়ে কাঁদতে থাকে। কান্নার শব্দে পুতলাও নড়েচড়ে ওঠে। সেও যেন এবার কান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
রাহেলা বলল, আসো বাপ, বইনেরে একটু আদর কইরা দেও। সে তোমাগো জন্য কানতেছে।
দু ‘ভাই এগিয়ে এসে পুতলার কপালে চুমু খায়। রাস্তায় গাড়ি দাঁড়িয়ে, উকিল বউ পাঠিয়েছে। রাহেলা এবার পুতলাকে বুকে জড়িয়ে তাড়াতাড়ি এগিয়ে যায়। আর পেছনে তাকালে চলবে না। তাকে এবার যেতে হবে। রাহেলা উকিল বউয়ের সাথে যাচ্ছে।
যারা বাচ্চাটা নিতে চায়, রাহেলা তাদের বাড়িঘর ও বাচ্চাটা যে তারা সত্যিই সন্তান হিসেবে গ্রহন করছে সেটা দেখে আসতে চায়। এর আগে এমন অনেকজন তার কাছে বাচ্চাটা চেয়েছে। অনেকে মোটা অঙ্কের টাকাও দিতে চেয়েছে। সঙ্গতই রাহেলা পাত্তা দেয়নি। এসব জানে উকিলের বউ। মুখে খবরদারী করলেও মনে মনে রাহেলাকে সম্ভ্রম করে সে। এ মেয়ের তেজ আর সততায় কোনো সন্দেহ নাই তার।
রাহেলা গাড়িতে উঠে বসলো।
পুতলার গায়ে উকিল বউয়ের দেয়া দামী জামা, পায়ে জুতো। পুরানো কাপড়, খেলনা জিনিসপত্র সব রয়ে গেছে রাহেলার ঘরে। রাহেলা মন ভরে দেখে পুতলাকে। কী সুন্দর মানিয়েছে তাকে। এ মেয়ে কী তার ঘরে থাকা মানায়? যাক, এই ভালো হলো। পুতলা দূরে চলে যাক, ওর জন্ম বৃত্তান্ত মুছে যাক। ও আর দশটা মেয়ের মত স্বাভাবিক জীবন নিয়ে বেড়ে উঠুক। ওর জন্ম দাগ ঢাকা পড়ে যাক সময়ের ধূলোয়।
উকিল বউ উঠে বসেছে গাড়িতে। বাস রাস্তা পর্যন্ত এসে নির্দিষ্ট বাসে ওঠার আগে রাহেলা উকিলের বউকে বলল
– ভাবীসাব, একটু খাড়ান। আমি যাবো আর আসবো।
রাহেলা বাচ্চাটাকে আঁচলের নিচে ঢেকে একটু এগিয়ে যায় ওদিকটায়। আসেপাশে একটু খোঁজে, তারপর হেঁটে আরেকটু সামনে যায়। দুইটা দোকানের চিপা ঢালে গুটিসুটি মেরে বসে পাগলী মন দিয়ে একটা পাওরুটি খাচ্ছিলো। বাচ্চা কোলে রাহেলা গিয়ে তার সামনে দাঁড়ালো। পাগলী একটু হেসে দুর্বোধ্য ভাষায় রাহেলাকে কিছু বলল এবং আবার খাওয়ায় মনোযোগী হলো।
রাহেলা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তারপর পাগলীর খুব কাছটিতে মুখোমুখি গিয়ে বসলো। বাচ্চার উপর থেকে কাপড়ের আচ্ছাদনটা সরিয়ে পাগলীর চোখের সামনে তুলে ধরে বলল
– দেখ….দেখ….তোর ….বাচ্চা… এইডা..। এর নাম হইলো পুতলা। এর ভাইয়েরা এর নাম দিছে। সুন্দর না?
পাগলী উদাসীন চোখে একবার বাচ্চাটার দিকে তাকালো। তারপর হাত বড়িয়ে আধখাওয়া রুটিটা এগিয়ে ধরলো রাহেলার দিকে। রাহেলা না সূচক মাথা নেড়ে পাগলীর হাতটা সরিয়ে দিল , বলল
– তুই খা। নে… বাচ্চাডারে একবার কোলে নে….।
রাহেলা পাগলীর কোলে বাচ্চাটা দেবার চেষ্টা করলো। কিন্তু পাগলী স্বভাবতই তা প্রত্যাখ্যান করলো।
রাহেলা এবার পুতলার দিকে তাকিয়ে হেসে, পাগলীকে দেখিয়ে বলল
– আম্মাজী, এইটা হইলো তোমার জন্মদাতী মা। দেখো দেখো… এইযে…! সে পাগলী। তুমি হয়তো তারে আর কোনোদিন দেকতে পাইবা না। কিন্তু আমি চাই, তুমি তারে অন্তত একবার দেখো…। সে তেমারে দুনিয়ার আলো দেখাইছে। তার মেলা বড় অবদান।
রাহেলা বোঝে, সে ছেলেমানুষী করছে। তার এসব কথাবার্তা এই দুই অবুঝের কাছেই অর্থহীন, দুর্বোধ্য। এরা কেউ তার কথা বা উদ্দেশ্য বোঝার ক্ষমতা রাখে না।
তবু সত্যি সত্যি সে পুতলাকে পাগলীর সামনে তুলে ধরে।
পাগলী ততক্ষণে বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। হাত দিয়ে রাহেলাকে সরিয়ে দিয়ে কী সব বকতে বকতে হাঁটা দিয়েছে উল্টো দিকে। হনহন করে সে চলে যাচ্ছে অন্য কোথাও।
রাহেলা নিরুপায় বোধ করলো।
তার চোখ থেকে দুফোঁটা পানি ঝড়ে পড়লো। হায়রে হতভাগ্য মা। তুই একদিকে ভালোই আছিসরে পাগলী। মাতৃত্বের কোন দায় নেই তোর। মায়া নেই, অধিকারবোধ নেই, পাবার আকাঙ্খাও নেই। ভাগ্যিস প্রকৃতি তোকে এ দায় থেকে মুক্তি দিয়েছেন।
রাহেলা আবার ঢেকে নিলো বাচ্চাটাকে। আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,
– আমার কোনো ভুল হইলে তুমি মাফ দিওগো মাবুদ।
তারপর কোনদিকে না তাকিয়ে সোঁজা এসে বাসে উঠলো। রাহেলাকে দেখে উকিলের বউ হাঁফ ছাড়লেন। জিজ্ঞেস করলেন,
– কই গেছিলি…?
রাহেলা কোন উত্তর দেয়নি।
বিকেল নাগাদ ওরা পৌছে গেলো রুবিদের বাড়ি। প্রধান ফটক থেকে পায়ে হেঁটে প্রায় অনেক খানি বাগান পেরিয়ে বাড়ির দরজা। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে একদল নারী, পুরুষ, বিভিন্ন বয়সের শিশু কিশোর। সবার মুখে হাসি এবং কৌতূহল। তাদের মধ্যমনি যে গোলগাল স্বাস্থ্য, শ্যাম বর্ণের মহিলা তিনিই রুবি। চৌধুরী বাড়ির মেজ বউ।
উৎসুক চোখে সে রাহেলার কোলে বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে আছে। উকিলের বউ এ বড়িতে বড় বুবু নামে খ্যাত। রুবির বিয়ে এ বাড়িতে তিনিই দিয়েছিলেন । রুবি তার সন্তানতুল্য।
চৌধুরীদের বিশাল বাড়ি। তিন ভাইয়ের একান্নবর্তী সংসার। একসাথে এক উঠানে বসবাস। বড় ভাসুর আর বড় জা দুজনই কলেজের শিক্ষক। তাদের দুই মেয়ে এক ছেলে। মেয়ে দুটি স্কুলে পড়ে, ছেলেটির বয়স দশ।
ছোট দেবরের ঘরেও দুটি ছেলেমেয়ে।
রুবির স্বামী তানভীর চৌধুরী, একজন ব্যারিষ্টার। বর্তমানে দেশের বাইরে আছেন। কিন্তু তারা নিঃসন্তান।
রাহেলার সাথে সবার পরিচয় হলো। রুবি, রাহেলার আঁচল সরিয়ে বাচ্চার মুখখানা দেখলো। দু’ চোখ সজল হয়ে এলো তার। মুখে এক অপার্থিব হাসি। রুবির দিকে তাকিয়ে ছিলো রাহেলা, কিছু বোঝার চেষ্টা করলো সে। বুক থেকে পাষাণ নেমে গেলো তার। বাচ্চাটাকে রুবির কোলে তুলে দিলো রাহেলা। রুবির চোখভর্তি পানি, মুখে একটু বোকা বোকা হাসি। বাচ্চা কোলে নিয়ে সবাইকে ডিঙিয়ে সোজা সে নিজের বেডরুমে চলে গেলো। হয়তো কান্না লুকাতে। উকিল বউ বলল
– থাক, ওকে একটু থাকতে দাও একা।
রুবির বড় জা অত্যন্ত ভাল মানুষ। তিনি সবাইকে আপ্যায়ন করে ভিতরে নিয়ে গেলো ।
এই বাড়িতে মেজ বউ, রুবির কদর অনেক বেশী। বাড়িতে ভাসুর দেবরের বাচ্চাগুলো রুবির তত্ত্বাবধানেই মানুষ। সংসারে তার প্রভাব প্রতিপত্তিটাই বেশি
কিন্তু ওই একটা ব্যাপারেই গরীব সে। মাতৃত্বের স্বাদ সে পায়নি। ভাসুর দেবরের বাচ্চা মানুষ করেও তার সে সুখ হয় না। তার নিজের , একদম নিজের যদি কেউ থাকতো। সে অন্যের বাচ্চা নাড়েচাড়ে, কিন্তুু দিনশেষে ওরা মা, মা করে মায়ের বুকেই ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই শূন্যতা রুবি কাউকে বোঝাতে পারে না। তাইতো ইদানিং সে সবাইকে বলে বেড়ায়
দাওনা এনে একটা বাচ্চা আমাকে, আমি মানুষ করব। কত এতিম বাচ্চা বড় হয় বাবা মা ছাড়া, আহা। একজন এনে দাওনা আমাকে, কেউ। কিন্তু ওরকম বাচ্চা পাওয়াতো সহজ কথা নয়। আত্মীয় বন্ধু পরিজনরা চেষ্টা করছে ঠিকই , কিন্তুু স্বয়ং তানভীরেরই এ ব্যাপারে ঘোর আপত্তি। সে বলে,
– কী দরকার রুবি, এই তো দেখো, বাড়ির বাচ্চাগুলো সারাদিন তোমাকে মেজ মা, মেজ মা বলে পাগল করে দিচ্ছে। তুমিও তো ওদের কে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসছো, তবে আর কেন? ওসব ঝামেলার দরকার নেই। ভাগ্যে যখন নেই…..
শেষের কথাগুলো বলতে বলতে গলাটা কেমন বিষণ্ণ হয়ে যায় তানভীরের। মনে বড় বেঁধে রুবির। বাচ্চা না হওয়ার সমস্যাটা রুবির। তার প্রথম একটা মিসক্যারেজ ছিল। তারপর অনেকদিন পর চিকিৎসক জানালেন, রুবির আর সন্তান ধারণ সম্ভব নয়।
তানভীর কোনদিনও এ নিয়ে কোন আফসোস জানায়নি। বরং রুবিকে অনেক বুঝিয়েছে। কিন্তুু সব বুঝেও রুবির তৃষ্ণা মেটেনি।
বড় বুবু ফোন করে যখন একটা বাচ্চা পাওয়ার সম্ভাবনার কথা তাকে জানিয়েছিলো, তখন সে প্রথমেই ওযু করে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়েছিলো। কিন্তুু সম্ভাবনা অনেকটা কমে গেলো যখন বাচ্চাটার জন্ম পরিচয় জানা গেলো। রুবি অনেক ভেবে এই সিদ্ধান্তে এলো যে, ওর পরিচয় কারো জানার দরকার নেই। রুবিই হবে ওর আসল পরিচয়। কত নদী কত নালা এসে মিশে যায় সমুদ্রে, অবগাহনের সময় কে দেখে বা ভাবে এর উৎস কোথায়, কোথা থেকে এলো, কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে?
আজ সারাদিনের অপেক্ষার পর অবশেষে রুবি তাকে পেলো। তানভীর এখন দেশের বাইরে। কাল প্রথম রুবি যখন তানভীরকে বাচ্চাটার কথা ফোনে জানিয়েছিল, একটু বিরক্ত হয়েছিলো তানভীর, বলেছিলো
– তোমাকে আর কত বোঝাবো বলতো রুবি? এসব পাগলামী এখনও গেলো না তোমার
কান্নাভেজা গলায় রুবি বলেছিল
– প্লিজ…প্লিজ তানভীর, আমি তোমার কাছে আর কিছুই চাইব না….প্লিজ। বাচ্চাটা আমাকে পেতে দাও।
তানভীর ফোন কেটে দিয়েছিলো
তবে সাহস আর সহযোগিতা পেয়েছিল পরিবারের অন্য সবার। জায়েরা জোরালো সমর্থন দিয়েছিলো। বড় জা সবাইকে বলেছিলো
– মেজ বউ সবার জন্য এত কিছু করে, আজ ও যদি এইটুকু সুখ চায় তবে আমাদের সবার উচিৎ ওকে সমর্থন করা। একটা বাচ্চার সন্ধান যখন পাওয়া গেছে, তখন তাকে আনা হোক। তানভীর যাই বলুক, আমরা এ বাচ্চা এ বাড়িতেই রাখবো এবং আমাদের পরিচয়েই বড় করব। কোনোদিন কেউ জানতে পারবে না, এ বাচ্চা আমাদের বাড়ির কেউ নয়।
তবে সত্যি সত্যিই, একমাত্র রুবি ছাড়া বাচ্চার আসল পরিচয় কেউ পেলো না। সবাই জানলো বাচ্চাটার মা জন্ম দিয়েই মরে গেছে। রাহেলা তাকে পেয়েছে, সুতরাং রাহেলাই এখন বাচ্চাটার অভিভাবক।
বাচ্চা কোলে নিয়ে অসাধারণ এক অনুভূতি আচ্ছন্ন করল রুবিকে। বাচ্চাটাকে বুকে জড়িয়ে আপাতত নিজের ঘরের দরজা লাগিয়ে দিলো সে। তারপর কাঁদলো কিছুক্ষণ প্রাণ ভরে। রুবি নিজেকে সামলে এরপর ফোন দিল তানভীরকে।
– এই শোনো, বড় বুবু বাচ্চাটা নিয়ে এসেছে। ওর নাম পুতলা। বাচ্চাটার বাবা মা কেউ নেই, জানো। মেয়ে বাচ্চা। খুব কিউট । বয়স মাস তিনেক হবে। যে নিয়ে এসেছে সে ওর বিনিময়ে কিছুই চায় না। শুধু মেয়েটা একটা ভালো জায়গায় থাকুক, সেইটুকুই চায়। কী বলো তুমি?
ওপাশে তানভীর চুপ থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর বলল
– তোমাকে কিছু বলে কী লাভ রুবি? তুমি কী আমার কোন কথা শোন? এসব নিয়ে পরে ঝামেলা হলে আমাকে কিছু বলতে পারবে না।
– ঠিক আছে বলব না, যাও।
তানভীর ফোন কেটে দিলো। রুবির মনটা খুব খারাপ লাগছে এখন। কিন্তু দশ মিনিটের মাথায় আবার ফোন এলো তানভীরের
সে ইতস্তত করে বলল
– হ্যা, বলছি শোন, ইয়ে মানে রুবি….তুমি কী বেবির কোন নাম ঠিক করেছ? না….মানে, কী একটা নাম বললে না? ওসব কিন্তু একদম চলবে না। তুমি আবার হুট করে একটা যেন তেন নাম দিয়ে দিও না, লেট মি থিংক, ….ও কে ?
ফোনের এপাশে রুবির ঠোঁটে হালকা হাসির রেখা ফুটে উঠলো।
তানভীর আবার বলল
– আর শোনো , বেবিটা যে আমাদের গিফট করেছে, তার সন্মানে যেন কোন ত্রুটি না হয়। তার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা করো। সে যা চায়, যত চায়, তুমি না বলবে না।
রুবি কথা শেষ করে, ফোন রেখে ঘরের বাইরে এলো।
রাহেলা খেয়েদেয়ে পাশের একটা ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাচ্চাটা মনে হয় এখন খাবে, সে কেমন উসখুশ করছে। রুবি ভালো ব্র্যান্ডের দুধ, সরঞ্জাম সব এনে রেখেছিলো। খুব দ্রুত সে বাচ্চার খাবার তৈরি করলো এবং কোলে নিয়ে পরম মমতায় তাকে খাওয়াতে লাগলো। রুবির বড় জা আর বড় বুবু মুখ টিপে হাসলো।
সারারাত রুবি টেনশনে ঘুমাতে পারে নি। বেবির খাবারের জন্য বেশ কয়েকবার উঠতে হলো তাকে। সকালে কেউ রুবিকে জাগালো না। সারাবাড়ি শুনশান করে রাখা হলো, কারণ সবাই জানে, রুবি ছোট বেবিকে নিয়ে রাত জেগেছে। তার ঘুম প্রয়োজন।
তানভীর ফোন দিলো বেলা করে। সে বেবিটার একটা নাম ঠিক করেছে, …. আরাধ্যা।
নাম শুনে ভিজে উঠল রুবির চোখ। সে বেবির মুখের দিকে তাকিয়ে কয়েকবার উচ্চারণ করল,
আরাধ্যা……..আরাধ্যা…..আমার আরাধ্যা।
(চলবে)